
অজিত সিং বনাম অজিত সিং
দশম পর্ব
তৃষ্ণা বসাক
প্রথমে ছিল বঙ্গলক্ষ্মী চানাচুর, তারপর এল আজাদ হিন্দ চানাচুর, তারপর একের পর এক বিপ্লব চানাচুর, সর্বহারা চানাচুর, উন্নততর সর্বহারা চানাচুর, এখন চলছে বিশ্ববাংলা। এখানেই কি ভাবছেন গল্প ফুরিয়ে গেল? এবার আসছে একে ফিফটি সিক্স চানাচুর। নাম যাই হোক, সোল এজেন্ট আমি।’ ‘বেওয়ারিশ’ গল্পের চানাচুরওলা এবার ঢুকে পড়েছে বাংলার শিল্পক্ষেত্র থেকে শিক্ষাজগতের ক্ষমতার অলিন্দে।খুন, যৌনতা, প্রতিশোধ, নিয়তিবাদের রুদ্ধশ্বাস সুড়ঙ্গে সে টের পাচ্ছে- -বহুদিন লাশের ওপর বসে বারবার হিক্কা তুলেছি আমরা -বহুদিন মর্গের ভেতরে শুয়ে চাঁদের মুখাগ্নি করেছি আমরা -অন্ধ মেয়ের মউচাক থেকে স্বপ্নগুলো উড়ে চলে গেছে (জহর সেনমজুমদার) এই সবের মধ্যে বাংলার কি কোন মুখ আছে আদৌ? থাকলে কি একটাই মুখ? না অনেক মুখ, সময়ের বিচিত্র রঙে চোবানো? বিগত প্রায় অর্ধশতাব্দী জুড়ে বাংলার অজস্র মুখের ভাঙ্গাচোরা টুকরো খুঁজে চললেন তৃষ্ণা বসাক, তাঁর নতুন উপন্যাস ‘অজিত সিং বনাম অজিত সিং’-এ । সব কথনই রাজনৈতিক, সেই আপ্তবাক্য মেনে একে কি বলা যাবে রাজনৈতিক থ্রিলার? সিটবেল্ট বাঁধুন হে পাঠক, ঝাঁকুনি লাগতে পারে। প্রকাশিত হল উপন্যাসের দশম পর্ব।
(পূর্বপ্রকাশিতের পর)
১০
‘…জাতীয় সড়কের ওপর দিয়ে সারি সারি সাইকেল, লেডিবার্ড,
লেডিবার্ড হড়কে ধানক্ষেতে নামে, ঘষটাতে ঘষটাতে ধানক্ষেতে,
রক্ত খুব ভালো সার, হাড়ের টুকরোয় ভরপুর ক্যালসিয়াম,
আমরা জীবনবিজ্ঞান পড়েছিলাম একদিন,
আমার খুব ওইরকম প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, নারী শিশু,
দাবাখানা, চশমা পরা ডাক্তারনি, করিনা কাপুরের মতো,
ইচ্ছে ছিল, লেডিবার্ড চড়ে, জাতীয় সড়ক ধরে আরও আরও ভেতরের গ্রামে…
কিন্তু হবে না, যেহেতু আমি মরে গেছি, আর ভালো করেও মরি নি,…’
ওরা ধানক্ষেত ধরে হাঁটছিল। অনেক বোমা পোঁতা আছে এখানে। জায়গাটা খুঁজে পাচ্ছে না। তাজমুলের পেচ্ছাপ পেল। কিন্তু টনটনে জ্ঞান ধানক্ষেতে পেচ্ছাপ করা উচিত না। তাজমুল দৌড়তে লাগল কোন ফাঁকা জায়গার উদ্দেশ্যে, সেখানে গিয়ে পেচ্ছাপ করবে, কোন ঝোপ ঝাড় যদি পায়। কিন্তু কী আশ্চর্য, সে কোথাও এমন কোন জায়গা খুঁজেই পেল না। সমস্তটাই ধানক্ষেত, তার ফাঁকে ফাঁকে বোমা, সেখানে বসলে হয়তো সে একটা বোমার ওপরেই বসবে, এদিকে তার তলপেট ফেটে যাবে এক্ষুনি, এখুনি হালকা হতে না পারলে…।ছুটতে ছুটতে সে কিছু একটায় হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। অমনি কানে তালা লাগানো শব্দ হল একটা। সে দেখতে পেল তার শরীর টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে, সে মাথায় হাত দিল, নাহ মাথা নেই তো, ঘিয়ে রঙের ঘিলু রক্তে মাখামাখি, তার হাতে উঠে এল।
ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসে তাজমুল। তাড়াতাড়ি দেখে তার হাতপাগুলো। কিছুই তো উড়ে যায়নি। সব ঠিক আছে। তাহলে এরকম একটা স্বপ্ন দেখল কেন ও? এই ধানক্ষেত কোথাকার? সেই কোন ছোটবেলায় গ্রাম ছেড়ে চলে এসেছিল, তারপর আর কোথায় ধানক্ষেত দেখল ও? ওহ সেই লাস্ট এনকাউন্টারটা… কিন্তু সেখানে বোমা কোথা থেকে এল? তিনটে দানা গুনে গুনে। মুঙ্গের থেকে এসেছিল মেশিন আর দানা। লোকটা লুটিয়ে পড়েছিল মাটিতে। ওর ভাই পয়সা দিয়েছিল। মারতে পারলেই সব সম্পত্তি তার।
সেদিন অ্যাকশন শেষ করে আবছা আলোয় মেয়েটাকে দেখেছিল। একদম চিকনা। ওরা চারজন পালা করে। তারপর বেফালতু ঝামেলায় জড়াবে না বলে খালাশ করে দিয়েছিল। নাহ, দানা খরচ করেনি। স্রেফ গলা টিপে।হাতে গ্লাভস পরতে ভোলেনি। গলা টিপে মারতে ভালো লাগে না যদিও। চোখদুটো কেমন ঠিকরে বেরিয়ে থাকে।
কিন্তু ওই যে প্রয়োজনের থেকে একটাও বেশি দানা খরচ করা যাবে না, এইরকম একটা নির্দেশ আছে ওপর থেকে। আর এই মেয়েটা এত ভোরে যে এসে পড়বে এখানে, আর তাকে যে এমন চিকনি চামেলি মার্কা দেখতে হবে, তা কে জানত? ছেঁড়া খোঁড়া শরীরটাকে ফেলে যাওয়া খুব রিস্কি। মেয়েটা ওদের চারজনকে যেরকম বাধা দিয়েছে, তাতে বোঝা যায় হেভি কড়ক মাল। একটু জান কলজেতে ধুকধুক করলেই সোজা পুলিশে গিয়ে রিপোর্ট লেখাবে। তাছাড়া পুলিশকে তো নাহয় ওপর থেকে চাপ দিয়ে চুপ করানো যাবে, কিন্তু এই টিভি ক্যামেরা, ধানক্ষেতে দরকার হলে সারারাত বডি ফেলে ছানবিন করবে। তারপর বাড়ির ভেতরে ঘুসে যাবে, মুখের সামনে ডান্ডা ধরে পুছতাছ করবে। এখন তো শুধু টিভিতে নয়, সবার হাতে ফোনে ফোনে খবর ছড়ায়। কিছু একটা ইস্যু পেলেই হল, অমনি ফেসবুকে দল তৈরি হয়ে যায়, মিছিল, মোমবাতি। মোম গলে যেতেই মিছিল শেষ। আবার আর একটা নিয়ে পড়ে যায়। কাজের কাজ হয় না, কিন্তু খানিক হুজ্জুতি হয়। কিছুদিন আন্ডারগ্রাউন্ড, ধান্দাপানি বন্ধ।
খুব খারাপ কাটে তখন তাজমুলের।এমনিতে কাজ না থাকলে ও একটু ঘুরেফিরে বেড়ায়। কলকাতায় এখন কত বড়বড় মল। সেখানে গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলেও সুখ। কত কিসিমের মেয়ে, কী চেহারা তাদের। কত রকম পোশাক। এসব জায়গায় গেলে হেব্বি ফরেন ফরেন ফিলিং হয়। তাজমুলের স্বপ্ন সে একবার ফরেন যাবে, ওইসব পাটায়া মালয়েশিয়া নয়, সত্যিকার সাহেবদের দেশে। সেখানেও নাকি ধান্দাপানির দারুণ সিস্টেম আছে।
তাজমুল বিছানায় উঠে বসে ঘরের দিকে চাইল। বাচ্চু আলো ছাড়া ভয় পায় বলে একটা নাইট ল্যাম্প জ্বলছে। বাচ্চু, কেতো, বিকাশ আর সে চারজনে শুয়ে আছে মেঝেতে। এটা গড়িয়ার খালপাড় । একটা গেরস্ত বাড়িতে তারা এসে আঁটি গেড়েছে, সামনের দিকে বাড়ির সবাই, রান্নাবান্না, চ্যাঁ ভ্যাঁ। পেছনে এই একটা ঘর, তার সঙ্গে লাগোয়া বাথরুম আছে। এই বাড়ির মালিক বাপিদার এজেন্ট। বাপিদার এরকম এজেন্ট ছড়ানো সারা বাংলায়। তারাই বিপদে আপদে শেল্টার দ্যায়। তাজমুল এই ক বছরে বুঝেছে বাপিদা পুরো অফিসের মতো এই দলটা চালায়। অনেকেই পে রোলে আছে। মাসে একটা থোক টাকার বদলে তারা নানা কাজ করে। কিন্তু অন্য অফিসের থেকে যে ব্যাপারটা আলাদা, সেটা হল এখানে কেউ কাউকে চেনে না। হতে পারে পাশাপাশি মেট্রোতে যাচ্ছে, কিন্তু কেউ জানে না পাশের লোকটাও বাপিদার লোক। আর এখানে গদ্দারি মানে খাল্লাশ।
তাজমুল উঠে বাথরুমে গেল। স্বপ্নে দেখছিল পেচ্ছাপ পেয়েছে, সেটা সত্যি সত্যি। মুখে চোখে জল দিয়ে ঘরের জানলায় এসে দাঁড়াল। জানলাটা বন্ধ করে রাখতেই বলেছে এ বাড়ির লোকটা। কিন্তু রাতে হেব্বি গরম লাগায় কেতো উঠে জানলাটা খুলে দিয়েছে। সেই জানলায় দাঁড়িয়ে তাজমুল দেখল আকাশ আস্তে আস্তে ফর্সা হচ্ছে। রাতে কি বৃষ্টি হয়েছে? বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে। আরাম লাগছিল শরীরে। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সে স্তব্ধ হয়ে গেল। একটা বৌ উঠোনের কলে স্নান করছে, পাতলা নাইটি জলে ভিজে তার শরীর স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, কিন্তু না, সেই শরীর দেখল না তাজমুল। এই প্রথম সে কোন মেয়ের শরীরের দিকে তাকাল না। সে আবছা আলোয় মেয়েটার মুখের রেখা স্পষ্ট দেখতে পেল। একটা সত্যিকারের মুখ, যে নিজের মধ্যে ডুবে আছে। এমন মুখ তার আছে?
মাথার মধ্যে একটা যন্তনা হচ্ছে খুব। খবরটা কাল দেখেছে টিবিতে। মানে মোবাইলের টিবিতে। সেই থেকে সব গুলিয়ে যাচ্ছে। ও এক ঠেলা দ্যায় বাচ্চুকে।
-শোন নারে, এই মাগিচোদা, এই বাচ্চু
বাচ্চু পাশ ফিরে শোয় ঠেলা খেয়ে।
-এই শুয়োরের বাচ্চা, ওঠ না মাইরি
জোর ঠেলা খেয়ে বাচ্চু ধড়মড় করে উঠে বসে।
-কী বাওয়াল আরম্ভ করলি বল তো মাঝরাত্তিরে?
-কিছু মনে পড়ছে না মাইরি, কিচ্ছু না।
-কি তখন থেকে নৌটংকিপনা করছিস বল তো?কালও বলছিলি এই কথা।
-তোর নৌটংকিপনা মনে হচ্ছে? যদি বুঝতিস মাথার মধ্যে কী যন্তন্না হয় আজকাল।মনেই করতে পারি না কিছু।
-কী মনে করতে চাইছিস তুই?
-এবার তো তুই ন্যাকামি করছিস, তুই, তুই ছিলিস তো সেইদিন আমার সঙ্গে
-কোন দিনের কতা বলচিস বে?
বাচ্চুটা বহুত ন্যাকামি করছে আজ, মনে হল তাজমুলের। রোজই তো কত অ্যাকশন করে তারা, কিন্তু দিন বললে তো সেই একটা দিনই বোঝায়। আর সেই দিনটাই মাথা থেকে প্রায় মুছে একটা ঘসা ঘসা ছবি রয়ে গেছে। সবুজ ধান ক্ষেতটা সেই ছবিতে কেমন কালচে, একটা সাঁকো ছিল, মনে আছে। সাঁকোটা পেরিয়ে গেছিল কি তারা? সাঁকোর ওপারে যারা ছিল, তারা এখন কয়েকটা ছায়া। সেই ছায়াগুলোকেই কি গুলি করেছিল তারা? ছায়ার গায়ে গুলি করলে তাহলে এত রক্ত এল কোথা থেকে? কোন লাশ পড়েনি, কোন লাশ পড়েনি, বিড়বিড় করে তাজমুল।
বাচ্চু যেন একটু টাল খেয়ে যায় এ কথায়। ২০১১ র সেই অ্যাকশনের কথা বলছে নাকি তাজমুল? ও শিউরে ওঠে। কী করে তা সম্ভব? তাজমুল তো তখন এই লাইনেই আসেনি। তাজমুলও না, সেও না। তারা তখনো হাফ প্যান্টে।এই তো দু হাজার সতেরোতে সবে তারা এই লাইনে নামল। তাহলে তাজমুল এসব কী বলছে? কথাগুলো নিশ্চয় ও কারো কাছে শুনেছে। কিন্তু এমন ভাবে বলছে যেন ও ওখানে ছিল। তাহলে কি লোকে যা বলে সব সত্যি? একজন আরেকজনের শরীরের মধ্যে ঢুকতে পারে? তাজমুল যা বলছে, তা তাহলে ওর ভেতরে সেঁদোনো লোকটার কথা?কেঁপে গেল শরীর। কিন্তু সে হচ্ছে বোমা বাচ্চু, এত সহজে টপকাবে নাকি? মাথা ঝাঁকিয়ে সে বলে
-আরে, তুই যে দেকচি পুরো বাউড়ে গেলি, লাইনে নতুন নাকি। নে কদিন ভালো করে মাল খা, মেয়েছেলে নিয়ে ধামসাধামসি কর, সব মনে পড়ে যাবে
তাজমুলের কী যেন একটা মনে পড়ে। সে ব্যগ্রভাবে বলে
-শোন, ধর বাপিদা আমাদের একটা অ্যাকশনে পাঠাল
-পাঠাল, তো?
-বলল এমন ভাব করতে হবে যে আমরা আসলে বাপিদার লোক নই, অন্য পার্টি পাঠিয়েচে
-এ তো হামেশাই হয়, খুন করব আমরা, কেস খাবে অন্যরা।
-এখন বাপিদা যদি দল ছেড়ে দ্যায়, তাহলে কি লাশগুলো নেই হয়ে যাবে?
– কী সব বলচিস আনসান কতা
– আমি বলতে চাইছি, আমরা কারা?
-আমরা কারা মানে? তুই তাজমুল, আমি বাচ্চু, ওই যে কেতো আর বিকাশ ঘুমোচ্ছে।
-সে কথা না, আমি জানতে চাইছি, আমরা কি খুন করেছি? না আমরা খুন হয়েছি? আমরা শালা বেঁচে আছি না মরে গেছি?
(ক্রমশ)
প্রতি পর্ব পড়ছি।ভালো লাগে
ভাল থেকো
দুর্ধর্ষ।
ধন্যবাদ
টান৷ টান। হুড় হুড় করে পড়া হয়ে যায়। কি যে স্বপ্ন আর বাস্তব মিলিয়ে দেওয়া, ভেতর খোঁড়া লেখা একটা। তবে, ইন্ট্রো পালটাও!!৷ এক ইনট্রো প্রতি কিস্তি তে কেন!
ভালবাসা
ভালো লাগলো। আগের পর্বগুলোও পড়ব।