অজিত সিং বনাম অজিত সিং
ত্রিত্রিংশতি পর্ব
তৃষ্ণা বসাক
অজিত সিং বনাম অজিত সিং দ্বাবিংশতি পর্ব তৃষ্ণা বসাক অজিত সিং প্রথমে ছিল বঙ্গলক্ষ্মী চানাচুর, তারপর এল আজাদ হিন্দ চানাচুর, তারপর একের পর এক বিপ্লব চানাচুর, সর্বহারা চানাচুর, উন্নততর সর্বহারা চানাচুর, এখন চলছে বিশ্ববাংলা। এখানেই কি ভাবছেন গল্প ফুরিয়ে গেল? এবার আসছে একে ফিফটি সিক্স চানাচুর। নাম যাই হোক, সোল এজেন্ট আমি।’ ‘বেওয়ারিশ’ গল্পের চানাচুরওলা এবার ঢুকে পড়েছে বাংলার শিল্পক্ষেত্র থেকে শিক্ষাজগতের ক্ষমতার অলিন্দে।খুন, যৌনতা, প্রতিশোধ, নিয়তিবাদের রুদ্ধশ্বাস সুড়ঙ্গে সে টের পাচ্ছে- -বহুদিন লাশের ওপর বসে বারবার হিক্কা তুলেছি আমরা -বহুদিন মর্গের ভেতরে শুয়ে চাঁদের মুখাগ্নি করেছি আমরা -অন্ধ মেয়ের মউচাক থেকে স্বপ্নগুলো উড়ে চলে গেছে (জহর সেনমজুমদার) এই সবের মধ্যে বাংলার কি কোন মুখ আছে আদৌ? থাকলে কি একটাই মুখ? না অনেক মুখ, সময়ের বিচিত্র রঙে চোবানো? বিগত প্রায় অর্ধশতাব্দী জুড়ে বাংলার অজস্র মুখের ভাঙ্গাচোরা টুকরো খুঁজে চললেন তৃষ্ণা বসাক, তাঁর নতুন উপন্যাস ‘অজিত সিং বনাম অজিত সিং’-এ । সব কথনই রাজনৈতিক, সেই আপ্তবাক্য মেনে একে কি বলা যাবে রাজনৈতিক থ্রিলার? সিটবেল্ট বাঁধুন হে পাঠক, ঝাঁকুনি লাগতে পারে। প্রকাশিত হল উপন্যাসের ৩৩তম পর্ব। এই উপন্যাসের সব চরিত্র কাল্পনিক।
৩৩
‘কাউকে মারার জন্যে যজ্ঞ করা যায়, এটা কি সত্যি ঠাকুর মশাই?’
একেকটা লোক আসে, তাদের আসার কোন উদ্দেশ্য বোঝা যায় না। কারো জন্মছক করানো নয়, নির্দিষ্ট কোন সমস্যার কথাও এরা বলবে না। এরা হচ্ছে তত্ত্ব আলোচনা টাইপ লোক। বসে বসে হ্যাজাতে আসে। এদের মনের মধ্যে নাকি অনেক আলোড়ন, অনেক প্রশ্ন। সেসব কথা কাউকে বলতে পারে না। তাই ভবানীর কাছে আসে, কূট প্রশ্নের মীমাংসা চেয়ে। এই পৃথিবীতে ঘটে চলা ঘটনাগুলোর কার্যকারণ জানতে চায়। তা অবশ্য বিনা পয়সায় নয়, রীতিমতো ভিজিট দিয়ে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেই আসে এরা। এ সেরকম একটা লোক। এসেছে, কতক্ষণ থাকবে ঠিক নেই। উঠতে উঠতেও নতুন প্রশ্ন গজিয়ে যাবে, আবার বসে পড়বে। আজও কর্মফল, গ্রহ নক্ষত্র, আয়ুরেখা, যশ রেখা, কিরো কতটা অথেনটিক, সত্যিই বিধাতাপুরুষ নবজাতকের কপালে ভাগ্য লিখে যান কিনা, সেটা কি ছ দিনের মাথায় ষষ্ঠী পুজোর দিন- এইসব হাবিজাবি প্রশ্নের উত্তর হাসিমুখেই দিচ্ছিলেন ভবানী। কারণ লোকটা প্রফেশনাল। সে এক ঘণ্টার জন্য মোটা ভিজিট দেয়। তাকে খানিক সহ্য করতেই হয়। আজ বেশি হাবিজাবি প্রশ্ন করেনি, উঠেও পড়ছিল ঠিক সময়ে। কিন্তু উঠতে উঠতে আবার এরকম এক উতপটাং প্রশ্ন করে বসল। শুনেই মনে হল যেন মারণযজ্ঞের একজন স্পেশালিস্টের কাছে এসেছে সে। আরে সব কিছু অত খুল্লম খুল্লা বলা যায় নাকি?এ তো জঙ্গি গোষ্ঠীর ট্রেন বাস ওড়ানো নয়, যে করার পর আবার তা স্বীকার করবে জাঁক করে। এসব সূক্ষ তত্ত্ব। কে কাকে মারে? সব তো আগে থেকেই ঠিক হয়ে আছে। তিনি নিমিত্ত মাত্র।
নিছক তত্ত্ব আলোচনার জন্যে, শেখার জন্যে অনেকেই আসত অবশ্য একসময়। একটা ব্যাপারের পর সেসব তিনি অনেক বছর ছেড়ে দিয়েছিলেন।একজন আসত তাঁর কাছে, নিজের ভাগ্য জানতে নয়, ভাগ্য গণনা কীভাবে হয়, নিছক সেই কৌতূহলে।আগুনের খাপরার মতো একটা মেয়ে। সেসময় ভবানী তো শুকিয়ে যাননি, সেই মেয়ে তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। বহু কষ্টে নিজেকে সামলেছিলেন তিনি। কোন সম্পর্ক অগম্য সেটা তাঁর থেকে ভালো কে জানে? নিজের সাময়িক শরীরের সুখের থেকে অনেক বেশি দামী জিনিস সে দিয়ে গেছে। তার হাত ধরেই ক্ষমতার অলিন্দে প্রবেশ করেছিলেন তিনি। ভবিষ্যৎ- কি মোহ এই শব্দের। কি ডান, কি বাম, কি মধ্যপন্থী –সবাই নিজের ভবিষ্যৎ জানতে চায়। অথচ কেউ অতীত জানতে আগ্রহী নয়। বরঞ্চ অতীতকে ভয় পায় বা অতীত নিয়ে কোন কৌতূহলই নেই। অতীত যেন দুঃস্থ সাহায্যপ্রার্থী আত্মীয়ের মতো। অথচ মজার ব্যাপার হল, ভবিষ্যৎ কী হবে, তার সব সঙ্কেত লুকিয়ে থাকে অতীতের মধ্যেই। অতীতের প্রতিটি ঘটনা ভবিষ্যতকে নিয়ন্ত্রণ করে। সেগুলো না জানলে ভবিষ্যতের দরজা খোলা যায় না। ভবানী কোন ঈশ্বর নয়। জ্যোতিষ চর্চার অনেকখানি মনস্তত্ব আর বাস্তববুদ্ধি। সেই বাস্তববুদ্ধিই তাঁকে বলেছিল নারীশরীরের থেকেও অনেক জরুরি সেই নারীর হাত ধরে ক্ষমতার অলিন্দে ঢুকে পড়া। তিনি ঢুকে পড়লেন, দেখলেন কী জনসম্মোহিনী শক্তি এই জ্যোতিষের। শুধু জ্যোতিষ নয়, তন্ত্রসাধনার গূঢ় রহস্যও সেই মেয়ে জানতে চেয়েছিল। খুব আশ্চর্য হয়েছিলেন তিনি। এত শিক্ষিত, আধুনিক বামপন্থী একটি মেয়ে, আত্ম নির্ভরশীল- সে কেন এসবে আগ্রহী হল? পরে মনে হয়েছিল, আসলে এগুলো অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে সে, তার আসল উদ্দেশ্য ক্ষমতা দখল। সত্যি সত্যি তো ক্ষমতার খুব কাছেই পৌঁছে গিয়েছিল, তাবড় তাবড় নেতা তার কথায় উঠত, বসত। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। কেন?
ক্ষমতার অলিন্দে তিনি ঢুকে পড়লেন আর ছিটকে পড়ল সেই মেয়ে। তার কারণ কি একজন মেয়ের উত্থান কেউ মেনে নিতে পারেনি? অথচ বাঙালি শুধু না, শক্তির সাধনা আর মাতৃপূজা ভারতীয়দেরই অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তারাও কেন নারীর উত্থান মেনে নিতে পারে না! সে মেয়েকে শুধু দমিয়ে দিলে তবু বোঝা যেত, তাকে মুছে দেওয়া হল। কোথায়? তাঁর জীবনের কিছু কিছু উত্তর না মেলা অংকের এটা অন্যতম। কিন্তু তিনি জানেন, তিনি নিশ্চিত জানেন, সে বেঁচে আছে। তার ছক তো তিনিই করেছিলেন। জাতিকা দীর্ঘজীবি, তাঁর থেকে ভালো কেউ জানে না। এবং প্রতিশোধপরায়ণ। শব্দটি তাঁকে কাঁপিয়ে দিল। কিন্তু কেন, তিনি তো কোন বেইমানি করেননি তার সঙ্গে। তিনি কেন ভয় পাচ্ছেন? হ্যাঁ, সে চলে যাবার পরেও সেই অলিন্দ তিনি ছাড়েননি। বরং উত্তরোত্তর তাঁর প্রভাব প্রতিপত্তি বেড়েছে। রং বদলের পরেও সেই অলিন্দে তাঁর প্রভাব অব্যহত শুধু নয়, তিনি আরও ক্ষমতাবান। এ স্বপ্ন যে দেখেছিল, সেই স্বপ্ন তো পূরণ হয়েছে। তার তো খুশি হবার কথা। কিন্তু তবু কেন মনে হয় আড়ালে অত পেতে কে যেন বসে আছে!
‘কাউকে মারার জন্যে যজ্ঞ করা যায়, এটা কি সত্যি ঠাকুর মশাই?’ আবার একই প্রশ্ন করল লোকটা।
হেভি রাগ হল প্রশ্নটা শুনে ভবানীর। তিনি তো চালকলা বাঁধা পুরুতঠাকুর নন যে ঠাকুর মশাই বলবে।তাঁকে সবাই শাস্ত্রীজী বলে, ভবানীদা বা ভবানীবাবু বলার সাহস কারো হয় না। এসব নামে যারা ডাকত, তারা সব কোথায় কে জানে! মরে হেজে গেছে নাকি পিসিমার মতো? অবশ্য চোখের দূর হলেই যদি মরে যাওয়া হয়, এমন অনেকেই মরে গেছে তাঁর কাছে। না, না দিদি তো এখনো বেঁচে, মাঝে মাঝে পোস্টকার্ড পাঠায়।ফোন করার অভ্যেস নেই তার। ফোন ধরারও অভ্যেস নেই ভবানীর। তাঁর একটা মোবাইল ফোন আছে বটে, কিন্তু তার নম্বর বেশি কেউ জানে না।ফোন এলেও ধরা হয় না অনেক সময়, দেখে দেখে রিং ব্যাক করা –তাও হয়ে ওঠে না। তাঁর কথা হল, যার খুব দরকার, সে এই কালী মন্দিরেই সোজা চলে আসবে, অথবা তাঁর কার্ডে মন্দিরের যে নম্বর দেওয়া আছে, সেই ল্যান্ড লাইনে ফোন করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেবে। সেখানে গগনকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। বামুনের ছেলে, আগে তন্ত্রধারকের কাজ করত, কিন্তু কিছুই গুছিয়ে রাখতে পারে না, এত বছরেও পুজোর খুঁটিনাটি নিয়ম কিছুই শিখল না, তাড়িয়ে দিলে না খেয়ে মরবে, তাছাড়া ওর ওপর ভবানীর একটু দুর্বলতা আছে, ওর মা গোলাপি, অনেকবছর মন্দির ধোয়া মোছার কাজ করেছে, ওঁর ঘরটাও সে খুব তকতকে করে রাখত। আগে আগে, তখন ভবানীর সব কিছু এত শুকিয়ে আসেনি, শনিবার শনিবার মন্দিরে রাত্রিযাপন করলে, ওকে ডেকে নিতেন। খুব নিষ্ঠাভরেই তাঁর সেবা করেছে গোলাপি। মোহর যদি এরকম করত! তা তো হবার নয়, মোহরের কুষ্ঠীতেই তো আছে সে … থাকগে, মোহর ভালই, তবে ইদানীং ওর একটু বাড় বেড়েছে, ডানা না ছাঁটতে পারলে… আর মোহরের মেয়ে তো তাঁকে মানুষই মনে করে না। এরকম কত দেখলেন জীবনে। অতি দর্পে হত লঙ্কা।যত বাড়ই বাড়, গ্রহের ফের কেউ কাটাতে পারবে না। চিরকাল তাঁর হাতের মুঠোতেই কাটাতে হবে।
লোকটা আবার বলল ‘ঠাকুরমশাই, বললেন না তো?’
ভবানী শাস্ত্রী তখন গোলাপির শীর্ণ কিন্তু দমদার শরীরের কথা ভাবছিলেন, গ্রহ নক্ষত্রের কেমন খেল দেখো, তাঁর শয্যায় জায়গা পেয়েও কি ভাগ্যের পরিবর্তন হল কিছু? সেই তো ঘর মুছেই জীবন কাটল, তারপর অকাল মৃত্যু, কী এক অজানা জ্বরে তিনদিনেই সব শেষ। আলো যে নিবে আসছে, বুঝতে পেরেছিল গোলাপি। নইলে তাঁর পা চেপে ধরে বলবে কেন ‘ছেলেটাকে দেখবেন ঠাকুরমশাই। আপনি ছাড়া ওর আর কেউ নেই’
হ্যাঁ, গোলাপিই শেষ তাঁকে ঠাকুরমশাই বলত, তাকে কোনদিন মানা করেননি তিনি। ওর ওপর একটা দুর্বলতা ছিল তাঁর, গগনের ওপরেও একটা টান আছে বুঝতে পারেন। এত ভুলভাল কাজ করে, তাও ওকে তাড়াতে পারেননি। ওর জন্যে চিন্তাও হয় তাঁর। তিনি চোখ বুজলে মন্দির কতৃপক্ষ ওকে তাড়িয়েই ছাড়বে। ওর নামে তাই একটা ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছেন, কিছু টাকা রেখেছেন, আরও কিছু রাখবেন। কিন্তু ছেলেটার বুদ্ধি নেই তো, মাথায় হাত বুলিয়ে নিয়ে নেবে লোকে। যাক, অত চিন্তা তাঁর নয়, তবে ওর জন্মের দিনক্ষণ কিছুই বলতে পারেনি গোলাপি, বলতে পারলে ছক কষে দেখতেন কতদিন আয়ু ওর। ওর আয়ু যদি কম হয় তাঁর থেকে, চিন্তার কোন কারণ নেই তাঁর।
লোকটা বড্ড বিরক্ত করছে তাঁকে। আরে তিনি সুপারি কিলার নাকি যে মারার বরাত দিতে এসেছে তাঁকে? খুব রাগ হয়। ভাবেন বার করে দেবেন। কিন্তু আজ প্রথম খদ্দের এ, লক্ষ্মী তাড়ানো যায় না, যায় কি?
তিনি গম্ভীর ভাবে বলেন ‘একটু খুলে বলুন কী বিষয়’
‘বিষয়টা স্যার খুব কনফিডেন্সিয়াল’এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে লোকটা। সে বেশ টেনশনে আছে বোঝা যায়, নইলে ঠাকুর মশাই থেকে এক লাফে স্যার বলবে কেন? এইসব লোকেদের কাছে বেশ টাকা খিঁচে নেওয়া যায়, বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্যে তারা যেকোন টাকা দেবার জন্যে তৈরি থাকে। কিন্তু ভবানী শাস্ত্রীর দক্ষিণা সব অবস্থাতেই এক থাকে। সবার জন্যে এক রেট। যজ্ঞ করতে হলে একটু বেশি পড়ে ঠিকই, কিন্তু মানুষের বিপদ বুঝে তা লাফিয়ে বাড়ে না। অনেকে পরে অনেক উপহার পাঠায় অবিশ্যি, সেসব বেশিরভাগই একে তাকে বিলিয়ে দেন তিনি, খুব মহার্ঘ কিছু হলে, ভালো শাড়ি, গহনা বা শো পিস, তবেই বাড়ি নিয়ে যান। এতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা আরও বাড়ে। লোকটার সঙ্গে কথা বলতে বলতে তিনি দেখলেন গগন নিজের হাতটাকে মুখের কাছে নিয়ে কু ঝিক ঝিক আওয়াজ করছে।
অমনি তাঁর কী যে হল, একটা ট্রেনের কথা মনে পড়ে গেল। দিদির বাড়ি থেকে কলকাতা আসতেন সেই ট্রেনে চেপে। সেই ট্রেনেই আলাপ মোহরমালার সঙ্গে। মোহর তখন একটা স্কুলে পড়ায়। দেখতে সুন্দর হলে কি হবে, এখনকার জেল্লাটা আসেনি। খুব সাধারণ শাড়ি, সাজগোজ, দীর্ঘ বিনুনি পিঠের ওপর। কানে বড় সোনার রিং। ভবানী তখন কী করেন? কিছুই না। মা, বাবা ছোট বেলাতেই মারা গেছে। দিদি আর তিনি পিসিমার কাছে মানুষ। দিদি গ্র্যাজুয়েশন করলেও তাঁর হায়ার সেকেন্ডারিতেই ঠেকে গেছে। টিউশনি করেন দু চারটে। আর অবসর সময়ে বাবার আলমারি খুলে দেখেন কিছু কি লিখে গেছেন বাবা মা তার জন্যে, কোন চিঠি? এ এক অদ্ভুত নেশা, কষ্ট পাবার নেশা। হঠাৎ করেই মারা গেছিল বাবা, মাও কয়েক বছরের মধ্যে। কেউই কিছু লিখে যায়নি তার জন্যে, থাকলে তো পিসিমাই বলত। তবু খুঁজতেন ভবানী। হলুদ হয়ে যাওয়া কত বই, বাঁধানো বসুমতী, দেবসাহিত্য কুটিরের পুজোবার্ষিকী- এসব ছাড়াও একদিন অদ্ভুত কিছু বই পেলেন। লাল কাপড়ে বাঁধা ছিল আলমারির একদম শেষ তাকে। সেদিন ভবানী না দেখলে সেগুলো উইয়ের পেটে চলে যেত। অদ্ভুত সব বিষয়ের বই। সংস্কৃত আর বাংলায়, দু চারটে ইংরেজিতেও। জ্যোতিষ চর্চা, ভাগ্য গণনা, গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান কীভাবে মানুষের জীবন বদলে দেয়, পিতৃস্থান মাতৃস্থান, পতিস্থান, পত্নীস্থান কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করে ভাগ্য। বইগুলো আদ্যোপান্ত পড়লেন ভবানী।ইংরেজি আর সংস্কৃত তিনি নামমাত্র জানতেন এর জন্যে সেসব ভালো করে শিখতে হল। এই সময় পিসিমা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, দোতলায় তাঁর ঘর থেকে তিনি বেরোতেই পারতেন না। পাড়াগাঁয়ে কাজের লোক বেশি পাওয়া যায় না, যতীন ভুইয়ার বৌ মনিকা বউদি এসে রান্না করে দিত, ভবানীর দেখাশোনাও করত। একদিন একতলার সেই বইয়ের গন্ধ ভরা অদ্ভুত ঘরে মেঝেতে বসে ভবানী বই পড়ছিলেন, মনিকা বউদি ওঁর পিঠ ঘেঁষে দাঁড়াল। ‘ও ঠাউরপো, কী পড়ো এত? ভাগ্য জেনে কী করবে গো? সব জুয়াচুরি। বুড়োবটতলার বাবা হাত দেখে বলেছিল বছর না ঘুরতেই কোল ভরে ছেলে আসবে, কোথায় কি। আরে আসলে যন্তরটি যদি অকেজো হয়, কল কি ঘোরে? ভাঙ্গা ছুঁচ দিয়ে কি সেলাই হয়? হ্যাঁ গো ঠাউরপো, তোমার তিলতত্ত্বের বই নেই? উরুতে তিল থাকলে নাকি মেয়েমানুষ স্বৈরিণী হয়? এই দেখো, আমার উরুতে কত তিল, লাল রঙের, দেখো দেখো’
পুরনো বইয়ের মধ্যে অমন একটা নতুন শরীর, কলাগাছের থোড়ের মতো সাদা উরুতে লাল লাল তিল কত, যেন হাজার বুটির জামদানি শাড়ি।
কী যে হয়ে গেল ভবানীর। তিনি দেখতে পেলেন রাহু কেতু রবি শুক্র মঙ্গল বৃহস্পতি তাঁর সামনে চক্রাকারে ঘুরছে। ওদের মধ্যেই যেন তাঁর জীবনের সব রহস্য লুকিয়ে আছে। তিনি ছুঁতে চাইলেন ওদের। আর ছুঁতে গিয়ে জীবনের প্রথম পাপ করলেন। শরীর শরীর, হা শরীর এত পাপ তোমার ভেতরে! নষ্টা নারী। ঘেন্না, ঘেন্না করি তোকে। রমণের পর তিনি প্রায় কুকুরের মতো তাড়িয়ে দিতেন মণিকা বউদিকে, প্রতিবার, অথচ, আবার ফিরে যেতেন সেই শরীরের কাছেই।
যা হবার তাই হল। মণিকা একদিন জানাতে এল তার গর্ভের কথা, এও বলল সে ভবানীর সঙ্গে ঘর ছাড়তে চায়। অন্যের সন্তান সে তার ভালমানুষ স্বামীর ঘাড়ে চাপাতে চায় না। ভবানীকে সে বিয়ে করার জন্যে বারবার চাপ দিচ্ছিল।
কী করতে পারতেন তখন ভবানী? তিনি তো ততদিনে তাঁর ভবিষ্যৎ বুঝে ফেলেছেন। মানুষের ভাগ্যই তাঁর ভাগ্য হবে।তাঁর অঙ্গুলিহেলনে ওঠবোস করবে অনেক তাবড় তাবড় মানুষ, তাই সেই জীবনের শুরুতেই এক পরকীয়া আর অবৈধ সন্তানের বোঝা বেশি ভারি হয়ে যাবে।মানুষ যাকে বিশ্বাস করে, তাকে সব রকম পাপ টাপ পদস্খলনের ওপরে দেখতে চায়। কাউকে ঈশ্বরের জায়গা বসিয়েই ওদের আনন্দ। সেখানে মনিকা বউদিকে টেনে নিয়ে চললে তাঁকে শুরুতেই মুখ থুবড়ে পড়তে হবে। তাছাড়া তাঁকে কলকাতায় যেতে হবে। এই ছোট গ্রামের চৌহদ্দিতে আটকে থাকলে যেমন চলবে না, তেমনই জীবনসঙ্গিনী হিসেবে মণিকা বউদির মতো ক অক্ষর গোমাংস, শরীরসর্বস্ব গাঁইয়া কেউ নয়, তাঁর দরকার এক আধুনিক যুগের মেয়ে, যার থাকবে সমাজের উঁচু তলায় মসৃণ যোগাযোগ। গ্রহনক্ষত্র হোক আর এই জগতসংসার- সব টিকে আছে সঠিক যোগের ওপর। ঠিক সেই স্বাতী নক্ষত্রের জলের মতো। একটা লোকের খুব অসুখ করেছিল। কবিরাজ বলেছিল মড়ার খুলিতে সাপের বিষে স্বাতী নক্ষত্রের জল মিশলে সেটাই হবে তার ওষুধ। সেটা ছাড়া বাঁচবে না সে। সবাই ভেবে আকুল তা কীভাবে সম্ভব? কিন্তু এক অমাবস্যার রাতে শ্মশানে ঘটে গেল সেই আশ্চর্য যোগাযোগ। মড়ার খুলিতে সাপ বিষ ঢেলে গেল আচমকা, আর তাতে পড়ল স্বাতী নক্ষত্রের জল। তৈরি হয়ে গেল জীবনদায়ী ওষুধ। জীবন আসলে যোগাযোগ ছাড়া কিছুই নয়। সেই লক্ষ্যে সামনের দিকে না এগিয়ে তিনি মণিকা বউদির কুয়োয় ব্যাঙ হয়ে থাকবেন?
হয়তো মণিকা বউদিরও মনে হয়েছিল একটা ছেলের ভবিষ্যৎ এভাবে নষ্ট করা উচিত নয়। আবার ভালমানুষ স্বামীর সঙ্গেও এভাবে বেইমানি করে সে অনুতপ্ত ছিল। একদিন দেখা গেল পুকুরঘাটে মরে পড়ে আছে, গেঁজলা বেরোচ্ছে মুখ দিয়ে। নীল হয়ে গেছে শরীর।
বিষ খেয়েছে যতীন ভুঁইয়ার বৌ। এত কি অশান্তি ছিল ওদের মধ্যে? কেউ তো শোনেনি ঝগড়ার শব্দ কোনদিন! হ্যাঁ, বাচ্চাকাচ্চা না থাকার জন্যে কষ্ট ছিল। কিন্তু তার আশা তো যায়নি তখনো। ভরা যৌবন। এর মধ্যে দুটি প্রশ্ন আর একটি আবিষ্কার বিষয়টি জটিল করে তুলল।
সে বিষ পেল কোথা থেকে?
ঘরে না খেয়ে পুকুরঘাটে বিষ খেল কেন?
আর ময়নাতদন্তে জানা গেল সে গর্ভিনী ছিল। এর বেশি কিছু জানতে পারেনি ভবানী। তাকে তো দিদির অসুখের জন্যে চলে যেতে হল মহুয়াতোড়, বাঁকুড়া। আর সেখান থেকে সোজা কলকাতা। আর পেছনে তাকায় নি সে। ট্রেনে তার সঙ্গে আলাপ হল মোহরমালার। ‘আপনার জন্য অনেক বড় সুযোগ আসছে। শুধু চিনে নেবার অপেক্ষা।’
মোহর ওই এক বলেই আউট। দুজনের দুজনকে চিনে নিতে সময় লাগেনি।
দারুণ গতিময় লেখা। বেশ ভালো লাগছে।