
সন্মাত্রানন্দ-র কবিতাগুচ্ছ
কথকতা
১
পুরোনো বছর, তোমার দিনগুলির মোড়কে রয়ে গেল অনেক অজানা কথা, অনেক ছবি, অনেক প্রজাপতি না হতে পারা গুটিপোকা… পুরোনো বছর, তোমাকে অনেক গল্প বলেছিলাম, সেগুলো লেখা হল না বলেই তুমি তাদের ভুলে যেও না… পুরোনো বছর তোমার শ্রুতিমূলে ডাক দিয়ে গেল অনেক ফেরিওলা, কলের গান, মধ্যরাত্রে এঞ্জিনের শব্দ…তোমার সঙ্গে আর দেখা হবে না কোনও দিন, পুরোনো বছর…অনেক অনেক ভুলে যাওয়া স্বপ্নের মত তুমি ফিরে আসবে না আর…এবং তোমার সঙ্গে হারিয়ে গেল অনেক উদাস দুপুর, অনেক নিস্তব্ধ সন্ধ্যা, অনেক শ্রমক্লান্ত দিন…তুমি নিয়ে গেলে তোমার সাথে আমার পুরোনো বছরের ‘আমি’কে…বিগত সেই ‘আমি’র সঙ্গে আবার হয়ত দেখা হবে মৃত্যুর পর, মেঘের মধ্যে কিংবা বৃষ্টির ফোঁটায় অথবা কোনও ধানের শীষের ভিতর নয়ত আমার ভাবী জন্মের গর্ভধারিণীর জরায়ুর অন্ধকারে…সেই ‘আমি’ হয়ত তখন হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে থাকবে সেই কুয়াশামাখা পথের পাশে পুরোনো বছরের ‘তুমি’ র সাথে… পুরোনো বছর, যাও ডুব দাও সেই অন্ধকার জলের ভিতর, যার নাম স্মৃতি-বিস্মৃতি, যার মধ্যে সঙ্গোপনে ঢাকা থাকে শামুক, ঝিনুক আর হারানো ভালোবাসাবাসির ইতিকথা…
২
মিতায়তন কবিতার দেশ থেকে
ভেসে আসছে মধ্যদুপুরে অচেনা পাখির ডাক…
সমুদ্রের বাতাস যেন এক বজ্রডাকিনী
আমন্ত্রণ জানায় পাখির ডাক হয়ে আমাকে
এই দুপুরবেলায়।
একবার ডাকে, দুবার ডাকে
তারপর থেমে যায় মধ্যপথে
তিন ডাক এর কেউ শোনেনি কখনও।
করুণা-নাও আমি তয়ের করেছি
গামারের শরীর দিয়ে
চুনো মাছের টক দিয়ে দুটি গরম ভাত খেয়ে
শুয়েছি দাওয়ায় শীতলপাটি বিছিয়ে
কুটিরের মেঝে কী ঠান্ডা শরীর জুড়োয়
ঘুমের ভেতর তন্দ্রার ভেতর
অচেনা পাখির ডাক ভেসে আসে
মিতায়তন কবিতার দেশ থেকে
ঘুম ভেঙে উঠে নদীর ঘাট থেকে নৌকা খুলে
ভেসে যাব উজানবেলায়
কেউ রুধে রাখতে পারবে না।
৩
আসলে যতই তুমি মহিলা হও,
আমি জানি, তুমি সহজ বালিকা।
তোমার যাবতীয় প্রচ্ছদ
আসলে একটি রূপকথাকে
ঢেকে রাখার জন্য।
আসলে যতই মহিয়সী হও,
আমি জানি,
তুমি তো ন্যাজারেথ গাঁয়ের সরলা মরিয়ম!
৪
বীতশোকদা এ শহরে একা একা মুখচোরা হাঁটতেন।
তাঁর কোনো সঙ্গী ছিল না।
না এ শহরের পথে, না চিন্তায়।
বীতশোকদা মনে মনে একা ছিলেন।
যেমন একা থাকে গোপগড়ের টিলা,
যেমন একা কংসাবতী।
বীতশোকদার বন্ধু ছিল একমাত্র তাঁর লেখার খাতা।
মনে মনে মুসাবিদা করতে করতে
বাসন্তীতলা থেকে মল্লিকচক,
মল্লিকচক থেকে রাজাবাজার,
রাজাবাজার থেকে ঘুরে রবীন্দ্রনিলয় হয়ে
শরৎপল্লীর দিকে বীতশোকদা
একা একা হাঁটতেন অপরাহ্ণবেলায়।
আসলে তাঁর কোনো সঙ্গী ছিল না।
এক এবং দুই ভালো লাগলো । এক-এ অমিতকথনের মধ্যে , পুনরাবৃত্তির মধ্যে তৈরি হল পারসোনার চরিত্র আর দুই-এ চর্যাপদের ব্যবহার নতুন করে ভাবালো । সেই কবে আমাদের মাস্টারমশাইয়ের কাছে পড়েছিলাম – “সোনে ভরতি করুণা নাবি/ রুপা ঠহি নহি কোঠাবি”