
সুতপা চক্রবর্তীর কবিতা
সজ্জন পুরুষ
১.
সজ্জন ব্যক্তি মঞ্চে উঠে নারী স্বাধীনতা নিয়ে বিশাল বক্তব্য রাখলেন
গোটা হলঘর ভরে গেল হাততালিতে
বাড়িতে এসে নিজস্ব নারীকে বললেন
‘খানকী মাগী কার সাথে এতক্ষণ মজেছিলি বল?’
নারীটির ভেতর একবার কেঁপে উঠলো
পরক্ষণেই সামলে নিয়ে এককাপ চা বাড়িয়ে দিলো
কাঙ্ক্ষিত পুরুষটির দিকে।
২.
সজ্জন ব্যক্তি প্লাথ নিয়ে একশো পাতার প্রবন্ধ লিখলেন
সম্পাদক আবেগমথিত গলায় প্রণাম জানালেন তাঁকে
নারীটি এসে পাশে দাঁড়ালো একটি ছোট্ট লেখা নিয়ে
সজ্জন ব্যক্তি চেয়ার থেকে উঠে গেলেন
‘রাস্তায় দাঁড়ানো বেশ্যা মাগীও তোমার চেয়ে বেশি সম্মান দাবী করে।
বল কাকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিস এগুলো?’
নারীটির জঠর থেকে দুফোঁটা রক্ত বেরিয়ে আসে
সজ্জন ব্যক্তি সেই রক্ত কলমে ভরে আগামীদিনের
নারীবিষয়ক পদটি লিখতে থাকেন।
৩.
সজ্জন তরুণ কাব্য লেখেন
দাবী করেন তিনিই এসময়ের শ্রেষ্ঠ তরুণ কবি
তরুণী নারী কাব্য লিখে সজ্জন তরুণকে পড়ায়
তরুণ প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন
তরুণ দাবী করেন, গভীর প্রণয়ে পড়েছেন তরুণীর
তরুণী আরো কবিতা লিখতে থাকে
একদিন তরুণীর লেখা কাব্যের প্রশংসা করেন
দূরদেশের রাজামশাই
সজ্জন তরুণ রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠেন
রাজা তরুণীকে রাজদরবারে ডাকেন
কপালে পরিয়ে দেন রাজতিলক
খোঁপায় পরিয়ে দেন কপৌ ফুলের মালা।
সজ্জন তরুণ চারদিকে বলে বেড়াতে থাকেন
‘ওই লেখা কোনোভাবেই ওর নিজের নয়
ওই লেখা বড় কেউ লিখে দিয়েছে।
মেয়ে তো, নিশ্চয় গিয়ে শুয়েছে রাজার বিছানায়।’
তরুণী নারীর হাত-পা কাঁপতে থাকে…
৪.
সজ্জন পুরুষ প্রেমে পড়েন তরুণী নারীর
নারীটি পুরুষটির কাছ থেকে গাছের একটি পাতা
উপহার পায়। আনন্দে তার সমস্ত শরীরে শিহরন জাগে।
নারী আরো বেশি আঁকড়ে ধরে পুরুষকে
একদিন রাতে তুমুল ঝড় উঠলে নারী
আশ্রয় চায় সজ্জন পুরুষের দরজায়
পুরুষটি বুক ফুলিয়ে সগর্বে ঘোষণা করেন তার পৌরুষ-
‘আমার যা করার আমি করে নিয়েছি
এবার তুমি যাও। আর ওই গাছের পাতা তোমার এ ক’দিনের রেট্।ওটা রেখে দিও নিজের কাছে।’
নারীটির চোখদুটো ধীরে ধীরে অন্ধ হতে থাকে
৫.
শুধু ব্রাহ্মণ নারী নয়, যেকোনো নারীকেই
বনের ভেতরে, বাসের ভেতরে, রাস্তায়, গোপনে, প্রকাশ্যে
ফুসলিয়ে তার উপর প্রস্রাব করে চলে যাওয়া যায়।
নারী তুলসী মঞ্চের মতো
সকলে পবিত্র বলেন অথচ
রাস্তার কুকুরও এসে ঠ্যাঙ উঁচিয়ে
তার গায়ে-গতরে সকলের সামনে
অবলীলায় মুতে দিয়ে চলে যেতে পারে…
অ-তান্ত্রিক
১.
দলবেঁধে লোকজন তখন পাথর ছুড়ছিলেন তরুণীর উপর।
মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক, গণ্যমান্য ব্যক্তি, শিক্ষাবিদ থেকে শুরু করে উঠতি ছোকরার দল।
একজন বললেন, ‘ মেয়েটি উন্মাদ, মানসিক বিকারগ্রস্ত। ’
আরকজন পাশ থেকে বলে উঠলেন, ’ এতো আস্পর্ধা মেয়ের।’
ছেলে ছোকরার দল বললো ‘ কী সাহস। কী সাহস।’
সুধাকণ্ঠী নারীবাদীরা বললেন, ‘ এ মেয়ের এমন রূপ দেখিনি তো আগে কখনো…’
তরুণী দেখছিল একটি জনপদ কীভাবে আস্তে আস্তে বন্ধ্যা ও বীর্যহীন হয়ে উঠছে
২.
সেই সময় অকস্মাৎ একজন পুরুষ এসে দাঁড়ালেন তরুণীর সম্মুখে
বললেন, ‘ভয় পেয়ো না। তোমার কাজ লেখা। চুপ করে লিখে যাও। নীরবে লিখে যাও। যে যা বলছে বলুক।
তুমি শুধু বধির হও৷ তুমি শুধু অন্ধ হও।’
তরুণী এরপর থেকে আর চোখে দেখতে পায় না
তরুণী এরপর থেকে আর কোনো শব্দ শোনে না
৩.
জীবনে প্রথম কোনো পুরুষ দেখেছে তরুণী
যে তাকে অসম্মান করলেন না
যে তাকে একবারও বললেন না, ‘তোমার দ্বারা কিস্যু হবে না।’
বরং তার সমস্ত ক্ষতে অষুধ লাগিয়ে পুরুষটি দৃপ্ত কণ্ঠে বলে উঠলেন-
‘তোমার দ্বারাই সব হবে…’
৪.
কেউ দাঁড়ায়নি তখন পাশে। সবাই তখন সংখ্যাগুরুর দলে। তরুণী একা, তায় পরিচয়হীনা…
‘এর পক্ষে থাকা সমীচীন নয় হে’।
অত:পর দলে দলে ঢিল ছোঁড়া শুরু হল
তরুণীর মাথা ফেটে রক্ত বের হয়। অজানা আতঙ্কে-ভয়ে রাতের পর রাত শিউরে শিউরে ওঠে সে।
সংখ্যাগুরুর দল, বুদ্ধিজীবীর দল উল্লাসে ফেটে পড়ে
৫.
পুরুষ এসে সম্মুখে দাঁড়ান
গোটা জনপদের বিপরীতে একা দাঁড়িয়ে পড়েন তরুণীর পক্ষ নিয়ে
যারা মেয়েটিকে ছিবড়ে-খুবলে খাচ্ছিল তাদের উদ্দেশ্য করে বলেন ‘ আমি মদ খেয়ে তোমাদের বাড়ি গিয়ে বমি করে আসবো। যে বমির দাগ তোমরা এজন্মে আর মুছতে পারবে না।’
সারাজীবন লাজুক থাকা একজন মানুষ অকস্মাৎ প্রকাশ্যে পুরুষ হয়ে ওঠেন।
৬.
সকলে যেমন নারী নন, তেমনি সকলেই পুরুষ নন।
গান গাইতে জানলেই কি আর সুর সবার গলায় ধরা দেয়?
অথচ কী আশ্চর্য এখনও কেউ কেউ নারী আছেন।
এখনও কেউ কেউ পুরুষ আছেন।
এখনও নীরবে দূর থেকে একটিও কথা খরচ না করে
একজন মানুষ নারীর সম্ভ্রম রক্ষা করে যান।
এখনও, দোর্দণ্ডপ্রতাপ কোনো কোনো লোক বাড়ি এসে নিজস্ব নারীর কোলে মাথা রেখে শিশু হয়ে ওঠেন।
এখনও, হ্যাঁ এখনও লাজুক তরুণ সবার অলক্ষ্যে অপেক্ষা করে বসে থাকে রাগী মেয়েটির জন্য।
এখনও পৃথিবী কাঁপানো যোদ্ধা ঘরে ফিরে জোকার সেজে নিজস্ব নারীর মান ভাঙাতে জানে।
এখনও গুনগুন সুরে গান গেয়ে ওঠেন কাঙ্ক্ষিত পুরুষ।
এখনও, হ্যাঁ এখনও কারো কারো গলায় সুর শোনা যায়…