সুতপা চক্রবর্তীর কবিতাগুচ্ছ
বালিকাজন্ম
১.
ধানের জমি কাদায় মাখা। ধানের জমি লাউ পাতা। সেই জমিতে লুটিয়ে পড়ি। সবুজ রঙের কেচরি তুলি। সুজু পিসি কেচরি চেনায়। হাতে পায়ে কাদা মাখায়। ধানের জমিতে ধান নাই। ন্যাড়া আছে ভাত খাই। ন্যাড়া জমি ল্যাংটা। পিঠে এক গাট্টা! সুজুপিসির পিঠে, মস্ত বড় গাট্টা। সুজু পিসি কাদা মাখায়। হাতে পায়ে জল ছিটায়। ধানের জমি স্বপ্নে আসে। চক্ষুর ভেতর আবছা ভাসে। ধানের ভেতর সুতপা কই? পথে পথে উড়াও খই। তোমরা সবাই উড়াও খই। ধানের ভেতর বালিকা হাঁটে। বুকে স্লেট, পড়া লাটে। ধানের আগায় আমি নাই। সুতপা তুমি শ্যামের রাই। আজ থেকে তুমি শ্যামের রাই। শ্যামের রাই, শ্যামের রাই। আজ থেকে সুতপা শ্যামের রাই। চিৎকারে আকাশ ফাটে। ধানের ভেতর বালিকা হাঁটে। ধানের ভিতর সুতপা হাঁটে। শ্যামসোহাগী রাই হাঁটে
২.
চলো চলো হাত ধরো।বন্দী খেলো।গোল্লা খেলো। পাঠশালায় ছুটি নাই। বালিকা তোর স্লেট খাই। চক খাই।তোর পুতুল খেলার ঘর খাই। লতাপাতা কেটে রাখি। রাতের বেলা খেলায় ঢুকি। রান্না করি, পুজো দিই। শিবের মাথায় ফুল ছুড়ি। স্লেট চক পাটিতে রাখা। মায়ের হাতের আলু মাখা। পাঠশালার শরম নাই। রোজ রোজ পড়া চাই। মেঘের ভিতর আলো চাই। রোজ রোজ পড়া চাই। জামাই বউ ঘুমিয়ে পড়ে। পুতুল দুটো হাতে ঘুরে। বালিকা তোর ঘুম খাই। ঘুমপাড়ানির গান গাই। বালিকা তোর কাপড় পড়ি। আটহাতি মায়ের শাড়ি। বুকের উপর বেলাউজ নাই। বালিকা তোর শরম নাই। লজ্জা! লজ্জা! শরম নাই। ছি ছি তোর শরম নাই! বালিকা তোর শরম নাই
৩.
ঘুমের ভেতর স্বপ্ন দেখছি। স্বপ্নের ভেতর স্বপ্ন আঁকছি। স্বপ্নের ভেতর অনেক মানুষ। হাঁটেন বসেন কথা বলেন। বালিকা তোর কেমন জন্ম! তুই বড়ই হীনমন্য।। ঘুমের ভেতর শৈশব আসে। মাছের পোনা জলে ভাসে। চেং মাছের বিশাল বাই। বালিকা তোর ঘুম নাই। ঘুমের ভেতর আসল জগত। বাকিসব ফাঁকি পথ। সেই পথে যাস না। জলের ভেতর আয়না। আয়নায় মুখ দেখ। কালো কালো অক্ষর লেখ। স্লেট চক পাঠশালা। পাহাড়ের উপর মস্ত গোলা। সেই গোলায় ধান নাই। বাংলা অক্ষর, বুকে ঘাই! বালিকা তোর পাঠশালা। শিবরাম স্কুলে তালা। বালিকা তুই ঈশ্বরী। বুকে তোর হাজার ঘুরি। স্বপ্ন আঁক, স্বপ্ন আঁক। কালাযাদু পুড়ে খাক। ছাই ছাই আকাশে ওড়ে। বালিকা তুই ভবঘুরে। ঘুমের ভেতর স্বপ্ন দেখিস। স্বপ্নের ভেতর কারে আঁকিস? স্বপ্নের ভেতর তুই কারে আঁকিস?
৪.
পায়ে জল ,পায়ে মল। পথের ধারে হাতির ঢল। জংলী হাতি পথে পাই। বালিকা আমি ইস্কুল যাই। খালি পায়ে পাথর গিঁথে। উঁচুনিচু পাহাড় হাঁটে। পাহাড়ের উপর পাঠশালা। বালিকা তুই দুধকলা। সাদা সাদা জামা পরিস। মাথার দু’দিক ঝুঁটি বাঁধিস। বালিকা তোর বালক কই? পথে পথে ওড়ায় খই? বালক তোকে আছাড় মারে। বালিকা তুই কেঁদে যারে! বালক তোকে ফেলে দেয়। গাছ থেকে ধাক্কা দেয়। বালকের সাথে আড়ি। বালিকা তুই শাড়ি। পাঠশালায় কি পরিস? শাড়ি, জামায় ছবি আঁকিস? বালিকা তোর জন্মদিন! জীবন জুড়ে শুধুই ঋণ। ঋণের বোঝা বইবি কত? হাতে পায়ে বেজায় ক্ষত! নিজের ক্ষত নিজে সারা।হোস না মেয়ে দিশেহারা! নিজের ক্ষত নিজে সারা।বালিকা তুই সবার সেরা! বালিকা তুই মাথার তাজ। কাপড়ের মাঝে জন্ম ভাঁজ। বালিকা তুই হেঁটে যা। আপদ বালাই ঘেঁটে খা। নিজের ক্ষত নিজে সারা। মেয়ে তুই সবার সেরা। বালিকা তুই স্বর্ণেপোড়া! সবার সেরা, সবার সেরা!
৫.
বনের মাঝে ডাইনি বুড়ি। আমি সেখানে মাটি খুঁড়ি। পিঠে আমার তীর ধনুক। লোকের নিন্দা লোকে শুনুক। আমি ভাই মাটি খুঁড়ি। এঁটেল মাটি সারি সারি। সেই মাটিতে হাতের কাজ। পাঠশালার পরীক্ষা আজ। খড়ের ভিতর খুন্দরী। সুপ্তা রুমি লুকোচুরি। আয় আয় সখী আয়। জলের উপর হাঁস সাঁতরায়। জলের উপর আমি উঠি। সারা বাড়ি হুটোপুটি। বালিকা তুই কোথায় গেলি? জলের দেবী খেয়ে নিলি! বালিকা তোর ভয় নাই? জলের উপর দিস ঘাই? এত্ত সাহস কোথায় রাখিস? ডাইনি বুড়ির ঘর খুঁজিস! বিরাট তোর বুকের পাটা। তুই নোস সাদামাটা! বালিকা তুই খেলতে আয়। শুঁয়োপোকা ঘর বায়। শুঁয়োপোকা বোতলে ভরি। বালিকা তুই অহংকারী। শুঁয়োপোকা প্রজাপতি। মেয়ে তুই একরত্তি। এত্ত কেন অহংকার? মাথা নোয়া বারবার। বালিকা তুই আকাশে উড়িস? এত্তো সাহস কোথায় রাখিস!
৬.
ভীমরুলের শরীর জলে ভরা। আঠা দিয়ে দেহ ঘেরা। সেই আঠা ফেলে যায়। ভীমরুল সে কী চায়? বালিকা তোর হৃদয় দিবি? ভীমরুলের প্রেমিকা হবি? তোর পাশে ভীমরুল উড়ে। ঠোঁটে চুমু দিয়ে যারে। ঠোঁট ফুলে বিষ ঢোল। বালিকা তোর সোহাগ জল। ভীমরুল প্রেমিক তোর। কথায় কথায় গায়ের জোর। কথায় কথায় হুল ফোটায়। গালে ঠোঁটে চোখে মাথায়। বালিকা তুই পারিস বটে! ভীমরুলও তোর প্রেমিক জোটে? ভীমরুলের মুখে ফুল। জঙ্গল জুড়ে হুলুস্থুল। বালিকা তোরে নিয়ে যাবে। ডানায় করে মধু খাবে। ভীমরুল তোকে ঘিরে ধরে। বালিকা তুই সরে যা রে। ভীমরুল তোর স্বপ্নে আসে। আঠা দিয়ে হাওয়ায় ভাসে। সেই আঠায় মজলি বেটী। সারা জঙ্গল কুটিপাটি। সারা জঙ্গল হেসে মরে। ভীমরুল তোর হাত ধরে। ভীমরুল তোকে করবে বিয়ে। বালিকা তুই আয় না নেয়ে। বালিকা তুই পালিয়ে যা। ফুলের মধু পেড়ে খা।