ফুরুঘ ফারখজ়াদ-এর কবিতা। ভূমিকা ও অনুবাদ- পৌলমী গুহ
বিংশশতকে ইরানের সর্বাধিক আলোচিত ও প্রভাবশালী নারী কবি ও চলচ্চিত্র নির্মাতা ফুরুঘ ফারখজ়াদএর জন্ম তেহরানের একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে ১৯৩৫ সালে। তিনি ছিলেন নারীবাদী ও প্রথাবিরোধী। রক্ষণশীল ইরানি সমাজে এমন দৃষ্টিভঙ্গি তাকে করে তুলেছিল নিঃসঙ্গ ও বিতর্কিত, যা তার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনকে প্রভাবিত করেছিল মারাত্মভাবে। ফুরুঘ ফারখজ়াদ ১৬ বছর বয়সে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন লেখক পারভেজ শাপুর এর সাথে। কিন্তু মাত্র দুই বছর বাদেই বিচ্ছেদ ঘটে তাদের এবং আইনি লড়াইয়ে পরাজিত হয়ে একমাত্র পুত্র সন্তানের অভিভাবকত্বও ছেড়ে দিতে হয় তাকে। এই বিষাদময় ঘটনার এক বছর পর ১৯৫৫ সালে প্রকাশি হয় তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘বন্দী’। জীবনের পরবর্তী অধ্যায়ে তিনি পরিচিত হন বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ইব্রাহিম গুলিস্তান-এর সাথে। মূলত তার অনুপ্রেরণা এবং সহযোগিতাতেই ফোরুখ প্রবেশ করেন চলচ্চিত্র জগতে। ১৯৬২ সালে তার নির্মিত ডুকুমেন্টারি ফিল্ম ‘দ্য হাউজ ইজ ব্ল্যাক’ অর্জন করে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র পুরস্কার। ১৯৬৫ সালে ইউনেস্কো তার অনবদ্য জীবন ও সাহসী কর্মের স্বীকৃতি সরূপ নির্মাণ করে ১৫ মিনিটের একটি ডকুমেন্টারি। তাছাড়া তার উপর নির্মিত হয়েছে আরো বেশ কয়েকটি ডুকুমেন্টারি ফিল্ম। ফুরুঘ ফারখজ়াদ মৃত্যু হয় ১৯৬৭ সালে একটি সড়ক দুর্ঘটনায়। তার এই স্বল্পদৈর্ঘ্য জীবনে তিনি রচনা করেছিলেন বেশ কয়েকটি আলোচিত ও সমালোচিত কাব্যগ্রন্থ যেগুলোর মধ্যে বন্দী (১৯৫৫), দেয়াল (১৯৫৬), বিদ্রোহ (১৯৫৭), আরেক জন্ম (১৯৫৯, মৃত্যুর পর প্রকাশিত) এবং পাপ উল্লেখযোগ্য।
গুটিয়ে যাওয়া পুতুল
আরও বেশি, হ্যাঁ,
কেউ একজন আরেকটু বেশি চুপ থাকতে পারে।
এই শাশ্বত বেঁচে থাকায়
একজন প্রাণহীন চোখে চেয়ে থাকে
সিগারেটের ধোঁয়ার দিকে,
কাপের দিকে,
কার্পেটের মিলিয়ে আসা ফুলের দিকে,
বা দেওয়ালের কাল্পনিক আঁকিবুকিতে।
শক্ত হাতে একজন টান মেরে
পর্দাগুলো সরাতে পারে, বাইরে তাকাতে।
যখন বৃষ্টি পড়ছে।
বেলুনের গোছা নিয়ে একটি বাচ্চা
ছাউনির তলায় গুটিসুটি। একটা ক্ষয়া
গাড়ি তাড়াতাড়ি
শুনশান চত্বরটুকু পেরিয়ে যাচ্ছে।
একজন একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারে,
এখানে
পর্দার পাশেই…কিন্তু বধির, কিন্তু অন্ধ।
অচেনা এক গলায়, পুরোপুরি মিথ্যে নিয়ে,
কেউ চেঁচিয়ে উঠতে পারে: আমি ভালোবাসি!
পুরুষের জালিম বাহুডোরের মধ্যেও একজন
হয়ে উঠতে পারে বলিষ্ঠ, সুন্দর রমণী-
ত্বক যার চামড়ার টেবিলঢাকার মতো,
শক্ত ও উন্নত দু’খানি স্তন।
একজন পবিত্রতম ভালোবাসার দাগ ফেলতেই পারে
মাতাল, উন্মাদ কোনও ভবঘুরের বিছানায়।
একজন অনায়াসে তুচ্ছ করতে পারে
প্রতিটা বিভ্রান্তিকর ধাঁধাকে।
একা ব্যস্ত থাকতে পারে ক্রসওয়ার্ডের
জটিল জালে,
গুরুত্বহীন শব্দ নিয়ে আনন্দিত,
হ্যাঁ, গুরুত্বহীন সব অক্ষর, পাঁচ-ছ’খানা।
কেউ একজন গোটা জীবন নতজানু হয়ে
মাথা ঝুঁকিয়ে কাটাতেই পারে,
ইমামের ঠান্ডা দরবারের বেদির সামনে
ঈশ্বরকে খুঁজে পেতে পারে নামহীন কোনও কবরে,
বিশ্বাস করতেই পারে ক’টা অকিঞ্চিৎ পয়সাতে।
মসজিদের কামরায় একজন পচতে পারে,
এক বৃদ্ধা হয়ে, যার ঠোঁট থেকে প্রার্থনা গড়াচ্ছে।
হিসেব যাইই হোক, একজন সবসময়
শূন্যই থাকতে পারে।
কোনও ফল ছাড়াই, যোগ হোক,
অথবা বিয়োগ, অথবা গুণও যদি হয়।
কেউ ভাবতে পারে তোমার চোখদু’টো আসলে বোতাম
একটা ছেঁড়া জুতো থেকে নেওয়া
তাতে রাগের ঝুলকালি লেগে আছে।
নিজেরই তৈরি নর্দমা থেকে
কেউ একজন বাতাসে মিলিয়ে যেতেই পারে।
লজ্জায় কেউ একজন একটা সুন্দর মুহূর্তকে
গোপন করতে পারে,
যেভাবে একটা কালো হয়ে আসা মজাদার ফটো
কাঠের বাক্সের গভীরে ছুঁড়ে ফেলি।
একটা দিনের খাঁ খাঁ শূন্যতার ভেতরে
কেউ একজন চড়াতে পারে
নিজের পরাজিত, নিন্দিত, ক্রুশবিদ্ধ ছবিখানাকে।
দেওয়ালের ফাঁকগুলো ভরাট করতে পারে
অর্থহীন, বোকা বোকা সব আঁকা দিয়ে।
একটা গুটিয়ে যাওয়া পুতুলের মতো
কেউ একজন কাচের চোখ দিয়ে দুনিয়া দেখতে পারে,
একটা বন্ধ বাক্সে বছরের পর বছর কাটাতে পারে,
খড়ে-ঠাসা শরীর নিয়ে,
সূক্ষ্ম লেসের আবরণের তলায়।
আর প্রতিটা কামুক হাতের চাপে,
কোনও কারণ ছাড়াই একজন চিৎকার করে উঠতে পারে:
আহ্, আমি আশীর্বাদধন্য, কী সুখী আমি!
স্নান
আমার জামাকাপড় মাতাল হাওয়ায় উড়িয়ে দিলাম
এই ঝর্নার জলে আবরণহীন স্নান করব বলে,
কিন্তু এই নিস্তব্ধ রাত আমাকে বশ করে নিল
আমার দুঃখগাথা বলিয়ে নেওয়ার জন্য।
জলের চকচকে ঠান্ডা ঢেউগুলো
আমাকে লোভাতুর গোঙানি নিয়ে ঘিরে ধরল,
তাদের নরম স্বচ্ছ হাতে জাগিয়ে দিল
আমার শরীর ও স্বত্ত্বাকে মিশিয়ে নিল।
একটা দূরাগত বাতাস ছুটে এসে
আমার চুলে এক কোটরভর্তি ফুল ছড়িয়ে দিল,
আমার মুখে পুরে দিল ইউরেসিয়ান মিন্টের
তীব্র, হৃদয়-স্পর্শী গন্ধ।
নিঃশব্দ এবং শূন্যে বিচরণকারী আমার চোখ বন্ধ হল,
আমার শরীর তরুণ নলখাগড়ার ঝোপে চেপে ধরলাম,
এবং প্রিয়তম’র বাহুতে ঢলে পড়া যুবতীর মতো
নিজেকে জলে বিলিয়ে দিলাম।
উত্তেজিত, তৃষ্ণার্ত এবং জ্বরে থরথর জলের ঠোঁট
কাঁপা কাঁপা চুম্বন এঁকে দিল আমার জঙ্ঘায়,
এবং আমরা হঠাৎই নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে তৃপ্তির সঙ্গে
মূর্ছিত হয়ে পড়লাম,
উভয়েই পাপী, আমার শরীর এবং ঝর্নার আত্মা।
উপহার
রাতের সীমা থেকে আমি কথা বলি
আমি কথা বলি অন্ধকারের সীমা থেকে
এবং রাতের সীমারেখা থেকে
হে দয়ার্দ্র, যদি তুমি আমার ঘরে আসো, একটি প্রদীপ এনো
একটু ছোট্ট ফাঁক রেখে দিও যাতে
আমি উৎফুল্ল রাস্তার ভিড়ের দিকে চেয়ে থাকতে পারি।
বাতাস আমাদের নিয়ে যাবে
হায় রে, আমার ছোট্ট রাত
বাতাসের সাথে আজ গাছের পাতার অভিসার আছে
আমার ছোট্ট রাতটিতে, ধ্বংসের ভয় ঢুকে আছে
শোনো
শুনতে পাচ্ছ অন্ধকারের হাহাকার?
বিচ্ছিন্ন হয়ে, আমি এ আনন্দ দেখি
আমি নিজের হাহুতাশে নেশাতুর
শোনো
শুনতে পাচ্ছ অন্ধকারের হাহুতাশ?
এই রাতে, কিছু একটা ঘটছে
চিন্তাণ্বিত চাঁদ হয়ে উঠেছে রক্তিম
সে ভয় পাচ্ছে যে কোনও মুহূর্তে এই ছাতের ওপর সে ভেঙে পড়বে
শোকার্ত মেঘের দল ঘুরছে
বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ার প্রতীক্ষায়
একটি মূহূর্ত
তারপর কিছু নয়
এই জানালার বাইরে রাত কেঁপে উঠছে
এবং পৃথিবী
বাধ্য নিরন্তর ঘোরার জন্য
এই জানালা ছাড়িয়ে অজ্ঞাত কেউ
আমাদের দেখে চলেছে
আর তুমি, মাথা থেকে পা অবধি সবুজ
তোমার জ্বলন্ত স্মৃতির মতো হাতখানা আমার প্রেমে আহত হাতে রাখো
এবং তোমার ঠোঁটখানা রাখো, উষ্ণ অস্তিত্বের মতো
আমার প্রেমবিজড়িত ঠোঁটে বুলিয়ে দাও
বাতাস আমাদের নিয়ে যাবেই
বাতাস আমাদের নিয়ে যাবে।
অনুবাদক-পৌলমী গুহ
ভালো লাগলো পৌলমী