সময়ের কাছে এসে সাক্ষ্য দিয়ে… <br /> সন্দীপন চক্রবর্তী

সময়ের কাছে এসে সাক্ষ্য দিয়ে…
সন্দীপন চক্রবর্তী

তেমন করে শুরু নেই, তেমন কোনো শেষও নেই। শুধু একটা অন্ধকার জেলির কলসি। তার মধ্যে হাঁটু মুড়ে, কুঁকড়ে মুকড়ে, শুয়ে আছি ন্যাড়ামাথা আমি। বা পতঙ্গের অপেক্ষায় মেলে দেওয়া, ব্যাঙের জিভের মতো, একটা ইস্পাতের প্ল্যাটফর্ম। সেখানে শুয়ে আছি। দুচোখে তুলসীপাতা; সারা শরীরে ঘি। খানিকক্ষণ পরেই আমায় সাঁৎ করে টেনে নেবে হা হা চুল্লী।
না, আমার স্মৃতির মধ্যে এ দুটোর একটাও নেই। তাহলে? হঠাৎ এ দুটো ছবি উড়ে আসলো কোত্থেকে? কল্পনা? কল্পনা বললেই মনে পড়ে কল্পনা চাওলা। কল্পনাকে একবার মহাশূন্যে নিয়ে গেলে তাকে এই খুচরোর পৃথিবীতে আর ফিরিয়ে আনা যায় না। আমাদের ধিঙ্গি ধিঙ্গি মিডিয়াগুলো সে কথা জানতো না। নাসা-র সাহেবরাও নাসাপথে ‘ইয়া ইয়া’ করতে করতে আর স্যান্ডুইচ চিবুতে চিবুতে, সে কথা ভুলেই গিয়েছিলো। কিন্তু ভোলে নি কালুদা– আমাদের পাড়ার ছেলে, বেকার ছেলে। অন্যের ঘাড় ভেঙে সিগারেট খেতো, মাঝেমধ্যে মদ; আর ভাবতো। আচ্ছা, ঐ যে ঋত্বিক ঘটক ‘যুক্তি তক্কো গপ্পো’-তে উৎপল দত্তকে বলেছিলো—‘ভাবো, ভাবো, ভাবা প্র্যাকটিস করো’, সেটা কি চাবুকমার্কা শ্লেষ, না কি সিরিয়াসলি ভাবার জন্যই…? আসলে, এমন অনেক প্রশ্ন থাকে, যেগুলোর কোনো উত্তর হয় না। অথবা হয়, কিন্তু সেটা একেকজনের কাছে একেকরকম। আর তাই নিয়েই যত বাওয়াল, যত কোঁদল। তুমি কোন দলে?
এই নামে শঙ্খ ঘোষের একটা কবিতা আছে না? আজকাল আর কবিতা পড়তেও ভাল্লাগে না। শুধুই হোঁৎকা হোঁৎকা ভারী ভারী প্রবন্ধ। সেগুলো না যায় গেলা, না যায় ফেলা। পড়লেই হেঁচকি ওঠে, মাথার চুল খাড়া হয়ে যায়। আঃ কী রগড়!! রগড়াতে রগড়াতে সে এক্কেবারে বোর্হেসের গোলকধাঁধায় ঢুকিয়ে দেয় আমাকে। আর আপনমনে বিড়বিড় করি ‘এই যে এত ঋত্বিক শঙ্খ বোর্হেস মারাচ্ছো, এর মধ্যে সত্যি সত্যি ক’আনা জানো আর ক’আনা রোয়াব?’ রোয়াবের সাথে খুব সহজ মিল খোয়াব। ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’ পড়েছ? আবার নেম ড্রপিং! বদহজম হলে এই-ই হয়!! সেদিন ছোড়দা বলছিলো– প্রায় ২০-২৫ দিন হয়ে গেল, আর সকাল বিকেল অ্যান্টাসিড খেতে হচ্ছে না। প্রাণায়াম করে নাকি হেবি উপকার পাচ্ছে। ‘আস্থা’ চ্যানেলে রোজ এসব শেখায়। এসব করেই আজকাল আস্থাভাজন হতে হয়!
আস্থার সাথে কী মিল দেওয়া যায়? আজ থাক? মোটামুটি। তাহলে? মাস্তান? নাঃ। হঠাৎ মিল দিতেই বা যাবো কেন? না পারলে তো এইরকমই বলে লোকে! ঠিক এইখান থেকে, একটা বিষাদ শুরু হয়ে, ধীরে ধীরে বিষাক্ত গ্যাসের মতো আমায় গিলে ফ্যালে। আর বিছানায় আধশোয়া হয়ে, আমি ভাবি, একটা থ্রিলার লেখার কথা ভাবি, যে গল্পের কোনো সিনেমা হয় না, সিরিয়াল হয় না, এমনকি নাটকও হয় না। কী নাম দেওয়া যায় গল্পটার…কী নাম…আচ্ছা…‘মাতাহারি’? ধুর, লোকে শাকাহারী মিতাহারী এসব শুনেছে, তা বলে ‘মাতাহারি’? পাবলিক খাবে না। লেখার আগেই পাবলিক কী খাবে…? ওফ্… যে যা পারে খাক, যে যা পারে ভাবুক; তোমার তাতে কী? ঠিক। ঠিকই। কিন্তু, এইখান থেকে, একটা সাহসের অভাব শুরু হয়ে, মেরুদণ্ডহীন সাপের মতো, ঢুকে পড়ে সেই বিষাদের মধ্যে। আর, যে সাপের বিষ নাই, কাউকে যে কাটে না, সেরকম কয়েকটা সাপ নিয়ে আমি বাবুরাম সাপুড়ের খেলা দেখানোর চেষ্টা করি। আপ্রাণ চেষ্টা করি। কিন্তু কেউটের ছোবল ছাড়া, কিছুতেই খেলা জমে না। নুন ছাড়া তরকারির মতো লাগে।
কতরকম খেলা! বাইরে দাঁড়িয়ে থাকলে, তোমায় সে চুম্বকের মতো টানবে। আর একবার যদি নামো, খেলায় নামো, তখন মেনে চলতে হবে রুল্স্ অফ দ্য গেম, মানতেই হবে, নাহলে কোনোদিন জিততে পারবে না। দেখাতে হবে নিপুণ ঘোমটার তলায় হুল্লাট খ্যামটা। দেখাতে দেখাতে এতটাই সয়ে যাবে, এরপর টেরও পাবে না যে তুমি নাচছো, কিন্তু নাচবে, সুতোর টানে টানে। ক্ষমতা ব্রহ্মের মতো, তাকে চোখে দেখা যায় না, কিন্তু সে সর্বঘটে আছে। রুল্স্-জেতা-পাওয়ার-ফুকো এসব তোমার মাথায় গেঁড়ে বসেছে। লাঁকা-ফুকো-দেরিদার এসব আঁতাত থেকে বেরিয়ে এসো। নিজের মতো ভাবতে শেখো, নিজের মতো। সাহেব বলেছে বলেই কি এসব ফালতু? না। সাহেব বলেছে বলেই কি এসব আউড়ে যেতে হবে? না। সাহেব ভেবেছে বলেই কি তবে এভাবে ভাবা বারণ? না। তাহলে? শূন্যের মধ্যে নিজেকে ছুঁড়ে দাও। আর ডুবে যেতে যেতে বাঁচার চেষ্টা করো, নিজেই তৈরি করে নাও নিজের নিয়ম। এখানে কোনো গাইড নেই, শিক্ষক নেই। তুমি ছাত্র, তুমিই শিক্ষক।
বইয়ের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে, এসবই ভাবছিলো কালুদা। পাশের বাড়ি থেকে ভেসে আসছে শ্রীকান্ত আচার্য—রিমেক—‘বঁধুয়া আমার চোখে জল এনেছে হায় বিনা কারণে’। একইসাথে ভেসে আসছিলো রাজার বাবার গলা ‘শুনেছো এসব? এই হচ্ছে আসল গান। কী যে সব জীবনমুখী আর ব্যান্ড শোনো! হুঃ…আরে বাবা, মানছি এর কথা খানিকটা কাঁচা। কিন্তু সুর? গানে তো সুরটাই আসল, কথাটা সেকেন্ডারি। কথাটা মেইন হলে তো কবিতা হয়ে যাবে, গান না। আর সেটাও যদি হতো! ঐ সুমনের কয়েকটা গান ছাড়া, আর বাকিরা যা সব গায়…হুঃ…’। রাজা বাধা দিয়ে বলে, ‘আচ্ছা আচ্ছা…অনেক হয়েছে…এবার তুমি যাও তো…আমাদের একটু গল্প করতে দাও’।

— আচ্ছা কালুদা, সেদিন আড্ডায় তুমি আমাদের ফরে কিছু বল্লে না কেন?
— কবে?
— আরে ঐ যে, পরশু, রূপমরা বলছিলো না যে, খেলতে নেমে প্রতিষ্ঠানকে মানতেই হবে, নাহলে…
— হ্যাঁ। তো?
— ‘তো’ মানে? তুমিই তো শিখিয়েছিলে, প্রতিষ্ঠানের হেজিমনির বিরুদ্ধে সবার সাথে জোট বেঁধে একটা…
— সেটা তখন ভাবতাম। কিন্তু এখন ভাবি না।
— মানে?
— সিম্পল্…নিজের মতটা হঠাৎ আমি অন্যের ঘাড়ে চাপাবো কেন? তার ব্রেনওয়াশ করে তাকে নিজের লাইনে টানার ধান্দা কেন করবো? তার চেয়ে, যে যেমন চায়, থাকুক না…
— তুমি…মানে…এ তো রিঅ্যাকশনারি…তুমি…
— হ্যাঁ, আমি। প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে চেঁচালে, চেঁচিয়ে পাঁচটা লোককে জড়ো করলে, সেটাও কি একটা উল্টে ধরা প্রতিষ্ঠানই গড়ে তোলে না?

একটু প্যাঁচে পড়ে গিয়ে রাজা হঠাৎ ‘দাঁড়াও মা’কে এট্টু চা করতে বলি। মা…ও মা…এট্টু চা হবে?’
মশার ভয়ে, সন্ধে থেকেই সব দরজা জানলা বন্ধ। দমবন্ধ লাগে। পূর্বদিকের জানলাটা তাই একটু খুলে দিলো রাজা। গ্রীলের ফাঁক দিয়ে এক চিলতে আকাশ। অন্ধকারের নাকে অজস্র হিরের নথ। বর্ষার মেঘ ছাড়া রাতের আকাশ চিরকুমারী। তার নথ কেউ ভাঙতে পারে না।
চায়ে শেষ চুমুকটা মেরেই, কালুদা কাজের অজুহাত দেখিয়ে উঠে এসেছিলো। আসলে, কথা বলতে– বিশেষত ওসব গম্ভীর গম্ভীর তাত্ত্বিক কথা বলতে, তর্কের জন্যই তর্ক করে যেতে– একদম ভাল্লাগছে না। মাথার মধ্যে এলোমেলো চিন্তাগুলোর সাথে সময় কাটানো বরং অনেক ভালো। ভাঁড়ের মধ্যে জমানো একেকটা পয়সার মতো, একেকটা মুহূর্ত। মনে পড়ে, সন্ধ্যায় আকাশভরা তারা চেনাতো মা। মা’কে একবার জিগ্যেস করেছিলো—‘মা, ওরা তো সবাই মুনি। তবে ওরা তারা হয়ে গেল কী করে?’ সপ্তর্ষিমণ্ডলের দিকে আঙুল তুলে মা বলেছিলো, ‘সেটা তো ওরা নিজেরাও জানে না। ওদের কাছেও এটা প্রশ্ন। আর তাই সাতজনে মিলে আকাশে ওরকম একটা প্রশ্নচিহ্ন বানিয়েছে।’ বলার সাথে সাথেই যেন সাতখানি ঘুম আমাকে ধরলো ঘিরে; আর তখনই চুল বাঁধা ফিতেটা দাঁতে চেপে মেজদি ছাদের আকাশের দিকে চেয়ে দেখে কী—ওমা! ওরা সবাই এসে গেছেন পড়ন্ত আলোর দেবতা, কমলে কামিনী, রাত্রির কিন্নর, বরাহ অবতার, অশ্বিনীকুমার দুজন, তাঁদেরও আড়ালে মারাঙবুরু পাহাড়ে সিঁদুরমাখা পাথরখণ্ড, শিরীষ গাছের ঝুলন্ত নরদেহ, গায়ে আগুনলাগা অসুরপত্নী– আর এই দেখতে দেখতেই কলকাতার ওপর ধীরে ধীরে সন্ধ্যা আরও ঘন হয়ে আসে।
এও তো উৎপল বসুর কবিতা!! কিন্তু এভাবেই বোধহয় সৃষ্টিরহস্যের অলিগলি চিনতে শিখেছিলাম আমরা। শোনার মুহূর্তেই যাকে মিথ্যে বলে মনে হয়, আসলে সে মিথ্যে নয়, সে শুধু এক শুঁড়িপথ, যেখানে হামাগুড়ি দিতে দিতে সত্যির দিকে দু’এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া যায়। তাছাড়া ওভাবে, সত্যি এবং মিথ্যেকে কি আর আলাদা করে আইডেন্টিফাই করা যায়– ভাবছিলো কালুদা– এই যে এখন, যে স্পেসটাইম কো-অর্ডিনেটে আমি আছি, এটাকে যদি অসীম করে নিয়ে ভাবি, তাহলে? আমি তো ভাবতেই পারি যে, বহমান এই বিরাট সময়ের মধ্যে, এই বিশাল ব্রহ্মাণ্ডের তুলনায় আমি কী তুচ্ছ, কী ক্ষুদ্র!! আমি না থাকলেই বা এর কী এসে যেত!! কিচ্ছু না। এরা নিজের মতো, যেমন চলছে তেমনই চলতো। শুধু আমি থাকতাম না। আমি তাহলে এদের কেউ না? আমি শুধু আমারই? এই তাহলে সত্যি? তাহলে বিচ্ছিন্নতা বা স্বার্থপরতাই আমার পথ?
কিন্তু, যদি ভাবি, যতই ছোট যতই তুচ্ছ হই না কেন, আমি তো এই বিশালতারই একটা অংশ, যে বিশালত্বের প্রতি বিন্দুই বিকল্পহীন, এক ও অদ্বিতীয়…তাহলে? তবে কি আমার এই জায়গাটা আমি ছাড়া আর কাউকে দিয়েই ভরাট হতো না? তৈরি হতো এক অনিবার্য শূন্যতা? কিন্তু এই বিশালত্ব তো শূন্যেরও বিরোধী!! তবে কি…আমি না থাকলে…সেই শূন্যতাটুকুর ভারেই ধ্বসে পড়তো গোটা সৃষ্টি? তাহলে এই বিশালতার থাকা না থাকাও আমার থাকা না থাকার সাথে জড়িয়ে? তাহলে তো আমি ক্ষুদ্র না, তুচ্ছ না!! আমার এই থাকা তো তবে ছড়িয়ে আছে এই বিশালতার প্রতি অণু-পরমাণুতে। এভাবে ভাবলে সত্যিটা কী দাঁড়ায়? একইসাথে দুটো উল্টো সত্যি? সে কী করে হয়? সত্যির উল্টো তো মিথ্যে।। তাহলে কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যে? সত্যির খোঁজে, আসলে, আমরা এক শাশ্বত পেঁয়াজের সামনে এসে দাঁড়াই, একের পর এক খোসা ছাড়াতে থাকি, কিন্তু তারপর? হঠাৎ এসব উটকো চিন্তাই বা করবো কেন? আমার কী দায় পড়েছে?
কালুদার পিছন পিছন একটা নেড়ি কুকুর আসছিলো। হঠাৎ কালুদার মনে হলো– আচ্ছা, যদি এই কুকুরটাই হয় স্বয়ং ধর্ম! তাহলে কি আমি যুধিষ্ঠির? এই অন্ধকার রাজপথ কি তবে স্বর্গের সিঁড়ি? নাঃ, আজকাল এত উদ্ভট সব চিন্তা মাথার মধ্যে ঘোরে!! এরপর তো লোকে পাগল বলে ঢিল ছুঁড়বে, কুকুর লেলিয়ে দেবে, হয়তো এই কুকুরটাকেই!!
যাক গে, এভাবেই তো উনত্রিশটা বছর পেরিয়ে গেল। কত লোকে এর মধ্যে কতভাবে গুছিয়ে নিলো। কিন্তু কালুদা কিছুই করে উঠতে পারলো না। সেই যে মাধ্যমিক দেওয়ার আগে, আগেই তো, হঠাৎ করে কালুদার মাথা ঘুরিয়ে দিলো একজন কবি, সেই থেকেই ডুবে যাওয়ার শুরু, ডুবে যেতে যেতে যেতে…। ডুবে যেতে নাকি উড়ে যেতে? একেকজন একেকরকম বলে। যাই হোক, এরপর থেকে কালুদার স্কুলের বন্ধুরা, ইউনিভার্সিটির বন্ধুরা, এমনকি লেখালিখির বন্ধুরাও সব তরতরিয়ে উঠে গেল নানা সিঁড়ি বেয়ে। কিছু কিছু সিঁড়ি কালুদাও চিনতো। এমনকি মাঝে মাঝে ভীষণ লোভও হতো। কিন্তু মজ্জার ভিতর ফালতু একটা অহংকার, কিছুতেই চৌকাঠটা পেরিয়ে ওকে সিঁড়িতে যেতে দিতো না। প্রত্যেকবার হোঁচট খেয়ে পড়তো চৌকাঠে।
তাই একটা আগ্নেয়গিরির চূড়ায় বসে বাঁশি বাজানোর চাকরি নিলো কালুদা। পাড়াপড়শী, আত্মীয়স্বজন, সবাই কত বাধা দিলো, পইপই করে বারণ করলো! কিন্তু কে কার কথা শোনে!! কালুদা সেসব কিছু পাত্তা দিলো না। আর ওভাবে বাঁশি বাজাতে বাজাতেই একদিন পাগল হয়ে গেল সে। বদ্ধ পাগল। পাগল হবার ঠিক আগের মুহূর্তে কী ভেবেছিলো সে? ভেবেছিলো– এর চেয়ে মৃত্যুও অনেক ভালো। কিন্তু বাঁশির নেশা ভয়ংকর। একবার ধরলে, তাকে ছেড়ে আর লোকালয়ে ফেরা যায় না। ভেবেছিলো– এভাবে বসে থাকতে থাকতেই হয়তো একদিন এই আগ্নেয়গিরির পেট থেকে ঘুরতে ঘুরতে বেরিয়ে আসবে তালগোল পাকানো আগুনের পিণ্ড; আর ছাই করে দেবে তাকে। অথচ কয়েক বছর পর জানা গেল, ওটা একটা মৃত আগ্নেয়গিরি। এবার? বাঁশিটা কালুদা ছুঁড়ে ফেলে দিলো আগ্নেয়গিরির গহ্বরে। কিন্তু আগ্নেয়গিরির ভিতর থেকে, আচমকা একটা ভূত উঠে এসে, বাঁশিটা কালুদার হাতে ধরিয়ে দিয়েই, আবার হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। অগত্যা, ফের বাঁশি বাজাতে থাকলো কালুদা।
আচ্ছা, এটাকে কি ইতিহাস বলা যায়, নাকি ভাঁওতা? এই প্রশ্নটারও কোনো উত্তর পাচ্ছে না কালুদা। শীত মরে মরে আসছে। দিনে এখন বেশ গরম, রাতের দিকে ঠিকঠাক। হাওয়ায় হাওয়ায় ইউক্যালিপটাসের হালকা গন্ধ। কালুদা ভাবছিলো– এর মধ্যে কত কী ঘটে গেল! গোধরা থেকে ইরাক উপচে গেল রক্তে, ভেঙে গেল বামিয়ানের বুদ্ধ, কলকাতাকে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ময়াল সাপের মতো উঠে গেল সারি সারি ফ্লাইওভার, দিল্লীর গদি ডিগবাজী খেয়ে বিজেপি থেকে চলে এলো কংগ্রেসের হাতে, ঘন্টাখানেকের সুনামিতে মরে গেল আড়াই লাখ, আরও কত কী!! কিন্তু বাঁশি ছেড়ে, আগ্নেয়গিরির থেকে আর নামতে পারলো না কালুদা। তার চূড়ায় বসেই দেখতে পেলো, পৃথিবীটা আস্তে আস্তে গুটিয়ে, একটা ইতরদের গ্রাম হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটা হিংস্র শান্তি। সেখানে কেউ কোথাও নেই, কিন্তু সকলেই সর্বত্র আছে। সেখানে মনের সুখে চলছে খেউড় আর খ্যামটা। এর বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলতে গেলেই, সোনা দিয়ে সিল করে দিচ্ছে তার মুখ। তবুও যারা বলছে, তাদের উপর গলা চড়িয়ে, খোল কর্তাল নিয়ে, টিকি দুলিয়ে, দাড়ি নাচিয়ে, একদল পণ্ডিত গিটকিরি দেয়া কীর্তন গাইতে গাইতে নেমে পড়ছে পথে। সত্যি, কত কীই না হয়ে গেল!!
বাড়িতে কলিংবেল বাজাতেই কাজের লোকটা দরজা খুলে দিলো। ‘কী রে, বাবা মা বাড়িতে নেই?’ কালুদার কথার উত্তরে মেয়েটা জানায়—‘না গো, পাশের পাশে ঐ বাড়িটার মাসীমা সন্ধ্যে থেকে একা একা বসে থাকে তো! তাই মাসী আর মেসো ওখেনে গেছে। এট্টু পরেই এসে পড়বে। তোমায় চা করে দেবো?’ ‘নাঃ, থাক।’ জিভটা পুরো তেতো হয়ে আছে। যাক গে, বাবা মা তো আর এক্ষুনি ফিরছে না। এই ফাঁকে বরং একটা সিগারেট ধরাই। সিগারেট ধরিয়ে, চেয়ারটা টেনে নিয়ে, কালুদা টিভি চালিয়ে দেয়। কিছুই দ্যাখে না, শুধু একের পর এক চ্যানেল সার্ফ করে যেতে থাকে। কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়– ঝাঁ চকচকে, স্মার্ট– গলে যাওয়া সাবানের মতো তারা ঢুকে পড়ে চোখের তারায়। চোখ জ্বালা করে। গোটা শহরটাই বিজ্ঞাপনের বিরতির মতো লাগে। এরা বাইপাসের ধারের জলা বা ধাপার মাঠটাকেও ছাড়ে নি। গোবদা গোবদা সব বিলবোর্ড ফিট করে দিয়েছে; যাতে যেতে যেতেও তুমি টের পাও– এইসব খোলা মাঠ, এই ক্ষেত, এই জলা, এগুলোও সব কলকাতাই। অথচ দ্যাখো, তবুও পার্কস্ট্রিট সেই কেতাবাজ আর বাগবাজার সেই রংচটা থেকে যায়। এ এক্কেবারে দারুণ ছক। সেই যে আমাদের দেশ নিয়ে, ছেলেবেলা থেকেই গ্যাদগেদিয়ে মুখস্থ করেছি ‘ইউনিটি ইন ডাইভার্সিটি’, পুরো সেই ছক। পুরো খাপে খাপ পল্টুর বাপ!! আগেকার দিন হলে, বিধবা ঠাকুমার মতো বলতাম, ‘পোড়ামুখো, তোর মরণ হয় না? মুখে নুড়ো জ্বেলে দিই। থেঁৎলে দিই। থু…থু…থু…’
নাঃ, কিছুই আর ভাল্লাগছে না। টিভিটা বন্ধ করে কালুদা উঠে আসে। মনে হয়, কাগজ কলম নিয়ে চুপচাপ বসে থাকা প্রয়োজন আজ। কিন্তু চুপচাপ বসবে কোত্থেকে? গাঁক গাঁক করে টেলিফোন বেজে ওঠে। বড়পিসী।

— কী রে, তর বাবায় বাড়ি নাই?
— না, বাবা আর মা একটু বেরিয়েছে।
— অ, তা তুই একা একা কী করস?
— আমি এই এট্টু টিভি দেখছিলাম। তোমার শরীর কেমন আছে?
— ঐ আছি আর কী!! মাজায় ব্যাদনা…। তর বাবায় কখন আইবো?
— সে তো জানি না। তবে মনে হয়, দেড় দু’ঘন্টা পর ফোন করলে পাবে। কেন? কিছু বলতে হবে?
— না, বহুদিন দ্যাখা নাই…এট্টু কথা কইতাম আর কী…
— ঠিকাছে, বাবা ফিরলে আমি ফোন করতে বলবো। রাখি তাহলে?
— আচ্ছা

রিসিভারটা নামিয়ে রাখতে রাখতে, কালুদা ভাবে তাও ভাগ্যিস মোবাইল নেই। সময় নেই, অসময় নেই, এই যে রাস্তাঘাটে যখন তখন, হাঁসছানার মতো প্যাঁকপ্যাঁক করে বেজে ওঠে, এ একেবারে অসহ্য!! যেন একলা থাকার কোনো সময় নেই, থাকতে নেই, নিজের মুখোমুখি নিজের দাঁড়াতে নেই, তাহলেই সর্বনাশ। নাকি, কুঁড়ের বাদশারা বোধহয় এরকমই ভাবে! কালুদা নিঃসন্দেহে কুঁড়ের বাদশা, কিন্তু ওর চিন্তাগুলো ইলেকট্রনের মতো, নির্দিষ্ট রাস্তায় চলে না, ঝপাং ঝপাং করে এক অরবিট থেকে খালি আরেক অরবিটে লাফ মারে। ওর জীবনটাও সেরকম। জীবনে কোনোকিছুই ঠিকঠাকভাবে তাই করা হয়ে উঠলো না।
নিজের ঘরে ঢুকে কালুদা আধশোয়া হয়ে বসলো। সামনে সাদা কাগজ আর ডটপেন। নাঃ, এভাবে কবিতা হবে না। কিন্তু একটা কিছু লিখতে হবে। লিখতেই হবে। যা খুশী। নিজেকে অন্তত রিলিজ করা দরকার। কী আছে নিজের ভিতর? অন্ধকার? নাঃ। কোনো শব্দ না, আলো না, অন্ধকার না, কিচ্ছু না। উপনিষদের সেই যে শ্লোকটা…আচ্ছা, ওটার বাংলা অনুবাদ কী হবে? হয়তো–

বলুন যাজ্ঞবল্ক্য,
যখন চন্দ্র সূর্য নিভে গেছে
আগুন নির্বাপিত
এমনকি সব কথাও যখন স্তব্ধ,
তখন কোন সে জ্যোতি
যা নিয়ে মানুষ বাঁচে?

ধুস্, উপনিষদের অনুবাদ তো যে কেউ করতে পারে। কিন্তু নিজেকে? নিজেকে অনুবাদ করবো কীভাবে? কোন ফর্মটা প্রপার হবে? গল্প? ওরেবাবা, সে তো কখনোই লিখিনি!! তাতে কী? সবকিছুই তো একদিন না একদিন শুরু করতে হয়। কিন্তু প্লট? গল্পের প্লট? সেও তো কিছু মাথায় আসছে না!! আর তাছাড়া, সেই যে ইস্কুলে পড়েছিলো, ছোটগল্পের শেষে ‘শেষ হয়ে হইল না শেষ’-এর এফেক্ট আনতে হয়। তারপর, কীসব, বিন্দুতে সিন্ধুদর্শনের মতো ব্যাপারস্যাপার। সেসব কী হবে? তার চে’ বাবা, ওসব গল্প কবিতা প্রবন্ধ কিচ্ছুটির মধ্যে যাওয়ার দরকার নেই; এমনি এমনি একটা লেখা শুরু করলে হয় না? কিন্তু কীভাবে? শুরুটা হবে কীভাবে? আর শেষ? সেটাই বা কীভাবে? মাঝখানটা ভরাবো কী দিয়ে? মাথায় তো কিছুই আসছে না। পুরো ফাঁকা। শুধু হাওয়া খেলে যাচ্ছে করোটির মধ্যে দিয়ে। সরু, পাতলা একটা হাওয়া। আর হাড়ের বাঁশির মতো বেজে উঠছে সেই করোটি।
মরীয়া হয়েই একটা পাতা টেনে নেয় কালুদা। যদি কিচ্ছু না হয়? তবে সেটাই, সেই না পারাটাই অন্তত লিখে রাখবে! একটা কিছু তো করতে হবে; একটা কিছু করতে হবে তো!! মাথার মধ্যে সমস্ত কিছু জট পাকিয়ে আছে। উগরে দিতে হবে…হড়হড় করে বমি…টকটক গন্ধ…। আস্তে আস্তে কালুদা লিখতে শুরু করে—‘তেমন করে শুরু নেই, তেমন কোনো শেষও নেই। শুধু একটা অন্ধকার জেলির কলসি। তার মধ্যে হাঁটু মুড়ে, কুঁকড়ে মুকড়ে, শুয়ে আছি ন্যাড়ামাথা আমি। বা পতঙ্গের অপেক্ষায় মেলে দেওয়া, ব্যাঙের জিভের মতো, একটা ইস্পাতের প্ল্যাটফর্ম। সেখানে শুয়ে আছি। দুচোখে তুলসীপাতা; সারা শরীরে ঘি। খানিকক্ষণ পরেই আমায় সাঁৎ করে টেনে নেবে হা হা চুল্লী’…

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes