
প্রসূন ভৌমিকের কবিতা
প্রসূন ভৌমিকের সদ্য লিখিত কবিতাগুলির মধ্যে প্রথম তিনটি কবিতা প্রকাশিত হয়েছে 'তিলোত্তমা' নামক কাব্যপুস্তিকায়, যেখানে কবি কবিতাগুলির কোনও নাম দেননি। তারপরও কবিতা লিখিত হচ্ছে এবং অনতিবিলম্বেই হয়তো আরও একটি গ্রন্থের মধ্যে নবলিখিত কবিতাগুলি প্রকাশিত হবে। বা অন্য কোনও কাগজের মুদ্রিত সংখ্যায়ও এই কবিতাগুলিকে পাওয়া যেতে পারে। আপাতত, আবহমানে এই কবিতাগুলি রইল। যেভাবে রাস্তার ধারে কখনো কখনো স্মৃতির শহর পড়ে থাকে। জিরিয়ে নেওয়ার জন্য।
পিণ্ড
নারী জন্ম হওয়া পাপ, বলেছিল কাজের মেয়েটি
পিসি বলল: ভুল, পাপী মরদের ছোঁকছোঁক মন
নারীর সুরক্ষা চাওয়া মিছিলেও নারী অসহায়
ভিড়ে তার বুকে হাত, লালসার বলিষ্ঠ কনুই
আমি চাই শুভ হোক শুভ হোক কল্যাণী পৃথিবী
হিম্মত প্রদান করো, অস্ত্র দাও মেয়ের তুনীরে
যে দেশে ক্ষমতা শুধু ব্রিজভূষণের পদতলে
যে পৃথিবী আশারাম, যে পৃথিবী রামরহিমের
যা বললে, গুরুত্বহীন, শুধুমাত্র লেখা থেকে যায়
ভাতের থালায় দেখি সে কন্যার পোড়া স্বরলিপি
দেখি তার ঠোঁট ফাটা, রক্তদাগ, দু’চোখে আঘাত
দেখি হাঁসফাস করছে, বজ্রমুঠি গলা চেপে ধরা
শিউরে উঠেছি, থালা ছুঁড়ে ফেলি, উচ্ছিষ্ট দেওয়ালে
ধর্ষিতা মেয়ের শ্রাদ্ধে পিণ্ড পাক অর্চনা গুহও!
স্বর্ণতারা
রাখি বাঁধি? কন্যা তোর কব্জিতে সুরক্ষা বেঁধে দিই!
আমার ক্ষমতা শুধু এটুকুই, অগম্যে হাঁটার…
প্রদীপ জ্বালাই? নিভু প্রদীপের শিখা হাতে ঢাকি!
ধৃতরাষ্ট্র রাতে জ্বলি? নিজেকে পাকাই সলতে এক!
আমার জননতন্ত্র চির অবনত হয়ে যাক!
কাটুক কলিঙ্গ রাত্রি, আলো হও জননী আকাশ
মায়ের নাভিটি আজও আমার নাভিতে জেগে আছে
সেখানে শরণ রাখি বন্ধনের গহীন ইশারা
যত না প্রবুদ্ধ রশ্মি, যত মায়া ধরণীকে গড়ে
ফল্গুর বহতা অশ্রু কণ্ঠরুদ্ধ করেছে যত না
ভাবি কবে নদীটির কাছে আমি প্রয়াণ ভিক্ষায়
হাত পাতবো, প্রজ্বলিত অগ্নিতে সে অঙ্গ পুড়ে যাক
শেষ হোক ধর্ষকাম লালসা-নিষ্ঠুর গুপ্ত মন
তারা হয়ে থাকবো আমি, কামহীন এক স্বর্ণতারা
অগ্নিশিখা
জাস্টিস মেলেনি আজও, এ লড়াই জাগ্রত থাকুক
চোখ যেন খোলা থাকে, জরদ্গবে আঘাত হানার
মনোবল বুকে থাকে, হাতে থাক দাবির দাপট
এ সুযোগ তিলোত্তমা মরে গিয়ে দিয়েছে তোমাকে
এ মুহূর্ত নদীদের, ঘাট ভাঙছে আছড়ে পড়া স্রোত
সন্তানের শীর্ষে রাখো দুই হাত, ক্ষুধিত শপথ
আগ্নেয়গিরির মুখে রাজপথ জ্বলন্ত মশাল
বীরভোগ্যা পৃথিবীতে মেয়েদের অধিকার বেশী!
দিশা যেন উদভ্রান্ত না হয় কখনও, স্থির থেকো
আগুন ছিনতাই করতে আসবে বকধার্মিকের দল
উস্কানি দিয়েছে দেখো মেধাবী উজবুক কারা কারা
বিচ্ছেদ না হয় যেন বন্ধুরা, কথায় কাটাকাটি
দৃষ্টিভঙ্গি যেন হয় দৃষ্টিশক্তি অতিরিক্ত চোখ
প্রীতিলতা ওয়াদেদার জ্বলে থাকো পাড়ায় পাড়ায়!
অঞ্জলি পিসি
অঞ্জলি পিসির কাব্যে পাখি বাসা বাঁধে, সে বাসায়
প্রতিদিন ঠোঁটে করে কত কথা লুকিয়ে রেখেছে
ওপার বাংলার কথা… জানোই তো কাঁটাতার মানে না পাখিরা,
যত গন্ধ ভালোবাসা, ক্ষোভ দুঃখ, প্রতিরক্ষা যত
চোখ বুঁজে ঘরে তোলে, সে ভাবে সে একা কুঁড়েঘর
আমি সব টুকে রাখি, নোটবুকে লিখেছি তাদের
একটি আলো রেখে দিই, উষ্ণ যেন থাকে বাসাখানি
রাতে খাতা খুলে পড়ি প্রবালের মণি মুক্তো হীরা
লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়, কুহেলী ফোঁপায় গোঁসাঘর
গোস্বামী তিলক কেটে গান গাইতে যান দ্বারে দ্বারে
আমি প্রাণপণে বাসা আগলাই ঝড়ের হিংসা থেকে
দাপট সামলাতে গায়ে আঘাত লেগেছে, কাটে ত্বক
বিক্ষত পাঁজরে আমি হেই সামালোর গান করি
গোপনে আমিও পাখি, পাখিদের হিসাবরক্ষক!
অঞ্জলি পিসি ২
সঠিক আগুন চিনতে ভুল যেন না হয় বাবুই
যৌবনে যা উষ্ণতার, নারী ও পুরুষ নির্বিশেষে
তাপ দেয়, উত্তাপ শেষে শুধুই কলহ আর ছাই
আগুন চেনার আছে, যে দহন কুশের ভগিনী
মৃগনাভি থেকে ঘ্রাণ যতই কলঙ্ক দিয়ে যাক
যতই গন্ধটি ভাসে, “তস্কর তস্কর” গাল দেয়
মন্থনে মোচড়ে শ্লোক লেখা হয় দগ্ধ আলপনায়
এক্কা দোক্কা খেলতে খেলতে ঘর পুড়ে গেছে, ফিরে শুই
যত ভালোবাসা আছে, আমি তার ছাতা বানিয়েছি
যত ফুল নদী চাঁদ, সকলকে অমরত্ব দিই
বাক্য-চাবুকের ঘাত সপাং মেরেছে, অঙ্গ জ্বলে!
সন্ত্রস্ত থেকেছি, বিষ উচ্চারণ যে যেখানে করে
মা বাবা পিসির মুখে যা দিয়েছি, আমাকেও দিস
মুখাগ্নির জন্য ওই সামান্য যেটুকু, করতলে…