
সুলেখা সান্যালঃ এক রাগী মেয়ের গল্পকথা
সুমিতা মুখোপাধ্যায়
অপরিমেয় এক দুর্লভ ঔদ্ধত্যের মিহি বুনোটে রোকেয়ার “পদ্মরাগ”-এ সিদ্দিকা যখন বলে, “তাঁহারা আমার সম্পত্তি চাহিয়াছিলেন, আমাকে চাহেন নাই। আমরা কি মাটির পুতুল যে, পুরুষ যখন ইচ্ছা প্রত্যাখ্যান করিবেন, আবার যখন ইচ্ছা গ্রহণ করিবেন ? …………… আমি যদি উপেক্ষা লাঞ্ছনার কথা ভুলিয়া গিয়া সংসারের নিকট ধরা দিই, তাহা হইলে ভবিষ্যতে এই আদর্শ দেখাইয়া দিদিমা-ঠাকুমাগণ উদীয়মানা তেজস্বিনী রমণীদের বলিবেন, ‘আর রাখ তোর পণ ও তেজ- ঐ দেখ না, এতখানি বিড়ম্বনার পরে জয়নব (সিদ্দিকা) আবার স্বামীসেবাই জীবনের সার করিয়াছিল। আর পুরুষসমাজ সগর্বে বলিবেন, ‘নারী যতই উচ্চশিক্ষিতা, উন্নতমনা, তেজস্বিনী, মহীয়সী, গরীয়সী হউক না কেন – ঘুরিয়া ফিরিয়া আবার আমাদের পদতলে পড়িবেই পড়িবে। আমি সমাজকে দেখাইতে চাই, একমাত্র বিবাহিত জীবনই নারীজন্মের চরম লক্ষ্য নহে ; সংসারধর্মই জীবনের সারধর্ম নহে।” সিদ্দিকার বয়ানে এমন অকপট সাহসী আঁতের কথা বলার ধৃষ্টতা সেই সময়ে প্রথম বেগম রোকেয়াই বুঝি দেখাতে পেরেছিলেন। পরবর্তীকালে বেগম রোকেয়ার সেই সাহসীকন্ঠ রাগে ফেটে পড়ল চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকের লেখিকা সুলেখা সান্যালের ছোটগল্পে। “আসলে সে এক রাগী মেয়ে, শিল্পের ছদ্মবেশে আমার জেগে-ওঠা খেয়ে নেয়”, কবি চৈতালীর কবিতার এই একটা লাইন-ই বোধহয় যথেষ্ট লেখিকা সুলেখা সান্যালকে চিনে নিতে! বিশশতকের মাঝামাঝি সময়, পোড় খাওয়া বাস্তব জীবনাভিজ্ঞতার ক্রোধ নিয়ে বাংলাকথাসাহিত্যের উন্নাসিক ভুবনে তাঁর উদ্ধত সাহসী পা রাখলেন লেখিকা সুলেখা সান্যাল।
১৯২৮ থেকে ’৬২ মাত্র এই ক’বছরে ক্ষণজন্মা লেখিকার গল্প উপন্যাসের সংখ্যা নিতান্তই কম। কিন্তু সল্প সংখ্যার সীমিত আয়োজনেও জীবনসত্য প্রকাশে তিনি ছিলেন অপ্রতিরোধ্য এবং স্পর্ধিত। আবেগের আতিশয্য নয় বরং সত্য প্রকাশে তাঁর অবিচল মনোভঙ্গী তৈরি করে নিলো এক সাহসী বয়ান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, আকাল, ’৪৭-এর খন্ডিত স্বাধীনতা ও তার পরবর্তী সময়ে ওপার থেকে আসা উদ্বাস্তু ছিন্নমূল মানুষের ঢলে মেয়েযাপনের নিরন্তর লড়াইটা তাঁর প্রায় প্রতিটা গল্পকেই জেদি করে তুলেছে। যেখানে মধ্যবিত্তের আদর্শ ও মূল্যবোধের নীতিকে সরিয়ে রেখে শরীরকে পণ্য করে টিঁকে থাকা মুখের ভিড়ে সামিল হয়ে যায় ‘সিঁদুরে মেঘ’ গল্পের মালতী। অন্যদিকে সুন্দরী স্ত্রী ললিতাকে পাজী মিলিটারি অফিসারের কাছে ভেট পাঠিয়ে অনন্ত বড়ো কন্ট্রাক্ট পেয়ে আরো বড়োলোক হতে চায়। ললিতা আত্মহত্যা করে। মেয়েশরীর হয়ে ওঠে বেঁচে থাকার আলম্বন বিভাব। যুদ্ধের অবক্ষয়ী পরিনামে, “যে মেয়েরা সৈন্যদের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছে, তারা তো ছেঁড়া জুতোর মতো পরিত্যক্ত এখন, ঠোঁটের রঙ চোখের জলে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে, ইস্কুল-ছাড়া পথ না-পাওয়া মেয়েগুলোর ভবিষ্যৎ ঠিক হয়ে রয়েছে চোরা-গলিগুলোর মধ্যে -মালতী করে কি এখন! ড্রিঙ্কওয়াটার তাকে ধন্যবাদ দিয়ে গিয়েছে যাবার সময়-কমপেনিয়ানশিপের জন্যে। সেদিনকার ছোট্ট মালতী তিক্ততার আর গ্লানির সমুদ্রে স্নান করে উঠে নিজের দিকে আর চাইতে পারে না যেন! অসহ্য দাহ সারা শরীরটায় !” অন্যদিকে সরাসরি যুদ্ধকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে মানদা ফিসফিস করে বলে, “তোর জীবন ব্যর্থ হতে দেবো না আমি, দেখি এ যুদ্ধের কত বড় ক্ষমতা।” মনুষত্বের অপচয় হতে হতে একটা সময় মানুষ মরিয়া! মেয়েকে ব্যর্থতার হাত থেকে বাঁচাতে মানদার ভূমিকা কখনো শিকারী পাখির মতো কখনও বা বাঘিনীর মতো! ঘটনাচক্রে অনন্তর সঙ্গেই মালতীর বিয়ে হয়। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মধ্যে দিয়ে দাম্পত্যের এক শীতল যাপনের দুরূহ ছবি উঠে এলেও গল্পের শেষে আস্থা আর স্বস্তির মাদুর বিছিয়ে দেন লেখিকা !
attitude towards the life…..বেঁচে থাকার একধরণের জেদী আগ্রাসন ‘জীবনায়ন’ গল্পে মেয়েযাপনের বদল ঘটিয়েছে। দারিদ্রের সঙ্গে আপোষহীন বেঁচে থাকার লড়াইয়ে আসন্ন সন্তান সংসারে আরও একটা বাড়তি মুখ! রিয়ালিটি আর আবেগের লড়াইয়ে তবু টিঁকে যায় বাস্তব, কারণ “বাঁচতে আমাদের হবেই। পরের আশা আছে বলেই তো এবারে মরতে পারছি।” জীবনসত্যের এমন নির্মম সংকটে মুখ-না দেখা আসন্ন সন্তানসুখের চেয়ে ক্রুদ্ধ সময়ে বিপন্ন অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রাখতে সীমা বদ্ধপরিকর। যেভাবেই হোক ওদের বেঁচে থাকতেই হবে! শুধু শাশুড়ির চোখে চোখ পড়তেই অপরাধীর মতো হাসে আর সুখদা ভাবে, “এই দিন, এই দেশ-আর কতো না খেয়ে থাকবে ওরা !” এখানে বিপর্যস্ত সময়ের ঘূর্ণাবর্তে মেয়েদের চিন্তার বিপন্নতা অন্য ভাষায় কথা বলে! আক্ষেপ হতাশা সব মিলিয়ে একটা সময়ের আঁধার ঘনিয়ে আসে গল্পে। চল্লিশের দশকের দাঙ্গা বিধ্বস্ত আগুনখাকি এক সময়ে দাঁড়িয়ে ‘ফল্গু’ লেখার সাহাস দেখিয়েছেন সুলেখা সান্যাল। জাত কি গায়ে লেখা থাকে? সদাহাস্যময়ী প্রতিবাদী ভাইপো-বৌ বরুণার এই প্রশ্নের উত্তর মহেশ্বরীর কাছে না থাকলেও নিষ্ঠ বিধবা তার শুচিতা বাঁচাতে গৃহত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পিসিশাশুড়ির আজন্ম সংস্কারকে বেপরোয়াভাবে চুরমার করে দিতে চেয়েছে বরুণার সংস্কারমুক্ত জীবনচর্চা। ক্রুদ্ধ মহেশ্বরী দূরে ঠেলে দিতে চেয়েও পারেন নি হাসিখুশি প্রত্যয়ী বরুনাকে অগ্রাহ্য করতে। দেশভাগাভাগির যন্ত্রণাকে বুকে নিয়ে নিঃসঙ্গ এই জীবনে তাঁর বেঁচে থাকার মূল মন্ত্র ‘শুচিতা’। কিন্তু তিনি ফিরেই যাবেন শহরে, ‘নিজের শুচিতাকে বাঁচাতে হলে চলে যেতেই হবে’। প্রবাহিত সামন্ততান্ত্রিক মূল্যবোধের সঙ্গে আধুনিক উদারনৈতিক জীবনবীক্ষার এক চরম সংঘাত। একটা সন্ত্রস্ত্য সময়ের আবহে জীবনই মহেশরীকে চরম শিক্ষা দিয়েছে। বেগার খাটা মুসলমান প্রজা হাবিবের ছেলে মতির হাতের জলই মহেশ্বরীর প্রাণ রক্ষা করেছে। রাতে অসুস্থ মহেশ্বরীকে পাখার বাতাস করতে করতে পায়ের কাছে কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থাকা ঘুমন্ত মতির মুখের দিকে অপলক চেয়ে মহেশ্বরী চৈতন্যের অন্ধকার কাচিয়ে বরুণার কথাগুলো বুঝতে চেষ্টা করেন, “কই পিসিমা দেখুন তো,ওর গায়ে কি ওর জাত লেখা আছে? আমার গায়ে আমার জাত -? আছে লেখা?” বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। অন্তরমহলের প্রচ্ছন্ন বাৎসল্য নিঃশব্দে গড়িয়ে আসে, নিজের মাথার বালিশ মহেশ্বরী গুঁজে দেন মতির মাথার নিচে। নারীযাপনের অন্ধকার ছিঁড়ে আলোকিত চৈতন্যের উদ্ভাসে একটা শান্ত নিশ্চিন্ততায় গল্প শেষ হয় লেখিকার স্বতন্ত্র্য চিন্তনের ব্যতিক্রমী অভিজ্ঞানে।
লেখিকার ক্রোধ আর বাস্তব অভিজ্ঞতার মিশেলে ‘জন্মাষ্টমী’-পুরাণকথার অনুষঙ্গে জেলের ভেতর মেয়েযাপনের এক নির্মম গল্প। নারকীয় জীবনেচর্যার কদর্য সমাচার। নিরপরাধ মেয়েদের জেলজীবনের দুর্বিসহ বঞ্চনা আর অত্যাচারের কাহিনী কী শান্ত এক কাঠিন্য অবলম্বন করে লেখিকা বলে গেছেন! বোঝাই যায় এ তার ব্যক্তিগত জীবনাভিজ্ঞতার প্রত্যক্ষ ফসল। কমিউনিস্ট আন্দোলনে যোগদানের পর লেখিকা প্রেসিডেন্সি জেলে একবছর কারারুদ্ধ ছিলেন। তখনই তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন জেলে মেয়েযাপনের কদর্যতা। নৃশংসভাবে নির্যাতিত হতে হতে আজ কাঁদতেও ওদের ঘেন্না করে। স্বাধীন ভারতে ওপার বাংলা থেকে আসা রিফ্যুজি মেয়ে নির্মলা, ভলান্টিয়ার ধরে খেতে বসা উপোসী ঊষা, ভরা পোয়াতি মেনকা ওরা জানে, ‘যাদের ইচ্ছেয় দেশটা ভাগ হয়েছে তাদের হুকুম এসব।’ তাদের হুকুমেই ভরা মাসে মানসীর পেটে ওরা বন্দুকের গুঁতো আর লাঠির খোঁচা দিয়ে বলে, ‘দে শালার জাতের দফা শেষ করে’। এই রাক্ষসের রাজত্বেই নির্মলার ছেলেটাকে বাঁচাতে পারে নি দিদিমা সুখময়ী, “ঘর ভাঙছে মান্ষের! জুতার নীচে গুড়াইয়া দিছে সোনাডারে !” জেলের ভেতরেই মৃত সন্তানের জামা বুকে জড়িয়ে নির্মলা যেন পাষান! হারিয়ে যাওয়া ছেলেকে ফিরে পেতে পাগোল ঊষা ! এদের দেশ থাকতে নেই, ঘর থাকতে নেই, ছেলে থাকতে নেই! তাই ঊষা ঠিক করে নেয় সে আর ছেলের জন্য কাঁদবে না। তবু সারা রাত জেলের আনাচে কানাচে গুমরে ওঠে সন্তানহারা মায়েদের কান্না। দমবন্ধ করা একটা ঝাঁঝালো রাগে তেতে ওঠে গল্পের প্রতিটা বর্ণ থেকে বাক্য। ফেটে পড়বার আগেই পূতিগন্ধময় মহিলা সেলে একটুকরো আলো নিয়ে মেনকার ছেলে ভূমিষ্ট হয়। ওরা গায়ে গায়ে সেঁটে দাঁড়িয়ে থাকে। উৎকর্ণ! চোখে খুশির দৃষ্টি! কৃষ্ণ এলো বুঝি ! সারা গল্পে নারীজীবনের দহন আর জ্বলনের উপসংহারে নতুন প্রাণের আগমনে কোথাও নিশ্চিদ্র অন্ধকারেও এক কুচি আলো এসে এদের মন ছুঁয়ে যায়। অবিমিশ্র হতাশা আর ক্রোধই জীবনের শেষ কথা বলে না।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সুলেখা সান্যালের গল্পের মুড ও ভাষা পরিবর্তিত হয়েছে। বাইরের বিস্তীর্ণ ঊষর আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক পথ উজিয়ে এসে লেখিকা সেঁধিয়ে গেলেন মেয়ে-মনের অতলান্ত গভীর অবচেতনে। প্রশ্ন তুললেন, বিবাহিতা মেয়ের কি ভালোবাসার অধিকার আছে ? অমীমাংসিত এই প্রশ্নের উত্তর জানা ছিল না ‘উলুখড়’-এর অনুপমার। তাই বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য ও পাশাপাশি বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বিচারিতায় অনুর মেয়েজীবন বয়ে গেছে অপ্রেম আর মৃত্যুর অনিঃশেষ গভীরে। জীবনের বিচিত্র ইকুয়েশনে নারীপুরুষ সম্পর্কের বিভিন্ন রসায়ন জমাট বেঁধেছে ‘খেলনা’, ‘কীট’, ‘বিবর্তন’ ‘একটা মামুলি গল্প’, ‘ভাঙা ঘরের কাব্য’-এর মতো অনেক গল্পে। উচ্চকিত নয়, কিন্তু দমবন্ধ করা গুমোট এক আবদ্ধ জীবন! সাফোকেটিং! আসলে সেই সময়টা ছিল ‘ওয়েস্টল্যান্ড’-এর মতোই বন্ধ্যা, যেখানে প্রেম, বিশ্বাস, ভালোবাসার বারিবিন্দু নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে অপ্রেম আর অবিশ্বাসের চোরাবালিতে। জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতে জর্জ্জর লেখিকা কখনো কখনো তীব্র ক্ষোভে জীবনকে কাটাছেঁড়ায় নির্মম হয়ে উঠেছেন। কখনও যুদ্ধের বাজারে কখনও রিফিউজি ক্যাম্পে বা উদ্বাস্তু কলোনিতে কখনো বা একেবারেই শহরের বুকে ধূসর মেয়েযাপনের বৃত্তান্ত প্রকাশে তিনি অকরুণ। ধীরে ধীরে প্রথানুগ প্রাচীন সংস্কার, আত্মকেন্দ্রিকতা, স্বার্থপরতা, না-পাওয়ার ছটফটানিতে গল্পগুলো ভারি হয়ে ওঠে,পড়তে পড়তে এক একসময় মনে হয় বড়ো বেশি ভালো না লাগার গল্প, অথচ রিয়ালিটির কী দুর্দ্দমনীয় আগ্রাসন! “শোনো তবে। অন্ধকূপের চেয়েও অন্ধকার এক ঘরে তিনজন মেয়ে মিলে থাকি। তাকে বলি বোর্ডিং ! তিনখানা সস্তা দামের সিল্কের শাড়ি আমার সব মিলিয়ে, রাতে কেচে শুকিয়ে সকালে পরি,তাই গুছিয়ে পরতে দেখে হিংসেয় মরছ ! পাঁচমাসে শোধ করা কুড়ি টাকা দামের ঘড়িটা চলে না, সময়মতো কাঁটা ঘুরিয়ে দিতে হয় ! আর চাকরি! বলে রাগে রাস্তার মাঝখানেই প্রায় কেঁদে ফেলে কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ থেকে একমুঠো কি যেন নিয়ে পাগলের মতো ছুঁড়ে দেয় রাস্তায়, যে কারখানার মালিক দয়া করে ঘর দিয়েছে থাকতে, তারই মাল এসব, স্যাম্পেল নিয়ে দোকানে দোকানে ঘুরে অর্ডার এনে কমিশন পাই,এই আমার চাকরি প্রবীর! জিনিসগুলো এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়েছে ততক্ষণে। লাল, নীল,সবুজ প্ল্যাস্টিকের পুতুল, কুকুর, সেলাইকল, টেলিফোন, বাড়ি। একরাশ খেলনা !” কী অসম্ভব ধারালো প্রকাশ ! ছটিয়ে পড়া খেলনাগুলো যেন বিলাসী জীবনের সিম্বল হয়ে নমিতার দারিদ্রকে চরম উপহাস করে ওঠে! জোরালো লেখনের গুনে মেয়েভাষার এ এক আগুনেরূপ! ক্ষোভ,হতাশা,বঞ্চনায় বিবর্ণ জীবনের পাঠ কখনো কখনো পাঠককে মরবিড ক’রে তোলে, ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে যেতে হয়। লেখিকার ভাবনা ও নির্মাণ কখনো রেয়াত করে না সত্যযাপনের সত্যি কথা বলতে, তা সে যতই ধূসর পাঁশুটে হোক! তবুও সুলেখা সান্যাল পেসিমিস্টিক নন! রঙবিহীন ঘোলাটে চোখের জীবনবীক্ষণই তাঁর গল্পের শেষ কথা বলে না। সহস্র না-পাওয়ার মধ্যেও এরা একে অন্যের গা-ঘেঁষে দাঁড়ায়, জীবনের তরঙ্গ যেন ওরা ! উদ্বাস্তু কলোনিতে ছেলে কোলে কণিকা এসে দাঁড়ালে,“-ওরা আবার এসে ঘিরে দাঁড়ালো-শাঁখ বাজাল,উলু দিল।” যাপনের মালিন্যকে সরিয়ে রেখে উৎসাহিত হয়ে কণিকা বোনকে বলে, “দ্যাখ সেই সুন্দর বাড়িটাকে ভাগ করে দেওয়া যেত যদি এদের মধ্যে বেশ হত, না রে ? তারপর দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে, তুই ভাই থেকেই যা আমাদের কাছে। বিয়ে-টিয়েও তো করতে হবে। থাকবিনে বিনু ?” খরখরে ভাষার চোখ রাঙানি নয়, আপোষের পেলবতায় কোথাও যেন মসৃণ শান্তি নেমে আসে। আবার ‘সংঘাত’-এ, তুষের আগুনের মতো ধিকি ধিকি জ্বলতে থাকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ। সময়কে দায়ি করে অমিতা প্রশ্ন তোলে, “যা দিন আসছে সামনে আমাদের মতো মধ্যবিত্তদের বাঁচতে দেবে নাকি ভেবেছেন ?” মধ্যবিত্তের জীবনে বেঁচে থাকাটাই যেখানে একটা ক্রাইসিস সেখানে আলোকিত চৈতন্যের হাহাকারে ফেটে পড়া বিমলার আক্ষেপ, কেন অমিতা তাকে দুঃখের মধ্যে এমনি করে জাগিয়ে দিয়ে গেল ! এখন অমিতার জেলে যাওয়ার ব্যাখ্যা বিমলার কাছে স্পষ্ট, “অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছিল ওরা ………অন্যায় ? হ্যাঁ সুকুমার, সুরেশের আর ওদেরই মতো হাজার হাজার লোকের চাকরি যাওয়ার অন্যায়,এই অসহ্য অভাবের অন্যায়………কেঁদে কেঁদে নিজেই এক সময় চুপ করে গেল বিমলা।” আর “গাজন সন্ন্যাসী’-র পশুপতিকে রিফিউজি ক্যাম্প থেকে প্রতিবাদের শাস্তি দিতে সেপাইরা গাড়িতে তুলে নিলে , “কেবল মানদা ওঠে না- সে ওই ধুলোয় গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদে। তার সকালের ফর্সা জামাকাপড় বেলা দুপুরের গরম হাওয়ায় ওড়া লাল ধুলোয় আর সবাইয়ের মতই ময়লা হয়ে ওঠে।” শ্রমিক আন্দোলনের পটভূমিকায় লেখা এই গল্পগুলো পড়তে পড়তে বার বার মন ছুটে যায় মানিক বন্দোপাধ্যায়ের দিকে। গল্প সংখ্যা অল্প হলেও জীবনের এক বিস্তৃত ক্যানভাসে তিনি প্রবৃত্তি ও আবেগের অনিবার্য সংকটের মধ্যে দিয়ে একটা বিড়ম্বিত সময়ের জীবনকে সরীসৃপের মতো নিঃশব্দে গ্রাস করেছেন ! আবার উগ্রে দিয়েছে্ন প্রবল ক্ষোভে। তবু ‘মেঘে ঢাকা তারা’-র নীলার মতোই বেঁচে থাকার তীব্র আশ্লেষে তাঁর গল্পের চরিত্র শেষ পর্যন্ত বলে যায়, “সুটনিয়া কভি মরবে না।” এক কলি হিন্দি গানের সুর ভেসে আসে, কোন্ বাজায়ে বাঁশরীয়া……। আর লেখিকার বয়ানে তাঁর গল্পকথার মেয়েদের মুখে ফুটে ওঠে এক ভিন্ন ভাষার স্বতন্ত্র্য উদ্ভাস।
লেখক একজন বিশিষ্ট অধ্যাপক