উঁকিঝুঁকি, আয়না ও দু’চারটে দিন চতুর্থ পর্ব   কৃষ্ণালক্ষ্মী সেন

উঁকিঝুঁকি, আয়না ও দু’চারটে দিন চতুর্থ পর্ব কৃষ্ণালক্ষ্মী সেন

কলকাতা! কলকাতা কি চাট্টিখানি ব্যাপার! বিরাট বড় জায়গা, বুঝলে! আমাদের ঘনু জেলে, ঘনশ্যাম, পায়রাচোখো দিঘিতে গায়ের জোরে ডাইনে ঘুরে ফাঁদি জাল ফেললে যেমন এ মুড়ো থেকে ও মুড়ো চারিয়ে পড়ে, কলকাতা তেমনই। কলকাতা ওই বিশাল ফাঁদি জালের মতো। ছড়িয়ে আছে। পড়ে হে পড়ে, আরে নাক নাক নাক, টাক টাক টাক, লাগ লাগ লাগ— সকাল থেকে রাতে এই জালে কত কত মাছ পড়ে জানো! কিলবিলোয়। জালে পড়ে চুনো চুনো মাছগুলো সব খুব খাবি খায়। তিড়িং বিড়িং বড্ড বেশি লাফায় দেখো মাগুর, ল্যাটা। বোয়াল—রাঘব বোয়াল, পাঁকালগুলো ফিকির জানে, জাল কেটে যায়।

কলকাতা তো কলকাতা-ই।

এই কলকাতার সাত ফুট বাই তিন ফুট একটা ঘরে আমার ছাপোষা পৃথিবী। সেই পৃথিবীতে নাটকের মতো একটি বিছানা তক্তপোষের উপরে আর প্রহসনের মতো একফালি মেঝে। তবে এই একখণ্ড পৃথিবীর ছোটখাটো অগোছালো রঙ্গমঞ্চে আমার মতো একান্ত অপটু আনাড়ি এক অভিনেত্রীর বেশ একরকম চলে যায়— অথবা দু’রকম…তিনরকম… একশোরকম। কী নেই আমার সেই ঘরোয়া পৃথিবীর ভিতর? জুতো সেলাইয়ের সুতো থেকে চণ্ডীপাঠের চশমা— সবই আছে। একটা জানালাও আছে। এই পৃথিবীর দেওয়ালের অনেকটা উঁচুতে ঠিক ঘুলঘুলি নয়, জানালাও নয়, শিক আর লোহার জাল দিয়ে ঘেরা হাত দেড়েক লম্বা চওড়া মতো একটা ফাঁক—মালিকের দাবি মোতাবেক ওটা জানালা — অতএব জানালা আছে। জানালার ওপারে যে কলকাতা সেখানে দিয়ে একটা গলি চলে গেছে, তস্য গলি, হাতিবাগানের। এ জগতের শ্রেষ্ঠ রহস্যময় গলিগুলি কেবল উত্তর কলকাতার পেটের ভিতরেই পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে রয়েছে পৌষ্টিকনালির মতো। এই গলি দিয়েও মানুষ যায়, মানুষ আসে, মানুষের পায়ের শব্দ শুনি। মানুষ কথা বলে ফিসফিসিয়ে, মানুষের সঙ্গে অথবা মানুষীর কানের বড় বেশি কাছে মুখ এনে। খুব সরু, আঁকাবাঁকা অদ্ভুত এই গলিটা, টেনিদার মতো দু’জন লোক পাশাপাশি হেঁটে যেতে পারে না। তবুও এখান দিয়ে দিনে রাতে বড় বেশি লোক চলাচল করে।

গলির ওপাশেও একটা দেওয়াল, রংচটা গোলাপি দেওয়াল। শরীর থেকে ছাল উঠে যাওয়ার মতো কোথাও কোথাও তার সিমেন্টের চাকলা উঠে গিয়ে আদ্যিকালের ইট বেরিয়ে পড়েছে। ওটা একটা ছাপাখানা। দাদরার তালে সারাদিন ওখানে মেশিন চলে — ঘট ঘট ঘটাং ঘট ঘট ঘটাং ঘট ঘট ঘটাং আর থেকে থেকে গ্রিজের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে হাওয়ায়। আমার ঘরের পৃথিবী অনবরত শব্দগন্ধময় হয়ে ওঠে।

হস্টেলে আমার এই ঘরের চারপাশে কেবল কলকাতা— বড় বড় বাড়ি, দেওয়াল, গলি, মানুষের পর মানুষ, হরেক আওয়াজ ইত্যাদি ইত্যাদি। ঘরটায় আলো প্রায় ঢোকে না, স্যাঁতসেঁতে। সারাদিন একটা লাইট জ্বলে। এই স্যাঁতসেঁতে ব্যাপারটির সঙ্গে সারাবছর একরকম সমঝোতা করে কেটে যায় কিন্তু বর্ষায় এই ভেজা ভেজা রঙ্গমঞ্চে সদলবলে হাজির হয়ে যায় উইপোকার দল। ঘরের দেওয়াল ভরে উঠতে থাকে তাদের বিচিত্র সব শিল্পকলায়। ব্যর্থ সিম্বলিজম, কিউবিজমের পর্ব পেরিয়ে পোকার দল দ্রুত এগিয়ে আসতে থাকে আমার বইগুলোর দিকে, থাকে থাকে রেখে দেওয়া অভিধানগুলোর দিকে। ওরা আসলে ফোঁপড়া করে দিতে চায় ভিতরকার সমস্ত অর্থ, নিরর্থক করে দিতে চায় সব। ইচ্ছে করে টিপে টিপে ওদের মেরে দিই। রাগ হয়। কিন্তু ওরা সংখ্যায় বেশি, চিরকাল সংখ্যায় বেশি। দেখলে গা ঘিনঘিন করে।

ঠক ঠক ঠক— দরজায় টোকা পড়ল।
— কে?
— আমি বিশাখা, দিদি।
— ও! এসো, ভিতরে এসো।
— বলছি, এখন তো জলখাবারের সময়। আপনি হাত মুখ ধুয়ে নিচে খাবার ঘরে আসুন।
— হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুমি চলো। আমি আসছি কিছুক্ষণের মধ্যেই।

সময়টা এখনও সকালবেলার ভাগেই পড়ে। ঘড়িতে সাড়ে ন’টা। কিন্তু রোদের ঝাঁঝ দেখে সকাল বোঝার উপায় নেই।

জানালার ফাঁক দিয়ে ঘন জমাটি রোদ এসে পড়েছে বিছানার উপর। বিছানায় একটা গদি, তাতে হালকা নীল ফুল ফুল চাদর বিছানো। সঙ্গে একটা মাথার বালিশ। ব্যাস।

অন্য তক্তপোষটি ফাঁকা থাকায় আমার সুবিধা হয়েছে। তার উপর ব্যাগপত্তর সব চাপিয়ে রাখতে পেরেছি।

ঘরটি ছিমছাম। ছিমছাম বলেই আমার চোখে সুন্দর। একজন মানুষের জন্য অবশ্য এ ঘর মাপে অনেকটা। বড় বড় দুটো জানালা থাকায় সারা ঘরে আলোর লুটোপুটি। এখান থেকে রাশিকৃত আকাশ দেখা যায়। গাছ দেখা যায়, গাছেদের সারি, অবিরাম ডালপালা মেলে তারা এই লীলাময়ী প্রকৃতিভূমির প্রহরী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ফুরফুরে টাটকা হাওয়া জানালা দিয়ে ঢুকে ঘর ভরিয়ে দেয়। অস্পষ্টভাবে চোখে পড়ে অনেকটা দূরে এই বিশাল কম্পাউন্ডের ধোঁয়া ধোঁয়া আবছা সীমানার পরে এক বিশাল মেঠো টামনা শুয়ে আছে মাঠে মাঠে।

আগামী দু’চারদিন এমন একটা বাউল বাউল ঘরে খোলা জানালার পাশে থাকতে পারব ভেবেই দারুণ একটা অনুভুতি জাগছে। গুনগুন সুরে আমার ভিতর থেকে দেখি সেই গানটিই বেরিয়ে আসতে চাইছে যেটা ছেলেবেলায় খুব শুনতাম — আউশজমির আল ভেঙে যেতে যেতে গাঁয়ের সুজন গোঁসাই একতারাখানি জাপটে ধরে দরাজ গলায় গাইত— ‘আপন ঘরের খবর নে না।/ অনায়াসে দেখতে পাবি/ কোন্‌খানে কার বারাম খানা।।‘
গানের তালে লোকটার পায়ের তলায় নাচ ছিল। একবার বাঁ পা নাচিয়ে ডানপায়ের দিকে নিয়ে যেত, একবার ডান পা নাচিয়ে বাঁ পায়ের দিকে, আর খোলা মাঠের বাতাসে বাতাসে ওর ফতুয়া উড়ত ফরফর করে।

কাছেই কোথাও একটা কোকিল ডেকে উঠল। জানালার কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম, পেলাম না। এই এক পাখি, বড় বেশি ওর আড়াল আবডাল।

প্রদীপকাকুর প্রতি কৃতজ্ঞতায় মন ভরে উঠল এমন একটি ঘরে আমায় থাকতে দেওয়ার জন্য।

দেখেছি, একটানা অনেকগুলো দিন শহরে কাটিয়ে ফেলার পর আমার মধ্যে তনছট শুরু হয়ে যায়, ভিতরটা হাঁকপাঁক করতে থাকে। কেবলই মনে হয় পালাই। পালিয়ে চলে যাই তেমনই এক জায়গায় যেখানে ধারাবাহিক নিস্তরঙ্গতা। নিস্তব্ধতা যেখানে চিলেকোঠার নিমগ্ন দুপুর হয়ে ওঠে। বেঁচে থাকার খাজনার মতো এই এতো জীবনের হুটোপুটি, হরেক দরের পাইকারি বাধ্যবাধকতা কিছুই সেখানে নেই। সেখানে সকাল আসে সকালের ছন্দ নিয়ে, সেখানে দুপুর আসে দুপুরের ছন্দ নিয়ে, সেখানে সন্ধ্যে আসে সন্ধ্যের ছন্দ নিয়ে, সেখানে রাত্রি আসে অন্ধকারের মায়া জড়িয়ে। দেশলাই বাক্সের মতো খোপে ও খুপচিতে— ফ্ল্যাটে ক্রমাগত থাকতে থাকতে আমার ভিতরে একটা রং-চটা বিষাদ তৈরি হয়। ফ্ল্যাটের ওই চার দেওয়ালের সমষ্টিগত আয়তক্ষেত্রের ভিতর আমার ভালো লাগে না, যতই সেখানে বারান্দা থাক— দক্ষিণের বারান্দা, উত্তরের বারান্দা, পুব-পশ্চিমের বারান্দা। এই বারান্দাগুলি আসলে বারান্দার-ই প্রতিচ্ছবি। আমার বারান্দা থেকে সামনে দেখা যায় ব্যানার্জীদের বারান্দা, ডানদিকে ম্যাডাম রক্ষিতের বারান্দা, বাঁদিকে মুখুজ্জেরা না থাকলেও তাদের ধুলোপড়া বারান্দা। আলাদা করে কোনও দৃশ্যের জন্ম হয় না। ক্লান্তিকর! আমরা আধুনিক জীবের দল আমাদের এই আধুনিকতম বাস্তু-ভিটেতন্ত্রে দেখছি শহরের সমস্ত ফ্ল্যাটগুলিই যেন ঘুষোঘুষি করে অভিযোজিত হতে হতে একে অপরের সঙ্গে প্রবল টেক্কা দিয়ে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। আর অনেক দূর থেকে মানুষের এসব কাণ্ডকারখানা দেখে চার্লস ডারউইন তাঁর “দি অরিজিন অফ স্পিসিস” বইখানি ঝোলায় পুরে মুচকি মুচকি হাসছেন।

আমিও একবার নিজেকে দেখে খানিকটা মুচকি হাসলাম, ড্রেসিং টেবিলের আয়নায়। পরপর তিনদিন ছুটি আর একদিন ম্যানেজ করে নিতে পারলেই দুর্গ এবং কেল্লাফতে। শহর ক’দিন থাক খুব শহুরে হয়ে তার নিজের জায়গায়। আমি বরং বেরিয়ে পড়ি এই শহর থেকে, দূরের পথে। তারপর নিজস্ব ঝোলাঝুলি বের করে ধুলো ঝেড়ে এই টামনামুখো আমি। এখানে আসার পর থেকেই মনে হচ্ছে এমন একটা জায়গাতেই আমি আসতে চেয়েছিলাম।

এবার আমার নিচে খেতে যাওয়া একান্তভাবেই উচিত, কেননা বিশাখা ইতিমধ্যেই হাতমুখ ধুয়ে খেতে যাওয়ার হাঁক পেড়ে গেছে। এখন আপাতত হাত ধুয়েই যাওয়া যাক, মুখ না হয় পরে ধোওয়া যাবে।

(ক্রমশ)

CATEGORIES
Share This

COMMENTS Wordpress (0)

demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes
Just a moment...

Checking your browser

This process is automatic. Your browser will redirect to your requested content shortly.

Please allow up to 5 seconds…

DDoS protection by Cloudflare
Ray ID: 8a55e83a58d629d9