ডিসটোপিয়ার দিকে দশচক্রে :
হিন্দোল ভট্টাচার্য
আট-এর দশকের শেষের দিকে একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হল। সেই কাব্যগ্রন্থটির নাম ভুতুম ভগবান। কে যে এই ভুতুম ভগবান তা আমরা কেউই জানি না। জুজু কোনও? মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ভয়? না কি সেই ভয় যা আমাদের দেখানো হচ্ছে প্রতিনিয়ত? ভয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে ভক্তি। আর সে যে কী চরম ভক্তি! এমন ভক্তি তো ছিল না আগে। কোথা থেকে এল? মানুষের পিঠ যত দেওয়ালে ঠেকে যাচ্ছে, মানুষের জীবন যত ভেঙে চুরমার হতে হতে শেষ হয়ে যাচ্ছে, তত মানুষ একই সঙ্গে হয়ে উঠছে ভূত ও ভগবান। কিন্তু যিনি ভুতুম ভগবান তিনি কি আসলে জীবনানন্দের বুড়ো পেঁচা? ধরা যাক দু একটা ইঁদুর এবার বলে যে নিয়তির মতো ঝাঁপিয়ে পড়বে? পাঠক হিসেবে আমার এই সব অসংলগ্ন চিন্তাধারার শেষ হয় না জয় গোস্বামীর ভুতুম ভগবান পড়তে পড়তে। কিন্তু এইটুকু বুঝতে পারি, তিনি এক আশ্চর্য কাব্যভাষা তৈরি করছেন এবং এমন সব কথা বলছেন যেগুলি বাইরে প্রবল অস্থির, ভিতরে প্রবল অন্তর্ভেদী। যেন হাসির আড়ালে লুকিয়ে থাকা বিষাদ। বাইরে এক যন্ত্রণার উদযাপন। সব অস্থির বুদ্বুদের লক্ষণ। তখন পৃথিবীর প্রায় সব কমিউনিস্ট সরকারের পতন হয়ে গেছে। ক্যাপিটালিস্টরাও বাঁচার জন্য খুঁজছে রাস্তা। আমরা এখন জানি, যে সময়ে এই বই, তার আর কয়েক বছর পরেই আসবে গ্যাট ডাঙ্কেল চুক্তি। শুরু হবে বিশ্বায়নের প্রস্তুতির দিনগুলি। সেই ইঙ্গিত কি তখনই কবি টের পাচ্ছিলেন? একটা কথা খেয়ালে রাখতে হবে, এই কবি চোখের সামনে দেখেছেন কীভাবে যুক্তফ্রন্ট নকশাল তরুণদের লাশের পর লাশ ভাসিয়ে দিয়েছে জলে। এই কবি এও দেখেছেন বাম জমানার ভয়ংকর দিনগুলো কীভাবে আত্মপ্রকাশ করছে। গ্রামে গঞ্জে প্রবল শোষণ এবং অত্যাচারের কাহিনি শুনে আমরা লজ্জায় মুখ ঢাকতেও পারছি না। তবে কি একপ্রকার নৈরাজ্যের সৃষ্টিই হয়েছে? আমাদের দিন কেটে যায় সাধারণ ভাত কাপড়ে। নিজের শোকবিধ্বস্ত নিঃসঙ্গ জীবনযুদ্ধে কবি জানেন, আসলে কোনও ব্যবস্থাই মানুষের জন্য নয়। মানুষকে লড়াই করতে হয় নিজের মতোই। আর সে যুদ্ধে হার নেই জিত নেই। টিকে থাকা আছে।
‘দশচক্র’ কবিতাটি সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলেই মনে হয় এই কাব্যভাষা একেবারেই জয়ের ব্যক্তিত্বকে চিহ্নিত করে তা যেমন সত্য, তেমন এই কবিতা স্পষ্টই তুলে ধরে একটা অস্থির নির্দেশহীন সময়কে। যে সময় এখনও আমরা বহন করছি। আর বহন করতে করতে আমরা কোন দিকে যাচ্ছি, তার সামান্য ইঙ্গিত পর্যন্ত আমরা পাচ্ছি না। এমন একটা বোবা মাথা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি, যে আসলে ভীষণ বিভ্রান্ত। স্বপ্নহীন একটা সমাজের ভিতর আর কীই বা হতে পারে দশচক্রের মতো সময়ের ভিতর ডুবে থাকা ছাড়া?
রাস্তায় রাস্তায় আমি ভগবান দেখে দেখে বেড়াচ্ছি ভুতুম ওই
হাত পা কাটা ভগবান সব
কী মুখ খারাপ করছে বাপ রে বাপ! মাকে করছে বাপকে করছে করতে করতে
ফাঁক করছে দশচক্রে ভগবান সব
বাপকে মেয়ের সঙ্গে ছেলেকে মায়ের সঙ্গে ঠেলাকে মারুতির সঙ্গে
জোর করে শূইয়ে দিচ্ছে এক বিছানায়
আমি যদি মেয়ে হতাম ওদের আদর করে ওদের শরীর দিয়ে
শান্ত করতাম
আমি যদি হোমো হতাম তাহলে ওদের যত রাগরক্ত বাঘরক্ত নিজমুখে
গ্রহণ করতাম
এই কথা বলা মাত্র স্বয়ং মা সরস্বতী – কী বলব ভুতুম আজকে
শুনলে তুমি বিশ্বাস করবে না –
স্বয়ং মা সরস্বতী বীণা ও পুস্তক ফেলে দু-হাত দিয়ে পথ আটকে
দাঁড়ালেন আমার রাস্তায়
পরনে কিচ্ছুটি নেই, একদম ন্যাংটো শুধু আঙুলে নেলপালিশ
সরু সরু নখশুদ্ধ আঙুল
ঢুকিয়ে দিলেন চোখে, মরে গেলাম, মরে গেলাম, মরতে মরতে কী দেখলাম
বলব কী ভুতুম আমি কী বলব তোমায়
দেখতে দেখতে আমি স্বয়ং ভগবান হয়ে যাচ্ছি মাকে ডাকছি বাপকে ডাকছি
চোদ্দগুষ্টিকে ডাকছি আয় আয় আয়
বাপলে মেয়ের সামনে ছেলেকে মায়ের সামনে মেরে শুইয়ে দিচ্ছি কেটে
ভাসিয়ে দিচ্ছি সব গ্রামগঞ্জ নদীনর্দমায়—
ভয়ংকর কবিতা! ভয়ংকর দুঃস্বপ্নের কবিতা। আর এই দুঃস্বপ্ন মোটেই বাস্তবতা থেকে দূরের কোনও বিষয় নয়। কেউ যদি বলেন বিশ্বায়ন পরবর্তী সময়ে বিশ্ব এক সুন্দর অমরাবতীতে দিন কাটাচ্ছে, তা তো চরম মিথ্যে। আসলে বিশ্বায়ন পরবর্তী বিশ্বে যা চলছে তা হল সত্যের উৎপাদন। উৎপাদিত সত্যের এই পৃথিবীতে পোস্ট ট্রুথ বলে গালভরা কথাও বলা যায়। কিন্তু মোদ্দা কথা হল সত্যকে নিজের মতো করে তৈরি করছে বিশ্বায়নের নতুন বড়লোকেরা। কোম্পানির নতুন মালিকেরা। আর একটা ইন্দ্রপ্রস্থসম পৃথিবীর নীচে কিলবিল কিলবিল করছে আমাদের এই সাধারণ মানুষের পৃথিবী। যেখানে কালো লাল পিঁপড়ের মতোই মানুষজন কখন কীভাবে বেঁচে থাকছে, কীভাবে মরে যাচ্ছে, কীভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, তার কোনও হদিশ নেই। ওদিকে ইন্দ্রপ্রস্থে বসে সব কিন্তু বোঝা যাচ্ছে। সব দেখতে পাওয়া যাচ্ছে কীভাবে কিলবিল কিলবিল করতে করতে মানুষ শ্বাসরুদ্ধ হয়ে পড়ছে। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দেওয়ার মতো করে তারা ঢেলে দিচ্ছে তাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সংস্কৃতির বীজ। আমাদের কোমর নাচাতে বললে আমরা কোমর নাচাচ্ছি, আমাদের ধার্মিক হতে বললে আমরা ধার্মিক হচ্ছি, আবার আমাদের যদি বলা অল্প সময়ের বিপ্লবী হতে, তবে আমরা তাও হচ্ছি। আমাদের একে অপরের মধ্যে তৈরি হচ্ছে এক প্রবল অসহিষ্ণুতার, অবিশ্বাসের সম্পর্ক। জয় গোস্বামী সেই আট-এর দশকে যে অসহিষ্ণুতাকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন তা সম্ভবত তার তিরিশ পয়ত্রিশ বছর পরে আরও অনেক বেশি সত্য হয়ে উঠেছে। আমাদের মধ্যে এই পারস্পরিক সন্দেহ, অবিশ্বাস, অসহিষ্ণুতা এবং সংশয় তীব্র হয়ে নির্মাণ করছে এমন এক পরিস্থিতি, যেখানে আর কোনও ব্যবহৃত শব্দের কোনও অর্থ নেই।
আমি যদি মেয়ে হতাম ওদের আদর করে ওদের শরীর দিয়ে
শান্ত করতাম
আমি যদি হোমো হতাম তাহলে ওদের যত রাগরক্ত বাঘরক্ত নিজমুখে
গ্রহণ করতাম
কবি জানেন, কী ভয়ংকর গরল আমাদের মধ্যে। কী ভয়ংকর দুঃস্বপ্নের বিষ আমাদের বিষাক্ত করে দিচ্ছে আর আমরা সেই বিষ ঢেলে দিচ্ছি আমাদের নিজেদের মধ্যেই। যেন অভিশপ্ত পতঙ্গ। যেন আমরা নিজেরাই জানি না কীভাবে মৃত্যু আমাদের তাড়া করছে। কীভাবে প্রতিটি অনিশ্চয়তার মধ্যে আমরা শুয়ে পড়ছি একে অপরকে শত্রু ভেবে নিয়ে। আমরা আগুন লাগিয়ে বিষের মধ্যে পুড়িয়ে দিচ্ছি নিজেদের। আমরা উল্লাসে মাতছি নিজেদের ধ্বংস করে চলার উদযাপনের ভিতর। এক ভয়ানক নরক চারিদিকে। যেন বাতাসের বদলে আমরা বুকের মধ্যে নিয়ে নিচ্ছি আগুন। আর আস্তে আস্তে নিজেদের ভিতরটা পুড়ে যাচ্ছে খাক হয়ে। পুড়তে পুড়তেও বুঝতে পারছি না কী ভয়ংকর অসুখ আমাদের মধ্যে বাসা বেঁধে আছে। সেই কবে, জয় গোস্বামী রচনা করেছিলেন এই পলিটিকাল ডিসটোপিয়া।
এই প্রসঙ্গেই বলতে চাই, পলিটিকাল ডিসটোপিয়ার কবিতা কবি জয় গোস্বামী ছাড়া সেই সময়ে খুব একটা পড়ি না বললেই বলা যায়। কারণ এমন একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে এখন চলেছি আমরা, সেই সময়টার ভাষ্য কবি সেই সময়েই টের পেয়ে গিয়েছিলেন। নব্বই দশক শুরু হওয়ার আগেই একবিংশ শতকের দ্বিয়ীয় দশকের কেন, আরও তিরিশ বছর পরের ভারতবর্ষের চিত্রও তিনি দেখতে পেয়েছিলেন। এই কবিতাতে কোনও মতাদর্শগত, কোনও দার্শনিক ইউটোপিয়ার কথা বলা নেই। বরং রয়েছে এমন এক ডিসটোপিয়া, যার মধ্যে আমরা হাঁসফাস করছি। কিন্তু যা থেকে বেরোনোর উপায় আমাদের জানা নেই। ওষুধ নেই কোনও।
বাপকে মেয়ের সামনে ছেলেকে মায়ের সামনে মেরে শুইয়ে দিচ্ছি কেটে
ভাসিয়ে দিচ্ছি সব গ্রামগঞ্জ নদীনর্দমায়-
প্রসঙ্গত, এই কবিতাটি কিন্তু শেষ হচ্ছে না। এক অনির্দিষ্টি ড্যাশ দিয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে কবিতাটির চলন। কবিতাটি অসম্পূর্ণ। যেন একটা ধ্বংস চলছে, কিন্তু সেই ধ্বংসের পরবর্তী সময়টার কথা আমাদের জানা নেই। আর কী আশ্চর্য এই কবিতাটির কাব্যভাষা। যেন ফর্ম বা আঙ্গিক ইচ্ছে করেই এমন শ্বাসরোধী, এমন যতিচিহ্নহীন শুধু একটি দুটি ড্যাশ ছাড়া। কবিতাটি চলছে। ধ্বংস চলছে। তার পরে কী আছে, তা সত্যিই আমরা জানি না।
ভুতুম কে আজ পর্যন্ত আমি জানি না। মনে হয় কবিও জানেন না। এই কবিতা আমার মতে জয় গোস্বামীর লেখা অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি কবিতা, যা নিজে থেকেই চলেছে এক অনির্দিষ্ট সময়ের দিকে। আগামী এমন একটা সময়ের দিকে চলেছে, যে সময়ে হয়তো মানুষ আর কবিতা পড়বে না।
সত্যিই এক ডিসটোপিয়ায় হাঁসফাঁস করছি।অসম্ভব মন ছুয়ে গেল।
খুব সুন্দর ও যথার্থ আলোচনা,,,,দরকার ছিল,,
চমৎকার এক আলোচনা। ডিসটোপিয়া শব্দটি ব্যবহার না করলেও হিন্দোল যেমন অভ্রান্তভাবে বলেছেন – “কবি জানেন, কী ভয়ংকর গরল আমাদের মধ্যে। কী ভয়ংকর দুঃস্বপ্নের বিষ আমাদের বিষাক্ত করে দিচ্ছে আর আমরা সেই বিষ ঢেলে দিচ্ছি আমাদের নিজেদের মধ্যেই। যেন অভিশপ্ত পতঙ্গ। যেন আমরা নিজেরাই জানি না কীভাবে মৃত্যু আমাদের তাড়া করছে। কীভাবে প্রতিটি অনিশ্চয়তার মধ্যে আমরা শুয়ে পড়ছি একে অপরকে শত্রু ভেবে নিয়ে।” – এ পরম এক সত্য। সত্য হবার গুণেই লেখাটি উজ্জ্বল।
কিন্তু এরপরে কথা থাকে। শুধু বাম নকশাল পুঁজিবাদের উচ্চারণে বিষয়টি শেষ হয়ে যায়না। আজ বিশ্বপুঁজি চাইছে minimum state, maximum governance কিংবা রাষ্ট্র হবে কর্পোরেট পুঁজির বাহক। এখানে একটা সংকট তৈরি হয় গণতন্ত্রের ধারণা আর অতিরাষ্ট্রের মাঝে। সমস্ত স্বাধীন সংস্থা এবং নাগরিক পরিসরকে গিলে নিতে চায়। করে তোলে রাষ্ট্রের প্রসারিত শাখা, অন্য অনেক শাখার মতো। রাষ্ট্র এবং রাজনৈতিক দল একীভূত হয়ে যায়।
এ এক ভয়ানক দুঃস্বপ্নের কাল। শাম্বর মতো গলিভূত যাপন কাল।
দৈহিক লাশ হয়ে যাবার চাইতেও মারাত্মক গোটা দেশের একটু একটু করে আত্মিক লাশ হয়ে ওঠা।
এসময়ে কি আবার ভুতুম ভগবানের রেজারেকশন হবে? কবিতার বহমানতা, আত্মা বেঁচে থাকবে? নাকি ভুতুম ভগবান লাশ হয়ে স্মারক হিসেবে থাকবে?
রাত কত হইল? উত্তর ম্যালে না!
অসম্ভব সুন্দর আলোচনা। দারুণ।
খুব ভালো লাগল। কবিতাটিও বড্ড প্রিয়। জয় গোস্বামীর “জনপ্রিয়” কবিতাগুলির বাইরেই ওঁর সব থেকে ভালো কবিতাগুলি আছে। ভুতুম ভগবান, হরিণের জন্য একক অসাধারণ। আলোচনাটি খুব ভাল লাগল।
চমৎকার আলোচনা। এইরকম একটি কবিতা নিয়ে আলোচনা হলে বাস্তবিকই কবিতাটির গভীরে অনেকদূর যাওয়া যায়।
ভয়ংকর সুন্দর হয়েছে আলোচনাটি।
খুব ভালো লেখা. Joy Goswami r কবিতা uplabdhi te sahazya karbe.
খুব সুন্দর আলোচনা করলেন।