জেগে আছ, রান্নাঘর?
তৃষ্ণা বসাক
একরকম হাওয়া দ্যায় এই রাস্তাটায়। মনে হয় ঋতু বদলাচ্ছে। বেড়ালছানাগুলো কিছু বোঝে না , খালি ছটফট করে। মাজাভাঙ্গা পলাশ গাছটায় লাফ দিয়ে উঠতে চায় ওরা। এই পলাশ গাছে কোনদিন ফুল ফুটবে না, ওরা জানে।
কাঁঠাল গাছটা ছেঁটে দেওয়া হয়েছে। একটা রিকশাওলা কপালের ঘাম মুছতে মুছতে ডালপালাগুলো রিকশায় তুলছে। ওর খুব খিদে পেয়েছে। বাড়ি ফিরেই খেতে পাবে জানে। এখন বউয়ের কোন কাজ নেই। কাজের বাড়িগুলো সব ছেড়ে গেছে। মাগি বাড়িতে বসে কিছু চেষ্টা করতে পারে তো, করবে না। খালি ঘুমোবে। সে নাকি অনেকদিন ঘুমোয়নি।
ঘুম, ঘুম হতে পারে আজকের গল্পের বিষয়। মানুষ কীভাবে ঘুমোয়? ঘুমিয়ে মানুষ কী পায়?
বেড়ালছানাগুলো অস্থির। ‘এই জীবন লইয়া কী করিতে হয়? এই জীবন লইয়া কী করিব?’
ওরা তো কাঁঠালপাতা হাতে হাতে তুলে দিতে পারত রিকশায়। কয়েকটা চেখে দেখতে পারত, কিছুই করবে না। কাজে লাগে এমন কোন জিনিসে ওদের আগ্রহ নেই। হয়তো কয়েক মুহুর্ত পরেই ওরা থাকবে না। তিনটের মধ্যে দুটো তো থাকবেই না, এ কথা হলফ করে বলাই যায়। মা দুধ খাওয়ানোর আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে, রাস্তা পার হতে গিয়ে গাড়ি চাপা পড়বে। আরও অনেক রকম মৃত্যু আছে নিশ্চয়। কিন্তু বেশিরভাগ বেড়ালছানারাই এই দুভাবে মারা যায়। দুধ না পেয়ে আর গাড়ি চাপা পড়ে।
তাতেও ওদের কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। শেষ কয়েক মুহূর্ত ওরা পলাশ গাছে ওঠার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ওদের দেখে কাঁঠালের ডাল কাটতে গিয়ে লোকটা বারবার শ্লথ হয়ে পড়ছে। কী হবে এসব করে? এত জ্বালানি নিয়ে গিয়ে করবেটা কী?
কেমন একরকম হাওয়া দ্যায় এই সময় রাস্তায় দাঁড়ালে। ওদিকে ওই রক্তকরবী গাছের ওপর দিয়ে আসে হাওয়াটা। মেহগনি গাছের পাশে একটু দাঁড়ায়, তারপর কদমের ঘ্রাণ নিয়ে আবার একটু এগিয়ে যায়। ঋতু বদলাচ্ছে নাকি?
কদমগাছের তলায় একটা লোক জিরোচ্ছে। মুখোশ বিক্রি করে সে। আজ কিছু বিক্রি হয়নি। এ পাড়ায় সবাই মুখোশ কিনে ফেলেছে। মুখোশ কি আর রোজ রোজ কেনে কেউ? অনেকে তো রুমাল বেঁধেও বেরিয়ে পড়ছে। লোকটার নাকে কদমের ঘ্রাণ এল। সে চমকে গেল। তার বউয়ের নাম কদম ছিল বুঝি। ফুলের শখ ছিল তার। সে চলে গেছে বহুদিন। কিন্তু ঘ্রাণ রয়ে গেছে।
তারপর ধরো ওই রান্নাঘরটার কথা। ওই রান্নাঘরটা, বুঝতে পারি ও বাড়ির নার্ভ সেন্টার। কে যে কখন এসে রাঁধছে, বোঝাই মুশকিল। একজন রাঁধছে, আরেকজন ঘাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছে রাঁধবে বলে। বাচ্চারা ঢুকছে, বেরোচ্ছে, যেন এটা খেলার জায়গা। তবে অনেক চিন্তা আর চর্চার জায়গা তো বটেই।
যেমন কুমড়ো কী কী ভাবে খাওয়া যায়?
চিংড়ি দিয়ে অবশ্যই। সঙ্গে পুঁইডাঁটা আর বেগুন। ছোলা দিয়ে ছক্কা। নিরামিষের দিন ডালের সঙ্গে ভাজা। দেখা গেল ও বাড়ির সবাই কুমড়ো খেতে ভালবাসে। কিন্তু একেকজন একেকভাবে। দেখা গেল ও বাড়ির সবাই কুমড়ো খেতে ভালবাসে না। বাধ্য হয়ে খায়। একেকজন একেকভাবে।
তারপর ধরা যাক ফ্রিজ। সেটা খারাপ হয়েছে। অনেকটা মাংস ফেলে দিতে হল। ভাবা যায়, মাংস!
তারপর, ডাল ভেজানো হয়েছে? এখনো হয়নি? রোদ উঠেছিল বেশ। হ্যাঁ আবার সবাই খেয়াল করে, রোদ ওঠে কিন্তু এখনো এ পাড়ায়। দেশ বা পৃথিবীর কথা না বলাই ভালো। পাড়াময় রোদ ওঠে বড়ি শুকোনোর মতো, জামাকাপড় এবং মুখোশ শুকোনোর মতো। সুতরাং ডাল ভেজানো হয়নি এখনো? চলতেই থাকে…
এর মধ্যে কারো কারো জন্মদিন আসে। দুধ রাখা হয় অনেকটা। দুধ ঘন করা হয়। তাতে গোবিন্দভোগ চাল, কাজু, কিসমিস, ছোট এলাচ। নামাবার আগে একটু ঘি। সব রান্না শেষ হবার পর গ্যাস মুছে পায়েস। একটা নিরামিষ গ্যাস আভেন কেনার সংকল্প হয়। না, নিরামিষ আভেন বাজারে কিনতে পাওয়া যায় না। তাকে প্রতিদিন ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে নিরামিষ করে নিতে হয়। তবেই সে নিরামিষ আভেনের মান্যতা পায়।
ঠাকুরের ভোগ। হ্যাঁ বাবা লোকনাথ। রাস রথ জন্মাষ্টমী। সবই আছে। ষষ্ঠীগুলোও ধরতে হবে। নিরামিষ একটা আভেন হলে…
মানে স্বপ্ন। এখানে স্বপ্ন বোনা হয়। খেদ আক্ষেপ আছে। এই ডিম ফুরিয়ে যায়, এই ডাল ভেজানো হয় না। সংশয়ও। এই ডিম আছে না কি রে?
আবার বাগানে গিয়ে সাবধানে কলাপাতা কেটে আনা হয় দল বেঁধে। দলীয় ঝান্ডার মতো উঁচু করে তুলে রান্নাঘরকে দেখানো হয় ‘চলবে?’
রান্নাঘর দেখে। রান্নাঘরের খুন্তি নাড়া থেমে যায়। রান্নাঘর ভাবে জানলার ওপারে যেমন রোদ ওঠে, তেমনি কলাপাতা ফোটে। ফিকে সবুজ আরাম রঙের।
কাঁঠালপাতার রঙ কিন্তু গাঢ় সবুজ। একটু কালোও যেন মিশে আছে। একটু রক্তও। আমি দেখেছি হাঁড়িকাঠের কাছে অনেক কাঁঠালপাতা পড়ে থাকে। রিক্সাওলা একমনে কাঁঠালের ডাল ভাঙছে। কদমতলায় বসে মুখোশওলা কী যেন ঘ্রাণ নিচ্ছে। এমন সময় বৃষ্টি এল। বেড়ালরা ছুটে পালাল। মানুষের জায়গা হল না কোথাও। তারা ভিজল আর ভিজল।
বৃষ্টি পড়ল। সারা দুপুর ধরেই বৃষ্টি পড়ল। আর কিছু হল না। একটু শরীর হল খালি। শরীর শরীর। চিকেনের ম্যারিনেটের গন্ধ লেগে ছিল নখে। খাওয়ার আশ্লেষ লেগে ছিল ত্বকে। চকচকে মাছের আঁশের মতো, রুপালি ইলিশের মতো চামড়া জেল্লা দিচ্ছিল। ইলিশের ডিমভরা পেটির মত বউটা সোহাগ চাইছিল। ভাত খেয়ে ঘুমোতে গেলে যেমন হয়। ভাত ভাত। সাদা ! ভাত সবসময় সাদা হয় না। বাদামি চালও হয়। ব্রাউন রাইস। কালো হয়। কালো নুনিয়া। লাল চাল মানে ঢেঁকিছাটা লাল চাল! কুলতলিতে একবার এক মাকে ছেলের রক্ত দিয়ে ভাত খাইয়েছিল। সেই ভাতের রঙ লাল ছিল। তবে খেতে পারেনি।
ঘুম থেকে উঠে বউটা দেখল সুপারস্টার পরিবার হচ্ছে। চার ভাই, পাঁচ মাস স্টেজ শো নেই তাদের, বাহারি পাঞ্জাবি পরে হাসছে আর বেলুন ফাটাচ্ছে। বেলুন ফাটাচ্ছে আর হাসছে। মাঝে মাঝে তাদের এক সুন্দরী পুতুলের দাঁতের মধ্যে দাঁড়িয়ে খুব এলেবেলে প্রশ্নের উত্তর দিতে হচ্ছে।অনেক কিছু উপহার ছিল সাজানো। ওরা কেবল কুড়ি কেজি চাল আর কুড়ি কেজি তেল নিল। হেয়ার ড্রায়ার, কফি মেকার, স্যান্ডুইচ মেকার, মিক্সি, এয়ার কুলার কিচ্ছু না! স্রেফ চাল আর তেল!
কোন মানে হয়! হাই তুলে বউটা ভাবছিল। বারান্দাটা বৃষ্টির ন্যাওটা হয়ে পড়েছে এক দুপুরেই। হাওয়ায় যেসব মাধবীফুল উড়ে এসেছিল, সেগুলো ভিজে শুয়ে আছে এখানে ওখানে। হাঁটতে গেলে মাড়িয়ে দিতে হয়। বউটা চায়ের কাপ হাতে দেখল সেই লোকটা এখন কাঁঠাল গাছের ডাল কেটে গুছিয়ে তুলছে রিকশায়। বাড়ি যায়নি? নাকি গিয়ে রেখে এসেছে এক চালান কাঠকুটো? বৃষ্টি থামলে আবার এসেছে? বড্ড বৃষ্টি পড়ে আজকাল। অবশ্য কোথাও যাওয়ার নেই, এই পাড়াটার বাইরে পৃথিবী যেন ফুরিয়ে এসেছে। কদম গাছের তলায় মুখোশওলা ঘুমোচ্ছে। ভিজে গেছে । ওর মুখোশগুলোও সমস্ত ভিজে গেছে।
আরও বৃষ্টি, আরও আরও। অথচ সেই রান্নাঘর খিচুড়ির আয়োজন করল না, কি আশ্চর্য। বরং বলছে কয়েকটা চিংড়ি চিচিঙ্গেতে দিয়ে দাও। ওই রান্নাঘরের জানলায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টির মন খারাপ হল। সে অন্য কিছু আশা করেছিল। আমাদের সবার আশা থাকে, খেয়াল করি না অনেকসময়, রাস্তায় যে জল জমে তারও একরকম আশা থাকে।
যে কাঠঠোকরাটি ভিজে কাঠ দেখে বিরক্ত হল, তারও আশা কাল সে শুখনো কাঠ পাবে।
‘আমার কী আশা?’ মুখোশওলা ভাবছিল। কোনটা ঠিক আশা? তার সব মুখোশ বিক্রি হয়ে যাক নাকি মুখোশের প্রয়োজনই হয় না যেন কারো? তার বাড়িতে কে কে আছে মনে পড়ছিল না তার। বাড়ি দুপুরে যায়নি কেন মনে পড়ছিল না। বৌ নেই বলে না সেই আজকাল নেই হয়ে গেছে?
সব ডাল কাটা হয়ে গেছে। রিকশা চলে কাঁঠালগাছের ডাল পাতা নিয়ে।
মনে হয় এখানে আমার জন্ম রয়ে গেছে। অনেক গুলো জন্ম। ঘাস জন্ম, পোকা জন্ম, মাটি জন্ম। তারপর সেই মাটি থেকে বৃক্ষ হল। বৃক্ষ ছায়া দিল।
ছায়া পড়ে মুখোশওলার মুখে। শেষ বিকেলের ছায়া। সে সমস্ত ভিজে মুখোশ গুছিয়ে চলে যাওয়ার আগে একবার রান্নাঘরটার দিকে শেষবারের মতো তাকায়। ওখানে কি চা ছাঁকা হচ্ছে এখন?