বহুযুগের ওপার থেকে একটি দেখা <br /> সন্দীপন চক্রবর্তী

বহুযুগের ওপার থেকে একটি দেখা
সন্দীপন চক্রবর্তী

সেসব কথা বলবো কেমন করে? ভাষা কি আছে আমার? বাক্সটা টেনে নিয়ে, বসবো কি বসবো না করছি। আচমকা খুলে গেল বাক্স — স্মৃতির ঝাঁপি। সে অনেক অনেক রামধনু আর রংবেরঙের পাথর। একে একে বেরিয়ে আসছে। পাথরগুলোর বুকে রামধনুর আলো পড়ে ঠিকরে উঠছে, ঝিলমিল করছে। আর ছোট্ট একটা পাখি শিস দিচ্ছে একটানা। ঠোঁটে করে একটা-দুটো পাথর রেখে যাচ্ছে আমার জানলায়। তার ডাক শুনে, বন্ধু-পাখিরাও সব ডেকে উঠছে নানা সুরে। আর সেই সমবেত অর্কেস্ট্রা, সেই সুরের ঝর্ণা, উঠে যাচ্ছে আলোর দিকে। উঠছে, আর উঠে ঝরে পড়ছে। উলালা! উলালা!!
*************************
১. ইয়ে হ্যায় মেরি জিন্দেগী
তখন জীবন ছিল কাকচক্ষু জল। তখনও হৃদয়পুরে বেজে ওঠেনি জটিলতার খেলা। তখনও কলুষ স্পর্শ করতে পারেনি আমাদের। কিন্তু বাবা হেবি চাপ দিতো। খাওয়া, চান করা, বাথরুমে যাওয়া আর ঘুম — এর বাইরে সারাক্ষণ পড়া করো। কেন? কেননা ভালো কোনো সরকারি স্কুলে ভর্তির চান্স পেতে হবে। তখনও এরকম ব্যাঙের ছাতার মতো প্রত্যেক গলিতে গজিয়ে ওঠেনি ইংলিশ মিডিয়াম। পাতি বাঙালি মধ্যবিত্তের জন্য ভালো স্কুল বলতে, মূলত সরকারি স্কুলগুলোই ছিলো ভরসা! কিন্তু আমার জন্য সে ঠাঁইও সোজা ছিলো না। যাদের বাবা বা মা সরাসরি রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারী, অলিখিতভাবে তারা ভর্তির জন্য খানিক অগ্রাধিকার পেতো। সে কপাল করেও আসিনি। ফলে পুরো ‘লড়কে লেঙ্গে হিন্দুস্তান’ ভঙ্গি নিয়ে বাবা রেডি করছিলো আমায়।
কী ভয়াবহ সব প্রশ্নবাণ! একটা ছ’বছরের বাচ্চা সামলাবে কী করে!! পরীক্ষকেরা মাথা খাটিয়ে বের করতেন, নিয়ম মেনেও কতরকম প্যাঁচে ফেলা যায় বাচ্চাদের। নিয়ম ছিল যে ক্লাস ওয়ানে ভর্তির পরীক্ষায় লেখা বা পড়ার ক্ষেত্রে যুক্তাক্ষর দেওয়া যাবে না। অংক করতে দিলে দু’অংকের সংখ্যার যোগবিয়োগের বেশি কিছু দিতে পারবে না। কিন্তু কী প্রতিভাধর সব পরীক্ষক! একটা সরকারি স্কুলে পরীক্ষা দিতে গিয়ে ডিক্টেশন পেয়েছিলাম — ‘নিপীড়ক ভূপতির পারিষদেরা বিদূষকের সরস কৌতুকে সবিশেষ পুলকিত হইলেন…’। হ্যাঁ, একটাও যুক্তাক্ষর নেই। কিন্তু হ্রস্ব ই, দীর্ঘ ঈ, হ্রস্ব উ, দীর্ঘ ঊ, তিনরকম শ, স, ষ, দুরকম ন, ণ — এর সবকিছুর চূড়ান্ত প্যাঁচ প্রয়োগ করে ছিলো সেই ডিক্টেশন। বা আমাদের ভর্তির আগের বছরে একটি সরকারি স্কুলে অংকের প্রশ্নে এসেছিলো — ‘তোমাকে দুই অংকের এমন একটি সংখ্যা লিখিতে দেওয়া হইল, যাহার এককের ঘরের সংখ্যাটি সবচেয়ে ছোট এবং দশকের ঘরের সংখ্যাটি সবচেয়ে বড়। অথচ তুমি ভুল করিয়া যে সংখ্যাটি লিখিলে, তাহার এককের ঘরের সংখ্যাটি সবচেয়ে বড় এবং দশকের ঘরের সংখ্যাটি সবচেয়ে ছোট। তোমাকে যাহা লিখিতে বলা হইয়াছিল এবং তুমি যাহা লিখিলে, তাহার বিয়োগফল কত?’ আসলে ব্যাপারটা খুবই সহজ — ৯১ থেকে ১৯ বিয়োগ করা; কিন্তু সেটাকে এমন ভাষায় বলা হলো, যার মর্মোদ্ধার করতে কোনো প্রাপ্তবয়স্ক লোকেরও কালঘাম ছুটে যাবে। আমাদের স্কুলে এতটা বাড়াবাড়ি না করলেও খুব যে পিছিয়ে ছিলো, এমনটাও নয়! আমাদের ভর্তির সময়েই একজনকে ইন্টারভিউতে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল ‘ভারতের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহের নাম কি?’ এবং তার থেকেও আশ্চর্যের যে, তার মা ছেলেকে সেটাও শিখিয়ে রেখেছিলেন। ছেলেটির মনে না থাকায় সে বলেছিল যে ‘মা কী যেন একটা বলেছিল…ভটভট না কী যেন একটা…’। ‘আর্যভট্ট’ নামটা তার মনে পড়েনি। বা আরেক বন্ধুকে (সম্ভবত অনির্বান মৈত্র। নাকি ভুল বলছি?) জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল — ‘প্রধানমন্ত্রীর কাজ কী?’ সে বেশ স্মার্টভাবেই উত্তর দিয়েছিল — ‘হেলিকপ্টারে করে ঘুরে ঘুরে বেড়ানো আর সব দেখা’। আমায় যেমন এটা সেটা জিজ্ঞাসার পর জানতে চাওয়া হয় ‘এটা কোন মাস?’ ইংরেজি মাসের নাম বলতেই পরের প্রশ্ন — ‘আর বাংলায় কোন মাস?’ আন্দাজে দিলাম ঠুকে — ‘পৌষমাস’। লেগে গেল বাইচান্স। আর কী অদ্ভুত! কিছুদিন পরই দেখা গেল চিচিং ফাঁক…খুলে গেছে দরজা…

২. মরুভূমির জাহাজ
না, কোনো উটের কথা বলতে বসিনি। একেবারে প্রথম প্রথম, বালি থইথই বিডি ব্লকের মাঠটার মধ্যে দিয়ে স্কুলের দিকে ঢুকতে গেলেই, মনে হতো — মরুভূমির মধ্যে যেন সত্যি একটা জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে। ওদিক থেকে দেখলে, বাড়িটার গড়নই ছিলো ওইরকম। তা প্রথম দু-একটা সপ্তাহ আমি যেতে পারিনি স্কুলে। বোধহয় শরীর খারাপ ছিলো, বা মন।
তখন আমরা থাকতাম নিউবারাকপুরে। সেখানেই, ‘আলোকতীর্থ’ নামে একটা প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলো বাবা। বেড়ার ঘর, টিনের ছাদ। কিন্তু ভারি মায়াময়! আর কে.জি. ক্লাসে বেশ ভালো রেজাল্ট করতাম। ফলে সেখানে ছিলো অগাধ প্রশ্রয়। এসব ছেড়ে কেউ ওই ধু ধু বালির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা, অচেনা লোকজনে ভরা, নতুন একটা স্কুলে আসতে চায় নাকি? পাগল! কিন্তু কে আর শুনবে তার কথা? ফলে আসতেই হলো। আর তারপর থেকেই জীবনের বারোটা বছর বাঁধা পড়ে গেল সেখানে।
প্রথম যেদিন বাবা আর মা হাত ধরে পৌঁছে দিয়েছিলো স্কুলের গেটে, আর আমার সমস্ত ভয় অস্বস্তি জড়তায় কান্না ঠেলে উঠছিলো শুধু, উঠে আসছিলো নিষ্ফল এক প্রতিরোধ আর অভিমান, তখন নিজের থেকেই অচেনার পাঁচিল ভেঙে ‘আয় আয়, কোনো ভয় নেই’ বলে আমার হাত ধরে টানতে টানতে ক্লাসে নিয়ে গেছিলো যে ছেলেটি, সে আমাদেরই ক্লাসের। তার আসল নাম ‘গেছো’। যদিও তখন সে তার পরিচয় দিয়েছিলো অরিজিৎ মুখার্জি নামেই। বিডি স্কুলে আমার প্রথম বন্ধু।
আর নিউবারাকপুর ছেড়ে, কিছুদিনের মধ্যেই, আমরাও উঠে এলাম সল্টলেকে, করুণাময়ীতে। দেশলাই বাক্সের মতো ছোট্ট দুই কামরার ফ্ল্যাটে।

৩. শান্ত শিষ্ট লেজবিশিষ্ট
টেনে হিঁচড়ে কোনোমতে ঘুম থেকে তুলেই, স্কুলের জন্য রেডি করতো মা। আর স্কুল তো অপার বিচ্ছুমির জায়গা। তবে বাঘের মতো ভয় পেতাম রীনাদিকে। আর আরেকটু বড় হয়ে, মারাত্মক ভয় পেতাম হরপ্রসাদ স্যার আর দিলীপ স্যারকে। দিলীপ স্যারের স্পেশাল শাস্তি ছিল জুলপি ধরে টানা। তবে আমাদের হেডস্যার — সত্যেনবাবু — দু’একদিন মর্নিং সেকশনে ঢুকলেই, সেই বয়সেও, আমরা বেশ সম্ভ্রমমিশ্রিত চোখে দূর থেকে অবাক হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম। খুব বয়স্কা এক দিদিমণি (নাকি তখনকার চোখে আসল বয়সের চেয়েও বয়স্ক লাগতো?) পড়াতেন আমাদের — লগনদি। ছবি আঁকা শেখাতেন দীপ্তিদি। আরেকজন ছিলেন আমার সবচেয়ে প্রিয় — মিলন স্যার। ছিপছিপে আর ঝকঝকে চেহারা। সবসময়ে হাসিমুখ।
নিউবারাকপুর ছেড়ে এলেও, তখন শুক্রবার স্কুল সেরেই, মা আমায় নিয়ে সোজা চলে যেত নিউবারাকপুরে। বাবাও কলেজ সেরে সোজা পৌঁছে যেত ওখানে। আর ফিরতাম সেই রবিবার সন্ধ্যেবেলা। ছেলেমেয়েদের নিতে আসা মায়েদেরও আড্ডার একটা বড় দল ছিল। শুক্রবার আমরাও দিব্যি স্কুল থেকে বেরিয়ে, মায়েদের সঙ্গে হাঁটা দিতাম। এডি ব্লকের মধ্যে দিয়ে গিয়ে, ফুটব্রিজ পেরিয়ে, লেকটাউনে গিয়ে বাস ধরা। আর সেই পথে মাঝেমাঝেই দেখা হয়ে যেত মিলনস্যারের সঙ্গে। আমাদের সঙ্গে থাকতো টুং (অনির্বান রায়), রীতেশ, রণজয় আর ওদের মায়েরাও। এভাবেই মর্নিং সেকশনে কখন যেন আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু হয়ে উঠলো টুং। ক্লাস ফাইভে উঠলাম যখন, তখন আর দেখে কে! তখন তো আমরা গোটা মর্নিং সেকশনের দাদা। কীভাবে ফলানো যায় এই দাদাগিরি? আমি আর টুং মাঝেমাঝেই টিফিনের সময়ে, দৌড়াদৌড়ি করা নিচের ক্লাসের ছাত্রদের ধমকে দাঁড় করিয়ে, তাদের নাম আর ক্লাস জিজ্ঞাসা করতাম। তারা তাতে বেশ ঘাবড়ে যেত। এই ছিল আমাদের দাদাগিরি দেখানোর ধরণ।
এতটাই শান্ত ছিলাম তখন, যে ক্লাস থ্রি-তে পড়ার সময়েই একবার গার্জিয়ান কল হয়েছিল। বড়দির সঙ্গে দেখা করতে এসেছে মা। কথা বলছে। স্নেহমিশ্রিত ঠাট্টা করেই, বড়দি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন — এরপর এমন দুষ্টুমি করলে কিন্তু আমার ঘরে এনে, ওই আলমারিটার মাথায় তুলে বসিয়ে দেবো, আর নামতে পারবে না। আলমারিটার দিকে তাকিয়ে, একটু ভেবে, আমিও স্মার্ট উত্তর দিলাম — আমি আলমারির মাথা থেকে লাফ দিয়ে নেমে পড়বো। তারপর দৌড়ে ক্লাসে চলে যাবো। এই অসাধারণ উত্তরের জন্য, কোথায় মা তার ছেলেকে বাহবা দেবে! তা না, মা ঘর থেকে বেরিয়েই আমার পিঠে বসিয়ে দিল কয়েক ঘা।
সেটা ক্লাস ওয়ান? নাকি টু? ঠিক মনে নেই। একদিন দুটো ক্লাসের মাঝের সময়টায়, জানলায় উঠেছি বাহাদুরি দেখানোর জন্য। আচমকা রীতেশ এসে, পা ধরে মারলো হ্যাঁচকা টান। সামলাতে না পেরে, সোজা মুখ থুবড়ে পড়লাম মেঝেতে। রক্তারক্তি। রক্ত আর থামেই না। দিদিমণিরা সব ছুটে এলেন। ছুটির তখনও দেরি। আমার মনে আছে, দিদিরাও সহ্য করতে পারছেন না সেই দৃশ্য। সরে যাচ্ছেন সামনে থেকে। দূরে দাঁড়িয়ে অসহায় তাকিয়ে আছেন লগনদি। হাপুস নয়নে সমানে কেঁদে চলেছেন দীপ্তিদি। আর সবচেয়ে ডাকাবুকো যে রীনাদি, তিনিও আমার দিকে তাকাতে পারছেন না। আমায় কোলে নিয়ে, আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে আছেন। স্কুলের সাদা শার্ট পুরো রক্তে ভিজে লাল।
অনেক পরে মা এসেই শোনে এই কাণ্ড। ক্লাসের ছেলেরা সবাই মিলে, কালপ্রিটকে এনে হাজির করলো মা’র সামনে — এই যে কাকিমা, ও করেছে। ও সন্দীপনকে ফেলে দিয়েছে। আর সেই উত্তেজিত বৃত্তের মধ্যে, গণধোলাই খাওয়ার আগমুহূর্তে ধরা-পড়া চোরের যেমন অবস্থা হয়, প্রায় সেইরকম মুখ করে দাঁড়িয়ে রীতেশ। মা বললো — ও তো ইচ্ছে করে করেনি। ও আসলে বুঝতে পারেনি। ওকে ছেড়ে দে। হতাশ হয়ে ফিরে এলো বন্ধুরা। কিন্তু মা আমায় নিয়ে তখন কী করবে? সদ্য নতুন সল্টলেকে এসেছি। কোনো ডাক্তারও চেনা নেই। বাবাও নেই বাড়িতে। এমন সময়ে, আমাদের উপরের ক্লাসে পড়া একটি ছেলের বাবা এগিয়ে এলেন সাহায্যে। তারাও থাকেন করুণাময়ী। স্কুল যাতায়াতের পথে সামান্য আলাপ। আমায় নিয়ে গেলেন ডাক্তারের কাছে। থুতনিতে তিনটে সেলাই পড়লো। স্কুলফেরত ছেলেসহ রইলেন পুরোটা সময়। তখনও প্রবল কান্নাকাটি চলছে আমার। সেলাইপর্ব সাঙ্গ হতেই দেখি, তিনি আমায় ভোলাবার জন্য, কিনে নিয়ে এসেছেন রসগোল্লা। শেষ পর্যন্ত সেই রসগোল্লা দেখে আর খেয়ে, কান্না থামলো আমার। আর সেই থেকেই আমাদের পারিবারিক বন্ধু হয়ে গেলেন ওনারা। আমাদের থেকে এক ক্লাস উপরে পড়লেও, তাঁর ছেলে বুবাই (অনির্বান মুখার্জি) হয়ে উঠলো আমার প্রাণের বন্ধু। অবশ্য গোটা স্কুলে কেউ তাকে অনির্বান মুখার্জি নামে চেনে না। সে বিখ্যাত ছিল ‘খেঁদু’ নামে।

৪. পৃথিবী হাজারদুয়ারী
ছিলাম রুমাল, হয়ে গেলাম বেড়াল। ছিলাম সবচেয়ে উঁচু ক্লাস, হয়ে গেলাম সবচেয়ে নিচু ক্লাস। ফাইভ থেকে সিক্স। মর্নিং সেকশন থেকে ডে সেকশন। পুরো নতুন পৃথিবী, হাজারদুয়ারী। এইসময়েই হাতেখড়ি হলো বখাটেপনায়। শিখতে শুরু করলাম যৌনতার গোপন সব রহস্য আর সুড়সুড়ি। ক্লাস সেভেন থেকে শুরু হলো একা একা স্কুল যাতায়াত। শিখে গেলাম সিগারেট খেতে, পর্নোগ্রাফি দেখতে। বাসের পাদানিতে ঝুলে ঝুলে আসতে। টিকিট ফাঁকি দিয়ে কীভাবে বাসে আসতে হয়, সেইসব। এতদিন যেন শীতঘুমে ছিলাম। ক্লাস সিক্সেই বসন্ত এসে স্পর্শ করে গেলো আমাদের। প্রাণের বন্ধু টুং চলে গেল অন্য সেকশনে। ক্লাস সিক্স থেকে নাইন — প্রত্যেকটা ধাপেই সেকশন পাল্টাতে থাকলো আমার। ফলে এই সময়ে গড়ে উঠলো না তেমন স্থায়ী বা অচ্ছেদ্য কোনো বন্ধুত্ব। আর ক্লাস নাইনে এসে, আমায় বসিয়ে দেওয়া হল এক ঝাঁক ভালো ছেলেপুলের সঙ্গে। ভাগ্যিস, তার মধ্যে ছিল টুং-ও একজন, নাহলে দমবন্ধ হয়ে মরে যেত আমার মতো বখাটে। ক্লাস সেভেনে যাদের মধ্যে বসতাম, স্কুল চলাকালীন তাদের বিনোদন বলতে ছিলো পরস্পরের হস্তমৈথুন করা বা লুকিয়ে লুকিয়ে পর্নোগ্রাফি পড়া। আর ক্লাস নাইনে যাদের মধ্যে যাদের মধ্যে এসে পড়লাম, তাদের বিনোদন বলতে ম্যাপ পয়েন্টিং, গোটা ম্যাপ দিয়ে তার মধ্যে খুব খুদে খুদে অক্ষরে লেখা কোনো জায়গার নাম খুঁজে বের করা, সাহিত্য নিয়ে আলোচনা, নানাধরণের সাধারণ জ্ঞানের প্রশ্ন বা ক্যুইজ ইত্যাদি। এ যেন গ্রীষ্মের থর মরুভূমি থেকে তুলে এনে পুরো শীতের গুলমার্গে বসিয়ে দেওয়া! খাপ খাইয়ে নিতে হলো তাতেও।
এই ক্লাস নাইনেই, রীতেশ একদিন ঠিক করলো যে অনন্যাকে প্রপোজ করবে। তখন টিফিন পিরিয়ডে শুধু মেয়েদেরই ক্লাসে থাকতে দিতো, ছেলেদের থাকতে দিতো না। ফলে টিফিনের সময়টাই প্রপোজ করার জন্য আদর্শ। কায়দা করে ও সেদিন ক্লাসে থেকে গেল টিফিনের সময়ে। কিন্তু সম্ভবত কেউ অনন্যাকে আগেই জানিয়ে দিয়েছিলো রীতেশের এই মহৎ উদ্দেশ্য। এবার টিফিনের ঘন্টা বাজতেই অনন্যা ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেল টিফিন খেতে। আমরা বাইরে থেকে নজর রাখছি। সময় কাটছে। রীতেশের মুখ ক্রমশ গম্ভীর। অনন্যা ক্লাসে ফিরছে না। টিফিন শেষ হওয়ার ৫-৭ মিনিট আগে ক্লাসে ঢুকলো অনন্যা। রীতেশের মুখে বেশ একটা আলো খেলে গেল। কী হয় কী হয় উৎকণ্ঠা নিয়ে আমরা সব উঁকি মারছি বাইরে থেকে। ওই তো রীতেশ বেশ দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে অনন্যার দিকে! কিন্তু তার আগেই অনন্যা রীতেশের দিকে ঘুরে তাকালো, বলে উঠলো — ‘কী রে গণ্ডার! তুই নাকি আমাকে কী বলবি শুনলাম!’ এহেন বাক্যবাণে রীতেশের অবস্থা তখন কাহিল। দরদর করে ঘামছে। প্রায় তোতলাতে তোতলাতে বললো — ‘না, মানে, এই ক’টা বাজে জিজ্ঞেস করছিলাম’। উত্তর — ‘কেন? তোর নিজের হাতেই তো ঘড়ি আছে। ঘড়ি দেখতে জানিস না?’ রীতেশ তখন কোনোমতে পালাতে পারলে বাঁচে আর কী! তবে, অনন্যার প্রতি সবচেয়ে বড় ব্যথা ছিলো যার, সে সবদিক থেকেই ছিলো আমাদের ক্লাসের সেরা ছেলে। ছোটবেলার নানা ব্যথার কথা ভুলে, আমরা সবাই সংসারী হয়ে গেলাম। শুধু সে বাদে। আজ পর্যন্ত সে বুকে পুষে রেখেছে সেই ক্ষত।
ক্লাস নাইন থেকেই আমার বেশ বন্ধু হয়ে উঠেছিলো সপ্তর্ষি। ক্লাস টেনে উঠে সেই সপ্তর্ষি প্রবল প্রেমে পড়লো আমাদের থেকে এক ক্লাস নিচে পড়া একটি মেয়ের — সর্বানী। কাউকে দিয়ে তার কাছে সেই খবর পাঠিয়েওছিলো বোধহয়। একতলায় ক্লাস তখন আমাদের। সিঁড়ির পাশেই। একদিন তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। বারান্দা পুরো পিছল। সেটা সম্ভবত আগস্ট মাস। ক্লাস হচ্ছে না। বৃষ্টির ছাঁটে বারান্দা পেরিয়ে জল ঢুকে আসছে ক্লাসেও। সপ্তর্ষি বেশ উদাস উদাস মুখ করে তার মধ্যেই বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টির ছাঁট গায়ে মাখছে। এমনসময়ে সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে নেমে এলো সর্বানী। সপ্তর্ষির দিকেই এগিয়ে আসছে। সপ্তর্ষি পুরো বাকরুদ্ধ! এগিয়ে এসে সর্বানী হাত ধরলো সপ্তর্ষির। তারপর রাখি পরিয়ে দিলো। আর রাখির সুতোয় গিঁট বাঁধা শেষ হতে না হতেই, সপ্তর্ষি পা পিছলে দড়াম করে পড়ে গেল বারান্দায়। তার কিছুদিন পরেই স্কুলের একটা ফাংশনে সপ্তর্ষির গান গাওয়ার কথা ছিলো। সেখানে গিয়ে ও মনের দুঃখে গান গাইলো — ‘সে আমার ছোট বোন’।

৫. নামের ফেরে মানুষ ফেরে
ক্লাস সিক্সে ওঠার পর জানলাম যে, অনেক শিক্ষক শিক্ষিকারই প্রকৃত নাম ছাড়াও আরেকটি গোপন নাম আছে ছাত্রছাত্রীদের কাছে। জেনে গেলাম কার নাম ম্যাও, কার নাম বড়া (জুনিয়ার বড়া অবশ্য আমাদের সঙ্গেই পড়তো), কে ট্যাঁপা, কে বোতল, কে টেরু। একসঙ্গে ‘ঘটিবাটি’ কথাটা উচ্চারণ হতে শুনেছি আগে, এখানে এসে একসঙ্গে দেখলাম ‘ঘটু’ আর ‘নুটু’। তবে সবচেয়ে সৃজনশীল নাম ছিলো আমাদের এক শিক্ষিকার। বেঁটেখাটো চেহারা, কিন্তু জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বর। ফলে তাঁর নাম ছিলো বেঁটে বচ্চন। অবশ্য এইসব নাম জানার পথও ছিল সংকটময়। সিক্সের গোড়ার দিকেই একদিন ছুটি হয়ে গেছে, মা তখনও নিতে আসেনি আমাকে। সবাই একে একে চলে যাচ্ছে। আমি দাঁড়িয়ে আছি তো দাঁড়িয়েই আছি। হঠাৎ দেখি ম্যাও বেরোচ্ছে স্কুলের ছোট গেটটা (পার্কের দিকের গেট) দিয়ে। হঠাৎ কী মনে হলো, খানিক দূরেই অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে, আমি অবিকল বেড়ালের স্বর নকল করে ডেকে উঠলাম — ম্যাওওওও। আর কী আশ্চর্য! সেই ডাক শুনেই ম্যাও দৌড়ে এলো আমার দিকে। এসেই সপাটে এক থাপ্পড়! আর বললো — ‘আবার আমার সেই খারাপ নামটা ধরে ডাকছো!’
খুব গম্ভীর লোক ছিলো নুটু। বিরাট মিলিটারি গোঁফ। জ্যোতি বসুর মতো তাঁকেও কেউ কোনোদিন হাসতে দেখেনি। খালি তাঁর কাছে প্রাইভেটে পড়ার সুবাদে, টুং একদিন তাঁর বাড়িতে দেখেছিলো — একটা বিড়াল কী যেন দুষ্টুমি করে জানলা দিয়ে পালানোর সময়ে, নুটু তাঁর লেজ চেপে ধরেছে। এই অপার্থিব দৃশ্যের সাক্ষী থাকার জন্য, আমরা নিশ্চিত ছিলাম যে টুং-এর প্রায় স্বর্গদর্শন নিশ্চিত। প্রেয়ারের পর যখন বিভিন্ন ক্লাসের ছেলেরা (মূলত সিক্স থেকে টেন) সিঁড়ি দিয়ে উঠে ক্লাসরুমের দিকে যেতো, তখন সিঁড়ির ধারেই তীক্ষ্ণদৃষ্টি নিয়ে, প্রত্যেকের পোশাক বিচারের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতো নুটু। আমাদের স্কুল ইউনিফর্মের মধ্যেও নেভি ব্লু প্যান্টখানি যদি কারও জিন্স বা কর্ডের হতো, তাহলে তার শাস্তি ছিলো অবধারিত। এ অত্যাচার কতদিন সহ্য করা যায়! আমাদের উপরের ব্যাচের ছেলেরা একদিন প্রেয়ার-শেষে সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময়ে, খেয়াল করলো যে নুটু একটু যেন অসতর্ক। ফলে তাদেরই একজন, তিড়িং করে দিলো নুটুর গোঁফ টেনে। ফলস্বরূপ, তাদের গোটা ব্যাচকেই ছুটি পর্যন্ত, সারাদিন ধরে, প্রেয়ার গ্রাউন্ডে দাঁড় করিয়ে রাখলো নুটু।
ক্লাসের ছেলেদের মধ্যে বজ্জাতির কোনো প্ল্যান তৈরি হলে, লাস্ট বেঞ্চ থেকে প্ল্যানটা সার্কুলেট হয়ে যেত প্রথম বেঞ্চ অব্দি। ক্লাস সেভেন না এইট, মনে নেই ঠিক। বড়ুয়া স্যারের ক্লাস চলছে। লাস্ট বেঞ্চ থেকে খবর এলো যে, শেষদিক থেকে এক এক করে সব বেঞ্চের সবার জ্যামিতিবক্স মাটিতে ফেলতে হবে, আর জিজ্ঞেস করলেই বলতে হবে যে — এই জ্যামিতিবক্সটা একটু পড়ে গেলো। প্ল্যান অনুযায়ী শুরু হয়ে গেলো কাজ। ধাঁই ধাঁই ধাঁই ধাঁই করে একের পর এক জ্যামিতিবক্স মাটিতে পড়া শুরু হয়ে গেলো গোটা ক্লাস জুড়ে। উদ্ভ্রান্ত বড়া চোখ ছানাবড়া করে যাকেই জিজ্ঞাসা করে — কী হচ্ছেটা কী! সে-ই উত্তর দেয় — এই জ্যামিতিবক্সটা একটু পড়ে গেলো, স্যার। পড়াশুনো ভণ্ডুল। ‘দাঁড়া, সবাই দাঁড়া কান ধরে’। আরও মজা। ক্লাস তো গুবলেট হলো!
আমাদের ক্লাসে এসে প্রায়ই হাপুসনয়নে কান্নাকাটি করে, আমাদের নামে হেডস্যারকে (তখন অবশ্য ‘হেডু’-ই বলতাম) নালিশ করতে যেতেন লাইব্রেরিয়ান মঞ্জরীদি। বা রিক্সায় করে শুভ্রাকে নিয়ে পাঁচুস্যার যাচ্ছেন। পাশ থেকে শুধু একটা তীক্ষ্ণ আওয়াজ ভেসে এলো — ‘পাঁআআচুউউউউউউ’। তাকিয়ে দেখেন চারিদিক ভোঁ ভাঁ! অথবা নতুন এক শিক্ষিকা এসেছেন স্কুলে। আমাদের ক্লাস নেবেন। ক্লাসে একটি পায়াভাঙা চেয়ার ছিলো। ভালো চেয়ারটি সরিয়ে রেখে, সেইখানে ওই পায়াভাঙা চেয়ারটি রেখে, সন্তর্পণে তার ভাঙা পায়াটি আলগা করে লাগিয়ে রাখা হলো। তিনি আসলেন, বসলেন, দড়াম করে পড়লেন, তারপর কাঁদতে কাঁদতে হেডস্যারের কাছে নালিশ করতে চলে গেলেন। এরকম কত কাণ্ডই যে হতো! আমাদের অল্প কিছুদিনের জন্য ইংরেজি পড়াতে এসেছিলেন এক প্রবল সুন্দরী স্টাইলিশ যুবতী — লিপিকাদি। তখন বাজারে হিন্দি সিনেমার নতুন হট নায়িকা সোনাম। ফলে অবধারিতভাবেই ছাত্রদের মুখে মুখে লিপিকাদির নাম হয়ে গেল সোনাম। তবে এত বিচ্ছু হলেও, আমরা সবাই কিন্তু প্রবল ভয় পেতাম সুরমাদিকে। পড়া না পারলেই তিন-চার বার করে পুরো চ্যাপ্টার লিখে আনতে হতো যে!
শিক্ষকদের একজনই ছিলেন বেশ মাই ডিয়ার লোক — শূরস্যার। একবার স্কুলশেষে শূরস্যারের কাছেই প্রাইভেট পড়তে যাবো। তার আগে সিডি পার্কে সিগারেট টানতে গেছি। দূর থেকে দেখি শূরস্যার সাইকেল করে এদিকেই আসছেন। তাড়াতাড়ি একটা বড় গাছের পিছনে লুকিয়ে পড়লাম। সাইকেল নিয়ে সামনে দিয়েই বেরিয়ে গেলেন শূরস্যার। গাছের পিছন থেকে বেরিয়ে এসে, বেশ আরাম করে সিগারেট টানতে টানতে সামনের গলিটার মুখে গিয়ে সিগারেটটা ফেলেছি। দেখি শূরস্যার সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে। খুব শান্ত মুখে, পকেট থেকে দুটো লজেন্স বের করে বললেন — ‘এটা খেয়ে নে, গন্ধ চলে যাবে’। এই শূরস্যারকেই একদিন মজা করে বলেছিলাম — ‘আপনাকে নাকি একদিন পাঁচুবাবু ডেকেছিলেন ও শূর ও শূর বলে। আপনি সাড়া দেননি। আর তারপর হেডস্যার এই শূর এই শূর বলে ডাকতেই নাকি সাড়া দেন?’ শুনে সে কী হাসি — ‘আমাকে তো ওরকমই দেখতে রে! অসুর বললে রাগ করবো কেন?’

৬. যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙলো ঝড়ে
ক্লাস টেনের টেস্ট হয়ে যাওয়ার পরপরই, কিছু ঘটনা প্রায় বিস্ফোরণ হয়ে আছড়ে পড়লো আমার উপর, চিরস্থায়ী প্রভাব রেখে গেলো আমার জীবনে। পাল্টে দিলো আমার জীবনের গতিপথটাই। কিছু জনপ্রিয় গল্প বা উপন্যাসের বাইরে, আর কোনো সাহিত্য পড়ারই খুব একটা গরজ ছিলো না আমার। মূলত হিন্দি গান শুনতাম। টেষ্টের পর একদিন মোটা মৈনাকের বাড়িতে আড্ডা মারতে গেছি দুপুরে। শুনলাম সদ্য নতুন বেরোনো একটি ক্যাসেট – ‘তোমাকে চাই’। সুমন। নেশাগ্রস্তের মতো যেন টলছি। ওর কাছ থেকে চেয়ে এনে, সেদিনই অন্তত আরও বার দশেক শুনলাম পুরো ক্যাসেটটা। গান নিয়ে আমার এতদিনের জানা পুরো জগৎটা যেন এক ফুঁয়ে উড়ে যাচ্ছে। জন্ম নিচ্ছে এক নতুন স্থাপত্য। এরপর অনেকগুলো বছর – ক্যাসেট-যুগের প্রায় শেষ পর্যন্ত – জীবনের এক অনিবার্য ও অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠবেন সুমন।
এরকমই আরেকটা দুপুর। নিউবারাকপুর গেছি। খেয়েদেয়ে সবাই ঘুমোচ্ছে। আমি কী করি! বড়জেঠুর আলমারি ভর্তি বই। কিন্তু সেসব জমাটি গল্পের বই না। মূলত প্রবন্ধ আর কবিতার বই। ধুর! ওসব কেউ পড়ে নাকি! যা খুশী একটা কিছু লিখে, লাইনে লাইনে ভেঙে দিলেই হলো, তাকেই আধুনিক কবিতা বলে। এরকমই ভাবতাম তখন। কিন্তু উপায় যখন নেই, তখন সেই হাবিজাবিই দেখি একটু নেড়েচেড়ে। ওই তো দেখছি কী একটা বই — ‘কবিতার মুহূর্ত’। লেখক শঙ্খ ঘোষ। দেখি কী বস্তু! পড়তে শুরু করলাম। আর পড়তে পড়তে আমার সমস্ত চেতনা আচমকা বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে কাঁপতে লাগলো থরথর করে। তুমুল ঝড় আমায় ছিটকে ফেললো যেন শূন্যের ভিতর। শূন্যের ভিতরেও যে এত ঢেউ, এই প্রথম জানলাম। সেখান থেকে আকাশপানে হাত বাড়ালেম কাহার তরে? আমার ঈশ্বর স্পর্শ করলেন আমায়। তখন বুঝতে পারিনি, এখন পারি, যে সেই দুপুরেই নির্ধারিত হয়ে গেছিলো আমার ভবিতব্য।
ক্লাস নাইন টেন থেকেই আমার ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছিল পরন্তপ, ইন্দ্রনীল (লম্বা), অনির্বান (টেরু), সপ্তর্ষিরা। টেন থেকেই আমি, পরু, ইন্দ্র আর টেরু এক বেঞ্চে বসতাম। ইলেভেন টুয়েলভেও একই বেঞ্চ। তার মধ্যেও আবার আমার সঙ্গে পরুর, আর ইন্দ্রর সঙ্গে টেরুর একটা আলাদা কেমিস্ট্রি তৈরি হয়ে উঠেছিলো। ক্লাস ইলেভেনে এসেই আমি পেলাম আমার স্কুলজীবনের সেরা শিক্ষককে — দুর্গাবাবু, যাঁর কাছ থেকে আজও আমি অনেক কিছু শিখি। ক্লাস ইলেভেনেই নতুন একটি ছেলে এসে ভর্তি হলো আমাদের স্কুলে। অর্ণব সেন। আমি যেন এরকম একজনের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম তখন। আমার প্রাণের বন্ধু হয়ে উঠলো অর্ণব। পড়াশুনো ডকে উঠলো আমার। তার আরেকটা কারণও ছিলো অবশ্য। পড়তে চেয়েছিলাম আর্টস নিয়ে। বাবা ভর্তি করে দিলো সায়েন্সে। অকাট্য যুক্তি — সায়েন্স নিয়ে পড়লেও পরে আর্টস পড়া যায়। কিন্তু আর্টস নিয়ে পড়লে পরে ইচ্ছে হলেও সায়েন্স পড়া যাবে না। অর্ণব পড়তো আর্টস। সেও বখাটে। সেও কবিতা লেখে। সেও সাহিত্য বলতে পাগল। ফলে অচিরেই পাগলে পাগলে জমে গেল। শুধু অর্ণব এসব করেও সিলেবাসের পড়াশুনোটা ঠিকঠাক চালিয়ে গেলো। আর আমি প্রায় ছেড়েই দিলাম সেটা। তাছাড়া আরেকজন সাহিত্যপ্রেমীও এসে জুটলো ইলেভেনেই। সন্মিত্র। যদিও স্কুলে ভর্তি হওয়ার অনেক আগে থেকেই ওকে চিনতাম। তবে ডাকনামে। লাল্টু। ওরা টুংদের হাউসিং-এই, এমনকি একই বিল্ডিং-এ, থাকতো। লাল্টুর বাবা কৃত্তিবাসে একসময়ে কবিতা লিখেছেন। লাল্টু ছিলো ক্লাসিকাল মেজাজের। সেই বয়সেই ওর পছন্দের কবি ছিলো সুধীন দত্ত। দেবাঞ্জন, সপ্তর্ষি, দীপাঞ্জন এরাও বেশ সাহিত্য-অনুরাগী। ফলে কেস পুরো জমে ক্ষীর। আরেকটি মেয়ে এসে ভর্তি হয়েছিল আর্টসে। সুমনপাগল, কবিতাপ্রেমী। পুরো চরিত্রটা খেয়াল করতে মাস সাত-আট লেগেছিলো। মনে মনে প্রেমে পড়ে গেলাম তার। কিন্তু বলতে পারি না কিছুতেই। আড়ষ্টতা এসে ঘিরে ধরে। এইভাবে কেটে গেলো হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা পর্যন্ত। তারপর যেদিন তাকে বলবোই বলে মনস্থ করলাম, সেদিনই জানতে পারলাম যে সে অলরেডি এনগেজড। ফল হলো দেবদাস সিনড্রোম। হায়ার সেকেন্ডারি দেওয়ার পরপরই, রেজাল্ট বেরোনোর আগেই, মূলত আমি আর অর্ণব মিলে একটা লিটল ম্যাগাজিন বের করি, কাঁচা মাথা আর একরাশ স্বপ্ন নিয়ে। নাম — ‘সৃষ্টি’। অবশ্য এক সংখ্যাতেই তার ইতি। এর কিছুদিনের মধ্যে রেজাল্ট বেরোতেই, ছেড়ে চলে আসতে হলো আমাদের এতদিনের শিকড়, আমাদের সেই স্কুল।

*************************
ছোড় আয়ে হাম উয়ো গলিয়াঁ? সত্যিই কি তাই? তাহলে স্কুলে থাকতে যেসব সহপাঠীর সঙ্গে তেমন বন্ধুত্ব ছিলো না, বা খুবই ক্ষীণ ছিলো, তাদেরই দু-তিনজন স্কুল ছাড়ার পরে আস্তে আস্তে আমার জীবনের অচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠলো কী করে? এই যে দেবারতি, তনুশ্রী, ইউসুফ — এদের ছাড়া তো আজ আমি অসম্পূর্ণ। কিন্তু স্কুলে পড়ার সময়ে তো এরা আমার এত বন্ধু ছিলো না! তাহলে? বিশেষত দেবারতি — এই আরেকজন, যার কাছ থেকে আমি আজও জীবনের পাঠ নিই। এই মেয়েটা জীবনের যেসব ভয়ংকর আগুন পেরিয়ে এসেছে, অন্তত আমি হলে পারতাম না। অনেক আগেই আত্মহত্যা করতাম। আমি ওর থেকে শিখি যে কী করে বাঁচতে হয়! স্কুল মানে তো শুধু একটা ইঁট কাঠ পাথরের বাড়ি নয়। স্কুল মানে তো এই বন্ধুরাই! তাহলে কি স্কুল ছেড়ে আসতে পেরেছি সত্যিই? আজও তো চোখ বুজলে দেখতে পাই — ছোট্ট একটা পাখি শিস দিচ্ছে একটানা। তার ডাক শুনে, বন্ধু-পাখিরাও সব ডেকে উঠছে নানা সুরে। আর সেই সমবেত অর্কেস্ট্রা, সেই সুরের ঝর্ণা, উঠে যাচ্ছে আলোর দিকে। উঠছে, আর উঠে ঝরে পড়ছে। উলালা! উলালা!!

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes