
আমার প্রথম শিক্ষক
একরাম আলি
সেসব বাচ্চাবেলার কথা। মানে সত্যযুগের। আমাদের গেঁয়ো স্কুলঘরটা ছিল লম্বাটে, কাদামাটির তৈরি। মাথায় তার খড়ের ছাউনি। মাঝে দু-দেওয়ালে দুটো দরজা, মুখোমুখি। এ-দিকে ঢুকে সটান ওদিকে বেরিয়ে যাওয়ার মতো। যেমন বছর-বছর ফেল করে বাচ্চারা বেরিয়ে গিয়ে স্কুলছুট হত। দরজার ডাইনে তিনটে, বাঁয়েও তাই, ঘুলঘুলির মতো জানলা। স্কুলঘরের সামনে খোলা জায়গা খানিকটা। তারপর বাঁহাতি গেরেম্ভারি চালের ইঁদারা। বড়োসড়ো। সম্ভ্রম জাগানো। সারাদিন জলও উঠত বালতি-বালতি।
পাঁচ বছর বয়সে যখন ঢুকি, বসবার আসন ছিল চটের। ক্লাস ফোর শেষ করে স্কুল ছাড়বার দিনও সেই চটের আসন। মাস্টারমশাইদের জন্যে একই নড়বড়ে চেয়ার।
আশ্চর্যের যে, এ-হেন প্রাইমারি স্কুলে কী করে যেন সেঁধিয়ে গিয়েছিল কাঠখোট্টা এক আলমারি। আর তাতে কিছু শিশুপাঠ্য গল্পের বই, ম্যাপ, গ্লোব, এমনকী দু-একটা খেলনাও! কেননা, মাত্র বছর সাতেক আগে দেশ স্বাধীন আর দু-টুকরো হয়েছে যদিও, শরণার্থীর চাপে সরকারের আর মানুষের শত অনটনও সীমাহীন, তবু চারদিকে কেমন যেন কোমর বেঁধে কাজে লাগবার তৎপরতা। যাকে বলে দেশগঠনের কাজের মতো কিছু একটা উদ্দীপনা চারদিকে।
আমাদের ছোটোকুষ্টিকুরি প্রাইমারি স্কুলেও তার ছোঁয়া লেগেছিল। সদ্য হেড টিচার হয়ে এলেন মহম্মদ ইউসুফ নামের এক তরুণ। হাফহাতা শার্ট আর ধুতি ছিল তাঁর নিত্যদিনের পোশাক। খালি পা। কিন্তু পাশের বাঁশুলিপুকুরের ঘাটে পা-দুটো ধুয়ে তবে স্কুলে ঢুকতেন, যেমন গাঁয়ের গৃহস্থেরা নিজের বাড়িতে ঢোকার আগে তখনকার দিনে করত।
সেই ভগ্নপ্রায় কুঁড়েঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে বাড়ি থেকে আনা টর্চ জ্বেলে তিনি গ্লোবটাকে কোলে রাখতেন— স্কুলে টেবিলও ছিল না– আর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাতেন দিন-রাতের রহস্য। ভরদুপুরে আমরা যখন দেখতাম, জানতে পারতাম– কোথাও তখন সবে সকাল হচ্ছে, কোনো দেশে গভীর রাত, কোথাও ভোর হবে-হবে। কচি চোখে বিস্ময়ের ভিড় জমে যেত। তিনিই আবার মালকোঁচা মেরে ধুতি পরে ব্রতচারী শেখাতেন। পিছনের আমবাগানের ছায়ায় তাঁর নাচের তালে আমরা পা মিলিয়ে গাইতাম— চল কোদাল চালাই/ভুলে মানের বালাই…।
আরও দু-জন মাস্টারমশাই ছিলেন। কিন্তু ওই বলে না, অগণন ভিড়ে খ্যাপার সংখ্যা দু-একজনই! ইউসুফ মাস্টার (আমরা আড়ালে এমনই বলতাম। স্যর বা সার শব্দটি আমাদের মতো গেঁয়ো শিশুদের তখনো সড়গড় হয়নি।) ছিলেন তেমনই। তাঁরই উৎসাহে সামনের জমিতে আমরা একটা তাক লাগানো বাগান করেছিলাম। রূপ, রং আর গন্ধ চিনেছিলাম নানা জাতের গোলাপ, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, সূর্যমুখী, বোগেনভিলিয়া, জুঁই আর কামিনী ফুলের। কচি হাতে কোদাল আঁটছে না দেখে ভসভস করে তিনিই কুপিয়ে দিতেন নরম মাটি আর ঘাড় ফিরিয়ে বলতেন— ‘এই তো। নে, এবার বাকিটা কুপিয়ে ফেল।‘ কিন্তু, তখন আর কোপানোর মতো মাটি বাগানে থাকত না।
একটা ঝাঁকড় গাছে ছোট্ট-ছোট্ট, গোল, বেগুনি রঙের, বাহারি বোতামের মতো, কিন্তু গন্ধহীন, অসংখ্য ফুল ফুটত। আমরা বলতাম বোতাম ফুল। কী যে তার আসল নাম, আস্ত একটা বাগান করেও, আজও জানি না। গাছে জল দেওয়ার জন্যে ঝারি কেনা হয়েছিল। নল দিয়ে ঝিরঝির করে জল পড়ত পল্লবিত পাতা চুইয়ে গাছের গোড়ায়। সেই গৌরবটুকুর অংশীদার হওয়ার জন্যে ঝারির দখল নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যেত।
স্কুলের চাবি থাকত কোনো সিনিয়র, অর্থাৎ ক্লাস থ্রির অথবা ফোরের, ছেলের কাছে। সে-ই এসে স্কুল খুলত। বন্ধও করতে হত তাকেই। কোনো বিশেষ প্রশিক্ষণ ছাড়াই, ওইটুকু বয়সে, এক গেঁয়ো শিক্ষক কোথা থেকে যে শিখেছিলেন তাঁর ছাত্রদের এমন দায়িত্বসচেতন করে তুলতে!
আদর্শ শিক্ষক কাকে বলে, তখন কি জানতাম! জানলে তাঁকে তো মাথায় করে রাখার কথা। যদিও আমাদের মাথাগুলো ছিল এইটুকু আর তাঁর ছিল পেটানো চেহারা। হলে কী হবে, মনটা ছিল কেমন যেন; আমাদেরই মতো কচি আর নরম–নরম? হবে হয়তো। ইস, তখন যদি জানা থাকত!
কী করতাম, জানা থাকলে? আজ যে তাঁর চওড়া-পাতার ধুলোমলিন পা-দুটোর কথা মনে পড়ছে, সে-কি একবার প্রণাম করতে চাওয়ার জন্যে?
এই বোধ অবিচ্ছিন্ন,একেবারে কাদাজল মাটি মিশে যাওয়া। চোখ তো স্বাভাবিক থাকে না ভিজে যায়