রবীন্দ্রনাথ, জাতীয়তাবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতার নতুন সংলাপ <br /> জয়ন্ত ভট্টাচার্য

রবীন্দ্রনাথ, জাতীয়তাবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতার নতুন সংলাপ
জয়ন্ত ভট্টাচার্য

জাতীয়তাবাদী ইতিহাস রচনার মাঝে কখনোসখনো কিছু ফাঁক-ফোকরও চোখে পড়ে। ইতিহাস রচনা করতে গিয়ে ইউরোপীয় আলোকপ্রাপ্ত শিক্ষিতেরা মাঝেমধ্যে আতান্তরেও পড়েছেন। এরকম একজন ভূদেব মুখোপাধ্যায়। ১৮৯৫ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর স্বপ্নলন্ধ ভারতবর্ষের ইতিহাস। নামেই অনুমান করা যায় যেহেতু স্বপ্নলব্ধ এজন্য বহু কথাই হয়তোবা স্বপ্নের ঘোরে বলা, সঠিক অর্থে ঐতিহাসিক যুক্তির বাঁধনে রচিত নয়। তিনি লিখছেন – “একজন ব্রাহ্মণ একজন মুসলমানকে বলিতেছেন “যে রাম সেই রহীম, ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়”।

ওয়াল্টার লিপম্যান তাঁর Public Opinion (1921) একটি নজর করার মতো মন্তুব্য করেছেন – “We are told about the world before we see it. We imagine most things before we experience them. And those preconceptions, unless education has made us acutely aware, govern deeply the whole process of perception. They mark out certain objects as familiar or strange, emphasizing the difference, so that the slightly familiar is seen as very familiar, and the somewhat strange as sharply alien.” একথাগুলোরও আগে আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন – “Great men, even during their lifetime, are usually known to the public only through a fictitious personality.” তাঁর এই কথাগুলোর সাথে আমরা বর্তমান সময়ের সাযুজ্য পাব।
২০২১ সালের ৬-৮ জুলাই সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সংবাদপত্রের শিরোনাম ছিল এনসিইআরটি-র সিলেবাস অনুযায়ী উত্তরপ্রদেশ বোর্ড তাদের সিলেবাস থেকে রবীন্দ্রনাথের ছুটি গল্পের ইংরেজি অনুবাদ, দার্শনিক ও ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রাধাকৃষ্ণনের রচনা, ঐতিহাসিক এ এল ব্যাশামের (“ওয়ান্ডার দ্যাট ওয়াজ ইন্ডিয়া”-র লেখক) লেখা ইত্যাদি ডজনখানেক লেখা বাদ দিয়েছে। কারণ? ঐতিহাসিকভাবে যেকোন শাসনব্যবস্থা এর প্রয়োজনানুযায়ী, অল্প কথায়, প্রাথমিকভাবে দুটি কাজে হাত দেয় – (১) ইতিহাসের পুনর্লিখন হয়, এবং (২) শিক্ষাব্যবস্থার সিলেবাস পরিবর্তন করে। সিলেবাস পরিবর্তনের সুদূরপ্রসারী ফলাফল হচ্ছে কয়েক লক্ষ বা তারও বেশি ছাত্রছাত্রী কিছু সৃষ্টির কথা, কিছু নাম কখনওই জানবেনা – প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। ভিন্ন আরেকধরনের নাম এবং চরিত্র বুঝতে ও চিনতে শিখবে। রাষ্ট্র তার দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী সুবোধ, সুশীল, অনুগত ও বাধ্য ভবিষ্যৎ নাগরিক তৈরির কৃৎ-কৌশল চালু রাঝতে পারবে যতদিন না ক্ষমতার ধরন বদলায়। এবং আমাদের সাধারণ সহজ বুদ্ধিতে বোঝা যায় এ প্রক্রিয়াটি একটি উৎপাদন যন্ত্রের মতো – এক বিশেষ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গী ও মতামত ক্রমাগত উৎপাদন করেই চলবে, ছড়িয়ে যাবে পরিবারে এবং পারিপার্শ্বিকতায়।
কিন্তু আর সবার সাথে রবীন্দ্রনাথও যখন বাতিল হয়ে যান তখন বিস্মিত হতে হয় বৈকি। হাজার হোক তিনি প্রতিবেশী দুটি দেশের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা, ভারতের প্রথম নোবেল বিজয়ী এবং বিশ্বভারতীর মতো প্রতিষ্ঠানের জন্মদাতা। তাহলে কি তাঁর সম্প্রদায় নিয়ে চিন্তাভাবনা এবং ইতিহাসের বোধ ও জীবনবীক্ষা বর্তমান ভারতের রাষ্ট্র পরিচালনায় বৌদ্ধিক সমস্যা তৈরি করছে?
বেশ কিছুদিন আগে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল ঐতিহাসিক দীপেশ চক্রবর্তীর একটি প্রবন্ধ (১৮.০১.২১) ‘যেন লজ্জা স্বীকার করি’। মূলত তিনটি বিষয়ের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন তিনি – (১) ‘ফেক’ নিউজ’, (২) কর্তিত বা খণ্ডিত উদ্ধৃতি – বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের মতো স্রষ্টার যাঁর সৃষ্টি সম্ভার বিপুল, এবং (৩) ইতিহাসের কোন বিশেষ সময়ক্রমে কোন উক্তি বা বক্তব্য জন্ম নিচ্ছে, তৈরি হচ্ছে। তৃতীয় ক্ষেত্রে সংক্ষিপ্ত উদাহরণ হিসেবে তিনি ১৯২১-এর মোপলা বিদ্রোহ, ১৯২১-এর কিছু হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা এবং ১৯২৫-২৬-এর ‘কাজিয়া তুঙ্গে’ ওঠার প্রসঙ্গ এনেছেন। সাথে এটাও জানিয়েছেন “একটি সাময়িকভাবে শান্ত বছরে চিঠিটি লিখছেন রবীন্দ্রনাথ।”
এ প্রসঙ্গের সূত্র ধরে প্রাক-উপনিবেশিক ভারতে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের চালচিত্র বোঝার চেষ্টা করা যায়, ইতিহাস ও কল্পকাহিনীর (মিথ) মধ্যেকার সম্পর্কর পুনর্বিবেচনাও করা যায়। তেমনি বিপরীত পথে ধূর্ত পায়ে হেঁটে ইতিহাসের মধ্যে পুরাণ, কল্পকাহিনী, গল্পগাথার উপাদান সফলভাবে নতুন করে প্রবিষ্ট করানো যায়। এরফলে অতি সহজে বিশ্বাস করার বা শক্তিশালী গুজবে প্রভাবিত হবার মতো বিপুলসংখ্যক মানুষের মাঝে কোনটি ইতিহাস আর কোনটিই বা ‘ফেক নিউজ’ তথা মশলাদার কল্প-কাহিনী এ বিভাজনরেখা অস্পষ্ট হয়ে যায় শুধু দুটি কাজ নিষ্ঠাভরে করে গেলে – প্রথম, ফেক নিউজ নিরন্তর, ছেদহীনভাবে তৈরি করে যেতে হবে; দ্বিতীয়, ‘নির্মিত’ খবরগুলোকে অবিরত এই মানুষগুলোর কাছে পৌঁছে দিতে হবে নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহে। যদিও একাজের জন্য একটি তৃণমূল স্তর অব্দি প্রসারিত ও সজীব রেজিমেন্টেড সংগঠন থাকতে হবে, যা এখন আমরা ভারতবর্ষে প্রতিমুহূর্তে বিপজ্জনকভাবে প্রত্যক্ষ করছি।
আবার ওয়াল্টার লিপম্যানের শরণ নিচ্ছি। তাঁর আরেকটি গ্রন্থ The Phantom Public-এ (১৯২৭-এ প্রথম প্রকাশিত, ১৯৯৩ সালে পুনঃমুদ্রণ) বলছেন – “The private citizen today has come to feel rather like a deaf spectator in ·the back row, who ought to keep his mind on the mystery off there, but cannot quite manage to keep awake. He knows he is somehow affected by what is going on.” আমরা কি সাম্প্রতিক সময়ের ভারতীয় নাগরিক সমাজের সাথে কোন মিল খুঁজে পাচ্ছি?
২০২১ সালে প্রকাশিত অড্রে ট্রুশকের (Audrey Truschke) লেখা The Language of History: Sanskrit Narratives of Muslim Pasts বইটি ভারতের বর্তমান পরিস্থিতির বিপক্ষে কিছু অস্বস্তিকর তথ্য উদ্ঘাটিত করেছে। “হিন্দু-মুসলিম” সম্পর্কের ক্ষেত্রে ট্রুশকে সংস্কৃতে লেখা আখ্যানে ব্যবহৃত শব্দভাণ্ডারের দিকে মনোযোগ দিয়েছেন। ইতিহাস ঘেঁটে দেখিয়েছেন যে প্রাক-আধুনিক অতীতে সমাজকে হিন্দু-মুসলমান দ্বিত্বতায় দেখা হতনা। এটা অনেক পরের নির্মাণ।
তিনি স্পষ্টভাষায় জানিয়েছেন – “The Hindu-Muslim binary assumes the primacy of religious identities, which is arguably inaccurate in many instances in modernity and certainly so in premodernity.” (The Language of History, পৃঃ xliv) তাঁর লেখা থেকে জানতে পারছি ১২৬৪ সালে গুজরাতের সোমনাথের কাছে ভেরাভল নামে একটি স্থানে এক মুসলিম বণিক একটি মসজিদ তৈরি করেন। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল “accompanied by a Sanskrit inscription and a shorter Arabic summary”। (পৃঃ ৪৮)
পরবর্তীতে জানাচ্ছেন যে জিনপ্রভ রচিত বিবিধতীর্থকল্প-তে (৬০টি কল্প নিয়ে ১৪০০ সালে রচিত গ্রন্থ) “we find a fleeting indicatiobs of a possible larger recognition of what we now term Indo-Muslim rule.” এবং লিখছনে, বিদ্যাতিলক নামে একজন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত নিশ্চিত করেছেন যে “Muslims continued premodern India’s political tradition of supporting multiple religious communities.” (পৃঃ ৮৪-৮৫)
২০১৯-এ প্রকাশিত বানু সুব্রমনিয়ামের লেখা Holy Science: The Biopolitics of Hindu Nationalism (University of Washington Press) গ্রন্থে লেখক বলছেন – “It is disconcerting to track how easily Hindu nationalists appropriate South Asian history as Hindu history and how uncritically they embrace Western science as Vedic science in order to forge the idea of India as a Hindu nation and a global superpower … Hinduism is a heterogeneous, diverse, polyvocal, and polytheistic religion that proves to be infinitely flexible and adaptable. There is no singular fundamental text, no singular religious authority, no singular code of conduct, no singular religious ritual, no singular religious practice, no singular god.” (পৃঃ ২১৬-২১৭)
ফেক নিউজ – সামান্য কথা
নেচার জার্নালে প্রকাশিত নোয়েবল ম্যাগাজিন-এর একটি সংবাদ “Synthetic media: The real trouble with deepfakes” (১৬.০৩.২০২০) বেশ কিছু ছবি এবং ভিডিও পোস্ট করে জানায় যে এসমস্ত ছবি হল “deepfakes” – গভীর মিথ্যে। এগুলো হচ্ছে কম্পিউটারে তৈরি অত্যাধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে নির্মিত মিথ্যেকে সত্যি করে দেখানো ছবি। আপনি নিজেও নিজের সিন্থেটিক ছবি ThisPersonDoesNotExist.com-এ তৈরি করতে পারেন। বায়োলজির দিক থেকে এটা বলার কথা যে যতবেশি মানুষ উপরিস্তরের নিউরনের কাজের মধ্যে আটকে থাকবে ততবেশি গুজব এবং মিথ্যের বাতাবরণ ফনফনিয়ে বেড়ে উঠবে। নিউরনের পাশে শুয়ে থাকা গ্লায়াল কোশের কাজ যত কম হবে তত মানুষের গভীরে গিয়ে ভাবার ইচ্ছে এবং ক্ষমতা কমবে। এতে লাভ? রাষ্ট্র এক মানুষ-পিণ্ড তৈরি করতে পারবে যারা প্রশ্ন করতে ভুলে যায়। শুধু দৌড়ে চলে নির্মিত মিথ্যা, অর্ধসত্য বা গুজবের পেছনে – একে নিজের মধ্যে আত্মীকরণও করে নেয়। এবং নিপুণতার সাথে এই কাজটিই ছেদহীনভাবে করা হয় তাহলে জনমানসে গুজব গেলানোর সাথে ভোটের ঈপ্সিত ফলাফলের একটি সমানুপাতিক সম্পর্ক তৈরি করা যায়।
ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে কিভাবে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ এবং ইন্সটাগ্রামের মতো মাধ্যম ২০১৪ আর ২০১৯-এর নির্বাচনের সময় ব্যবহার করা হয়েছিল তার অনুপুঙ্খ বর্ণনা ধরা আছে সিরিল স্যাম এবং পরঞ্জয় গুহঠাকুরতার লেখা দ্য রিয়্যাল ফেস অফ ফেসবুক (২০১৯) গ্রন্থে। এ গ্রন্থের পরতে পরতে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে মিথ্যাচার, গুজব, মাথা ঝিম-ধরানো প্রবঞ্চনার। সাংবাদিক রবীশ কুমার তাঁর দ্য ফ্রি ভয়েস গ্রন্থে একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ রেখেছেন – “বর্তমান সময়ে ্নাগরিকদের মাঝে এক নতুন প্রবণতা জন্ম নিচ্ছে … যখন একজন ভোটার একজন নেতার সাথে একাকার হয়ে যায়, সেসময়ে সে আর সাধারণ জনতা থাকেনা, এমনকি একজন ভোটারও থাকেনা। তখন এক ঝোড়ো হাওয়ায় উড়ে যাওয়া একটি ধুলিকণায় পর্যবসিত হয়।”
নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় রোমিলা থাপারের একটি আমন্ত্রিত প্রবন্ধে (“They Peddle Myths and Call It History”, মে ১৭, ২০১৯) থাপার বলেন – “জাতীয়তাবাদীরা একটা গ্রহণযোগ্য ইতিহাস নির্মাণ করে যেখানে এই রাষ্ট্র গড়ার ক্ষেত্রে তাদেরই অবদানকে ইতিহাসে আনা হয় যাদেরকে এরা প্রয়োজনীয় মনে করে; অতি জাতীয়তাবাদীদের প্রয়োজন তাদের নিজস্ব এবং বিশেষ ধরনের ইতিহাস যেখানে এরা বর্তমানে যা করছে তাকে অতীত দিয়ে বৈধ করে তোলা যায়। ভারতের ইতিহাসের পুনর্লিখন এবং ইতিহাসের এই ভার্সনটিকে স্কুল কলেজে শিক্ষার মধ্য দিয়ে চারিয়ে দেওয়া হল এদের মতাদর্শের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ … মুসলিম এবং হিন্দু উভয় জাতীয়তাবাদেরই শেকড় রয়েছে ব্রিটিশদের ভারতকে নিয়ে উপনিবেশিক বোঝাপড়ার মধ্যে।”
রবীন্দ্রনাথের চিঠি এবং অন্যান্য
১৯৪৬ সালে প্রকাশিত রবীন্দ্র-রচনাবলীর চতুর্বিংশ খন্ডে ৩৭৪ থেকে ৩৭৭ পাতা জুড়ে রয়েছে কালিদাস নাগকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠিটি যা দীপেশ চক্রবর্তীর আলোচনার ভরকেন্দ্র। পরে এই চিঠিটি “কালান্তর’ সংকলনে সংকলিত হয়। সে চিঠিটি শুরু হচ্ছে এভাবে – “ঘোর বাদল নেমেছে। তাই আমার মনটা মানব-ইতিহাসের শতাব্দীচিহ্নিত বেড়ার ভিতর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেছে।” এরপরে লিখছেন – “ঠিক এমনসময় সমুদ্রপার হতে তোমার প্রশ্ন এল, ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলমান সমস্যার সমাধান কী। হঠাৎ মনে পড়ে গেল, মানবসংসারে আমার কাজ আছে – শুধু মেঘমল্লারে মেঘের ডাকের জবাব দিয়ে চলবে না, মানব-ইতিহাসের যে-সমস্ত মেঘমন্দ্র প্রশ্নাবলী আছে তারও উত্তর ভাবতে হবে। তাই অম্বুবাচীর আসর পরিত্যাগ করে বেরিয়ে আসতে হল।”
এখানে এসে রবীন্দ্রনাথের চিন্তনপথের একটি সরণ ঘটলো। লিখলেন – “পৃথিবীতে দুটি ধর্মসম্প্রদায় আছে অন্য সমস্ত ধর্মমতের সঙ্গে যাদের বিরুদ্ধতা অত্যুগ্র – সে হচ্ছে খৃষ্টান আর মুসলমান-ধর্ম।” এরপরে – “অপরপক্ষে হিন্দুজাতিও এক হিসাবে মুসলমানেরই মতো। অর্থাৎ, তারা ধর্মের প্রাকারে সম্পূর্ণ পরিবেষ্টিত। বাহ্য প্রভেদটা হচ্ছে এই যে, অন্য ধর্মের বিরুদ্ধতা তাদের পক্ষে সকর্মক নয় – অহিন্দু সমস্ত ধর্মের সঙ্গে তাদের non-violent non-co-operation। হিন্দুর ধর্ম মুখ্যভাবে জন্মগত ও আচারমূলক হওয়াতে তার বেড়া আরও কঠিন। মুসলমানধর্ম স্বীকার করে মুসলমানের সঙ্গে সমানভাবে মেলা যায়, হিন্দুর সে পথও অতিশয় সংকীর্ণ।” আরও বললেন – “আধুনিক হিন্দুধর্মকে ভারতবাসী প্রকাণ্ড একটা বেড়ার মতো করেই গড়ে তুলেছিল – এর প্রকৃতিই হচ্ছে নিষেধ এবং প্রত্যাখ্যান। সকলপ্রকার মিলনের পক্ষে এমন সুনিপুণ কৌশলে রচিত বাধা জগতে আর কোথাও সৃষ্টি হয় নি। এই বাধা কেবল হিন্দু-মুসলমানে তা নয়। তোমার আমার মতো মানুষ যারা আচারে স্বাধীনতা রক্ষা করতে চাই। আমরাও পৃথক, বাধাগ্রস্ত।” এ অংশটি আজ একবিংশ শতাব্দীতে এসেও সমান সত্যি! যারা আচারে স্বাধীনতা রক্ষা করতে চায় তারা পৃথক, বাধাগ্রস্ত। তাদেরকে পৃথক করে বাধা দেবার এক প্রবল রাষ্ট্রিক উদ্যোগ দুর্মর বেগে সমাজকে প্লাবিত করছে।
পরে “হিন্দুমুসলমান” প্রবন্ধে বলছেন – “আমি যখন আমার জমিদারি সেরেস্তায় প্রথম প্রবেশ করলেম তখন একদিন দেখি, আমার নায়েব তাঁর বৈঠকখানায় এক জায়গায় জাজিম খানিকটা তুলে রেখে দিয়েছেন। যখন জিজ্ঞেস করলেম, ‘এ কেন’ তখন জবাব পেলেম, যে-সব সম্মানী মুসলমান প্রজা বৈঠকখানায় প্রবেশের অধিকার পায় তাদের জন্য ঐ ব্যবস্থা। এক তক্তপোষে বসাতেও হবে অথচ বুঝিয়ে দিতে হবে আমরা পৃথক। এ প্রথা তো অনেক দিন ধরে চলে এসেছে; অনেকদিন মুসলমান এ মেনে এসেছে, হিন্দুও মেনে এসেছে। জাজিম-তোলা আসনে মুসলমান বসেছে, জাজিম-পাতা আসনে অন্যে বসেছে।” “কোট বা চাপকান” প্রবন্ধে বললেন – “এক্ষণে যদি ভারতবর্ষীয় জাতি বলিয়া একটা জাতি দাঁড়াইয়া যায়, তবে তাহা কোনমতেই মুসলমানকে বাদ দিয়া হইবে না। যদি বিধাতার কৃপায় কোনোদিন সহস্র অনৈক্যের দ্বারা খণ্ডিত হিন্দুরা এক হইতে পারে, তবে হিন্দুর সহিত মুসলমানের এক হওয়াও বিচিত্র হইবে না। হিন্দু মুসলমানের ধর্মে না – ও মিলিতে পারে, কিন্তু জনবন্ধনে মিলিবে—আমাদের শিক্ষা আমাদের চেষ্টা আমাদের মহৎ স্বার্থ সেই দিকে অনবরত কাজ করিতেছে। অতএব যে বেশ আমাদের জাতীয় বেশ হইবে তাহা হিন্দু মুসলমানের বেশ।”
“কালান্তর” সংকলনে লিখলেন – “আমার অধিকাংশ প্রজাই মুসলমান। কোর্‌বানি নিয়ে দেশে যখন একটা উত্তেজনা প্রবল তখন হিন্দু প্রজারা আমাদের এলাকায় সেটা সম্পূর্ণ রহিত করবার জন্য আমার কাছে নালিশ করেছিল। সে নালিশ আমি সংগত বলে মনে করি নি, কিন্তু মুসলমান প্রজাদের ডেকে যখন বলে দিলুম কাজটা যেন এমনভাবে সম্পন্ন করা হয় যাতে হিন্দুদের মনে অকারণে আঘাত না লাগে তারা তখনই তা মেনে নিল। আমাদের সেখানে এপর্যন্ত কোনো উপদ্রব ঘটে নি। আমার বিশ্বাস তার প্রধান কারণ, আমার সঙ্গে আমার মুসলমান প্রজার সম্বন্ধ সহজ ও বাধাহীন।”
প্রাক-উপনিবেশিক এবং উপনিবেশিক যুগে সাম্প্রদায়িকতার সংক্ষিপ্ত চেহারা
এ বিষয় নিয়ে যোগ্য ব্যক্তি এবং ঐতিহাসিকেরা বিবিধ ও সুপ্রচুর বিশ্লেষণ করেছেন। সি এ বেইলি ১৯৯৫ সালে মডার্ন এশিয়ান স্টাডিজ-এ প্রকাশিত তাঁর “The Pre-history of ‘Communalism’? Religious Conflict in India, 1700-1860” প্রবন্ধে দেখাচ্ছেন যে প্রাক-উপনিবেশিক সময়ে ও সমাজে ধর্মীয় সংঘাত থাকলেও খুব কম ক্ষেত্রেই, অন্তত ১৮২০ পর্যন্ত, তা সাম্প্রদায়িক সংঘাতের চেহারা নিয়েছে। অর্থাৎ, ধর্মীয় দূরত্ব মানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এরকম কোন সরল সমীকরণ করার যাথার্থ্য নেই। তিনি ঐতিহাসিকভাবে উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন যুদ্ধজীবী (warbands) রাজপুত শ্রেষ্ঠদের হারেমে মুসলমান রমণীদের রাখা হত। এবং এই প্রথা উলমাদের অসীম বিরক্তির কারণ ছিল। দেখিয়েছেন হিন্দুরা যেমন বহুক্ষেত্রে মসজিদ রক্ষা করার দায়িত্ব নিয়েছে, তেমনি মুসলমান সুলতানেরাও বহু মন্দিরের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। এমনকি শিখেরা গুরুদ্বারের মধ্যে মসজিদও বানিয়েছে। জমি নিয়ে যুদ্ধ কিভাবে ‘সাম্প্রদায়িক’ হয়ে উঠলো? অনেক কারণের মধ্যে সম্ভাব্য একটি কারণ, বেইলির মতে, গোঁড়া জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গী সাম্প্রদায়িকতার সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ নয়।

হিন্দুমুসলমান সম্পর্কের প্রসঙ্গে ইংরেজ শাসনের একেবারে গোড়ার দিকে যারা বিভিন্নভাবে লিখেছেন তাদের একজন শ্রীরামপুরের ত্রয়ী কেরি-মার্শমম্যান-ওয়ার্ডের একজন উইলিয়াম ওয়ার্ড। তাঁর লেখা পুস্তক (শ্রীরামপুর থেকে ১৮১৮ সালে ২য় সংস্করণ প্রকাশিত হয়) হল A View of the History, Literautre, and Mythology, of The Hindoos-এ বলছেন – কলকাতার কুখ্যাত এবং লম্পট চরিত্রসম্পন্ন বাড়ির সংখ্যা অবিশ্বাস্য – “কয়েক বছর আগে ক্ষত্রিয় জাতের হিন্দু রাজারা ইংরেজ উপপত্নী রাখতো, এবং পরবর্তী সময়ে মুসলিম রমণীর পরিবারকেও পুষতো। এদের পুত্রদের হিন্দুমতে পৈতাও দেওয়া হয়েছিল এবং সবার বিয়ে হয়েছিল হিন্দুদের সাথে। রাজার রক্ষিতা এই মহিলার আলাদা বাড়ি ছিল যেখানে রাজা নিয়মিত যেতেন। এই মহিলা মূর্তি পুজো করতো এবং একজন ব্রাহ্মণ পূজারী ছিল, ছিল একজন ব্রাহ্মণ গুরু। চারপাশের সমস্ত হিন্দু এই মহিলার বাড়িতে রান্না হওয়া খাবার খেতো। ফলে শাস্ত্রাচারীদের মতে কয়েকহাজার হিন্দুর জাত খোয়া গিয়েছিল।”

ওয়ার্ড একথাও জানাচ্ছেন যে কলকাতা, ঢাকা, পাটনা, মুর্শিদাবাদের মতো বড়ো শহরগুলোতে অনেক ধনী হিন্দু মুসলিম উপপত্নীর সাথে সহবাস করে এবং “নীচুতলার মানুষদের মাঝে সবধরনের মেলামেশা খুব স্বাভাবিক বিষয় ছিল।” (১ম খণ্ড, পৃঃ ২১০) স্মরণে রাখবো, ওয়ার্ড পায়ে হেঁটে, ঘোড়ায় চড়ে কিংবা নৌকোতে করে বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে, গ্রামের অভ্যন্তরে মানুষের সাথে নিবিড়ভাবে মিশেছেন। ফলে ঊনিশ শতকের শুরুতে তাঁর এই গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা ফেলে দেবার মতো নয়।

পার্থ চট্টোপাধ্যায় তাঁর “ইতিহাসের উত্তরাধিকার” (নিম্নবর্গের ইতিহাস, ১৯৯৮, পৃঃ ১২১-১৬০) প্রবন্ধে বলছেন – “সেকুলার ইতিহাস চর্চার সংকট এইখানেই – আজকের রাষ্ট্রনীতির সঙ্গে জাতীয়তার ইতিহাসের সামঞ্জস্য আনা। সংকট এইজন্য যে জাতীয়তার যে ইতিহাস গত শতাব্দী থেকে লেখা হয়ে এসেছে, তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে রয়েছে এমন সব কাহিনী, ধারণা, ব্যাখ্যা যা আজকের উগ্রহিন্দু প্রচারের প্রধান উপাদান।” ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিত মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকারের রাজাবলী (১৮০৮) দিয়ে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের আলোচনা শুরু। রাজাবলী কার্যত পৌরাণিক উপাদান সমৃদ্ধ হিন্দু বিবরণ বললেও অত্যুক্তি করা হয়না। এই বইটি নিয়ে উইলিয়াম ওয়ার্ডও তাঁর পূর্বোক্ত গ্রন্থে আলোচনা করেছেন। (পৃঃ ২৬) “আলোকপ্রাপ্ত” ওয়ার্ডেরও নজরে এসেছে রাজাবলী-র ইতিহাসের ঢংয়ে পৌরাণিক চরিত্র এবং প্রধানত হিন্দু-মুসলমান সংঘাতের কাহিনী বলা। পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলছেন – “বঙ্কিমের যুগে এসে পৌরাণিক আর ঐতিহাসিক কালের মধ্যে যে তফাৎ করা হবে, পৌরাণিক বিবরণের থেকে ইতিহাসের মালমসলা বের করার পদ্ধতি নিয়ে যে আলোচনা হবে, মৃত্যুঞ্জয়ের চিন্তায় তার আভাসটুকুও নেই।” মৃত্যুঞ্জয়ের মতো যারা উপনিবেশিক কালে ইতিহাস রচনা করেছেন তারা হিন্দু গরিমায় উজ্জ্বল একটি ঐতিহাসিক স্মৃতি গড়ে নেওয়ার কাজ করেছেন। বিপরীতদিকে, মুসলমান রচয়িতা যারা তাদের কাছে মক্কা এবং মহম্মদের গরিমা কীর্তন প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরকমভাবে যেখানে ইতিহাস লেখার একটি জাতীয়তাবাদী তথা হিন্দু ইতিহাস লেখার উদ্যোগ শুরু হল সেখানে, পার্থ প্রশ্ন করছেন, “তাহলে হিন্দু নয় অথচ ভারতের অধিবাসী, এমন জনগোষ্ঠীর স্থান কোথায়?”
তারিণীচরণ চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ভারতবর্ষের ইতিহাস (১৮৫৮ থেকে ১৮৭৮ সালের মধ্যে ১৮টি সংস্করণ হয়েছিল) আলোচনা করতে গিয়ে বলছেন – “রাষ্ট্র সার্বভৌমত্বের আধুনিক চিহ্ন রামচন্দ্রের হাতে পত্পত্ করে উড়ছে, এ-ছবি একশো বছর আগের ইংরেজি-শিক্ষিত বাঙালি ব্রাহ্মণের কল্পনায় সহজেই এসে গিয়েছিল।” জাতীয়তাবাদীর কাছে প্রাচীন ভারত হয়ে উঠল তার ক্লাসিকাল আদর্শ। বেইলি তাঁর লেখায় যে ইঙ্গিত করেছিলেন জাতীয়তাবাদের সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার কোন অসঙ্গতি নেই বরঞ্চ সাযুজ্যপূর্ণ, সেকথাই অন্যভাবে পার্থর বিশ্লেষণে আমরা দেখতে পাচ্ছি। ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগ থেকেই জাতীয়তাবাদী চেতনায় ইতিহাস রচনার সাথেই সংপৃক্ত হয়ে আছে সাম্প্রদায়িক বোধের বিকাশ। পার্থর পর্যবেক্ষণে – “বস্তুত জাতীয়তার অর্থ হিন্দু জাতীয়তা, এই ধারণাটিকে কোনও প্রাক-আধুনিক ধর্মীয় মতাদর্শের বলে ভাবলে মারাত্মক ভুল করা হবে। ধারণাটি সম্পূর্ণ আধুনিক। আধুনিক অর্থেই তা যুক্তিবাদী; অযৌক্তিক আচার-ব্যবহার কুসংস্কার বিরোধী। আধুনিক অর্থেই তা রাষ্ট্রকেন্দ্রিক; রাষ্ট্রের অখণ্ডতা এবং সার্বভোউমত্বের ব্যাপারে কট্টরপন্থী এবং সমাজনীতি নির্ণয় ও সংস্কারের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে বিশ্বাসী।” (পৃঃ ১৫৩)
এখানেই এই “নির্মিত” ইতিহাসের সাথে রবীন্দ্রনাথের ইতিহাসবোধ, নেশন তথা রাষ্ট্রিক চেতনা এবং সমাজে মুক্ত মানুষের ভূমিকার বোধের মাঝে অনপেনয় দূরত্ব তৈরি হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথকে ফেলাও যায়না, গেলাও যায়না, আবার রাখাও যায়না। ফলে রবীন্দ্রনাথকে নিজেদের মতো করে আত্মীকরণের জন্য টুকরো টুকরো অংশে ভেঙ্গে প্রয়োজনমতো ব্যবহার করা জরুরী হয়।
কিন্তু জাতীয়তাবাদী ইতিহাস রচনার মাঝে কখনোসখনো কিছু ফাঁক-ফোকরও চোখে পড়ে। ইতিহাস রচনা করতে গিয়ে ইউরোপীয় আলোকপ্রাপ্ত শিক্ষিতেরা মাঝেমধ্যে আতান্তরেও পড়েছেন। এরকম একজন ভূদেব মুখোপাধ্যায়। ১৮৯৫ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর স্বপ্নলন্ধ ভারতবর্ষের ইতিহাস। নামেই অনুমান করা যায় যেহেতু স্বপ্নলব্ধ এজন্য বহু কথাই হয়তোবা স্বপ্নের ঘোরে বলা, সঠিক অর্থে ঐতিহাসিক যুক্তির বাঁধনে রচিত নয়। তিনি লিখছেন – “একজন ব্রাহ্মণ একজন মুসলমানকে বলিতেছেন “যে রাম সেই রহীম, ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়”। মুসলমান বলিতেছেন “ঠাকুর যথার্থ কহিয়াছেন, সমস্ত জগৎ সেই এক অদ্বিতীয় ঈশ্বরেরই বিভূতি মাত্র, মানুষ ভেদে যেমন আচারভেদ-পরিচ্ছদভেদ-ভাষাভেদ – তেমনি উপাসনার প্রণালীভেদও হইয়া থাকে। সকলেই এক পিতার পুত্র। … কোন্ মুসলমান হিন্দু দেবতার এবং ব্রাহমণ ঠাকুরের যথোচিত সম্মাননা না করে? আমার জানত অনেক মুসলমান ব্রাহ্মণদিগকে খরচপত্র দিয়া দুর্গোৎসব করান। … নগরময় এইরূপ কথোপকথন, কোথাও হাস্য পরিহাস, কোথাও গান বাজনা, কোথাও প্রীতিভোজের সমারোহ।” (পৃঃ ১০-১১)
ইতিহাস রচনার তাত্ত্বিক এবং বৌদ্ধিক পরিসরের বাইরে ছিল ব্যবহারিক দিক – উপনিবেশ সুপ্রতিষ্ঠিত হবার পরে। কলকাতা থেকে ঊনিশ শতকের শুরুর দিক থেকে ফার্সিতে সংবাদপত্র প্রকাশিত হত। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবং নরমপন্থী সংবাদপত্র ছিল জাম-ই-জাহান-নুমা। ১৮৪৫ পর্যন্ত এই সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। (এ এফ সালাহ্উদ্দিন আহমেদ, সোশ্যাল আইডিয়াজ অ্যান্ড সোশ্যাল চেঞ্জ ইন বেঙ্গল – ১৮১৮-১৮৩৫, প্যাপিরাস, ২০০৩, পৃঃ ১২৭) কোর্টের ভাষা ছিল ফার্সি। পরিণতিতে, ইংরেজিতে শিক্ষিত হিন্দুদের ফার্সি আয়ত্ব করা আবশ্যিক ছিল। হিন্দুদের ক্ষেত্রে এটা অসন্তোষ এবং বিরোধিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল। মে, ১৮২৮-এ ইংরেজ সরকার পয়সা বাঁচানোর জন্য ভারতীয় ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলোর subscription বন্ধ করে দেয়। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৩২) ফেব্রুয়ারি, ১৮৩৫-এ হিন্দু কলেজের পরিচালকবৃন্দ সহ কলকাতার ৬,৯৪৫ জন অধিবাসী (এর মধ্যে ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষিত ছাত্র এবং তাদের অভিভাবকেরাও ছিল) উইলিয়াম বেন্টিঙ্ককে স্মারকলিপি দেয় যেখানে বলা হয় কোর্টে ইংরেজি ব্যবহারের ক্ষেত্রে যে নিষেধাজ্ঞা আছে তুলে নেওয়া হোক। স্মারকলিপি প্রদানকারীরা উল্লেখ করে যে ফার্সি “as foreign to the natives of Bengal as to their rulers”। এসবের ফলশ্রুতিতে সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একটি জুডিশিয়াল ডেসপ্যাচে (২৬ জুন, ১৮৩৫) ফার্সিকে ভাষার ব্যবহারিক মাধ্যম হিসেবে বিলোপ করা হয়। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ২০৪)
এর বিপরীত একটি ঘটনাও ঘটেছিল। সে বছরেই (১৮৩৫) ফার্সিতে ৮,৩১২ জন মুসলিম অধিবাসীর স্বাক্ষরিত একটি স্মারকলিপি সরকারের কাছে জমা দেওয়া হয় – “Petition on behalf of the Muslims of Calcutta against the Proposed Abolition of Madrasa”। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৬৪-২৬৭) কিন্তু সংখ্যাধিক্য থাকা সত্বেও ফলপ্রসূ হলনা। একদিকে ভাষা হিসেবে ফার্সি নির্বাসিত হল, অন্যদিকে শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে ইংরেজের তৈরি মাদ্রাসা ইংরেজদেরই সিদ্ধান্তে বন্ধ হয়ে গেল। মুসলিম সমাজের গণমানসিকতায় এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়লো। শুধু মাদ্রাসাই নয় ১৮৩৫-এ ভারতের প্রথম আধুনিক মেডিক্যাল স্কুল “নেটিভ মেডিক্যাল ইন্সটিটিউশন”ও বন্ধ হয়ে গেল। সংস্কৃত কলেজ বা হিন্দু কলেজ বন্ধ হয়ে গেলে শিক্ষিত হিন্দুদের ওপরে যেরকম প্রভাব পড়ত, এ প্রভাবও সেরকম। মুসলিম মানসিকতায় “অপর” নির্মিত হতে শুরু করল – একদিকে হিন্দু, অন্যদিকে ইংরেজ।
এখানে “নেটিভ মেডিক্যাল ইন্সটিটিউশন” কিছুটা আলাদা আলোচনার দাবী রাখে। ১৮২২-এ তৈরি হওয়া এই প্রতিষ্ঠান আধুনিক মেডিক্যাল শিক্ষার জন্য তৈরি ভারতের প্রথম মেডিক্যাল স্কুল। ডাক্তারদের অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে তৈরি করার জন্য এখানে ৩ বছর পড়ানো হত। এবং সেসময়ে উর্দু হয়েছিল পশ্চিমী পদ্ধতিতে ডাক্তারি শিক্ষার ভাষাগত মাধ্যম। (সীমা আলাভি, ইসলাম অ্যান্ড হিলিং – লস অ্যান্ড রিকভারি অফ অ্যান ইন্ডো-মুসলিম মেডিক্যাল ট্র্যাডিশন)।
১৮৩৫-এ এ প্রতিষ্ঠানটি ভেঙ্গে দিয়ে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ তৈরি হল। সেদিন এখানকার সমস্ত ছাত্রকে কুলোর বাতাস দিয়ে বিদেয় করে দেওয়া হল। “নেটিভ” শিক্ষক শেখ ওয়ারিস আলি এবং হীরা লালের তত্ত্বাবধানে নিজেদের খরচে নৌকা ভাড়া করে এরা ফিরে গেল দিল্লি, এলাহাবাদ, লক্ষনৌ-এর মতো জায়গাগুলোতে – নিজেদের ভিটেতে। এরা এবং এদের বংশধরেরা সিপাহী বিদ্রোহের সময় লক্ষ্যণীয় শক্তি হিসেবে কাজ করেছে ইংরেজদের বিরুদ্ধে। সেসময় বাংলার হিন্দুবাবুরা প্রায় ব্যতিক্রমহীনভাবে সিপাহীদের দমনে প্রত্যক্ষ মদত জুগিয়েছে।
আবার রবীন্দ্রনাথ
রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ ও হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক নিয়ে বিভিন্ন প্রবন্ধের সংকলন কালান্তর প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৩৭-এ বিশ্বভারতী থেকে। এই সময়কাল জুড়ে একাধিক ভয়াবহ হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা হয়ে গিয়েছে। এ সংকলনের “হিন্দুমুসলমান” প্রবন্ধে স্পষ্টভাবে বললেন – “যে দেশে প্রধানত ধর্মের মিলেই মানুষকে মেলায়, অন্য কোন বাঁধনে তাকে বাঁধতে পারে না, সে দেশ হতভাগ্য। সে দেশ স্বয়ং ধর্মকে দিয়ে যে বিভেদ সৃষ্টি করে সেইটে সকলের চেয়ে সর্বনেশে বিভেদ।” (পৃঃ ৩২৮-২৯) অন্য আরেকটি প্রবন্ধ “স্বামী শ্রদ্ধানন্দ”-তে তিনি বলছেন – “আজকে দেখতে হবে, আমাদের হিন্দুসমাজের কোথায় কোন্ ছিদ্র, কোন্ পাপ আছে; অতি নির্মমভাবে তাকে আক্রমণ করা চাই। … আমাদের পক্ষে এ বড়ো সহজ কথা নয়। কেননা, অন্তরের মধ্যে বহু কালের অভ্যস্ত ভেদবুদ্ধি, বাইরেও বহু দিনের গড়া অতি কঠিন ভেদের প্রাচীর। …. আমাদের মধ্যে কত ছোটো ছোটো সম্প্রদায়, কত গণ্ডী, কত প্রাদেশিকতা – উত্তীর্ণ হয়ে কে আসবে?” (পৃঃ ৩২৪-২৫)
অনেকদিন আগে দীনেশচন্দ্র সেনের বঙ্গভাষা ও সাহিত্য (ইংরেজপ্রভাবের পূর্ব্ব পর্যন্ত) (১৮৯৬ সালে প্রথম সংস্করণ) প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি বাঙ্গালির নিজস্ব ভাষার অন্দরমহলের রত্নরাজির সম্ভার বাংলাভাষী পাঠকের সামনে খুলে দিয়েছিলেন। ভাষাগতভাবে বাংলা যে এত সমৃদ্ধ এই বোধ হয়তো কিছু পরিমাণে বাঙ্গালির নতুন আত্মপরিচিতির জন্ম দিতে সাহায্য করে থাকবে। এই পুস্তকের একটি নজর দেবার মতো বিষয় হল সাম্প্রদায়িকতা বোধহীন বক্তব্যের স্পষ্ট প্রকাশ। দীনেশচন্দ্র লিখছেন – “হিন্দুগণ যেরূপ পীরের সিন্নি দিতেন, মুসলমানগণও সেইরূপ দেবমন্দিরে ভোগ দিতেন উত্তর পশ্চিমে হিন্দুগণ এখনও মহরম উৎসব করিয়া থাকেন। অর্দ্ধ শতাব্দী হইল, ত্রিপুরার মৃজাহুসেনআলি নামক জনৈক মুসলমান জমিদার নিজ বাড়ীতে কালীপুজা করিতেন এবং ঢাকার গরিব হুসেন চৌধুরী সাহেব বিস্তর টাকা ব্যয় করিয়া শীতলা দেবীর অনুষ্ঠান করিতেন, আমরা এরূপ শুনিয়াছি।” (দ্বিতীয় সংস্করণ, “কাব্যশাখা”, পৃঃ ৫৪০)
এ সত্যকে কি আমরা স্বীকার করতে পারব? কিংবা প্রত্যেকের নিজের আত্মচিহ্ন মুছে ফেলে একটি সমস্তত্ব রাষ্ট্রিক সংস্কৃতির মাঝে বিলীন হয়ে যাব?
রবীন্দ্রনাথ এবং দীনেশচন্দ্র আমাদের বড়ো শক্ত প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেন।

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (18)
  • comment-avatar
    Anup+Sengupta 3 years

    গভীর বিশ্লেষণে খুবই প্রাসঙ্গিক একটি প্রবন্ধ। ইতিহাসের বাঁকগুলিকে যেভাবে প্রমাণ, তথ্যসহ উপস্থাপন করছেন লেখক, তা আজকের ভারতের মৌলবাদের উৎসকে চিনতে অনেকাংশে সাহায্য করে।

  • comment-avatar
    Bhaskar 3 years

    তীক্ষ্ণ যুক্তিক্রম ও ঠাস বুনোটে গাঁথা খুব শক্তিশালী প্রবন্ধ। প্রতিক্রিয়ার লেখনী-জীবীদের কাছে এবং পাল্টা-নির্মাণে সক্রিয়দের বহুল পঠিত হওয়া উচিৎ।

  • comment-avatar
    তুহিন কুমার চন্দ 3 years

    অসাধারণ লেখনি।ঋদ্ধ হলাম।এধরণের লেখা সচরাচর চোখে পড়েনা।লেখকের কাছে কৃতজ্ঞ থাকলাম।

  • comment-avatar
    Koyel Somsarkar 3 years

    Ank dhonnobaaad apnake kaku,eto sundor o sohoj kore,moner avibekti bojhanor jonno 🙏🙏🙏

  • comment-avatar
    তমা দাস 3 years

    সমৃদ্ধ হলাম। অনেক নতুন তথ্য পেলাম। আরও পড়তে চাই।

  • comment-avatar
    Dipankar Ghosh 3 years

    বাস্তবের অতি নিকটবর্তী একটা লেখা।ধর্মীয় বিভেদের ইতিহাস খুব পুরোনো নয়।

  • comment-avatar
    বিশাল 3 years

    অনেক কিছু জানতে পারি স্যার আপনার লিখা পরে
    অনেক অনেক ধন্নবাদ স্যার এতো ভালো করে গুছিয়ে লিখা উপহার দেবার জন্য

  • comment-avatar
    Gora 3 years

    Khub Bhalo lekha.ekhon sob gulie deoa hocche.

  • comment-avatar
    Barnali dutta 3 years

    আমাদের সংস্কৃতিতে মিশ্র সংস্কৃতি সে কথা সত্য, কিন্তু আমরা বর্তমানে হিংসাবশত সেসব ভুলতে চলেছে বা জোর করে ভুলছি এবং হিংসা কে বাড়িয়ে তুলছি। তোমার লেখনীর খোঁচায় হয়ত মানুষ আবার সেই সমস্ত কিছু নিয়ে ভাববে।

  • comment-avatar
    রাজীব ব্যানার্জি 3 years

    লেখাটা পড়ে ভালো লাগল। ‘দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে যাবে না ফিরে এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে….’ এই সংস্কৃতিকে আবার মনে করিয়ে দিলেন তার জন্য ধন্যবাদ….

  • comment-avatar
    দেবাশিস দত্ত 3 years

    আপনার লেখা পড়ে সমৃদ্ধ হই। সে একদিক। আমি প্রায়শই ভাবি সমাধান কি এবং কোন পথে? রবীন্দ্রনাথ এই সমস্যার স্বরূপ উপলব্ধি করেছিলেন। হয়ত অনপনেয় না হোক দুরপনেয় কিছু সম্ভাবনার পথ অনুসন্ধানের উদ্যোগও নিয়েছিলেন তাঁর বিশ্বজনীন ভাবনার আন্তরিক উদারতায়। ক্রমবর্ধমান বিজ্ঞান বিবর্জিত ধর্মীয় আয়োজনের পৃষ্ঠপোষকতা যেখানে বিবদমান (অবশ্যই লোকদেখানো) রাজনৈতিক গোষ্ঠীদের মুখ্য উপজীব্য সেখানে এই সঙ্কটের পরিত্রাণ কোন পথে? দুই প্রধান ধর্মীয় গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন হয়ত কিছুটা ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টির সহায়ক হতে পারে।

  • comment-avatar
    Jaga 3 years

    বেশ কিছুদিন বাদে তোমার এই লেখাটি পড়ে ভীষন ভালো লাগলো ৷

  • comment-avatar
    রঞ্জন দাস 3 years

    অনেকের মতো আমিও একজন, যে কিনা সমাজের পারিপার্শ্বিক বেশ কিছু ঘটনাবলী অনেক সময়েই ওপর থেকেই দেখি ও ভাবি। আপনার লেখা পড়লে বোঝা যায় এদেশের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, পরোমপরা ইতিহাসের পুনর্লিখনএর মাধ্যমে কিভাবে আস্তে আস্তে ধংশের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সত্যি লেখাটা অসাধারণ। ব্যক্তিগত ভাবে ভীষণ উপকৃত হলাম

  • comment-avatar
    Gautam Chaudhuri 2 years

    তোমার প্রাজ্ঞতা আর লেখনশৈলী আমাকে মন্তব্য করা থেকে বিরত করতে চায়।
    আমি just অভিভূত হয়ে পড়ি।

  • comment-avatar
    Rajib Banerjee 2 years

    সমৃদ্ধ হলাম। জয়ন্ত দা ধন্যবাদ নয় কৃতজ্ঞতা জানাই

  • comment-avatar
    ভাস্কর ভট্টাচার্য 2 years

    আবারও পড়লাম রবীন্দ্র জয়ন্তীর দিনে। ভক্তরাও যদি পড়ত!

  • comment-avatar
    ওয়ালিউল ইসলাম 2 years

    তোমার অসামান্য বিশ্লেষণী লেখা আমাদের বিবেকে ঘা দিক, বিভেদের রাজনীতি পেরিয়ে ঐক্য ও সংহতির পরিবেশ কায়েম হোক এই প্রার্থনা করি।

  • demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes