
মেরু- নিশীথের নাবিকেরা
চতুর্থ পর্ব
পার্থজিৎ চন্দ
এ কবিতাটির শরীরের মধ্যে ঘটনাক্রমের কালখণ্ড অতি-সংক্ষিপ্ত। একজন মানুষ যেন এইমাত্র একটা কথা বলা শুরু করেছিল আর এইমাত্র শেষ হয়ে গেল তার কথা। কিন্তু কবিতাটির কাছে বারবার ফিরে আসলে বোঝা যাবে এ কবিতা আসলে এক মানবের জীবনব্যাপী সাধনার সারাৎসার ধারণ করে রয়েছে। যে উত্তুঙ্গ মানসিক অবস্থায় গিয়ে পৌঁছেছেন কবি তা কোনও মুহূর্তের অর্জন হতে পারে না। এই নিরাভরণ উচ্চারণ করবার জন্য বহুদিন আগেই তিনি যাত্রা শুরু করেছিলেন, আমাদের কাছে সে বার্তা এসে এইমাত্র পৌঁছালো।
কমলালেবু ও অসীম নক্ষত্রের মাতা
আচার্য পিপ্পলাদ’কে তাঁর ছয় ছাত্র ছটি প্রশ্ন করেছিলেন, দর্শনের প্রশ্নে সেগুলি তখনও অতিগুরুত্বপূর্ণ ছিল; আজও সেগুলি অতিগুরুত্বপূর্ণ হয়েই রয়ে গেছে। জীবের জন্ম থেকে শুরু করে কীভাবে ‘প্রাণ’ দেহধারণ করে ও দেহত্যাগ করে বেরিয়ে যায়… প্রাণের স্বরূপ ইত্যাদি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছিলেন আচার্য পিপ্পলাদ তাঁর শিষ্যদের সঙ্গে। প্রশ্নোপনিষদ নামটি এই প্রশ্ন ও উত্তরদান প্রক্রিয়ার ভেতর থেকেই উঠে এসেছে। উপনিষদের এ শ্লোকের উপর একদিন ঘন মেঘের মতো ছেয়ে এসেছিল জীবনানন্দ দাশের একটি কবিতা; দূর, ক্ষীণ সংযোগ স্থাপিত হতে শুরু করেছিল দুটির মধ্যে। সংযোগটিকে আবিষ্কার করার আগে একবার শ্লোকটি পড়ে নেওয়া যাক, ‘আত্মনঃ এষ প্রাণো জায়তে। যথৈষা পুরুষে ছায়া, এতস্মিন্নেতদাততং মনোকৃতেনায়াত্যস্মিন শরীরে’।।
প্রাণ যে ছায়ার মতো সত্য পুরুষে বিস্তৃত আছে তাহা অনৃত, অর্থাৎ মিথ্যা। ছায়া যেরূপ পুরুষকে আশ্রয় করিয়া থাকে সেইরূপ প্রাণও আত্মাকে আশ্রয় করিয়া থাকে, স্বতন্ত্রভাবে থাকিতে পারে না।… আত্মা হইতেই প্রাণ জন্মগ্রহণ করে, যাহা সত্য হইতে জাত হয় তাহা কখনও মিথ্যা হইতে পারে না। আলোক হইতে যেমন অন্ধকারের উদ্ভব হইতে পারে না, সেইরূপ সত্যরূপ আত্মা হইতে কোনও মিথ্যার উদ্ভব হইতে পারে না… মনের ইচ্ছা-সংকল্পাদি দ্বারাই প্রাণ নূতন দেহকে আশ্রয় কর; যাহার মনের সংকল্প যেরূপ সে সেইরূপ দেহই পাইয়া থাকে। সাধারণতঃ মৃত্যুকালে মনের সংকল্প বা অবস্থা অনুসারেই এই দেহপ্রাপ্তি ঘটে, কিন্তু মৃত্যুকালিন মনের সংকল্প আবার সমস্ত জীবনব্যাপী মানসিক অবস্থার উপর নির্ভর করে…।
এই শ্লোকটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একের পর এক স্তর উন্মোচিত হতে শুরু করে, যেন একটি মহাবৃক্ষ ক্রমশ বল্কল ত্যাগ করতে করতে প্রতিমুহূর্তে নবীন থেকে নবীনতর হয়ে উঠছে… প্রতিটি স্তরে এক একটি বাস্তবতা। যত বল্কলমোচন তত গূঢ় রূপ।
এবার জীবনানন্দের ছয়-পঙক্তি’র একটি কবিতা, বহুল পঠিক, উদ্ধৃত করা যাক। কবিতাটির নাম ‘কমলালেবু’,
‘একবার যখন দেহ থেকে বার হয়ে যাব
আবার কি ফিরে আসব না আমি পৃথিবীতে?
আবার যেন ফিরে আসি
কোনো এক শীতের রাতে
একটা হিম কমলালেবুর করুণ মাংস নিয়ে
কোনো এক পরিচিত মুমূর্ষুর বিছানার কিনারে।’
-কবিতাটির প্রথম দু’-লাইনে যে প্রশ্ন লুকিয়ে রয়েছে তার উত্তর যে কবি খুব একটা প্রত্যাশা করছেন এমন নয়; কারণ প্রশ্নের মধ্যেই সূক্ষ ইশারা যেন রয়ে যাচ্ছে – ফিরে আসবেন, ‘তিনি’ ফিরে আসবেন। শুধু রূপান্তর ঘটে যাবে হয়তো। এবং কবি এই রূপান্তরই প্রত্যাশ্যা করছেন কবিতার পরের চারটি লাইনে।
কিন্তু প্রথম দুটি লাইন যতটা ‘সহজ’ মনে হয় আদপে সে দুটি তেমন নাও হতে পারে, দেহ থেকে বার হয়ে যাবার পর কী পড়ে থাকে তবে? যা পড়ে থাকে তার সঙ্গে প্রাণের সংযোগ কতটা? প্রশ্নোপনিষদের শ্লোকে আমরা পেয়েছিলাম, ‘প্রাণ আত্মাকে আশ্রয় করিয়া থাকে, পৃথকভাবে থাকিতে পারে না।’ প্রাণ নির্মোকের মতো ত্যাগ করে যাচ্ছে শরীর’কে। জীবনানন্দের কবিতায় যেন তারই ইঙ্গিত রয়েছে।
কবিতাটির তৃতীয় পঙক্তি’তে এসে পরিস্ফূট হচ্ছে জন্মান্তরের ইচ্ছা এবং সে ফিরে আসার মধ্যে স্বেচ্ছাকৃত কৃচ্ছতাসাধনের বিষয়টিকে অস্বীকার করা যাবে না। কারণ তিনি ফিরে আসতে চান ‘এক শীতের রাতে’।
এই লাইনটিতে ‘শীত’ শব্দটি প্রয়োগের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যাচ্ছে জীবনের অসীম ভারের প্রতি অঙ্গুলিনির্দেশ। জীবনের সমস্ত মিঠে রোদ ফিকে হতে হতে যেন ঝরে পড়ছে অন্ধকার শীত-সন্ধ্যার দিকে। অনতিদূরে অপেক্ষা করছে দীর্ঘ শীতের রাত, তার ভেতর অপেক্ষা করছে এক মুমূর্ষু মানুষ অন্তিম ক্ষণটির জন্য। পঞ্চম লাইনে কমলালেবুর আগে বিশেষণ হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে ‘হিম’। হিম শব্দটি ব্যবহৃত হবার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মনে হতে বাধ্য প্রাণের খাদ্য হিসাবে যা অপেক্ষমান তাও আসলে ‘মৃত’। শুধু তাই নয়, আরও একটি বিশেষণ কিছুতেই চোখ এড়িয়ে যেতে পারে না, সেটি হল ‘করুণ’। যে কমলালেবুর শরীর নিয়ে কবি ফিরে আসতে চান তা যেন প্রত্যক্ষ করতে পারছেন তিনি। হতে পারে সে কমলালেবু হিম ও করুণ; কিন্তু একজন মুমূর্ষুর কাছে সে তখন মৃত্যুকে কিছুটা সময়ের জন্য হলেও পরাস্ত করার অমোঘ আয়ুধ। কবি হয়ে উঠতে চাইছেন সে আয়ুধ। ভবিষ্যতের সে মুমূর্ষুর সঙ্গে মুহূর্তে স্থান অদলবদল করে নিচ্ছেন কবি। যে পথ ধরে হিম কমলালেবুর করুণ মাংসের শরীর নিয়ে ফুটে ওঠবার ইচ্ছা প্রকাশ করছেন তিনি সে পথ ধরেই যেন ফুটে উঠছে মৃত্যুপথযাত্রী এক মানুষের ছবি। জীবনের বেশিরভাগ সময়ই হয়তো তার বৃথা কেটেছে; হয়তো সুউচ্চ কোনও শেষ-ইচ্ছাও নেই তার। জীবনের আনখশির ব্যর্থতার দিকে তাকিয়ে সুতীব্র হতাশা গ্রাস করছে তাকে। তার চাওয়া শুধু এটুকুই – একদিন, কোনও একদিন সে ফুটে উঠতে চায় কমলালেবুর করুণ মাংস নিয়ে। একটি অভিভূত ও বিস্মিত ঘাসের মাথা যেন সবার অগোচরে মাটির দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এ মুহূর্তে সে নিজেকে মিশিয়ে দিতে চায় মাটির সঙ্গে, শিশির ঝরে পড়া শব্দের সঙ্গে।।
এই কবিতাটি পড়তে পড়তে সব থেকে ঘাতক ভাবনাটি এসেছিল একদম শেষ পঙক্তি’তে এসে; কবি ফুটে উঠতে চাইছেন… পরজন্মে তাঁর সামান্য খুদকুঁড়ো নিয়ে ফুটে থাকতে চাইছেন ‘কোনো এক পরিচিত মুমূর্ষুর বিছানার কিনারে’।
বারবার পড়েও কিছুতেই বেরোতে পারছিলাম না ‘পরিচিত’ শব্দটির থেকে। কেন পরিচিত? কেন অপরিচিতের গণ্ডিটিকে ভেঙে চুরমার করে দিতে পারলেন না কবি?
এক একবার মনে হচ্ছিল এ শব্দটি কবিতাটির অসীম উচ্চতা ও সাবলীলতার সঙ্গে মানানসই নয়। উপনিষদের উদ্ধৃত শ্লোকের ব্যাখ্যায় আমরা পেয়ে গেছি, ‘মনের ইচ্ছা-সংকল্পাদি দ্বারাই প্রাণ নূতন দেহকে আশ্রয় কর; যাহার মনের সংকল্প যেরূপ সে সেইরূপ দেহই পাইয়া থাকে। সাধারণতঃ মৃত্যুকালে মনের সংকল্প বা অবস্থা অনুসারেই এই দেহপ্রাপ্তি ঘটে, কিন্তু মৃত্যুকালিন মনের সংকল্প আবার সমস্ত জীবনব্যাপী মানসিক অবস্থার উপর নির্ভর করে…’।
এ কবিতাটির শরীরের মধ্যে ঘটনাক্রমের কালখণ্ড অতি-সংক্ষিপ্ত। একজন মানুষ যেন এইমাত্র একটা কথা বলা শুরু করেছিল আর এইমাত্র শেষ হয়ে গেল তার কথা। কিন্তু কবিতাটির কাছে বারবার ফিরে আসলে বোঝা যাবে এ কবিতা আসলে এক মানবের জীবনব্যাপী সাধনার সারাৎসার ধারণ করে রয়েছে। যে উত্তুঙ্গ মানসিক অবস্থায় গিয়ে পৌঁছেছেন কবি তা কোনও মুহূর্তের অর্জন হতে পারে না। এই নিরাভরণ উচ্চারণ করবার জন্য বহুদিন আগেই তিনি যাত্রা শুরু করেছিলেন, আমাদের কাছে সে বার্তা এসে এইমাত্র পৌঁছালো।
অথচ এ দীর্ঘ পথের শেষেও কবি ‘পরিচিত’ শব্দটির ধাঁধা রেখে দিলেন আমাদের জন্য।
একটি কাল্পনিক দৃশ্যের কাছে ফিরে যাচ্ছিলাম বারবার; কবি হয়তো সব সময় নিক্তিতে ওজন করে শব্দ ব্যবহার করেন না। কিছু শব্দ জেন-সাধকদের মতো ‘নিষ্ক্রয়তা’র পথ ধরে আবির্ভূত হয় তাঁর কাছে। এ শব্দটি হয়তো তেমনই একটি শব্দ, সাবলীলতার পথ ধরে সে এসে বসেছে কবিতার শরীরে। কিন্তু পরমুহূর্তেই দৃশ্যটির ভেতর সন্ত্রাস পুরে দিচ্ছিলাম আমি নিজেই। সে সন্ত্রাসের ভেতর দিয়ে হেঁটে প্রায়ান্ধকার ঘরের এক কোণে রাখা কালো কাঠের টেবিলের ওপর একটি শুকিয়ে আসা একদা-পুরুষ্টু কমলালেবুর উপর ঝুঁকে আছেন তিনি। পায়চারি করছেন, ফুটে ওঠা দেখবেন বলে এক একবার এসে বসছেন টবের কাছে। অন্ধকার গাছের শাখায় শাখায় তখন একটি দুটি কুঁড়ি।
তিনি কি সচেতন ছিলেন না, তিনি কি কাল্পনিক ‘অপরিচিত’ শব্দটি বারবার কেটে দেবার সময় এটা ভেবে শঙ্কিত হয়ে ওঠেননি যে তিনি নিজে হাতে এ প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে ‘ধ্বংস’ করে দিচ্ছেন আরেকটি অমিত সম্ভাবনাকে?
না কি এই ‘পরিচিত’ শব্দটির ব্যবহার অতি-সচেতনারই নামান্তর মাত্র? এ শব্দটি কি চকিতে একবার মনে করিয়ে দেয় যে মানুষ আসলে তার অভিজ্ঞতার গণ্ডিটিকে অতিক্রম করতে পারে না কখনই?
যা তার ‘কনসাসনেস’-এর বাইরে রয়ে গেল মানুষ তাকে স্পর্শ করতে পারবে না কোনও দিন… তার কনসাসনেস জন্ম দেবে এমন এক সংস্কারের যার হাত থেকে মুক্তি নেই কিছুতেই… জন্ম-জন্মান্তর তাকে তাড়া করে বেড়াবে সে সংস্কার। এ সংস্কারের ফলেই তার জন্ম-জন্মান্তরে সে খুঁজে যাবে তার ‘পরিচিত’ ক্ষেত্রটিকে। এ পথ ধরে সব ভয়াবহ আরেকটি ধারণার কাছে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় বেশ কিছুক্ষণ; মানুষের মৃত্যুকালীন সংকল্পের ভেতরেও কি এভাবেই প্রবেশ করে সংস্কারের দীর্ঘ ছায়া?
২
সাধারণত জীবনানন্দের কবিতার কাছে একবার গিয়ে বসলে তাঁর এক একটি কবিতার হাত থেকে দ্রুত বিষ্ক্রমণ পাওয়া দুষ্কর হয়ে ওঠে, এখানেও তার ব্যতিক্রম হবার কোনও কারণ নেই; কিন্তু সেদিন ‘কমলালেবু’ কবিতাটির সঙ্গেই প্রায় সমান্তরালভাবে ‘হে জননী, হে জীবন’ কবিতাটি পাঠ হয়ে চলেছিল।
খুব বড় কবিরা অবধারিতভাবেই লিলিপুটের দেশে গ্যালিভারের মতো; তাঁদের কালচেতনা ও চৈতন্যের বিস্তার এতটাই বিপুল যে বহু সময় অতিক্রান্ত হয়ে যাবার পর এক একটি করে গ্রন্থি উন্মোচিত হতে শুরু করে। তুলনায় কম-পঠিত কবিতার মধ্যে রয়ে যায় এমন উপাদান যার একটি গ্রন্থি উন্মোচন করার ইশারা মাত্র আমাদের শিরদাঁড়া দিয়ে বিদ্যুতের স্রোত বয়ে যেতে বাধ্য। একজন পাঠকের কাছে সে আবিষ্কার নিছক ঠিক-ভুলের ঊর্ধ্বে… সে এক অপার্থিব প্রাপ্তির জগৎ।
জীবনানন্দের এ কবিতাটিও অগ্রন্থিত, তাঁর জীবৎকালে কোনও গ্রন্থে এটি সংকলিত হয়নি। ফলে এ কবিতাটি অপঠিত না-হলেও তুলনামূলকভাবে যে স্বল্প পঠিত তা বলাই যায়। কিন্তু কবিতাটির ভেতর দিয়ে বারবার যাবার সময় অনুভব করছিলাম কী অকল্পনীয় সব বিষয়কে কবিতার মধ্যে প্রবেশ করিয়ে ছিলেন তিনি। যেন সমুদ্রের নীচে ঘটে চলেছে আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত; অথচ পৃষ্ঠতলে খেলে বেড়াচ্ছে আনন্দ-ডলফিন।
এক মহাজাগতিক টেলিস্কোপ নিয়ে তিনি বসে রয়েছেন বাঙলার হিজলের কাছে। হিজল অথবা মেধার দ্যুতি – কে কার সাপেক্ষে ‘প্রতারক’ না নির্ণয় করা অসম্ভব। নশ্বর পাঠকের শুধুমাত্র সে রহস্যের আঁচল ছুঁয়ে থাকে কোনও কোনও মুহূর্তে অনুভব করার অধিকার আছে; তার থেকে একবিন্দু বেশি কিছুই আর তার কাছে নেই।
বিজ্ঞান ও সংকলিত জিনিসের ভিড়ের সংকীর্ণ গণ্ডির বাইরে রয়ে গেছে জ্ঞানের প্রকৃত ক্ষেত্র; জীবনানন্দ বারবার তাঁর কবিতায় এ পবিত্র জ্ঞানের কথা বলেছেন। এ বিশুদ্ধ জ্ঞান কি উপহার দেয় কালচেতনা ও সময়চেতনার অতি-প্রসারিত জগৎ?
কবিতাটি শুরুই হয়েছে মহাজাগতিক উল্লম্ফন দিয়ে, এক প্রাণ সম্বোধন করছেন নক্ষত্রমাতাকে, ‘হে অগাধ সন্তানের জননী, হে জীবন, / হে অসীম নক্ষত্রের মাতা,।’ ‘অসংখ্য’ শব্দটিকে জীবনানন্দ ‘অগাধ’-রূপে ব্যবহার করলেন। দৃশ্যমান ও দৃশ্যমান জগতের বাইরে রয়ে যাওয়া যে নক্ষত্রলোক, তার প্রসবদাত্রীকে সম্বোধনের মাধ্যমে তিনি শুরু থেকেই কবিতাটিকে অনুচ্চ-বাস্তবতার সীমা অতিক্রম করতে সাহায্য করলেন।
কিন্তু এই কবিতার তৃতীয় পঙক্তির মধ্যে লুকিয়ে থাকা বক্তব্যটিকে কি আমরা একমাত্রিক হিসাবে গ্রহণ করে তৃপ্ত থাকব? জীবনানন্দ লিখছেন, ‘তোমার ইশারায় অনন্ত সমতল – ঘাসে সবুজ হয়ে ওঠে।’ প্রথম কয়েকবার পাঠ করবার পর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মুগ্ধ ছাত্রছাত্রীর মতো আমাদের অনেকেরই ‘সূর্য সকল ক্ষমতার উৎস’, এই আপ্তবাক্য বেয়ে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে সূর্যের কারণেই পৃথিবীতে এই প্রাণ এবং তার ইশারাতেই অনন্ত সমতলের সবুজ হয়ে ওঠা।
কিন্তু একদিন কোনও রাত্রে শিহরণ খেলে গিয়ে মনে হবে জীবনানন্দ কি এই অনন্ত অনন্ত স্পেস (যা আসলে অনন্ত সমতল) ও সেখানে সবুজ প্রাণের কথাও বলে গেলেন ইঙ্গিতে? এই স্পেস কি সমতল?
ঠিক তার পরেই পঙক্তিতেই তিনি লিখলেন, ‘সোনালি চিনির ঢেউয়ে নিরবচ্ছিন্ন ক্ষেত হয়ে ওঠে মিষ্টি।’ লক্ষ করার, তিনি একবারের জন্যও আখ-ক্ষেতের কথা উল্লেখ করলেন না, তিনি লিখলেন ‘সোনালি চিনির ঢেউ’। যেন আখ নিমিত্ত মাত্র, কোথা থেকে কোন শূন্য থেকে ম্যাজিকের মতো নেমে আসছে সোনালি চিনির ঢেউ। ‘নিরবচ্ছিন্ন’ শব্দটি অনন্ত কন্টিনিউয়েশন’কে চিহ্নিত করে চলেছে অবশ্যই। এই কবিতার পঞ্চম-পঙক্তি’টি যেন এক জলবিভাজিকা, কবিতাটির মাঝখান দিয়ে বয়ে গিয়ে সে কবিতাটির শরীরকে দুটি-ভাগে বিভক্ত করে দিয়েছে। পাঠককে কোনও পূর্বপ্রস্তুতি নেবার সুযোগ না-দিয়ে তিনি লিখছেন, ‘নীহারিকা মিত্র চোখ বুজে ফুরিয়ে গেল – তুমি কোথায় চিলে মাতা!’
জীবনানন্দের কবিতার এ ধরণের ব্যক্তিনামের প্রয়োগ সুলভ।
নীহারিকা মিত্র চোখ বুজে ফুরিয়ে গেছেন কিন্তু সে অগাধ সন্তানের জননীর কাজ ফুরায়নি। সে এখনও মাছরাঙা উড়িয়ে চলেছে, স্ফটিকের মতো আলো বুনে চলেছে, ‘আজো তুমি মাছরাঙা ওড়াচ্ছ – স্ফটিকের মতো আলো বুনছ-।’ সপ্তম-পঙক্তি’টিতে এসে, হে পাঠক, অনন্ত অবসর নিন। থেমে থাকুন দীর্ঘ দীর্ঘ সময়, অনুভব করুন কীভাবে বিমূর্ত ক্রমশ মূর্ত হয়ে উঠছে, ‘হিজল জামের জানালায় সবুজ বাতাসকে চিলের ডানার মতো উড়িয়ে ঘুরছ-।’
অসীম নক্ষত্রের মাতা হয়ে উঠছেন সৃষ্টির মূলে থাকা সমস্ত কার্যকারণের প্রেরণাদাত্রী। জীবনানন্দের কাছে এ বিষয়টি এতটাই সুস্পষ্ট যে তিনি পরের পঙক্তি’তে আরও স্পষ্ট করে লিখলেন, ‘বিরাট ফলন্ত ভূখণ্ডের মতো সূর্যকে লক্ষ বন্দরের কোলাহলে অভিনন্দিত করে হাসছ তুমি,।’
কবিতাটি শেষ হয়ে যে দুটি পঙক্তি দিয়ে তা উল্লেখ করা যাক,
‘হাসছ তুমি জননী,
তুমি জেগে থাকতে নীহারিকা মিত্র কি ক’রে হারিয়ে গেল জননী, কি ক’রে হারিয়ে গেল?’
-এ দুটি পঙক্তি পড়লে একবার মনে হবে কবি পবিত্র ‘শিশুসুলভ’ মানসিকতায় এই বিপুল সৃষ্টির ভেতর থেকে তাঁর একান্ত ‘নীহারিকা মিত্র’র হারিয়ে যাবার শোক উদযাপন করে চলেছেন।
কিন্তু জীবনানন্দের কবিতার সামনে বসে কবেই বা আমরা একটি মাত্র ধারণাকে আশ্রয় করে আশ্বস্ত হতে পেরেছি! দ্বিতীয় তৃতীয় মাত্রা ছাড়িয়ে চতুর্থ মাত্রা আক্রমণ করেছে আমাদের।
এ কবিতাটি পড়তে পড়তেও মনে হবে সে নারীর নাম ‘নীহারিকা’। নীহারিকা… নীহারিকা… নীহারিকা শব্দটি ঘুরে ঘুরে বেড়াতে থাকবে আমাদের মাথার ভেতর। আকাশগঙ্গা… ছায়াপথ… কত ‘সূর্য’ জন্মে মরে গেছে। কত ডোয়ার্ফ স্টারের সঙ্গে আমাদের দেখাশোনা হবে না কোনও দিন।
ঠিক সে মুহূর্তে এসে আছড়ে পড়বে সেই ভয়াবহ প্রশ্ন – জীবনানন্দের এই নীহারিকা মিত্র কি এক ‘একক’ নীহারিকা?
একক এবং একটি মাত্র নীহারিকা? যে নীহারিকা সমগ্রের অংশ কিন্তু কিছুতেই সমগ্র নয়। তার চোখ বুজে ফুরিয়ে যাবার পরেও রয়ে গেছে অসীম নক্ষত্র মাতার ‘অসীম’ স্রোত… সৃষ্টিকে জাগরুক রাখার স্রোত।
সমগ্রের থেকে খসে পড়ছে একটি অংশ। অংশকে হারিয়ে সমগ্রের সামগ্রীকতার তেমন কোনও পরিবর্তন হচ্ছে না; সে রয়েছে আদি-অনাদির রূপ ধরে।
যেন কোথাও আকাশের কোনও এক দূরতম কোণে এইমাত্র ফুরিয়ে গেল একটি নীহারিকা; মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। কিন্তু সে মুহূর্তেও আমার জানালার পাশে বাঁশপাতাটি দুলে চলেছে একইভাবে।
এই ব্রহ্মাণ্ড-সমগ্রের মধ্যে একটি নীহারিকার উপস্থিতি এমনই তুচ্ছ, সামান্য। কোনও একদিন কোনও এক মানুষের মনে তার জন্য ব্যথার জন্ম হতে পারে, ঝরে পড়তে পারে এক-দু’বিন্দু অশ্রু; কিন্তু সে অগাধ সন্তানের জননীর বিশ্বজোড়া সংসার।
ব্যক্তির প্রশ্ন বড় জোর ছুটে যেতে পারে; কিন্তু সে কোনও দিন উত্তর পাবে না। হয়তো এটি উপলব্ধি করেই জীবনানন্দ লিখেছিলেন, ‘হাসছ তুমি জননী।’ নীহারিকা মিত্রের হারিয়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে জননীর এ হাসি ক্রূর, ইঙ্গিতবহ।
জগতজোড়া রন্ধনশালার কাছে বসে থাকা জননীর এই দুর্ভেদ্য হাসির দিকে চেয়ে থাকাই নিয়তি মানুষের।