
তিরন্দাজির পথে, জেন
শেষ পর্ব – (প্রথম অংশ)
পার্থজিৎ চন্দ
‘জেন’- শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে চলা রহস্যময়, মিস্টিক এক সাধনপদ্ধতি; প্রাচ্যের সুগভীর দর্শনের একটি ধারা, যে ধারার মধ্যে মিশে রয়েছে পারমিতার ছায়া, ‘না-জানা’র মধ্য দিয়ে জানার গূঢ় পদ্ধতি। একটি সুবিখ্যাত জেন-কবিতায় পাওয়া যায়, ‘Sitting quietly, doing nothing / Spring comes, and the grass grows itself’। এই ‘কিছুই না-করা’র পদ্ধতি অর্জন করতে হয় দীর্ঘ অনুশীলনের মাধ্যমে। আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানের এই ধারার সঙ্গে তিরন্দাজির মতো একটি শৌর্যময় বিষয়ের কি কোনও সংযোগ থাকতে পারে? তিরন্দাজি কি শিল্প? এই শিল্পের মধ্যে দিয়ে কি প্রবেশ করা সম্ভব জেন-এর মিস্টিক পৃথিবীতে? আজ থেকে প্রায় সত্তর বছর আগে প্রকাশিত হয়েছিল অয়গেন হেরিগেল-এর ‘Zen in the Art of Archery’। ব্যক্তি-অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ এ কাহিনি যেন এক রোমাঞ্চকর শান্ত থ্রিলার, ইউরোপের চোখে ‘জেন’ দর্শন অথবা ভিন্নধারার ডিসকোর্স।
অসিচালনা নিয়ে গুরুজিদের চমৎকার পর্যবেক্ষণ রয়েছে, কিছুটা তাঁদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা আর কিছুটা ছাত্রদের থেকে জানা। ওপরে ওপরে একজন শিক্ষার্থীকে যতই সাহসী আর লড়াকু বলে মনে হোক-না কেন গুরুজির কাছে শিক্ষাগ্রহণ করবার শুরুতেই তার গর্ব আর আত্মবিশ্বাস উবে যায়; জানতে শুরু করে ঠিক কতরকমভাবে তার জীবন তলোয়ারের আঘাতে বিপন্ন হয়ে উঠতে পারে। সে প্রতিপক্ষের দিকে আরও আরও বেশি নজর ও মনোযোগ দিতে শুরু করে। আঘাত প্রতিহত করবার কৌশল শিখে নিজে আক্রমণ করবার সুযোগে থাকে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, এই কৌশল তাকে বিন্দুমাত্র সুবিধা দেয় না, উলটে আগে তার যে আত্মবিশ্বাস ছিল তা কমতে শুরু করে। কিছুটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে সে লড়াই করবার আনন্দে নির্বোধের মতো মেতে ওঠে। এখন অভিজ্ঞতা তাকে শিখিয়ে দিয়েছে তার জীবন আসলে তার থেকে বেশি ক্ষমতাশালী, দক্ষ, যোগ্যতর প্রতিপক্ষের হাতের পুতুল। সে বুঝতে পারে শুধু দিনের পর দিন অনুশীলন করে যাওয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই; গুরুজিরও এই মুহূর্তে নতুন কিছু উপদেশ দেবার নেই। এখন তার লড়াই শুধু নিজের সঙ্গে; নিজেকে… প্রতিপক্ষ’কে অতিক্রম করে যাবার জন্য এবার দিনের পর দিন জীবন বাজি ধরে অনুশীলন করে যেতে হবে। এভাবে অনুশীলন করতে করতেই ধীরে ধীরে সে হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরে পেতে শুরু করে; তলোয়ার চালনার অপূর্ব সব কৌশল রপ্ত করতে করতে এক সময়ে তার মনে হয় লক্ষ্যের কিছুটা কাছাকাছি এসে পৌঁছেছে। এ বিষয়ে টাকুয়ানের কিছুটা ভিন্ন পর্যবেক্ষণ রয়েছে; তাঁর মতে, তলোয়ার তরুণ শিক্ষার্থীর মন চুরি করে নেয়।
তলোয়ার চালনার প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা এর থেকে বেশি ভালভাবে দেওয়া যায় না; একজন তরুণকে শিক্ষা দেবার এটাই সব থেকে ভাল উপায়। আবার এটি যে তরুণটিকে লক্ষ্যের দিকে খুব বেশি এগিয়ে দেবে না তাও গুরুজি জানেন। যে কোনও কারোর মধ্যে জন্মগতভাবে সাহস আর দক্ষতা থাকলেই সে দক্ষ অসিচালক হয়ে উঠবে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই; এ কথা জলের মতো সত্যি। তাকে লড়াইয়ের সময়ে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে গেলে চলবে না; মাথা বরফের মতো ঠান্ডা রাখতে হবে। শক্তি সঞ্চয় করে রাখতে হবে। কারণ, বুঝতে হবে তার সামনে লড়াই করবার জন্য এক দীর্ঘ ক্ষেত্র অপেক্ষা করে রয়েছে। ধীরে ধীরে নিজেকে প্রতিপক্ষের ধরাছোঁয়ার বাইরে নিয়ে চলে যেতে হবে। কিন্তু এতসবের পরেও একদম শেষ মুহূর্তে সে পরাজিত হতে পারে, এ পরাজয়ের কারণ হিসাবে টাকুয়ান অদ্ভুত একটা কথা বলেছিলেন।
টাকুয়ানের মতে, তলোয়ার-যুদ্ধের সময়ে একজন শিক্ষার্থীর প্রতিপক্ষের দিকে অনবরত নজর রেখে চলা’ই প্রথম ভুল। এখান থেকেই তার পরাজয়ের শুরু। প্রতিপক্ষের দিকে তাকিয়ে সে অনবরত ভাবতে থাকে তাকে কীভাবে পরাজিত করা যায়। তাকে আঘাত্ করার সুযোগ খুঁজতে থাকে। সে এতদিন যা শিখে এসেছে, যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে তার সার্থক প্রয়োগ করতে চায়। আর এভাবেই, টাকুয়ানের মতে, সে তার আপন সত্তার দিকে তাকাতে ভুলে যায়। সত্তার নিজস্ব একটি সচেতনতা আছে, তার কাজ করার নিজস্ব পদ্ধতি আছে। সত্তার কথা ভুলে যাবার ফলে সে ঠিক সময়ে ঠিক আঘাতটি করে উঠতে পারে না।
আসলে যাবতীয় কৌশল, শেখা কৌশলের সচেতন প্রয়োগের চেষ্টা, অভিজ্ঞতাগুলিকে ব্যবহার করবার উদগ্র বাসনা তার সত্তার স্বতস্ফূর্ততাকে নষ্ট করে দেয়, মনের স্বাভাবিক ক্রিয়াকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। এবার প্রশ্ন জাগতে পারে, তা হলে তার কী করা উচিৎ? কীভাবে অসিচালনার মতো একটি বিষয়কে আধ্যাত্মিকতার পর্যায়ে উন্নীত করা যাক? কীভাবে এতে সিদ্ধি লাভ করা সম্ভব? আমরা শুধু বলতে পারি শিক্ষার্থীকে ‘উদ্দেশ্যহীন’ আর ‘অহংশূন্য’ হতে হবে। তাকে ধীরে ধীরে শিখে নিতে হবে কীভাবে শুধু প্রতিপক্ষের থেকেই নয়, নিজের থেকেও নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে হয়। সে ব্যর্থ হতে পারে, কিন্তু তাকে নিজেকে অতিক্রম করে যাবার সাহস দেখাতে হবে। আপাতভাবে এই কথাটিও তিরন্দাজির ক্ষেত্রে বলা কথাগুলির মতোই অসার আর বোকামির মতো লাগতে পারে। তিরন্দাজিতেও বলা হয়, শিক্ষার্থীকে লক্ষ্যের দিকে তির ‘তাক’ না-করেই তির ছুড়তে হবে, লক্ষ্যের থেকে চোখ সম্পূর্ণ সরিয়ে নিতে হবে। এমনকি লক্ষ্যভেদ করবার সচেতন ইচ্ছাটুকুকেও বিসর্জন দিতে হবে। এক্ষেত্রেও মাথায় রাখা উচিত, টাকুয়ান অসিচালনা নিয়ে যে সব কথা বলেছেন তা কিন্তু হাজার হাজারবার সত্য প্রমাণিত হয়েছে।
তিরন্দাজির মতো এখানেও শিক্ষার্থীকে সোজাসাপটা একটা পথ দেখিয়ে দেওয়া গুরুজির উদ্দেশ্য নয়, তাঁর কাজ হল প্রতিটি শিক্ষার্থীকে তাদের নিজেদের দক্ষতা অনুযায়ী লক্ষ্যের দিকে ধাবিত হতে সাহায্য করা। গুরুজিরা তাই ছাত্রদের বাঁধাধরাপথে আঘাত হানার প্রবণতা থেকে বিরত থাকতে শিক্ষা দেন, এমনকি কেউ অতর্কিতে আক্রমণ করলেও শিক্ষার্থীরা যেন সে কাজ না-করে এমনটাই শেখান। ডি টি সুজুকি তাঁর লেখায় বিশদে ব্যাখ্যা করেছেন কীভাবে একজন গুরুজি নিজেকে এই কঠিন কাজে নিয়োজিত করতেন। তিনি লিখছেন, ‘জাপানের অসিচালনার গুরুজিরা মাঝে মাঝে জেন’কে ব্যবহার করতেন অসিচালনার শিক্ষা দিতে। হয়তো একজন শিক্ষার্থী এল এ-বিষয়ে শিক্ষা নিতে, গুরুজি জীবনের প্রান্তে এসে সবকিছু ছেড়ে-ছুড়ে দিয়ে পাহাড়ের উপর নির্জনে জীবন কাটাচ্ছেন, তিনি কিন্তু আবার শিক্ষা দেবার কাজ আনন্দের সঙ্গে শুরু করে দিতেন। ছাত্র তাঁকে সব রকমভাবে সাহায্য করত; জ্বালানির জন্য কাঠ কেটে আনা, ঝরনা থেকে খাবার জল আনা, কাঠ চেরাই করা, আগুন জ্বালানো, ভাত করা থেকে ঘরদোর-বাগান পরিষ্কার করা পর্যন্ত যাবতীয় কাজ সে করত। এখানে কোনও ধরণের প্রথাগত শিক্ষাদানের বিষয়ই নেই। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তরুণ শিক্ষার্থীর মনে অসন্তোষ আর বিরক্তি জন্ম নিত, কারণ সে একজন বৃদ্ধ গুরুজির কাছে বেগার খাটতে এতদূর উজিয়ে আসেনি। সে অসিচালনা শিখতে এসেছে। এভাবে একদিন বিরক্তি চরমে উঠলে সে গুরুজির কাছে গিয়ে সোজা প্রশ্ন করত, তাকে শিক্ষাদেবার কথা বলত। গুরুজিও না-করতেন না। ফল হত উলটো, সে তরুণ তখন থেকে আর নিজের খেয়ালখুশি মতো কোনও কাজ নির্বিঘ্নে করতে পারত না। কারণ তখন শুরু হত গুরুজির অদ্ভুত সব কাণ্ডকারখানা। ধরা যাক সে সকালে উঠে ভাত বসিয়েছে, গুরুজি তাকে পিছনদিক থেকে এসে খোঁচাতে শুরু করতেন। হয়তো সে ঘর মুছছে, গুরুজি হঠাৎ তাকে লাঠি দিয়ে খোঁচাতে শুরু করলেন। কোন দিক থেকে যে আক্রমণ আসবে তার ঠিক নেই, ফলে আত্মরক্ষার প্রশ্ন নেই। ধীরে ধীরে তরুণ শিক্ষার্থীর মানসিক স্থিতি নষ্ট হতে শুরু করত, কিছুতেই আর শান্তি নেই যেন। সব সময় সন্ত্রস্ত হয়ে থাকার মতো অবস্থা। বেশ কয়েক বছর কেটে যেত এই গুপ্ত খোঁচাগুলিকে এড়িয়ে যাবার কৌশল রপ্ত করতে। কিন্তু গুরুজির যেন তৃপ্তি হত না এত করেও। হয়তো একদিন ছাত্রটি দেখল যে গুরুজি একমনে রান্নাবান্না করছেন। ছাত্র মনে করল এটাই সেরা সময় গুরুজিকে একটু ‘শিক্ষা’ দেবার। গুরুজি কোমর বেঁকিয়ে রান্না করছেন, এদিকে শিষ্য একটা বড় লাঠি নিয়ে চুপিচুপি গুরুজির পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। এটাই সেরা সুযোগ গুরজির মাথায় লাঠি’টা ফেলার, সে সেটা করতে গিয়ে দেখত গুরুজি হাঁড়ির ঢাকনা দিয়ে লাঠি’টাকে ধরে ফেললেন।
শিক্ষার্থী তখন যা বোঝার বুঝে যেত, বুঝে যেত অসিচালনা-শিল্পের গভীর কথা। এতদিন গুরুজি সেটা তার কাছে থেকে গোপন করে রেখেছিলেন; আজ সে হাতেনাতে সেটা উপলব্ধি করল।
এই প্রথম শিষ্য উপলব্ধি করতে পারে তার প্রতি গুরুজির গভীর লক্ষ্যের বিষয়টি।
অসিচালনার একজন সার্থক শিল্পী হয়ে উঠতে গেলে শিক্ষার্থীকে প্রথমেই তার সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলির দিকে মন দিতে হবে, আরও পরিষ্কারভাবে বলা যায় ইন্দ্রিয়গুলির সচেতনতার দিকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। যে বিপদজনক আঘাতগুলি প্রকাশ পাবার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে তার হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করতে হবে। নিজের থেকে নিজেকে মুক্ত করবার এই শিল্প একবার রপ্ত করে ফেললে তাকে আর প্রতিপক্ষের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না। এমনকি প্রতিপক্ষ একজন, না একাধিকজন সে নিয়েও বিব্রত থাকতে হবে না। সে যেন তখন কী ঘটতে চলেছে তা আগে থেকেই বুঝতে ও দেখতে পাবে। এই আগে থেকে দেখতে পাবার ফলে ঘটনা ও তার পরিণাম থেকে সে নিজেকে বিযুক্ত করতে পারবে। এর ফল হবে মারাত্মক – প্রতিপক্ষকে বিদ্যুতগতিতে ‘উত্তর’ দেবার জন্য তাকে আর সচেতনভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে না। এর মধ্যে দিয়ে শিক্ষার্থী নিজেকে সব রকম সচেতন উদ্দেশ্যমূলক বিষয় থেকে বিরত রাখতে পারবে। এটা খুব বড় অর্জন।
কিন্তু গুরুজিদের কাছে এর থেকেও বড় প্রতিবন্ধকতা থেকে যায়, সেটা হল প্রতিপক্ষকে নিয়ে চিন্তা করা ও তাকে ঘায়েল করে দেবার হাজারো ফন্দি খোঁজা থেকে শিক্ষার্থীদের বিরত রাখা। কারণ প্রকৃত অসিচালনার শিল্পী হয়ে উঠতে গেলে প্রতিপক্ষকে নিয়ে চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলা জরুরি। শুধু তাই নয়, এটি যে জীবন-মৃত্যুকে হাতে নিয়ে একটা খেলা সে চিন্তার থেকেও বেরিয়ে আসা দরকার।
এটি শুরু করতে গেলে শিক্ষার্থীকে অনিবার্যভাবে একটা জিনিস’ই করতে হবে, প্রতিপক্ষ নিয়ে সমস্ত রকম চিন্তার থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা। শিক্ষার্থী হয়তো এটা করতে শুরু’ও করে, প্রতিপক্ষের থেকে নজর সরিয়ে দিয়ে সে নিজের দিকে বেশি নজর দেয়। কিন্তু এখানেও সমস্যা আছে, তখন সে অজান্তে নিজেকেই একজন প্রতিপক্ষ ও যোদ্ধা হিসাবে চিহ্নিত করতে শুরু করে। সচেতনভাবে সে যাই করুক না-কেন মনে মনে, অবচেতনে হয়তো তার গূঢ় উদ্দেশ্য থেকেই যায়। অর্থাৎ সে যত তীব্রভাবে নিজেকে নিজের থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করে তত’ই নিজেকে নিজের সঙ্গে বেঁধে ফেলে।
গুরুজিদের এ এক চরম পরীক্ষা, কারণ শিক্ষার্থীদের বোঝাতে হয় সে যতই চেষ্টা করুক না কেন, এর ফলে তার লাভের লাভ তেমন কিছু হচ্ছে না। সে শুধু মনোযোগ দেবার ক্ষেত্রটি পরিবর্তন করছে। গুরুজিরা শিষ্যদের মানসিক দ্বন্দ্ব ঘুচিয়ে বোঝাতে চান, এর থেকে পরিত্রাণের একটিই উপায় – প্রতিপক্ষ’কে সে যেভাবে নগণ্য করে তুলেছে, নিজেকে নিজের কাছে তাকে ঠিক একই উপায়ে নগণ্য করে তুলতে হবে। নিজের কাছে নিজে উদ্দেশ্যহীন হয়ে উঠতে হবে।এখানেও তিরন্দাজির মতো ধৈর্য, দিনের পর দিন অনুশীলন জরুরি। কিন্তু একবার অনুশীলনের মধ্যে দিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছালে শিক্ষার্থীদের মনের ভেতর থাকা ন্যূনতম আত্মগরিমা বা আত্মসচেতনতার বিলোপ ঘটে।
এই উদ্দেশ্যহীন হয়ে যাবার গভীর সুফল আছে। এর আগে শিক্ষার্থী তার ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভুতির উপর ভর করে আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করত। আগে আক্রমণের পূর্বানুমান করে প্রতি-আক্রমণ করা বা তার হাত থেকে নিজেকে বাঁচানো – এর মধ্যে একচুলের ব্যবধান থাকত। এখনও বিষয়টা আশ্চর্যজনকভাব এক; পার্থক্য শুধু একটাই। আত্মরক্ষা করা, বিদ্যুতগতিতে আক্রমণ করা – এখানে আর কোনও সময়ের ব্যবধান থাকে না। আত্মরক্ষা করার মুহূর্তেই অসি-যোদ্ধা আক্রমণ করে; অব্যর্থ আঘাত আছড়ে পড়ে প্রতিপক্ষের উপর। তখন তলোয়ার যেন নিজে নিজেই চালিত হয়, তিরন্দাজির মতো এখানেও শেষ পর্যন্ত ‘তিনি’ই একাধারে লক্ষ্য হয়ে ওঠেন ও আঘাত করেন। সমস্ত অহং মুছে গেলে ‘তিনি’ দৃশ্যমান হন, অহং-এর জায়গাটি তিনি অধিকার করেন। সচেতন প্রচেষ্টার পরিবর্তে বিষয়, এমন এক অস্তিত্ব যা সাধারণ পদ্ধতিতে ‘বোঝা’র নয়, ধরার’ও নয়। তিনি নিজেকে নিজে ব্যক্ত করেন শুধু তাদের কাছে যারা ‘তাকে’ উপলব্ধি করেন। টাকুয়ানের মতে, অসিচালনায় সিদ্ধি তখনই সম্ভব যখন ‘হৃদয়ে আর কোনও আলোড়ন থাকে না, আত্ম-পরের চিন্তা থাকে না, নিজের ও প্রতিপক্ষের তলোয়ার সম্পর্কে চিন্তা বা দুশ্চিন্তা থাকে না, তরবারি কীভাবে চালিত হবে সে নিয়ে উৎকণ্ঠা থাকে না; এমনকি জীবন-মৃত্যু নিয়েও সব চিন্তা দূর হয়ে যায়। এক অসীম শূন্যতা, নিজের সত্তা, ঝলসে ওঠা তরবারি আর একটা বাহু তরবারিকে চালিত করে। শুধু তাই নয়, শূন্যতা সম্পর্কে চিন্তাও সেখানে এসে শেষ হয়ে যায়।’