অজিত সিং বনাম অজিত সিং
অষ্টবিংশতি পর্ব
তৃষ্ণা বসাক
অজিত সিং বনাম অজিত সিং দ্বাবিংশতি পর্ব তৃষ্ণা বসাক অজিত সিং প্রথমে ছিল বঙ্গলক্ষ্মী চানাচুর, তারপর এল আজাদ হিন্দ চানাচুর, তারপর একের পর এক বিপ্লব চানাচুর, সর্বহারা চানাচুর, উন্নততর সর্বহারা চানাচুর, এখন চলছে বিশ্ববাংলা। এখানেই কি ভাবছেন গল্প ফুরিয়ে গেল? এবার আসছে একে ফিফটি সিক্স চানাচুর। নাম যাই হোক, সোল এজেন্ট আমি।’ ‘বেওয়ারিশ’ গল্পের চানাচুরওলা এবার ঢুকে পড়েছে বাংলার শিল্পক্ষেত্র থেকে শিক্ষাজগতের ক্ষমতার অলিন্দে।খুন, যৌনতা, প্রতিশোধ, নিয়তিবাদের রুদ্ধশ্বাস সুড়ঙ্গে সে টের পাচ্ছে- -বহুদিন লাশের ওপর বসে বারবার হিক্কা তুলেছি আমরা -বহুদিন মর্গের ভেতরে শুয়ে চাঁদের মুখাগ্নি করেছি আমরা -অন্ধ মেয়ের মউচাক থেকে স্বপ্নগুলো উড়ে চলে গেছে (জহর সেনমজুমদার) এই সবের মধ্যে বাংলার কি কোন মুখ আছে আদৌ? থাকলে কি একটাই মুখ? না অনেক মুখ, সময়ের বিচিত্র রঙে চোবানো? বিগত প্রায় অর্ধশতাব্দী জুড়ে বাংলার অজস্র মুখের ভাঙ্গাচোরা টুকরো খুঁজে চললেন তৃষ্ণা বসাক, তাঁর নতুন উপন্যাস ‘অজিত সিং বনাম অজিত সিং’-এ । সব কথনই রাজনৈতিক, সেই আপ্তবাক্য মেনে একে কি বলা যাবে রাজনৈতিক থ্রিলার? সিটবেল্ট বাঁধুন হে পাঠক, ঝাঁকুনি লাগতে পারে। প্রকাশিত হল উপন্যাসের ২৮ তম পর্ব। এই উপন্যাসের সব চরিত্র কাল্পনিক।
২৮
নিজের ভাবনায় বুঁদ হয়ে গেছিল পটা, পেছনের লোকটা
তাকে কিছু বলছে নাকি শুনতে পায়নি। সে বলল ‘সরি স্যার, কিছু বলছিলেন?’
কোন উত্তর নেই। পটা আবার বলল ‘শুনতে পাইনি স্যার, এমন সব আং সাং কথা মাথায় ঘোরে সারা দিন, বুঝলেন না, এ লাইনে কম দিন তো হল না, কত কিসিমের লোক দেখলাম, তার ইতিহাস বলতে গেলে হিস্ট্রি হয়ে যাবে। আমাদের গ্রামের এক মাস্টার আছে, ইস্কুলে কিছুদিন পড়েছিলাম কিন্তু, র ব ঠ এসব জানি, সেই স্যার আমাকে খুব ভালবাসেন। খুব নিরীহ ছিলাম কিনা, সাত চড়ে রা কাটিনি জীবনে, মা বলত সবাই কেষ্টের জীব, কাউকে কষ্ট দিবি না পটা, বুঝলেন না, তারক স্যার, তারক সেনাপতি, তিনি আমাকে দেখা হলেই বলেন এই যে চারচাকা, কবে থেকে বলছি যা দেখছিস লিখে ফেল, তোর মতো এত বিচিত্র জীবন কজন দেখতে পায়, কবে দেখবি তোর লেখা বই বেস্ট সেলার হয়ে যাবে।বেস্ট সেলার মানে জানি আমি স্যার। যে বইটা সবচে বেশি বিক্কিরি হয়। হাসির কথা নয়, বলুন স্যার? আমি, এই যে নেংটি ইঁদুরের মতো মানুষটা, পটা, ড্রাইভারি করি, আমার লেখা বই হিট হবে, শোলের মতো?’
এরপরেও কোন উত্তর এল না। আয়নায় দিব্যি ও দেখতে পাচ্ছে, লোকটা বসে রয়েছে, হাসি হাসি মুখ, অথচ কোন উত্তর দিচ্ছে না, প্রথমে অপমানই লাগল পটার, তারপর তার ভয় করল। অনেক সিনেমায় দেখায় এরকম। ভালো মানুষের মতো বসে আছে, ঠেলা দিলে গড়িয়ে গেল, আসলে মরে গেছে লোকটা। সে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, তা নয়, মোবাইলে কিছু একটা দেখছে মন দিয়ে। যা দেখছে তা যে খুব সুবিধের নয় তা বোঝাই যাচ্ছে। লোকটার মুখের মধ্যে উত্তেজনা ফুটে উঠেছে, নাকের পাটা ফুলে উঠছে, কী যে সুখ পায় লোকে ন্যাংটো মেয়েমানুষের ছবি দেখে বোঝে না পটা। কথায় আছে খেঁদি পেঁচি নূরজাহান/ আলো নিবলে সব সমান। সত্যি সত্যি ঘপাঘপ করবি তো কর না, কিন্তু এই যে বুড়ো হোক, ছোঁড়া হোক, দিন নেই রাত নেই, পার্কের বেঞ্চে, বাসে ট্রেনে অটোয় বসে ড্যাবড্যাব করে মোবাইলে মেয়েমানুষের না সুতো শরীর দেখছে, এ এক ভয়ানক অসুখ মনে হয় তার। পটার আবার পোঁদে ভয় বেশি। দেখবি দেখ, তার গাড়িতে কেন রে বাবা। পুলিশ কেস হয়ে গেলে সে তো ফেঁসে যাবে।কারণ গাড়ি সেই চালাচ্ছে। এ কথা শুনে একবার ছোড়দা হেসে খুন। ‘তুই আর হাসাস নি রে পটা। তোর গাড়িতে নীল ছবি দেখলে পুলিশ তোকে ধরবে! তাহলে তো ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে রে। সারা রাজ্যটা জেলখানা বানিয়ে কুলোতে পারবে না। এমনিতেই দেখ, এত চুরি, ডাকাতি, চিটিং, রেপ কেস- কটা সাজা হচ্ছে? হবে কোত্থেকে? যদি সব ঠিক ঠিক হত, তবে তো আর আলাদা কোন বাড়ি থাকত না, সারা দুনিয়ায় একটাই বাড়ি থাকত, জেলখানা।’ কথাটা বলে ছোড়দা একটা জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব করে হেসেছিল। যেন মোক্ষম একটা কথা বলেছে। পুলিশ কেন অপরাধীদের ধরছে না, তার আসল কারণ হল দেশে যথেষ্ট পরিমাণে জেলখানা নেই! কোন মানে হয়! ছোড়দা মাঝে মাঝে এমন অনেক জ্ঞানের কথা বলে। সাধারণত রুমকির কাছ থেকে আসার দুদিন পর অব্দি তার মুড খুব ভালো থাকে। সেসময় ছোড়দা পটার মেয়ের চকলেট কেনার টাকা দ্যায়, বিরিয়ানি খাওয়ায় ড্রাইভারদের। পটা বিরিয়ানি খেতে চায় না বলে ওর জন্য ফ্রায়েড রাইস আর পনির বাটার মশলা আসে। তাছাড়া মদ তো থাকেই।আর পটা মদ ছোঁয় না বলে ওর জন্য কোল্ড ড্রিংক আনতে ভোলে না ছোড়দা। খাবার সময় ছোড়দা রাজ্য রাজনীতি সমাজ নিয়ে অনেক লেকচার ঝাড়ে। দুদিনের সেই ঘোর কেটে গেলে এই লোকই আমূল বদলে যায়। তখন পান থেকে চুন খসলেই খিস্তি, পারলে তেড়ে মারতে আসে, চাকরিই খেয়ে নেয় এমন ভাব। ওরা তখন সবাই ভাবে শুক্রবার কখন আসবে, শুক্রবার এলেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে ওরা। লোকটা কেন তার কথার উত্তর দিল না ভাবতে ভাবতে পটার মনেই পড়ছিল না আজ কী বার।
এবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল মোবাইলে বুঁদ হয়ে আছে লোকটা। পটা আর ঘাঁটাল না তাকে। সেই পুরুলিয়ার কেসটা থেকে ফাঁকা গাড়ির একা প্যাসেঞ্জার নিয়ে তার ভয় ঢুকে গেছে। সেই লোকটা কখন যে কপ্পুরের মতো উবে গেল টের পায়নি সে। এখন ভেবে দেখছে প্রথম থেকেই ওর সন্দেহ করা উচিত ছিল লোকটাকে। দুটো ফ্যামিলি যাচ্ছে, তার মধ্যে ওরকম একা লোক ঢোকে কী করে? ঢুকিয়েছে আসলে ছোড়দা। ছোড়দার এরকম অনেক গুপি কেস আছে, যা বড়দা দু চক্ষে দেখতে পারে না। এরকম নানান চিড়িয়া টাইপ লোকের সঙ্গে ওঠ বোস করে ছোড়দা। আর এগুলো জোটে রুমকির ঠেক থেকে। রুমকি তো আর সারা সপ্তা সাদা শাড়ি পরে কীর্তন গায় না, তার সপ্তার সাত দিনে সাত ঘাটের নাগর বাঁধা থাকে, ছোট খুচরো কেস সে করে না বড় একটা, যদি না তার খুব পছন্দ হয়। আর ওর আবার একটা পরোপকারী মন আছে। তার স্থায়ী ও অস্থায়ী আশিক বা কাস্টমারদের কেউ বিপদে পড়লে সে তাকে যতটা পারে সাহায্য করতে চায়। ছোড়দার একবার যখন অ্যাপেন্ডিক্স ফাটি ফাটি করছি, এই রুমকি তার ডাক্তার আশিক শুভব্রত হাজরাকে বলে তড়িঘড়ি অপারেশনের ব্যবস্থা করে, সেইরকম অন্য কারো বিপদে ছোড়দাকেও দেখতে হয় বৈকি। সেই নিয়েই বড়দার খার। শুধু বড়দা কেন ছোটবউদিও এই কারণেই রুমকির নামে হাড়ে চটা। সে বলে, ‘তুমি ওই মাগির সঙ্গে শুতে যাচ্ছ যাও, তা বলে ওর কাস্টমার এখানে ঢুকিয়ে আমাদের ব্যবসা বাণিজ্য ডুবোবে কেন? ছেলেমেয়েগুলো তোমার জন্যে কি পথে বসবে?’
এমনিতেই সনাতন কাওরার দল এখনো তার পেছন ছাড়েনি। সেই একবার কিছু মেশিন তার কাছে রাখতে চেয়েছিল, সে রাজি হয়নি, তার পরেও হাল ছাড়েনি, প্রায়ই ফোন করে। সেই যে পুলিশকে মেরেছিল বলে তিনমাস হাজত বাস করিয়ে ছেড়েছিল মামারা, তাও আবার কলকাতায় নয়, ব্যারাকপুর জেলে ঠেলে দিয়েছিল, জেলখানার বাইরে কি সুন্দর সবুজ, আর জেলে একটা দশ ফুট বাই দশ ফুট ঘরে কজন ঠেসাঠেসি, বেগ চাপলে কান্না পেত, রাতে শোয়ার জো নেই, ওর শরীর ঠেসে ধরত একটা হুমদো, সেখানেই কী করে যেন ভাব হয়ে গেল সনাতন কাওরার সঙ্গে, গলায় কণ্ঠী, দারুণ কীর্তন গায়, সে নাকি হেন অপরাধ নেই করেনি, তার ওপর ড্রাগ, দানা, মেয়েমানুষ কী না পাচার করে, গলার মধ্যে হিরে ভরে রাখতে পারে, যাকে বলে মহাদেব মানুষ। সে একেবারে পটার প্রেমে পড়ে গেল। বলত ‘স্যাঙ্গাত, তোমার মধ্যে কৃষ্ণের রূপ আছে।’ তা পটার গলায়ও কণ্ঠী, ঠাকুরের নামগান জন্ম থেকেই শুনছে, মনেও আছে ভালো, গানের গলাও মন্দ নয়। সেই যে সনাতন জুটল, আর ছাড়ে না, অবশ্য ওর জন্যে অনেক সুবিধে হয়েছিল। কেউ আর জ্বালাত না, আর জেলের মধ্যে বসে ভালো ভালো খাবার কোত্থেকে যে জোগাড় করত। নম্বর নিয়েছিল, পটাও তখন আপত্তি করেনি দিতে। সে বলেছিল ‘সনাতনদা, এখান থেকে বেরিয়ে কিন্তু আর খারাপ লাইনে যাবে না, একদম ভালো হয়ে যাবে, বৌ ছেলে নিয়ে সংসার করবে, আর নামগান গাইবে’
সনাতন কী যে পবিত্র একটা হাসি হেসেছিল। বলেছিল ‘দেখি কেষ্টর কী ইচ্ছে’
পটা ভেবেছিল সনাতন এবার সত্যি লাইন ছেড়ে দেবে। জেল থেকে পটাই আগে ছাড়া পেল, মাত্র তিনমাস ছিল মেয়াদ। সনাতনের ছাড়া পাওয়ার কথা আরও এক বছর পর। বেরিয়ে ভুলেই গেছিল ওর কথা। হঠাৎ একদিন ফোন এল। ব্যস। সেই থেকে মাসে দু তিনবার ফোন করবেই। ছোড়দা বলেছে নম্বরটা ব্লক করে রাখা যায়, সেটা করতেও মন সরে না পটার। আহা সেই তিনমাস সনাতন না দেখে রাখলে ও কি বাঁচত ওই নরকে?
‘স্যার, বড্ড পেচ্ছাপ পেয়েছে, একটু গাড়িটা দাঁড় করাব?’
পটা এরকম করে কথা বলছে কেন কে জানে। যেন এই লোকটা ওকে কিনেই নিয়েছে, কিংবা সারাজীবনের জন্যে বুক করে রেখেছে গাড়ি, ও দিন রাত নেই গাড়ি চালিয়ে যাবে।বউ, মেয়ে, মা কিচ্ছু নেই ওর, ওর জন্মই হয়েছে ওকে পিঠে করে গাড়ি চালানোর জন্যে। এরকম বলে ফেলে নিজের ওপর ধিক্কার হয় পটার। কিন্তু কী করবে। যো বোল দিয়া সো বোল দিয়া। ও তো ওয়াপস নেহি হোয়েঙ্গা না? আরে হল কি তার! এত বছর কলকাতায় আছে সে, দু চারটে ইংরেজি শব্দ – থ্যাংক ইউ, ইয়েস স্যার, রেডি স্যার- এইসব বলতে পারলেও হিন্দির ধার দিয়েও যায় না পটা। অথচ তার যা কাজ, বেশি অবাঙ্গালি লোকজনকেই নিয়ে যেতে হয়, বিজনেস ট্রিপই বেশি। বেড়ানোর ট্রিপ তো কয়েকটা বাঁধা মরশুমে। তবে হ্যাঁ, সারাবছরের বেড়ানো পাবলিক আছে কিছু। দেখেই বুঝতে পারে এগুলো হচ্ছে শোয়া মাল। সমুদ্র টমুদ্র কিচ্ছু দেখবে না, যাবে আর হোটেলের ঘরের দরজা বন্ধ করে লদকালদকি করবে। ভাবলেও বিচ্ছিরি লাগে পটার। কিন্তু কী করবে, পেটের দায় বড় দায়। এদের তুললে উপরিও পাওয়া যায়। কথায় কথায় এরা একশ দুশ ধরিয়ে দ্যায় পটাকে। কিছু আনতে দিয়ে পয়সা ফেরত চায় না। আসলে তখন তো বেটারা নেশার ঘোরে থাকে। শরীরের নেশার থেকে আর বড় নেশা হয় না। শুধুই কি শরীর? পটা মাঝে মাঝে ভাবে এদের নিয়ে। বলতে নেই এদের দেওয়া বকশিসে তার মেয়ের একটা ভালো জামা কি মনির শখের পেতলের ফুলদানি হয়ে যায়, তাই এদের নিয়ে না ভাবলে বেইমানি হবে না কি? না, শুধুই শরীর নয়, এর মধ্যে অনেকখানি মুক্তির বাসনাও থাকে। পটা যেমন যখন জেলে ছিল, ছাড়া পাবার জন্যে হাঁকপাঁক করত, তেমনি এরাও যার যার সংসারের জেলখানায় হাঁকপাক করে। একটা জুড়ি গেছিল, যারা কলকাতা থেকে মন্দারমণি সারা রাস্তা দুজন দুজনেকে জড়িয়ে শুধু কেঁদে গেল। সত্যি বলতে কি, দেখে পটার চোখেও জল এসে গেছিল।মন্দারমণিতে ডিসকভারি বাংলা চেনের যে হোটেলে উঠেছিল, তার ম্যানেজার, পার্টি নিয়ে যেতে যেতে পটার খুব চেনা হয়ে গেছে, গেলেই সন্ধেবেলা মাল খেতে ডাকে। পটা অবশ্য ওসব ছোঁয় না, কিন্তু টুকটাক কাজু বা ফিশ বল চলে তার চায়ের সঙ্গে। আর তার সঙ্গে রাজ্যের কেচ্ছা। এই হোটেলটায় টলিউডের উঠতি নায়িকা বা টিভি সিরিয়ালের স্টারলেটদের সঙ্গে প্রযোজক কিংবা নেতারা ওঠে মাঝে মাঝে। আবার শিল্প, সাহিত্য জগতের তাবড় তাবড় নাম, যাদের এক সইয়ে বড় বড় পুরস্কার জুটে যেতে পারে, তাদের কৃপা পেতে কবিযশপার্থীরাও চলে আসে রাত কাটাতে। কুমারেশ বিশ্বাস, মানে ওই ম্যানেজারের ঝুলিতে তাই রসালো গল্পের অফুরন্ত ভান্ডার।পটা শুনতে না চাইলেও শুনতে হয়। আর করবেই বা কী। নইলে তো গাড়িতে বসে মশার কামড় খেতে হয়, আর নয়তো ড্রাইভারদের থাকার ঘরে চার পাঁচজনের সঙ্গে পয়সা দিয়ে তাস খেলার হুজ্জুতি। এর থেকে তো কুমারেশের সঙ্গ হাজার গুণ ভালো। কল্যাণীর ছেলে, বাবা মা ছেলে বৌ ওখানে আছে। মাসে মাসে বাড়ি যায়। ছেলে বৌ কে নিয়ে এলে আরামেই থাকবে বৌ, কিন্তু ছেলেটার আর পড়াশোনা হবে না।কুমারেশের ঘরের সঙ্গে একটু ব্যালকনি আছে, সামনেই সমুদ্র। অন্ধকার নেমে গেছে। বর্ষাকাল। সমুদ্র উত্তাল হচ্ছে আস্তে আস্তে। কিন্তু আকাশে মেঘের ফাঁকে আধখানা চাঁদ উঠেছে। পটার মতো লোকও মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে সেই দেখে। গ্লাসের হুইস্কিতে চুমুক দিতে দিতে সেই আধো চাঁদের আলোয় ভরা আকাশের দিকে চেয়ে অন্যমনস্ক ভাবে কুমারেশ বলেছিল ‘জিন্দেগী এক পহেলি, বুঝলে পটাদা। কে যে কীসে সুখী হয়, জানি না। দেখো বৌ বাচ্চা ছেড়ে এখানে আছি, সারাদিন দম ফেলার ফুরসত নেই, কিন্তু টাকা দ্যায় ভালো আর তার চেয়েও বড় কথা নানান চরিত্র দেখি বুঝলে। যেমন ধরো ওরা, এরকম আজব জুড়ি দেখিনি আমি। সবাই আসে ফূর্তি করতে আর এদের দেখো এসে থেকে কেঁদেই চলেছে’ পটা কুমারেশের আঙুল অনুসরণ করে দেখে চমকে ওঠে। আধো অন্ধকারে ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যে সেই পুরুষ আর মহিলাটি, যারা পরস্পরকে রানু আর বাবলা বলে ডাকছিল, যাদের ও আজকেই গাড়ি করে এখানে এনেছে, তারা পরস্পরের হাত ধরে হেঁটে আসছে। দুজনের পরনেই সাদা পোশাক বলে ওদের এত স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।ছেলেটা পরে আছে সাদা পাজামা পাঞ্জাবি । মেয়েটা সাদা সালোয়ার কুর্তি।
কুমারেশ হঠাৎ বলল ‘আমার খুব ভয় লাগছে পটাদা। ওরা কেন সাদা পরে আছে বল তো?’
পটা বুঝতে পারল না ওরা কী রঙ পরে আছে, তাতে কী ছেঁড়া গেল। সারাজীবন প্রায় ইস্কুলের দরজা না মাড়ানো পটার মনে হল মৃত্যুর কি কোন রঙ হয় আদৌ? মৃত্যু মানে তো একটা খালি জায়গা, যদি কিছু ভরাট থাকে তা সেই মানুষটার স্মৃতি দিয়ে ভরাট করা। স্মৃতিরই বা কি রঙ? মানুষ বোকার মতো, মরে গেলে সাদা বা কালো পোশাক পরে, সারা পৃথিবী জুড়ে। কেন বেগুনি, গোলাপি বা সবুজ নয়? এসবের কোন মানে নেই। তবে সাদা রংটা কেমন চোখে ধাক্কা তৈরি করে। যারা সাদা পোশাক পরে, ওর মনে হয়, অন্য মানুষদের থেকে আলাদা হওয়ার জন্যেই করছে। যেন তারা আলাদা কেউ, অনেক বলিদান চড়াচ্ছে এই পৃথিবীর জন্যে। সাদা পোশাকের মধ্যে একটা তৈরি করা রাজনীতি আছে বলে মনে হয় তার।তবে এরা কলকাতা থেকে কিন্তু সাদা পরে আসেনি। দুজনেই পরে এসেছিল লাল। মেয়েটা লাল শাড়ি, ছেলেটা লাল টি শার্ট। স্পষ্ট মনে আছে, কারণ ওদের লালটা একেবারে আগুন লাল, ওদের বসার পর মনে হয়েছিল পেছনের সিটে আগুন ধরে গেছে যেন।
সে খেয়ালই করেনি ওরা এখানে এসেই সাদা পরে যাচ্ছে লাগাতার। কুমারেশ না বললে খেয়ালই করত না হয়তো। সে ভ্যাবলার মতো বলল ‘সাদা পরে আছে তো কী?’
‘আরে বুঝতে পারছ না, ওরা এখানে এসেছে আত্মহত্যা করতে। আমি আগে এরকম দেখেছি। অনেক অনেক বছর আগে, আমি তখন অন্য হোটেলে ম্যানেজারি করতাম, বিয়ে করিনি, এরকম এক জোড়া এসেছিল। তারাও সাদা পরেছিল’-
এতেও বিশ্বাস হল না পটার। সারা পৃথিবীতে এরকম কোন নিয়ম আছে নাকি মরার আগে সাদা পরতে হয়? সে অবিশ্বাসের গলায় বলল ‘যাহ’ তবু কুমারেশের ভয় যায়নি। সে বলেছিল ‘এরকম আমি আগে দেখিনি বিশ্বাস করো। সবাই এখানে আসে মজা লুটতে, আর এরা সমানে কেঁদে চলেছে’। কুমারেশের ভয় সত্যি হয়েছিল। তবে ওরা কাউকে ফাঁসিয়ে যায়নি। পটাকে টাকা মিটিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিয়েছিল, বলেছিল ওরা কাছে কোন গ্রামে কী সব কাজ করবে, এখনই কলকাতায় ফিরবে না, কুমারেশের হোটেলের ঘরেও বিষ খায়নি।পরের দিন মাঝ রাতে ওরা সমুদ্রে নেমে গিয়েছিল । ওদের নিস্পন্দ দেহ দুটো পাওয়া গেছিল, তাতে সাদা পোশাকের শেষ সুতোও ছিল না।কুমারেশের হোটেলে কিছু পুছতাছ হয়েছিল অবশ্য, কিন্তু কোন এক অজানা কারণে পটাকে পুলিশ ডাকেনি। তাই সারাজীবনের জন্যে ওই জুটিকে কৃতজ্ঞতা জানায় পটা। সে মনে মনে বলেছিল, হায় আল্লা, এরা দুজন দুজনকে এত ভালবাসে, তাও এক ছাদের তলায় ঘর করতে পারল না, তোমার দুনিয়ায় আরও কত অবিচার হয়ে চলেছে কে জানে। নিজেই অবাক হয়ে গেছিল, ও ঠাকুর না বলে আল্লা বলল দেখে। মনির সঙ্গে থাকতে থাকতে এমনটা হল নাকি? ঠাকুর আবার পাপ দেবে না তো?
যাই হোক, সেই ছেলেমেয়েদুটো আর ফিরল না, সাগরের জলের পাশে বালিতে পড়ে রইল। কী লাভ হল। পুলিশ কাটাছেঁড়া করল। তবু সে কাটাছেঁড়া একদিন শেষ হবে। শেষ হবে না সমাজের কাটাছেঁড়া।