সুদেষ্ণা ঘোষ -এর কবিতা
জোরজুলুম
আমাদের বাড়ি কেউ কারও সঙ্গে কথা বলে না
একসঙ্গে খায়, ঘুমোয়, স্নান করে, অফিস যায়
যায়ও না কেউ-কেউ।
দুপুর হলেই সামনের পাঁচিল দিয়ে ধীরে চলে যায় বাদামি বিড়াল
কফির কাপে যখনতখন ছবি আঁকে মোমবাতির আলো
খুনোখুনির হুমকি চলে বন্ধ দরজার ওপারে সারাদিন
কিন্তু আমাদের বাড়ি কেউ কথা বলে না
এদিকে সমস্ত পথ পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়
সমস্ত ভয় ভালবাসার
অন্ধকার ঘরের নীল দেওয়ালে এল ই ডি মাত্রা ছাড়িয়ে যায়
নীচের ঘরে তিনদিন না খেতে পাওয়া কুকুরের চিৎকারও।
তবু আমাদের বাড়ি কেউ একটাও কথা বলে না।
আমি গানের ভিতর শুধু একটা ভাঙা ব্রিজের ছবি দেখি
যে-কোনও উৎসবের দিন নিজেকে বিলিয়ে দেব ভেবেও রাখি
তবু এত কিছুর পরেও কারও চোখের পাতা আচমকা পড়ে না
কেউ ভুলেও কখনও টুঁ শব্দ করে না
আমি তোমাকে ঘুম থেকে তুলে মাঝেমধ্যে কথাদের কষ্টের কথা বলি
তুমি খুব জোর করে হাসো,
অসহায় ঘুমে নিভে যাওয়া হাসি।
ওই হাসি নির্মম হাতে চিরে
আমি আর কথা, দুজনেই গায়ে-গায়ে লেপ্টে বসে থাকি।
হারিয়ে যাওয়ার আগে
অরণিও সুখে নেই। আমিও।
আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি।
স্পষ্ট বুঝতে পারতাম, সিঁড়িটা রোজ কীভাবে হেরে যাচ্ছে ঘাসের মধ্যে।
একটা ফোননম্বর একবার আর্তনাদ করেই থেমে যাচ্ছে বরাবরের মতো।
হাতেট মুঠোয় কী একটা না বলে ঢুকিয়ে দিলে।
তুমি পালিয়ে যেতে রোজ।
খবরটা জানাজানি হয়ে যাচ্ছিল।
আমি দেখলাম ট্যাঙ্কের পিছনে একটা জায়গায় কেউ কখনও পৌঁছাতে পারবে না।
দেখতাম দেওয়ালের ফাটল দিয়ে কারণে-অকারণে গলগল করে বেরিয়ে আসছে লোভী পিঁপড়েরা।
ঝিলপাড়ে পাখির আওয়াজ মানুষকে অন্ধ করে দিচ্ছে অথচ কাউকে দেখা যাচ্ছে না।
আমাদের রাতগুলো টনটন করে উঠত।
গাড়ির কালো কাচে মুখ নিচু করে পড়ে থাকত চাঁদ।
আমি কোনওদিন পরদার নীচে তাকাতাম না।
দূরে অন্ধকারের স্টিমরোলারের তলায় গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছিল দিন- আনি দুঃখ।
তুমি বলতে, কোনওদিনই ছিলে না তুমি।
তুমি বলতে, কোনওদিন না থাকার চেয়ে মিথ্যে কিছু হয় না।
আমাদের রাতগুলো অরণি রাতগুলো হন্যে হয়ে উঠত।
একটা হাত দিয়ে অন্য হাতের বিদ্রোহ আটকাতে- আটকাতে আমরা শিস দিয়ে উঠছিলাম।
মুখ দেখতে পেলে চেনা গল্প থেকে ধাক্কা মেরে বের করে দেওয়া হত আমাদের।
তুমি বলতে, ভেঙে ফেলা কষ্টের। কিন্তু আরও কষ্টের…
আকাশ পর্যন্ত উঠে যাওয়া পাঁচিলের ওপাশে দাঁড়িয়ে আর কিছু শুনতে পেতাম না।
অথচ দেখতাম ফাঁকা মেলার নাগরদোলা ছুটতে গিয়েও থেমে যাচ্ছে।
হাত ফসকানো হলুদ বেলুনের জন্য বাসের দিকে ছুটে যাচ্ছে তিন বছর বয়স।
আর ফুঁপিয়ে ওঠা বিকেলকে জড়িয়ে ধরবে-ধরবে ভাবছে সদ্য ঘাস উঠে যাওয়া মাঠ।
কিন্তু হাতের মুঠোয় আটকানো একটা শব্দ হারিয়ে গেছে বলেই সব কীভাবে আটকে রয়েছে।
চেরি ও দুঃখ
প্রচণ্ড বৃষ্টিতে আকাশ কালো হয়ে আসছিল।
আমরা একটা পুরনো কালো পাথরের দুর্গে বেড়াতে গেছিলাম।
তুমি খুব নরম নিচু গলায় কী বলছিলে।
আমার মনে হচ্ছিল চেরির রঙে ভরে যাচ্ছে পৃথিবী।
শ্বাস নেওয়ার জন্য মুখটা মাঝেমধ্যে হাঁ করতে হত।
জানলার অনেক নীচে লিলিপুলের উপর একটা ছোট্ট সাঁকো দুলছিল।
ঠাট্টাতামাশা নুড়িপাথরের মতো মাড়িয়ে
আমরা সেসব দিন মাঝেমধ্যে ছায়ার ভিতর
দুর্গে বেড়াতে যেতাম।
একটা দরজা,
খোলা বন্ধ করা দরজা
উত্তর দিত না কিছুতেই।
ঘুমের মধ্যে সারারাত একটা গানকে শক্ত করে জড়িয়ে রাখতাম আমি।
রাগ কমলে ছুটে এসে বলতাম, ‘সত্যি চলে গেলে?’
তোমার সঙ্গে কখনও কথা হয়নি।
শুধু বলার চেষ্টা করেছিলাম,
‘মা শুধু আমার জন্যই তিয়াত্তরটা জামা বুনেছিল।’
একবার বলব ভেবে থেমে গেছিলাম, ‘মা নিশ্চয়ই ভাল থাকবে ভেবেই ছেড়ে গেছিল আমাদের।’
মেঘবাদলের দিনে
হাহাকারের দিনে
আজও তোমার কী নরম নিচু চোখ…
দূর্গের ভিতর হারিয়ে যাওয়া ময়ূর ঘুরছে একা।
আর চেরির রঙে ছিটকে উঠছে আমাদের ক্লান্ত অন্ধকার।
চিৎকার বা আছাড়িপিছাড়ি
একটা পুরনো কেবিনের কথা মনে পড়ে
যার জানলার পরদা উড়ে গেলেই চোখে পড়ত
একটা টানা ঝুলবারান্দার গল্প।
কেউ বলে উঠত, সমাপন ও সমাপন
কেউ ডেকে উঠতে গেলেই অন্ধকার হয়ে যেত
শান্ত মরচে পড়া গ্রিল রোজ ভোরের অপেক্ষায় রাত জাগত।
ওকে সান্ত্বনা দিয়ে-দিয়ে ফতুর হয়ে যাচ্ছিলে তুমি।
ওদিকে আমাদের সব অপেক্ষা ফুলতোলা পরদার উপর আছাড়িপিছাড়ি।
এদিকে আমাদের সব কষ্ট অমোঘ টানেলে ঢুকে দিশেহারা
গোটা শীতকাল বাড়ির গল্প বাড়ির গল্প বলো
বাচ্চা ছেলের একটানা বায়না।
এত বিড়ম্বনার মধ্যে কাউকে খুঁজতে কিনা হাওয়ারা কক্ষনও মনে রাখেনি।
(রাখে কখনও?)
হঠাৎ হঠাৎ ট্রেনের হুইসল সব জেগে থাকা তছনছ করে দেয় তোমায় বলেছিলাম
হঠাৎ হঠাৎ ভুলতে বসা ব্যথা শান্তির টুঁটি চেপে ধরে বলতে পারতে…
ঘুমের মধ্যে বলে উঠতে, রাতের পর রাত জেগে নীল হয়ে ওঠা সকালগুলোর কথা।
স্বপ্নের ভিতর সরু কানা গলিদের ফেলে রেখে দ্রুত বেরিয়ে আসতাম আমি।
কতদিন।
পৃথিবীর সব পরদাদের রাগত চিৎকারের কথা আমি কোনওদিন তোমাকে বলেছি?