
আমা আটা আইডু’র কয়েকটি কবিতার অনুবাদ
অনুবাদ – পৌষালী চক্রবর্তী
আমা আটা আইডু পশ্চিম আফ্রিকাস্থিত ঘানা'র কবি ও সাহিত্যিক আমা আটা আইডু(১৯৪২-) আফ্রিকা মহাদেশটির সমসাময়িক বহুস্তরীয় সাহিত্যের এক স্বকীয় স্বর।স্বদেশে, বৃটিশ নব্য উপনিবেশবাদের উত্থানকালে তাঁর শৈশব যাপন।পারিবারিক বিপর্যয় পেরিয়ে তার পড়াশুনা ও বেড়ে ওঠা।ইংরাজী নিয়ে ঘানা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম নাটক _দ্য ডিলেমা অফ এ ঘোস্ট_(১৯৬৫)।প্রথম উপন্যাস _আওয়ার সিস্টার কিলজয়_(১৯৭৭),তাঁর জনপ্রিয়তম সৃষ্টি।১৯৮২ সালে তিনি প্রভিসনাল ন্যাশনাল ডিফেন্স কাউন্সিল এ শিক্ষামন্ত্রী হন।কিন্তু শিক্ষাকে সকলের জন্য উন্মুক্ত করার অপারগতায় তিনি পদত্যাগ করেন।একক মাতৃত্ব , অধ্যাপনা, লেখালেখি সবই অপার দক্ষতায় সামলানো আইডু'র কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ _সামওয়ান টকিং টু সামওয়ান_ (১৯৮৬), _বার্ডস এন্ড আদার পোয়েমস_(১৯৮৭), _অ্যান অ্যাংরি লেটার ইন জানুয়ারি_(১৯৯২)। বিবিধ পুরস্কারে ভূষিত এই সাহিত্যিক ২০০০ সালে ম্বাআসেম নামক প্রতিষ্ঠান তৈরী করেন যা ঘানা তথা আফ্রিকার প্রথম লিখতে আসা নারী সাহিত্যিকদের এক নির্ভার আশ্রয়।
“Time means nothing until you give it something to carry ”
সময় কিছু নয়
যদি না তাকে দাও
মানুষ-দোষ-জল বহুধারায়
_তবুও আমরা নারী_
দিদি ও বোনেরা, সত্যি বলছি
এখানে আনন্দের উল্লাস যেমন আছে
তেমনি অভাব নেই তিক্ততারও
কিন্তু তোমরা যদি প্রশ্ন করো
এই দুই ভাব সমানুপাতিক কিনা
তাহলে বলবো সারা পৃথিবীর মেয়েদের অর্ধেকের মধ্যেও তা নয়…
বুঝতে চাইলে,
আমাদের দেখা হোক
যেকোনও সাধারণ পাঠাগারে
যেকোনও কাজের দিনে নটা পাঁচটার পরে
আমরাই সেখানে দলে ভারি
আমাদের নানা জাতি
নানা দেশ
নিজস্ব ঐতিহ্যের বিবিধ বিস্তার…
_চিনুয়া আচেবে’র জন্য তিনটি কবিতা_
_১_
_প্রশ্নমালা_
_-আমাদের জন্য : আজকের আফ্রিকী প্রতিনিধিত্ব-_
ওরা বলে
সব প্রাণই
বেঁচে থাকার জন্য লড়ে যায়
গন্ধগোকুল
সিংহ
বায়স
তারা এও বলে
সব প্রাণীই
সংগ্রাম করে
জলে
স্থলে
অন্তরীক্ষে
আর
তোমার আমার মত
মানুষেরা…?
জংলী মাশরুমের মত
আমরা মুকুলিত হই
-অন্ধকারে-
সাপের মত সিঁদ কাটি
বিড়ালের লুকানো থাবার মত আঁচড় কাটি
অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ি
পিষে দিই
জয় করি
হত্যা করি
আত্মসাৎ করি
তারপর এগিয়ে যাই বিক্ষত পায়ে
দুপুরের গনগনে রোদে ঝলসানো
বন্য মাশরুম যেন
তাহলে
আমরা
কোথায় চলেছি?
কারই বা
খারাপ লাগে
জোর ফলাতে?
তা বলে কি জাহান্নামে যাবে
আমাদের একান্ত ভালোমন্দ?
ভাই রে, সত্যি করে বলতো
মুখবুজে
সব লাথি হজম করার ক্ষেত্রে
৫০০ বছর
কি সুদীর্ঘ নয়?
আরও বল,
এখনও
কী কারণে আমাদের হাতে
ভিক্ষাপাত্র?
আকুলিবিকুলি
অন্তহীন প্রব্রজন?
হিংস্র পশুর
এবং ততোধিক হিংস্র মানুষের
এই দুনিয়ায়
আমাদের কেই বা মানুষ থাকতে পারে?
বিশ্বাস করব সে সাহস কই,
যখন
সে ছুটি নিয়েছে-কত লক্ষ বছর আগে- আর
ফিরেও আসেনি?
কার নামে আমরা এতকিছু করেছি বলো?
কার আগামী আমরা বিকিয়ে দিয়েছি?
_২_
_আধুনিক আফ্রিকী আখ্যান_
হ্যাঁ
আশ্চর্য শোনালেও
এটা সত্যি
এই ভোর আমাকে আজ নির্বাসন দিল
আমার ঘর, আমার গ্রাম,আমার দেশ এমনকি এই ভূমির থেকেও
যেখানে আমার পূর্বপুরুষ , পূর্বনারীরা রক্তাক্ত হয়েছিলেন,
যে ঊষর ভূমি তারা কর্ষণ করেছিলেন
সময়ের ঊষালগ্ন থেকেই…
আমার অপরাধ?
কাঁটতারের যেকোন দিকের
আমার আর সব ভাই বোনের মতই
আমি দেখি
যে
ওর রাষ্ট্রপতি কিংবা আমার প্রধানমন্ত্রী, কেউই
মানুষের চোখে চোখ রেখে
তাকাতে পারে না ।
ভাই রে!
মনে রাখিস,
অধ্যাপকের প্রতিবাদ
শুধু তত্ত্বের কচকচি
আর ভাষার মারপ্যাঁচ
” কাউকে তার স্বদেশ থেকে উচ্ছেদ করা যায় না,
বলে তারা যখন চেঁচায়-অর্থহীন মনে হয়”
তাদের এসব বুকনির সময় আমি গোছগাছ করছিলাম
আমার সময় ছিল না দুদন্ড থেমে যে তাদের বলব , চারপাশটা দেখো :
এই সেই ভূমি
যেখানের স্বাধীনতা যোদ্ধারা আজ ভবঘুরে,
কিংবা
যাদের জন্য তারা যৌবন বাজি রেখেছিলেন,তাদের সম্পদ আগলানোর
বিনিময়ে আজকাল কিছু সম্মান জোটে;
কারখানায় শোষণের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিবাদ ছিল
জীবনের সোনালী দিনগুলোতে তারা রাতের অন্ধকারে চুপিসারে
বাড়িতে ঢুকত…আগুনে পুড়তে পুড়তে
যে কাউকে তার জন্মভূমি থেকে উচ্ছেদ করা যায়
যে কাউকেই ,
এবং
আমি
তাদেরই একজন
আর এই সেই ভোর….
_৩_
_নতুনের আফ্রিকায়_
প্লিনি কি সত্যি বিশ্বাস করতেন
তার নিজের বলা কথা:
‘আফ্রিকা থেকে সবসময়ই নতুন কিছু না কিছু উঠে আসে?’
শামওয়ারি(বন্ধুগণ), তিনি তো আর দূরদ্রষ্টা ছিলেন না
তাই আমাদের শেষ ৫০০ বছরে, ও কথা খাটে নি
যখন
সময় নিজে নিজেই ঘুলিয়ে উঠল এবং
ইউরোপ আমাদের গিলতে এল
তখন
নতুন যেটুকু আমরা নিজেদের দিয়েছিলাম এবং
শত্রুপক্ষও আমাদের পাতে তুলে দিয়েছিল
তা
অতি প্রাচীন গরল
-প্রায় সারাক্ষন হিংস্র-
পুরানো বিদ্বেষ বিষে
প্রতি একশ বছরের ব্যবধান…
জননী আফ্রিকা
নির্জিত হয়েছে
ধর্ষিতা হয়েছে
আবার বিজয়ডংকা
আবার ধর্ষণ
সে এখনও ত্রাসে কেঁপে কেঁপে ওঠে
ঠিক যেন সাপ
প্রজ্ঞাবাণ আনানসে যাকে খতম করছেন
আমরাও লড়ে যাই
-চক্ষুষ্মান বা অন্ধ-
কখনও সাথে গান
প্রায়শ নাচের ছন্দ
এবং অহরহ
ওষ্ঠে প্রার্থনা।
*
_আমার নবতিপর মায়ের জন্য_
“মাসিমা”!
জানতে চেওনা
আমার কাছে, কীভাবে
আমি মাকে এইভাবে ডাকা শুরু করলাম
দীর্ঘ
জটিল, বিচিত্র সে সব গল্প …
উষ্ণ হৃদ্য , যেন পারিবারিক গাথা এবং
উপনিবেশিত’র মত দুঃখজনক।
তুমি জান !
কী বিশ্রী, কী বিস্ময়কর
আমাদের তরুণ তরুণীদের সংবেদনহীনতা?
ভেবোনা যে আমরা এখানে প্রাপ্তবয়স্কদের নিয়ে কথা বলছি
তাদের জ্ঞানের নাড়ী টনটনে
কিন্তু এ ব্যাপারে কিসসু করবেনা!
মাসিমা
আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ যে
তুমি আজও বেঁচে আছ ,
সতর্ক আছ, চনমনে আছ
যেহেতু আমরা ভবিষ্যত দেখতে পাইনা
দ্যাখো ,আমরা কাঠ ছুঁয়ে
গাছের দীর্ঘ গুঁড়ি জাপটে,বনানী জড়িয়ে
প্রকৃতিলগ্ন হয়ে আছি…
যাতে
জরা, বয়স
তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে
আবার যৌবনে ফিরি
আমার সন্তানের কিচিরমিচির শুনি :
“মা, প্লাস্টিক ব্যবহার করো
এটা তো বেশিদিন টেকে”
হায় রে! মেয়ে তার মাকে ভালোই চিনেছে
নিরক্ষীয় বেদুইনের মত তার মা যেন কৃত্রিমতার রানী
আর,শখের পর্যটক!
অরণ্যে ঢুঁ মেরে দ্যাখো
এর ব্যাপ্তি, এই উষ্ণতা- অনুভব করো
দ্যাখো এই সুন্দর সারণী,সুগন্ধী বাকল
এভাবেই তোমার কথায় ফিরি, মাগো
অপূর্ব বৃন্দগান শুনি
যেন তোমার নামে
আমিও কি তা আওড়াতে চাইনা! মা!
এখানে ,ওখানে, সর্বত্র?
দিনে ,রাতে ,সবসময়।
সুযোগের অপেক্ষায় না থেকেই
আমি তোমার প্রসঙ্গ তুলি
একান্তে বা বহুজনের সাথে আলাপচারিতায়
“তোমার মা বেঁচে আছেন?”
কারও কারও এ কৌতুহলী জিজ্ঞাসার প্রত্যুত্তরে
তাদের ঠিকরানো চোখ,কেঁপে ওঠা বিস্ফারিত ঠোঁটের কোণে
আমি শুভেচ্ছাবার্তা দেখতে পাই
এখানে
এই সীমিত জায়গায়,আর
তার থেকেও সংক্ষিপ্ত সময়খন্ডে
আমি কোথায় থাকতাম?
তুমি ধারণ না করলে?
মা আমার!
খুব ভালো লাগলো