সমীরণ চট্টোপাধ্যায়ের গদ্য

সমীরণ চট্টোপাধ্যায়ের গদ্য

হকার

ট্রেন লাইনের ধারে এক চিলতে ঘর। সেইখানে অসীমের বাস। বিএ পাশ করার আগেই বিয়ের ব্যবস্থা পাকা করে ফেলেছিল। একদিন রাতে বাবা ঘুম থেকে তুলে বললেন, “বিয়েটা এবার করেই ফেল।“ উঁচু চৌকিতে শুয়ে ব্যাপারটা বোঝেনি। সকালে যখন বুঝল তখন বাবাও চোখ বুজেছেন। চৌকির তলায় সংসার পাতা আছে। মা নেই বলে সবটাই ছিল বাবা। সৎকার করে ট্রেন লাইনের দিকে হাঁটা লাগাল অসীম। ট্রেনের লাইন বাড়ির এত কাছে যে হাঁটলে ওই দুটো সমান্তরাল লাইন পড়বেই। চলন্ত ট্রেনের দিকে তাকিয়ে বুঝল, এর তলায় যাওয়া তার কর্ম নয়। ঠিক করল বেকার থাকার চেয়ে হকার হওয়া ঢের ভালো। প্রথম প্রথম পারত না। তবে মালতীকে বিয়ে করার কয়েক মাসের মধ্যে বিলু যখন ঘরে এল, হকারির বিষয়টা তখন আর ঐচ্ছিক রইল না, জীবনের পাশ ফেলের সাথে জড়িয়ে গেল। সারা দিন চা বিক্রি করে অনেক রাতে সে যখন বাড়ি ফিরে আসে, ততক্ষণে তার দুষ্টু ছেলেটা ঘুমিয়ে পড়ার কথা। কেটলি রেখে হাত পা ধুয়ে এসে খেতে বসা। মালতী ভয়ে ভয়ে বলে “বিকেলে রেলের পুলিশ এসেছিল। শিবু, মদন মিলে আটকেছে।” এই চোর পুলিশ খেলা দেখে দেখেই জীবন কাটে। খেয়ে উঠে আঁচাতে আঁচাতে অসীম আকাশের তারা দেখে আর ভাবে বিলু কবে বড়ো হবে। অসীমের বাবাও নিশ্চয় একই কথা ভাবত। শোবার আগে গারগ্ল মাস্ট। চা বিক্রি তো নয়, খাদে নেমে চড়ায় উঠে স্বরক্ষেপণ। এবার শুতে হবে অসীমকে। কাল আবার ভোর সাড়ে তিনটের ট্রেন। সকালে চায়ের বিক্রি বেশি।

টাকা গোনে মালতী। পাওনা গণ্ডা তাকেই মেটাতে হয়। কুড়ি টাকা কম হলে কুড়িটা প্রশ্ন করে। “চিন্ময়ের মা হাসপাতালে আছে। আমরা সবাই দিলাম একটু একটু।” বিলু কিন্তু ঘুমোয়নি। বাবা শুলেই তাকে জড়িয়ে ধরে। বাবাও পকেট থেকে একটা কালো লজেন্সের প্যাকেট বার করে ছেলের হাতে দেয়। এক মুখ হাসিতে ধুয়ে যায় সারাদিনের ক্লান্তি। রাত্তিরে প্রেম উথলে ওঠে। মালতীর হাজার প্রশ্ন। কোথায় খেলে, কখন খেলে, কী খেলে। সে দিব্যি জানে বদ্যিবাটীতে পশ্চিমের প্ল্যাটফর্মের শেষে কদম গাছের তলায় দল বেঁধে ওরা খায়। বেঁধে বেঁধে থাকার লাইনটা ওদের জীবনে পার্মানেন্ট কবিতা। চলন্ত ট্রেন থেকে নিত্য ওঠা নামা অসীমের আর গায়ে লাগে না। কিন্তু বিলুর ভয় করে। সে জানিয়ে দিয়েছে, বড়ো হয়ে ট্রেন চালাবে। এ বাড়িতে বিলু ছাড়া রাতে কেউ স্বপ্ন দেখার ফুরসৎ পায়না। রাত থাকতে থাকতে চান করে রেডি হয়ে কেটলি, ভাঁড়, সব মালপত্তর গুছিয়ে নিয়ে অসীমকে বেরোতে হয়। কিন্তু স্বপ্ন ওর বাবাও দেখেছিল। অসীমও দেখেছিল। একটা চায়ের বড়ো দোকান খুলবে, সেই দোকান আরও বড়ো হবে – মালতীর চায়ের চাতাল।

স্টেশন একটুখানি দূরে। হকারি করতে মেহনত কম লাগে না। গায়ে গতরে জোর লাগে। একে তো ভারী মাল বয়ে নিয়ে যাওয়া। তার ওপরে ভিড়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। সে মাখনের মধ্যে ছুরি চালানোর মতো সহজ নয়, বরং শুধু হাতুড়ি দিয়ে মজবুত দেওয়ালে মোটা পেরেক ঢোকানোর মতো কঠিন। প্রথমে কাঁধের বোঝা দিয়ে হালকা আঘাত করে ফাঁক করে নাও, তার পরে সেই ফাঁক চিরে তড়িৎ গতিতে এগিয়ে যাও। যার লাগল পিছন থেকে, সে পিছনের দিকে তাকানোর আগেই অসীম সামনে চলে গেছে। এই ভাবে খুঁজে নিতে হবে চেনা নিত্য যাত্রীদের। তারা একসঙ্গে বসে। অনেক কাপ বিকিয়ে যাবে। এগুলো চার, ছক্কা। কিন্তু এক রান, দু রানও নিতে হবে। চলতে চলতেই তাক বুঝে বলতে হবে, চা চলবে? তারপর নিপুণ নৃত্যশিল্পীর মতো হাতকে বেঁকিয়ে চুরিয়ে দূর থেকে চা আর কারও গায়ে না ফেলে ঠিক জায়গায় পাঠিয়ে দেওয়া। বয়স হলে এই সক্ষমতা থাকেনা। তখন কেউ কেউ নকল গয়না বেচে। ‘চায়ে গরমে’র স্বরে কিন্তু গয়না বেচা যাবে না। তা’তে নতুন চরিত্র, নতুন অভিনয়, নতুন রিহারসাল।

পড়ন্ত আলোয় গলার তেজ কমে আসে। একদিন জানালার কাছ থেকে এক মাঝবয়সী লোক চা চাইছে। আনমনা ভাবে চা নিতে নিতে দুজনের চোখে চোখ পড়ল। “আরে, কাকা না! অনেক বছর পরে!” “তুমি তো অসীম। তুমি তো খড়গপুরের ট্রেনে চা দিতে গো। সব ভালো তো?” “হ্যাঁ, মিসেস, ছেলে সব ভালো।” অসীমের তাড়া আছে। তাড়াতাড়ি কামরার সবার কাছে পৌঁছতে হবে। কাকার মাথায় ঘুরছে “মিসেস” শব্দটা। অসীমও ইংরেজি বলছে – হল কী! মাথা ঘুরেই যেত যদি না তখনই একটা কম বয়সী ছেলে “গিভ মি এ কাপ অফ টি” বলে চা চাইত। জানলা দিয়ে বাড়ি, গাছ সব পিছন দিকে ছুটছে। এইবার কাকার কথা বলতে হবে। কাকাও কলেজ শেষ না করে বীমার এজেন্ট হয়ে গেল। না ওর বাবা ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু কাকার মাথার ঠিক ছিল না। সে তখন তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে মিলিয়ন ক্লাব, বিলিয়ন ক্লাবে ঢোকার স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু পরে বুঝেছিল যে এটা ভোরের স্বপ্ন ছিল না, দিবাস্বপ্ন ছিল। স্বপ্ন মেলেনি। সে ক্লায়েন্ট ধরে আর নেপোয় মারে দই। মানে সিনিয়র ব্যাংকক যায়। আর কাকারা যাবে দিঘা, বড়জোর পুরী।

কাকাও দিন শেষে রিক্সা করে থামে একটা চারতলা বাড়ির সামনে। তিন তলায় পায়রার খোপের মতো একটা ফ্ল্যাট। আগে তিন তলা দৌড়ে উঠে যেত। বেল টিপলেই এক মুখ হেসে দরজা খুলে দিত তার ছোট্ট ছেলে। এখন একটু হাঁপিয়ে ওঠে। ভিতর থেকে ছেলের র্যাপ গানের শব্দ ধাক্কা দেয়। ধাক্কার এত জোর যে পাশের ফ্ল্যাট থেকে কমপ্লেন, পুলিস এসে তাদেরই ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ফ্ল্যাট থেকে দের করে দেবার জোগাড়। মাধ্যমিকের পরে ছেলেটা পড়া ছেড়ে দিল। র্যাপ গাইবে! বায়নার সঙ্গে সঙ্গে এসে গেল ল্যাপটপ, এক লাখ টাকার বাজনা। এত খাজনা দেবার পরেও মাসে একটা অবৈতনিক শো। প্রতিদিন নতুন নতুন বায়না। ভাগ্যি কাকার বৌ ছোট স্কুলে একটা চাকরি করে। প্রতি মাসে রঞ্জনা বলে সামনের মাসে কিছু হবে। কত পূর্ণিমা, অমাবস্যা এল আর গেল, সামনের মাস এখনও সামনে। কাকা এখন কথা বাড়ায় না। অনেক ক্লায়েন্টের বাড়ি যাওয়া আছে। হাসপাতালেও গিয়ে সরেজমিনে দেখে আসতে হয়। তার তো আর, আর পাচটা লোকের মতো অফিসে বসে দশটা পাঁচটার চাকরি নয়।

একদিন বেশ রাত হয়ে গেছে। গরম কাল। চা বিক্রি কম হয় এসময়। কেটলিতে এখনও চা আছে। কামরাও ফাঁকা ফাঁকা। বসার সিট পর্যন্ত ফাঁকা। সবাই নিজের মতো বসে আছে। কেউ জানলা দিয়ে অন্ধকার দেখছে। কেউ কম আলোতেই বই বা খবরের কাগজ পড়ছে। কেউ চোখ বুজে ঘুমোবার ভান করছে। এখন আর ‘চায়ে গরম’ বলে চিৎকার করে লাভ নেই। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে অসীম। “এই এক কাপ চা দাও তো!” ঈষৎ গম্ভীর গলায় ডাক। ভাঁড়ে চা ঢেলে এগিয়ে আসে অসীম। চা দিয়ে অপেক্ষা করে দামের জন্য। “তোমায় ভাই চেনা লাগছে। তুমি কী অসীম?” এইবার চোখ তুলে তাকাল অসীম। “স্যার, আপনি!”

ইনি রজত ব্যানার্জি। রূপো নয়, সোনার টুকরো ছেলে ছিলেন। লক্ষীর সাথে বিয়ে হবার পরে তিনি ঘরেই অচলা ছিলেন। ইংরেজির ডাকসাইটে মাস্টার। সরকারি স্কুলে পড়ানোর বাইরে ছিল বেসরকারি পড়ানোর রমরমা। কলকাতা থেকে ভোর বেলা ট্রেন ধরে স্কুলে পৌঁছতেন। তারপর টিউশনি সেরে রাতের ট্রেনে ফেরা। নিজেই গল্প করেছিলেন, রাতে গিয়ে শুয়ে পড়েন আর সকালে বেরিয়ে আসেন। ছুটির দিন না থাকলে ছেলে মেয়ের সঙ্গে দেখাই হত না তার। ছুটির দিনে সারা দিন বাড়িতে পড়াতেন। দলে দলে ছাত্র যেত আর আসত। বাড়ির সামনে মন্দিরের মতো চটির পাহাড়। দক্ষিণার বাক্সও উপছে পড়ত। বইও লিখেছিলেন। কবিতা, গল্পের বই নয়, মানে বই। যাকে বলে অর্থকরী ফসল। প্রচুর বিক্রি হত। যতজন প্রাইভেটে পড়ত, সবাই কিনত। নিজের স্কুলে তো বটেই চার পাশের স্কুলগুলোতেও দেদার বিক্রি। উনি টিচারদের স্থানীয় সংগঠনের সভাপতি ছিলেন যে!

ইনি মাঝে অ্যামওয়ে করতেন। সেও এক বেচা কেনা। মানে আপনি এক জায়গা থেকে মাসে মাসে অঢেল ডিটারজেন্ট, টুথপেস্ট, সাবান, পাউডার, এসব কিনে আনবেন আর চেনা লোকেদের সেটা বেচে দেবেন। এমন করবেন প্রতি মাসে। এমনও বলেছিলেন মাস্টারমশাই, এই টুথপেস্টে দাঁত মাজলে ইংরেজি বলা যাবে সাহেবের মতো, সব জড়তা কেটে যাবে। এই সব বলে উনি সব ছাত্রদের সেই টুথপেস্ট বেচতেন। এঁর মেয়ের বিয়ে হয়েছে মুম্বাইতে। ছেলেটা বাপের ধাত পেয়েছে। সব ক্লাসে প্রমোশন ঠিক মতো পায়নি। তবে নামকরা প্রোমোটার হয়েছে। নিজে কলেজের গণ্ডী পেরোতে না পারার দুঃখে একটা বিশ্ববিদ্যালয় খুলে আচার্য হবার প্ল্যান করেছে।

যাই হোক, সেদিনের কথা বলি। উল্টোদিক থেকে গলা খাঁকারির শব্দ শোনা গেল। “জায়গা আছে নাকি?” অসীম ঘুরে দেখে কাকা বসে আছে কামরার উল্টো কোণে। “কাকা যে! আসুন আসুন।” মাস্টার মশাই একগাল হেসে বলেন। কাকা এসে বসেন। “আপনারা নিজেদের চেনেন?” অসীম অবাক হয়ে যায়। “চিনব না, কাকার কাছে তো আমি পলিসি কিনেছি” মাস্টার মশাই জানান, তিনি বলে চলেন, “যা জব্বর পলিসি দিয়েছিলেন কাকা, পাঁচ বছরে কী বাড় বাড়ল মশাই! আপনার হাতে জাদু আছে।” রজত বাবু তারিফ করেন। অসীম দাঁড়িয়ে যায়। কেটলিতে একটু চা আছে। সে থাক। আজ একটু আলাদা।

“না, না আমার হাতযশ নয়, মাস্টারমশাই, আপনার কপাল ভালো” বলে একটু উদাস হয়ে যায় কাকা। কতজন যে কত কথা বলে যায় পলিসি খারাপ চললে। “মাস্টারমশাই এখনও ছেলে পড়ান?” জানতে চায় কাকা। “না, আর পড়াই না। তখন স্কুলে পড়াতাম, বন্ধু বান্ধব চেনা স্কুলে পড়াতো, ছাত্রের অভাব হতনা। মানে বুঝলেন, যাই করুন, খদ্দের ধরা চাই” বলে একটু থামেন। এই খেয়েছে। অসীম আর কাকার কাছে সব গুলিয়ে যায়। “নানা কারণ আছে অসীম, ভালো পড়ালেই হবে? ছেলে ভালো না পড়লে?” অর্থপূর্ণ ভাবে হাসেন মাস্টারমশাই। “এই ধরুন, কাকা। কোন্ পলিসি ভালো চলবে, কোনটা খারাপ, সে উনি জানেন না কেউ জানে?” মাস্টারমশাই বলে চলেন। কাকার মনের কথাটা বলে ফেললেন মাস্টার। “তুমি যে চা বেচো, এমন তো অনেকেই বেচে, সবাই সমান রোজগার করো?” অসীম চিন্তায় পড়ে যায়। এই দুদিন আগেই খেতে বসে কথা হচ্ছিল। দুজন হকারের মধ্যে ঝামেলা হয়েছে, এক কামরায় ওঠা নিয়ে। এও এক ফুল, দুই মালীর গল্প। একমাস আগে দুই হকারের ধাক্কায় ট্রেনে উঠতে গিয়ে এক যাত্রী পড়ে গেছিল। ভাগ্যি প্ল্যাটফর্মে পড়েছিল, রেল লাইনে পড়লে আর দেখতে হত না। “বেচা একটা শিল্প, যেমন মাল তেমন ছলা কলা,” মাস্টারমশাই নিশ্চিত।

ট্রেন একে একে সকলকে স্টেশনে নামিয়ে দেয়। কাকা ফিরে যায় র‍্যাপ গাইতে চাওয়া ছেলের কাছে, অসীম ফিরে যায় ট্রেন চালাতে চাওয়া বিলুর কাছে। মাস্টার মশাই একা ঘরে ঢুকে যায়। কাল আবার আলাদা আলাদা ট্রেন এদের তুলে নেবে। এরাও নিজেদের বাজারে ফেরি করবে। কেউ চা, কেউ বীমা, কেউ অন্য কিছু।

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes