
কিঞ্চিৎ পরচর্চা-৫
রূপশ্রী ঘোষ
একটা মেয়ের ক্ষতি একটা ছেলে যদি করে, সেই ছেলেটা আমার হবে না তো’
বেশ কয়েক বছর ধরেই একটা জিনিস খেয়াল করছি, আমি একা নই আমরা সবাই। আমরা কেউ কিন্তু কারোর সঙ্গে গল্প করি না, কথা বলি না। বা যেটুকু বলি সেটুকুও খুব দরকার ছাড়া কিছু নয়। আর পরচর্চা বলতে যা বোঝায় ব্যস্ততার যুগে তাও মনে হয় কমে এসেছে। বাসে, ট্রেনে, ট্রামে, পার্কে ঘরের আড্ডায় সবাই যে যার মোবাইল ফোন নিয়েই ব্যস্ত। দু হাজার ষোলো সালে এটা আমি ইতালির ট্রেনে এই দৃশ্য দেখে অবাক হয়েছিলাম। এখন নিজের ঘরে এ দৃশ্য দেখেও অবাক হই না আমরা কেউই। পরচর্চার জন্য এক জায়গায় জুটলেও আর ঠিক সেভাবে মন খুলে পরচর্চা করা হয় না। পরচর্চা মানে তো পরের ভালো মন্দ সবটা নিয়েই চর্চা। আজকাল আর তাও স্বতঃফূর্তভাবে হয় না, পরের খারাপ দিকটা নিয়ে কিছুটা বলে, কিছুটা সময় এ ওর নামে, সে তার নামে বা কিছুটা একে ওকে তাকে নকল করে দেখিয়ে থেমে যায়। পরের ভালোটা আর আসেই না। পরের ভালোয় সবাই পরশ্রীকাতর। তারপর হয় সেলফি, নয় রিলস দেখা, নয়তো কোনো হালকা গান, বা আড্ডায় হার্ড ড্রিঙ্কস থাকলে একটু লাউড গান চালিয়ে নাচ শুরু হয়। ঘরের আলো যতটা পারা যায় কমিয়ে, নীল বা লাল করে।
এ তো গেল পাড়া, বা বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে আড্ডার গল্প। যদি একই পরিবারের সকল সদস্য কোনোদিন এক জায়াগায় হয়, যাকে বলে গেট টুগেদার, সেখানেও দেখা যায় বাড়ির বড়ো থেকে সবথেকে ছোট্টোটা পর্যন্ত মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত। কেউ খবর শুনছেন, কেউ কেউ গেম খেলছেন, কেউ শেয়ার মার্কেটের ওঠাপড়া দেখছেন, কেউ গান শুনছেন কেউবা স্ক্রল করে করে একের পর এক রিলস দেখে চলেছেন। অর্থাৎ একই পরিবারের সকল সদস্য এক জায়গায় হলেও তাদের মধ্যে খুব বেশি কথা থাকে না। নির্দিষ্ট একটা টপিক ধরে এই যেমন, ভোটের সময় হলে ভোট, আরজি করের মতো ভয়ঙ্কর ঘটনা হলে ভয়ঙ্কর ঘটনা বা দুর্নীতি করে কারুর জেল যাওয়া হলে জেল যাওয়া এমন সমস্ত বিষয় নিয়ে কিছুক্ষণ আলোচনা হতে পারে কিন্তু খুব বেশিক্ষণ টানা যায় না। সবাই হাঁপিয়ে যান। তাহলে কী দেখা যাচ্ছে কেউ কাউকে যে খুব বেশি সময় দেয়, তা কিন্তু নয়। সেটা যে সম্পর্কের লোকই হোক না কেন। কিন্তু আপনি যদি সত্যিই কারুর সঙ্গে কোনো বিষয় নিয়ে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা করে কাটাতে পারেন আপনার পছন্দের টপিক নিয়ে, তৎক্ষণাৎ কিন্তু সেটা আপনার চোখে পড়বে। এবং খুব খারাপভাবেই চোখে পড়বে। তখন অনায়াসে একটা বাজে তকমা দিয়ে দাগিয়ে দিতে দ্বিধা হবে না। ও আপনি ওর সঙ্গে গল্প করছেন? তাহলে ওনার সঙ্গে আপনার ইয়ে। আর আপনি পাশে সারাদিন বসে থাকুন, বোর হোন, কান্নায় ভেঙে পড়ুন, হতাশ হন সেটা কিন্তু কোনোভাবেই কারুর চোখে পড়বে না। কী অদ্ভুদ ব্যাপার না? ওই একই চোখ কিন্তু। আপনি কী দেখবেন আর কী দেখবেন না, সেটা আপনার উপর নির্ভর করে না। উনি যেটা দেখতে চান সেটাই দেখা হবে। এটার ভিতর যত নিরীহ জিনিসই থাক না কেন, গোলাপের রং যদি তিনি সুন্দর বলেন তাহলে সুন্দর আর যদি কুৎসিত বলেন তাহলে কুৎসিৎ। এ নিয়ে কোনো দ্বিমত হবে না কিন্তু। বাবা, মা, ভাই, বোন, ছেলের বউ, মেয়ের বর, নাতি, নাতনি সব একজায়গায় বসে থেকেও বেশ যে যার মোবাইলেই ব্যস্ত থাকতে পারেন। কিন্তু বউটি বা জামাইটি উঠে গিয়ে তার বন্ধুদের সঙ্গে পছন্দের বিষয় নিয়ে কথা বললে বা ফোনে ফোনে কাজ কোনো দরকারি কাজ করলে সেটা কিন্তু ঘোর অপরাধের বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। এই অভূতপূর্ব বিচিত্র সময়ের মধ্যেই আবার কীভাবে জানি একে অপরকে ফাঁসাব বলে প্যাঁচও কষে নিতে পারি। জীবনের চরম লক্ষ্য নিয়ে সবাইকেই তো ব্যস্ত থাকতে হয়। কারও জীবনের লক্ষ্য যদি কাউকে ফাঁসানো, মেরে ফেলা, তার ভালো কাজ থামিয়ে দেওয়া হয় তাহলে সে ওইটুকু সময়ের মধ্যেই ছক কষে ফেলতে পারে। সবাই সবার লক্ষ্যে পৌঁছতে অবিচল। কারুর লক্ষ্য হল কাউকে খুন করা, কাউকে ধর্ষণ করা, কাউকে মানসিক অত্যাচার করা, কেউ অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে তাকে দেখে নেওয়া এসব যে যা করতে চায়, সে তার সময় বের করে ঠিক করে ফেলতে পারে।
এই অন্যায়গুলো যারা করে, তারপর তাদের কেমন লাগে সেটা জানতে খুব ইচ্ছে করে। তাদের কী খুব আনন্দ হয়? নাকি অনুতাপ হয়? নাকি কিছুই হয় না? এ তো হওয়ারই ছিল, এ নিয়ে আর আলাদা কী হওয়ার আছে টাইপের অনুভব হয়? এই আরজি করের ঘটনায় যে মেয়েটি মারা গেল তার কী হয়েছে, কেমন লেগেছে তা তো জানাও সম্ভব নয়। সেই নৃসংশ অত্যাচারের কষ্ট আন্দাজ করে নিতে হয়। তার মা, বাবা আত্মীয়স্বজনের অবস্থাও আন্দাজই করে নিতে হবে। কিন্তু আমার জানার ইচ্ছে যারা ঘটনাটা ঘটালো তাদের বাবা, মাদের মনের অবস্থার কথা। এত টাকা পয়সা খরচ করে ছেলেদের ডাক্তারি পড়তে পাঠিয়ে বাবা-মা হিসেবে এসব শুনতে কেমন লাগছে? নিশ্চয়ই ভালো লাগছে না। মনে হয় না ভালো লাগতে পারে। অতএব কন্যা সন্তানের মা হয়ে কেবল ভয়ে ভয়ে থাকতে হয় না, আমার মনে হয় পুত্র সন্তানের মা হয়েও ভয় আরও চারগুণ হওয়া উচিত। প্রতিনিয়ত ভয় পাওয়া উচিত,
আমার ছেলেটাই ওই ছেলেটা নয় তো?
ছেলেরা খারাপ কাজ করলে সব সময় যে, বাবা-মায়ের দোষেই করে তা কিন্তু নয়। করলে লজ্জার ব্যাপার ঠিকই। কারো কারো কাছে লজ্জার না হয়ে স্বাভাবিকও হতে পারে, সেইসব বাবা, মাদের বক্তব্য এমন হতেই পারে যে, ছেলেরা এমন করেই থাকে। সোনার আংটি আবার বাঁকা? সত্যিই তো কি করে বাঁকা হয়! কিন্তু একজন বাচ্চাকে বাবা-মা কতদিন শিক্ষা দিতে পারেন? একটা সময় পর্যন্ত পারেন। সারাজীবন তো আর আঁচলের তলায় রাখতে পারেন না। যদি সেই মা শাড়ি পরেন, শাড়ি না পরলে আলাদা কথা। যাহোক, তারপর তো ছেলে বা মেয়ে নিজের মতেই চলে। সেটা চলতে গিয়ে ভুল করতে পারে, কখনও মারাত্মক ভুলও করে বসে। তখন বাবা মায়ের হয়তো এতে কোনো হাত থাকে না, তবুও বাবা-মা যে ছোটো থেকে শেখাননি এটাই স্পষ্ট হয়ে যায়। তবে কোনো বাবা মা, ছেলে মেয়ের সামান্য ভুল ত্রুটি দেখে শুধরে দেবেন এমনটা যদি না করেন তাহলে সেই ছেলেমেয়ে একদিন মারাত্মক ভুল তো করবেই। এ নিয়ে তর্ক চলে না। তাই পরিবারের একসঙ্গে সবাইমিলে মোবাইলে ব্যস্ত না থেকে গঠনমূলক কোনো চিন্তা, বা কাজ বা আলোচনায় মন দেওয়া উচিত। বা সমাজের কোনটা ভালো, কোনটা খারাপ, কোনটা উচিত, কোনটা উচিত নয় সেটা আলোচনা করা দরকার। আজকাল সবার হাতেই স্মার্ট ফোন। এবং প্রত্যেক পরিবারেরই একটা করে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ আছে। সেই গ্রুপে প্রতিদিনই সুপ্রভাত, শুভ সন্ধ্যা মেসেজ বিনিময় হয়। কেউ হাতে লেখে না, একেবারেই ফরোয়ার্ডেড মেসেজ ঘুরতে থাকে এক মোবাইল থেকে অন্য মোবাইলে। অথচ খোঁজ নিয়ে দেখুন কেউ কারুর মনের কথা তো দূর অস্ত সামান্য কোথায় আছে, কী করছেটুকুও জানে না। একই পরিবারের লোক কিন্তু। তাহলে পরিবার কথাটারই আর অর্থ থাকে না। তার আবার গ্রুপ কীসের? ছোটোবেলায় কী শিক্ষা দেওয়া হয়েছে না হয়েছে সেটাও যে একটা সময়ে পর আর ম্যাটার করে বলে তাও মনে হয় না। আজ ওই আরজি করের প্রিন্সিপালের মায়ের কেমন লাগছে? যদি তিনি বেঁচে থাকেন, আছেন কিনা জানা নেই। বা যে সমস্ত মন্ত্রীরা জেলে আছেন তাঁদের মায়েদের কেমন লাগছে?
-
কিংবা এমন ছেলেও আছে সমাজে যারা খুব ঘোরতর অন্যায় অর্থাৎ চুরি, চামারি, খুন রাহাজানির মতো কাজ করেনি। কিন্তু এমন এমন কাজ করেছে সেগুলো লুকিয়ে করতে হয়েছে। সর্বসমক্ষে বলার মতো নয়। নিশ্চয়ই নয়, নিন্দনীয়ই কোনো কাজ হবে, তা নাহলে তো গোপন করত না, ঢাক ঢোল পিটিয়েই করত। এইসব ছেলেদের করা সেই সমস্ত অনুচিত কাজগুলো যে বাবা মায়েরা জানেন তাঁদের কেমন লাগছে? তাঁরা কী ছেলেদেরকে উচিত শিক্ষা দিচ্ছেন তারপর? কে জানে! আজ অকপটে স্বীকার করতে লজ্জা নেই, পুত্র সন্তানের মা বলে প্রতিটা মুহূর্ত ভয়ে ভয়ে থাকি। এটা আমার ছেলের মেয়ে বন্ধুদের কয়েকজন মা’ও জানে এই ভয়ের কথা। তাদেরকেই বলেছি, ‘তোমরা মেয়ের মা হয়ে যে ভয়টা বেশি পাও, তার ডবল ভয় পাই আমি, কারণ আমি ছেলের মা। একটা মেয়ের ক্ষতি একটা ছেলে যদি করে, সেই ছেলেটা আমার হবে না তো’।
চেষ্টা করি সাধ্যমতো ভালো শিক্ষা দিতে। কিন্তু সে তো এক তরফা শিক্ষাই পাচ্ছে না। সমাজের আরও অনেকের থেকে অনেকরকম শিক্ষাই পাচ্ছে। স্কুল, খেলার মাঠ, বন্ধুবান্ধব, স্যোশাল মিডিয়া, ইন্টারনেটের মাধ্যমে নানা সাইটে সার্চ করা সবই থাকে এর মধ্যে। এবার কতটুকু সে রাখবে কতটুকু ফেলবে সেটা সম্পূর্ণ তার ব্যাপার। মা বাবা হিসেবেও খেয়াল রাখা দরকার। এই শিক্ষা দেওয়াটাও সাবজেকটিভ ব্যাপার। মায়ের যেটা ঠিক মনে হবে বাবার সেটা ঠিক মনে নাই হতে পারে। আর বাচ্চা যদি খুব ছোটো হয় আলাদা কথা নাহলে তারও যদি একটা মত তৈরি হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে সেই বাচ্চা যার কাছে বেশি প্রশ্রয় পায় তার মতটাকেই গ্রহণ করবে। মা বা বাবা দুজনের উদ্দেশ্যই কিন্তু সন্তানের ভালোটা চাওয়া। কিন্তু ভালো-খারাপটাই যদি সাবজেকটিভ হয়ে যায়, তখনই নানান মতবিরোধ দেখা দেয়। তবে শুধু নিজেরা দ্বন্দ্ব করলেই হবে না, বাচ্চাদেরও মনটা বুঝতে হবে। সবকিছু তাদের উপর চাপিয়ে দিলেও হবে না। আমাদের পুরোনো ধ্যান ধারণাও সবসময় খাটবে না। আমরা জীবনে যা পাইনি তা বাচ্চাদের মাধ্যমে পেতে চেয়ে তাদের উপর জোর জবরদস্তি চলবে না। তাদের মতো হয়ে কিছুটা ভাবনা চিন্তা করে, বাবা-মা হিসেবে একটা সীমারেখা রেখে নৈতিক শিক্ষাটা দিতে হবে। বন্ধুর মতো হতে পারি আমরা, বন্ধু হয়ে তাদের সঙ্গে অ্যাডাল্ট মুভি পাশাপাশি বসে দেখতে পারি না। এখানেও একটা সীমারেখা টানা দরকার।
আমি বাচ্চাকে কতটুকু বলব, কতটুকু বলব না, কী শেখাব, কী শেখাব না সেটা নিজেরাই আগে ভালোমতো রপ্ত করা উচিত। নাহলে একটা বাচ্চার মাথায় পৃথিবীর সমস্ত জিনিস এ টু জেড গুঁজে দিয়ে তার জীবনটা দুর্বিসহ করে ফেলতে পারি না। তাহলে সে বাচ্চা পুরো ঘেঁটে যাবে, আলটিমেটলি কিছুই শিখবে না। আমার ছেলেই সেরা এটারও যেমন দরকার নেই আবার আমার ছেলে কিচ্ছু পারে না এমনটা বলে তাকে হতাশ করারও কোনো প্রয়োজন নেই। সবকিছুতেই একটা ব্যালান্স দরকার। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সুতোটা নিজের হাতে রেখে সময় মতোই ছাড়া দরকার। তবে এটা সত্যি, মা হিসেবে সারাক্ষণ এই ভয়টাই করে, আমার ছেলে যেন খারাপ কিছু না ঘটিয়ে আসে কোথাও। আমার ছেলের জন্য কোনোদিন খারাপ কিছু শুনতে যেন না হয়। এটা মনে হয় আমার একার কথা নয়, আমার মতো হাজার হাজার পুত্র সন্তানেরই মায়ের কথা। মেয়ের মা হয়ে কেবল ভয়ে থাকা নয়, সত্যি বলছি ছেলের মা হয়েও ভয়ে ভয়ে, আতঙ্কে থাকতে হয়। শুধু ছেলে নয় মেয়ের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। অর্থাৎ কোনো অভিভাবকই তার কুলাঙ্গার সন্তান চায় না। আমরা সবাই চাই ছেলেদের মাথায় শুভ বুদ্ধির জোগান দিতে, শুভ চিন্তার বিকাশ ঘটাতে। কিন্তু সবই সময়ের হাতে। কিন্তু একটা সময় পর্যন্ত শেখানো সম্ভব তারপর আর নয়। ছেলে বা মেয়ে বড়ো হয়ে কেমন চুলের ছাঁট দেবে, মাসল করবে কিনা, চুলে বেগুনি রং করবে কিনা, কতগুলো ট্যাটু তার কোনো জায়গায় রাখবে, ট্যাটুগুলোই বা কেমন দেখতে হবে, কানে মাকড়ি পরবে কিনা, বা কটা কানে, কান ছাড়া অন্য কোথাও আর পরবে কিনা, জামাকাপড় সে কেমন পরবে, ছেঁড়া, ফাটা, হাফ, ফুল, হাঁটু বেরোনো নাকি আদৌ পরবে না সবটাই তাদের রুচি হয়ে দাঁড়ায় তখন। দৈত্যকুলে যেমন প্রহ্লাদ হয় তেমনি উল্টোটাও সম্ভব। একবার অন্য একটা কলেজের ছাত্র আমাদের কলেজে পরীক্ষা দিতে এসেছিল। ইংরেজি অনার্স। ছেলেটা রীতিমতো অস্থির, পরীক্ষার পরিবেশটাকেও অশান্ত করে তুলছিল। তখন তাকে সার্চ করতেই একঝাঁক টুকলির কাগজের পাশাপাশি তার পকেট থেকে গাঁজাও বেরোল। পরীক্ষা শেষে আমরা সমস্ত টিচাররা সেই ছেলেকে আগলে বসে রইলাম, খেতে টেতেও দিলাম। ছেলেটা কী অকপট। সে কী করে না করে সব বলে গেল। বাবার চাকরি দূরে পোস্টিং। তাদের কলেজ কোনো স্টেপ না নেওয়ায় তাদের বাড়ির লোক আসা পর্যন্ত আমরা সবাই ছিলাম। মা আর মাসি এলেন। মা বেশ শিক্ষিত। ইতিহাসে এম এ, তাঁর বাপেরবাড়িরও যা পরিচয় দিলেন তা সত্যিই প্রশংসনীয়। এই ছেলেকে তিনি কিছুতেই পথে আনতে পারেননি। ছেলে মাকে মারধোর করে পয়সা আদায় করে, গাঁজা নিজে খায় অন্যদেরও কিনে খাওয়ায়। তাঁর কথা মতোই বলতে হয়, তাঁর প্রহ্লাদ কূলে ওই এক দৈত্যের জন্ম হয়েছে। ফলে মা বাবা অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হতে পারেন। আবার একেবারে না চেষ্টা করেও সফল হতে পারে। কিন্তু যাঁরা দেখেও না দেখার ভান করে থাকেন মুশকিলটা তাঁদেরই বেশি হয়। উল্টোটাও কী হচ্ছে না? হচ্ছে। এবছর মেয়েদের থেকেই সবচেয়ে বেশি টুকলির কাগজ উদ্ধার হয়েছে। এই ছোটো ছোটো চুরিই একদিন তাদের কোথায় নিয়ে যাবে জানা নেই। কয়েকদিন আগেই এক বন্ধু তার এক্স গার্লফ্রেন্ড সম্পর্কে বলল, মেয়েটি নাকি মাল্টি ভার্স। সে বহু ছেলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়। ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ভিডিও করে রাখে এবং তারপর সে সেই ছেলেগুলোকে ব্ল্যাকমেল করে। মেয়েটি সিপিএম করে, কোটি টাকার ফ্ল্যাটে থাকে এবং সর্বহারাদের হয়ে নাকি কুমিরের কান্না কাঁদে। এসব তার বয়ফ্রেন্ডই বলেছে। ফলে ছেলেরাই খারাপ এমনটাও ধরে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। তবে সংখ্যায় কোনটা বেশি সেটা ম্যাটার করে।
সব বাচ্চাকেই আমাদের শেখাতে হবে মেয়েদের সম্মান করতে। আবার উল্টোটাও। হ্যাঁ সেই বাচ্চা যদি দেখে তার বাড়িতে এই কালচার নেই, তার বাবা তার মাকে বা বাড়ির অন্যান্য মহিলাদের সম্মান করে না, তাহলে সে বাচ্চা কী শিখবে বলা মুশকিল। সেক্ষেত্রে হয়তো বাচ্চা, কেবল মেয়েদের নয়, তার চারপাশের কোনো মানুষ, আত্মীয়স্বজন কাউকেই সম্মান করতে শিখবে না। আমার পরিচিত একজনকে দেখেছি তিনি তাঁর স্ত্রীর নামে সারাক্ষণ বদনাম করতেন, তাই তাঁর ছেলেও তাঁর মাকে সম্মান করেনি কোনোদিন এবং সেই মা’ও কোনোদিন কোনো মানুষকেই সম্মান করেননি। এখন সেই ছেলে বড়ো হয়ে তার স্ত্রীকে সম্মান করে না, তাদের বাচ্চাও সেটা দেখছে তার বাবা তার মাকে সম্মান করে না। তবে সেটা নির্ভর করছে বাচ্চার কানে কোন মন্ত্র দেওয়া হচ্ছে। ওখানে যেমন তার বাবা বাচ্চা বয়সে শুনত তার মা খারাপ এবং মা’ও কোনোদিন কাউকে সম্মান করত না, আজ সে বাবার ভূমিকায় বাচ্চাকে হয়তো সেটাই শেখাচ্ছে। আমার পরিচিত সেই মহিলা পরিষ্কার করে বলতে পারল না কিছু। যাহোক, এই বাচ্চা বড়ো হয়ে কী হবে সেটাও পুরোটাই সময়ের উপর নির্ভর করছে। বাচ্চা বড়ো হয়ে কী করবে সে দায় সবসময় বাবা মায়ের উপর যেমন থাকে না আবার পুরো দায় এড়িয়ে চলে যাওয়া যায় বলেও মনে হয় না। দায় এড়ানো বা না এড়ানোটা কোনো বড়ো কথা নয়, বড়ো কথা হল আমাদের সমাজ। আমাদের চারপাশ। বাড়ি তো অবশ্যই একটা ব্যাপার। আমি যদি জানতে পারি আমার বাচ্চার মধ্যে একটা পার্ভাভারশন দেখা দিচ্ছে, তৎক্ষণাৎ সেই বাচ্চাকে বোঝানো উচিত। নাহলে বড়ো হয়ে সেই বাচ্চাই একজন পার্ভাট হবে। বড়ো হয়েও একই কাজ করবে। বাবা মায়ের নজরে এলে তো অবশ্যই সেই বিষয় নিয়ে কথা বলা উচিত বাচ্চার সঙ্গে। নজরে না এলে কিছু করার নেই, যা হওয়ার তা হবে। তবে এটা ঠিক যে, যারা ছোটোবেলায় লুকিয়ে লুকিয়ে মেয়েদের ক্লিভেজ দেখে, মেয়েরা ঝুঁকলে তাদের বেরিয়ে যাওয়া বুক দেখে উত্তেজিত হয়, বুক থেকে ওড়না খসে গেলে হামলে পড়ে গিলে খায় মেয়েদের, জানলার ফুটো দিয়ে মেয়েদের শাড়ি ছাড়া দেখে, বড়ো হয়ে তারা সবসময়ই চেষ্টা করবে সুযোগমতো কোনো মেয়ের পোষাক খুলিয়ে ফেলতে তার নগ্ন ছবি বা ভিডিও পাঠাতে বলতে পারে। সব মেয়েকেই বলবে এমনটা নয়, ঝোপ বুঝে কোপটা মারবে। সুযোগ সুবিধা বুঝে সেরম মেয়ে খুঁজে নেবে। সবার কাছে বলতে গেলে চড় থাপ্পড় খেয়ে যেতে পারে। তাই সেটাও বুদ্ধি করে, কাকে বললে সম্ভব আর কাকে নয় বুঝে নিয়েই তবে এগোয়। এবং নিজেও সেই নগ্ন ছবি বা ভিডিও করে পাঠাতে লিপ্ত থাকবে মেয়েটির তরফ থেকে আরও নগ্ন ছবি, ভিডিও পাওয়ার জন্য। ধরা পড়ে গেলে ব্যাপারটা বন্ধ হতে পারে কিন্তু সেটা না জানা থাকলে জোর দিয়ে বলা যায় না। হয়তো তারপর থেকে ওই একই কাজ খুব সচেতন হয়ে সবার চোখে ধুলো দিয়ে করতে পারে। এইজন্য বাবা-মাদের জানা থাকলে সচেতন হওয়া উচিত। দরকার হলে কাউন্সেলিং করানো দরকার। এই ধরনের যৌন বিকৃতিতে মানুষ আজ আক্রান্ত। ছেলেমেয়ে উভয়েই। এবং বয়স? খুব বুড়ো না হলে যে কেউ হতে পারে। আর কাউন্সেলিং মানে তো পাগলের চিকিৎসা নয়। মনোবিদরা এর সমাধানের পথটা বলে দিতে পারেন। শোনা যায় এই ধরনের যৌন বিকারগ্রস্ত মানুষগুলো নাকি তার পাশের মানুষটাকেও সেই গোত্রের বলে দাগিয়ে দিতে দ্বিধা করে না। নিজের আয়নায় অন্যকেও বিচার করে তার লাইফ হেল করে দিতে পারে। এমন ঘটনা আপনার সঙ্গে ঘটলে আপনি তাকে চ্যালেঞ্জ করে আইনের সাহায্য নিতে পারেন। আপনি বলতেই পারেন প্রমাণ করুন তারপর মানব। এদের ছাড়া উচিত নয়। ছাড়লেই এরা পেয়ে বসবে এবং আপনার পিছনে আপনার নামেই বদনাম ছড়াবে।
ভেবে দেখুন, এই রেপিস্ট বা ক্রাইম একদিনেই তৈরি হয়ে যায় না। কেউ একজন সকালে ঘুম থেকে উঠে ভাবল, চল আজ রেপিস্ট হয়ে যাই, বা চল আজ খুনি হয়ে যাই বলল, এমনটা হয় না। যাকিছু হয় তা দীর্ঘদিনের লালন করা জীবনযাপন, অভিজ্ঞতা, এবং অপ্রাপ্তি, সমাজের কিছু চাপিয়ে দেওয়া বস্তাপচা নীতি থেকেই হয়। আমরা নিজেরা সবাই সুস্থ তো? নিজেরা সুস্থ না হলে একটা সুস্থ মানসিকতার সন্তান তৈরি করব কীভাবে? নিজেরা যদি অসুস্থ হই কোনোভাবেই সুস্থ মানসিকতার সন্তান তৈরি করা সম্ভব নয়। সমাজ সুস্থ হোক। প্রত্যেক মানুষের মন এবং মানসিকতা সুস্থ হোক। তাহলেই ঘরে ঘরে সুস্থ ভবিষ্যৎ ফলবে। এর জন্য আলাদা কোনো প্রচেষ্টারই দরকার পড়বে না.
ছবিটি ফেসবুক সূত্রে প্রাপ্ত।
সৌজন্যে- অদিতি। এবং অগণিত বন্ধু