কিঞ্চিৎ পরচর্চা – ৭
রূপশ্রী ঘোষ
প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙত ঠাকুমার মুখে প্রবাদ, প্রবচন বা ছড়া শুনে। সেসব শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে যেত, এখনও আছে কিন্তু জীবনের সঙ্গে তার সংযোগ কিছুতেই বোঝার চেষ্টা করতাম না। অবলীলায় একটা মুখস্থের আকারে বলে দিতে পারতাম। আজ বুঝি প্রবাদ প্রবচন আসলে দীর্ঘ অভিজ্ঞতার ফসল। ওগুলো এমনি এমনি লোকের মুখে মুখে ঘুরত না। আচমকা টুপ করে লোকসাহিত্যেও ঢুকে যায়নি। কিছু প্রবাদের সঙ্গে কিছু ঘটনা মিলিয়ে নেওয়া যাক।
‘পড়ল কথা সভার মাঝে যার কথা তার গায়ে বাজে’
ছোটোবেলায় কোনোদিন ভেবেও দেখিনি বা কোনো ঘটনার সঙ্গে মিলিয়ে দেখারও চেষ্টাও করিনি। ‘সভার’ কথাটা তো আগে ‘সবার’ বলতাম। তাতে অবশ্য অর্থ খুব একটা বদলে যায় না, কারণ সবাইকে নিয়েই তো সভা। তা সভার মাঝে না পড়ে সবার মাঝে পড়লেও অর্থ অভিন্নই থেকে যায়। আপনার সঙ্গেও এমন ঘটনা ঘটছে কিনা দেখে নিন। ধরুন আপনি নিয়মিত লেখালেখি করেন এবং লোকজন আপনার লেখা পড়ে আপনাকে লিখতে আরও প্রশ্রয়ও দেন। আপনার লেখার স্পর্ধা বেড়ে যায়। তারফলে আপনি লিখেই চলেছেন। আর তাতেই আসলে মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। আপনি হয়তো আপনার অভিজ্ঞতা থেকে লিখছেন, আপনার মতামত পোষণ করে লেখা পাবলিক করছেন। এই পাবলিক করাটাই আসলে কাল হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এত কোটি লোকের মধ্যে যে গুটি কয়জনকে আপনি চেনেন জানেন তাঁদের অনেকেরই মনে হচ্ছে আপনি তাঁদেরকেই কটাক্ষ করে বা তাঁদের উদ্দেশ্যে লিখছেন। আসলে তো তা নয়। সম্পূর্ণটাই আপনি আপনার দৃষ্টিভঙ্গি লিখছেন। এবার সভার মাঝে ফেলছেন, অনেকে গায়ে মেখে নিচ্ছেন। তাতে আপনার কী দোষ বলুন তো! আপনার কোনো দোষ নেই। আসলে যিনি গায়ে মাখছেন তিনি নিজেই খুব ভালো করে জানেন তিনি কেন গায়ে মাখছেন। এখানে আপনার কিন্তু কোনো হাত নেই। মজার ব্যাপার হল তাঁদের যদি মনে হয় তাঁদেরকে মনে করেই লেখা তাহলে মশাই নিজেরা একটু শুধরে নিন না নিজেদেরকে। অমন দেখে নেব টাইপের মনোভাব দেখালে তো মুশকিল আরো বেড়ে যায়। কী বলি বলুন তো। আপনার আমার সবার এমন একই অভিজ্ঞতা দিনে দিনে বাড়ছে চারিদিকে। এই সভার মাঝে কথা পড়ছে, তারপর যে গায়ে মাখার মাখছে এবং তারপর দেখে নেবে ভাবছে। ভাবুক। ভাবতে দিন। ভাবাটাও প্র্যাকটিস করতে হয়। দেখা চলুক, সবাই সবাইকে দেখে নিক। তাই বলে আপনি হাল ছেড়ে দিয়ে বসে থাকবেন না যেন, লেখা চালিয়ে যান। আর আমার ঠাকুমার শেখানো প্রবাদের সঙ্গে সব ঘটনা মিলিয়ে নিন।
‘নেই কাজ তো খই ভাজ’
এই খই ভাজা কিন্তু মোটেই সহজ কাজ না। মুড়ি ভাজার থেকে সহজ বটে, তবে কাজ না থাকলে খই ভাজতে বসে যাওয়ার মতো সহজ নয় কিন্তু। তাও কেন প্রবাদ হল কে জানে। বাব্বা! ভাজলেই তো শেষ কথা না, তারপর বাছাটা যে, আরো কঠিন। হ্যাঁ কিন্তু সমাজে এমন অনেক মানুষ আছেন সত্যিই খই ভাজেন। আপনার সঙ্গে এমন ঘটনা ঘটে কিনা মিলিয়ে নিন। ধরুন আপনাকে নিয়ে অনেকেরই খুব মাথা ব্যথা। আপনার কিন্তু তাঁদেরকে নিয়ে নয়। আপনি কী করছেন, কী খাচ্ছেন, কী লিখছেন, কেন লিখছেন এসব নিয়েও তাঁরা নাক গলাতে খুব ভালোবাসেন। যদিও আপনি কিন্তু তাঁদের নিয়ে একবিন্দুও লিখছেন না। তাঁরা আপনার গুরুত্বপূর্ণ সময়ের একটা কোণার মধ্যেও আসে না তবুও তাঁদের ধারণা আপনি তাঁদের বাড়া ভাতে ছাই দিলেন। অবশ্য সবই ঘটবে কিন্তু আপনার পিছনে। আপনার সামনে কিছু বলতে সাহস হবে না। আপনারই কোনো ঘনিষ্ঠ কারুর কাছে কথাগুলো বলবে। যাতে আপনাকে তাঁরা এসে আবার বলেন। কত বুদ্ধি খাটিয়ে সমালোচকদের কাজ করতে হয় বলুন। অথচ নিজেদের গঠনমূলক কোনো কাজ করার কিন্তু একটুও সময় নেই তাঁদের। এত ব্যস্ত। আপনার সমালোচনা করার জন্য অঢেল সময় তাঁদের। আপনাকে কী করে ফাঁদে ফেলা যায়, আপনার কী করে ক্ষতি করা যায়, আপনাকে কীভাবে দেখে নেওয়া যায় এসব প্যাঁচ তো সারাদিন মাথার মধ্যে কষতে হয়। অঢেল সময় না থাকলে এসব চলবে কেন? আরে শুনুন আপনি একটা ভুল করছেন, আপনি কেন ভাবছেন তাঁরা গঠনমূলক কোনো কাজ করেন না? আপনার ক্ষতি করতে চাওয়াটাই তো তাঁদের নিজেদের গঠনমূলক কাজ। কাজ নেই বলে আপনি ছোটো করবেন না প্লিজ। কাজ আছে। অনেক কাজ। আপনিই তালিকাটা মিলিয়ে নিন না। তাহলে বুঝে যাবেন কত কাজ তাঁদের। যাহোক কাজ চলুক। আপনার পিছনে সমালোচনা চলুক। খই ভাজার মতো। আপনি কেবল খই বেছে খান নাহলে গলায় ধান আটকে যাবে।
‘যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ’
আরে বাবা এ তো আর একটা সাঙ্ঘাতিক প্রবাদ। আপনি কাউকে কয়েক ঘন্টার জন্যে হলেও লঙ্কায় পাঠিয়ে দেখুন না, থুড়ি ক্ষমতা দিয়ে দেখুন না। হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে যাবেন। তা তিনি যত চুনোপুঁটিই হন না কেন। এই হল আপনাদের মুশকিল। রাবণ শুনেই খারাপ ধরে নিলেন। কেন ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্য পড়েননি? সেখানে কে নায়ক? রাবণকে নায়ক হিসেবে উত্তর লেখার একটা সুযোগ আপনাকে দেওয়া হয়ছিল তো, নাকি? তাহলেই ভেবে দেখুন। সবসময় ক্ষমতাকে অমন খারাপ অর্থে ধরে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। কেউ কেউ ভালো কাজও করেন। অনিল কাপুরের ‘নায়ক’ সিনেমার কথা মনে নেই? মনে করুন। তবে হ্যাঁ আমাদের চারপাশে ক্ষমতার অপপ্রয়োগই চলে। ফলে বুঝতে পারছি, তাই এই প্রবাদটা পড়েই আঁতকে উঠলেন। আঁতকে উঠবেন না। কখনো কখনো কাউকে রাবণ হতে দিতে হয়। এত ভয় পাচ্ছেন কেন? অতি দর্পে হত লঙ্কা বলেও তো একটা কথা আছে? দর্প বাড়লে লঙ্কা হত হবেই।
‘অতি বাড় বেড়ো না ঝড়ে পড়ে যাবে, অতি ছোটো হোয়ো না ছাগলে মুড়িয়ে খাবে’।
আপনাদের মনে হবে ঠাকুমা কত প্রবাদ বলতেন রে বাবা। হ্যাঁ সত্যিই অনেক বলতেন। ছড়া, কবিতা, প্রবচন সব মিলিয়ে লিখলে একটা উপন্যাস হয়ে যেতে পারে। সত্যিই মানুষ একবারও যদি ভেবে দেখত যে কতটা বাড়া উচিত, কতটা নয়, তাহলে একটা সুস্থ সমাজ আমরা সবাই পেতাম। বাচ্চারাও পেত। চারিদিকে এই বাড় বাড়ন্ত দেখতে দেখতে সবাই ক্লান্ত। তাদের মধ্যে কেউ কেউ শাস্তি পাচ্ছে কেউ কেউ পাচ্ছে না। যতক্ষণ না পাচ্ছে ততক্ষণ তো থামারও কোনো শেষ নেই। তাই বাড় বাড়ন্ত ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। ছাগলে মুড়িয়ে খাওয়ার মতো জায়গায় না আসুক তবে কিছুটা ছোটো কখনো না কখনো তো হতেই হবে। নিশ্চয়ই হবে। সবই সময়ের অপেক্ষা। আচ্ছা মাঝে মাঝে আপনাদের চারপাশের ঘটনার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে ভুলবেন না কিন্তু। মিলিয়ে নিন।
‘ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে’
শুনেই প্রথমে তো খুবই ধাক্কা খেয়েছিলাম। ঢেঁকি কী মানুষ যে স্বর্গে যাবে? তৈরিই তো একটা মরা কাঠ দিয়ে। তাও আবার ঢেঁকি রূপে মানুষের পায়ের তলাতেই থাকতে হয়। তার আবার স্বর্গে যাওয়ার চান্স আসে কোথা থেকে? আরে বাবা বাইচান্স বলেও তো একটা শব্দ আছে। বাইচান্স যদি যায় তাহলে সেখানে গিয়েও ধান ভানবে। সব ঢেঁকি সত্যিই স্বর্গে চলে গেছে। আমাদের আগের প্রজন্মের সময় থেকেই বোধহয় ধানভানা মেশিন এসে গেছে। আপনারা ঢেঁকিতে ধান ভানা দেখেছেন কিনা জানি না, তবে আমি কোনোদিন দেখিনি। পার্বণে চাল গুঁড়ো করতে দেখেছি। এই দেখুন ধান ভানতে শিবের গীত হয়ে গেল। যাহোক আমাদের চারপাশে এমন অনেক মানুষ আছেন যাঁরা সত্যিই সারাক্ষণ কাজ করেন। যেখানেই যান না কেন কাজ করেন। বা তাঁদের দিয়ে কাজ করিয়েও নেওয়া হয়। যাঁরা ফাঁকিবাজ তাঁরা তো কাজ না করার অজুহাত দেন, কিন্তু যাঁরা সত্যিই কাজ জানেন বা কাজ ভালোবাসেন তাঁরা কখনো কোথাও বসে থাকেন না। নিরন্তর কাজ করে যান। কাজের ব্যক্তিটি যদি নীরিহ এবং ভালো মনের মানুষ হন তাহলে তো আর কথাই নেই। তাঁকে দিয়ে বেশ সব কাজ করিয়ে নেওয়া যায়। আর তিনি নির্দ্বিধায় করেও যান বটে, কোনো ক্লান্তিই আসে না তাঁর বা তাঁদের কাজ চলুক। ঢেঁকি ক্লান্ত না হওয়াই ভালো।
‘বড়ো যদি হতে চাও ছোটো হও তবে’
এটাও কিন্তু শিখিয়েছিলেন। কিন্তু হ্যাঁ আপনারা তা দেখতে পাচ্ছেন কিনা জানি না। আমার চারপাশে আমি কাউকে ছোটো হয়ে বড়ো হতে দেখছি না। কেবল ‘দেখে নেব’ টাইপের মনোভাবে মশগুল ব্যক্তিই বেশি। সবার প্রচণ্ড ইগো। এই ইগো থেকে কেউ একচুল নড়ছে না। একে অপরকে অপমান, কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি করেই চলেছে। পারস্পরিক সম্মানটুকুও নেই। অশ্রদ্ধা, অসম্মান, পারস্পরিক ঘৃণা, বিদ্বেষ কোনোটাই কাম্য নয়। আপনি যা করবেন আপনার নতুন প্রজন্ম আপনার থেকে সেটাই শিখবে। খেয়াল রাখুন আপনার কাছে কিন্তু সেটা ফিরেও আসবে। তখন পারবেন তো সেই ধাক্কাটা সামলাতে?
আজ বন্ধু দিবস। হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ‘হ্যাপি ফ্রেন্ডশিপ ডে’ মেসেজের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। এই বন্ধু মানে কী? সত্যিই কি আমরা কেউ কারো বন্ধু? নাকি বন্ধুত্বের ভান? আমরা সবাই সবার সামনে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলছি, অথচ ঠিক পিছনে গিয়ে তাকে ছুরিটি মারছি, অসম্মান করছি, তার সম্পর্কে নোংরা নোংরা কথা বলছি। আবার সে যখন সামনে আসছে তখন আবার মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে বুঝিয়ে দিচ্ছি সে আমার কত বন্ধু। যাঁরা এসব করেন বা করছেন তাঁরা সত্যিই সুস্থ তো? মানসিকভাবে অসুস্থ নন তো? মানসিক ভারসাম্যহীন সেইসব বন্ধুদের প্রতিও শুভেচ্ছা রইল। যাঁরা ভয় দেখান, তাঁরা আসলে যেমন মনে মনে সবচেয়ে বেশি ভীত, তেমনই যাঁরা অপরের সম্পর্কে নোংরা গুজব ছড়িয়ে শান্তি পান, তাঁরা আসলে জীবনে কোনোদিন শান্তির মুখই দেখেনি। তাঁরা শান্তির দেখা পান।
যাঁরা ভয় দেখান, তাঁরা আসলে যেমন মনে মনে সবচেয়ে বেশি ভীত, তেমনই যাঁরা অপরের সম্পর্কে নোংরা গুজব ছড়িয়ে শান্তি পান, তাঁরা আসলে জীবনে কোনোদিন শান্তির মুখই দেখেননি। তাঁরা শান্তির দেখা পান।