হোর্হে লুইস বোর্হেস-এর গল্প। অনুবাদ- অনুপ সেনগুপ্ত

হোর্হে লুইস বোর্হেস-এর গল্প। অনুবাদ- অনুপ সেনগুপ্ত

[আর্হেনতিনার স্বনামধন্য কবি, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক হোর্হে লুইস বোর্হেস (Jorge Luis Borges ) (১৮৯৯ – ১৯৮৬)। তাঁর ‘মার্ক লিখিত সুসমাচার’ (El Evangelio Segun Marcos ) গল্পটি ‘ডক্টর ব্রোদির রিপোর্ট’ বা ‘Informe de Brodie’ গল্পগ্রন্থের অন্তর্গত। ]     

মার্ক লিখিত সুসমাচার

 

 

ঘটনার সূত্রপাত — ছোট শহর হুনিনের দক্ষিণের লা কোলোরাদা খামার, ১৯২৮-এর মার্চ মাসের শেষ কয়েকটা দিন। আর পাত্র বা মধ্যমণি একজন ডাক্তারি পড়ুয়া। নাম বালতাসার এস্পিনোসা। এই মুহূর্তে এস্পিনোসা সম্পর্কে বলতে হলে, বুয়েনোস আইরেসের আর পাঁচটা যুবকের সঙ্গে তার তফাৎ তেমন চোখে পড়ে না। কেবল তার বাগ্মিতা — রামোস মেহিয়ার ইংরেজি বিদ্যালয়ে পড়ার সময় যে কারণে একাধিকবার পুরস্কৃত — আর অপার দরদি মন তাকে অন্যদের থেকে কিছুটা হলেও আলাদা করেছিল। ভালো বক্তা হলেও তর্ক করা তার ধাতে ছিল না, বরং নিজের চেয়ে সংলাপকারীর মতামতকেই সঠিক প্রতিপন্ন করতে চাইত। জীবনের সাপ-লুডোতে উৎসাহ ছিল, অথচ খেলোয়াড় হিসেবে একবারেই অযোগ্য — কেননা এই খেলোয়াড় জিতে আনন্দ পায় না। বুদ্ধিমান, কিন্তু সেই বুদ্ধি আবার দিশেহারা। কোনও কিছু জানতে শিখতে আগ্রহ ষোলো আনা, যদিও বেজায় কুঁড়ে। নইলে তেত্রিশ বছর বয়সেও ডাক্তারি ডিগ্রির শেষ ধাপটা পেরোতে কেউ এতটা উদাসীন থাকে! অথচ এই শেষ ধাপের পাঠক্রমটাই নাকি তার ভারি পছন্দের। এস্পিনোসার বাবা নিজের সমসাময়িক প্রায় সব ভদ্রলোকের মতোই মুক্তচিন্তক বা ফ্রি থিংকার  — প্রথাগত ধর্মের সমালোচক, স্বাতন্ত্র্যবাদী। একসময় ছেলেকে তিনি হার্বার্ট স্পেনসারের মতবাদ বুঝিয়েছিলেন। কিন্তু ছেলে যখন মোন্তেবিদেও গেল, মা তাকে রোজ রাতে প্রার্থনা আর শরীরে ক্রুশ আঁকার প্রতিজ্ঞা করালেন। তারপর বহু বছর হয়ে গেলেও সেই প্রতিজ্ঞা কখনও ভাঙেনি। তা’বলে এস্পিনোসার সাহস কিছু কম ছিল না।

 

এক সকালে তো কয়েকজন সহপাঠীর সঙ্গে মারপিটেও জড়িয়ে পড়েছিল। তা যত না রাগে, তার চেয়েও বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মঘটে অংশ নিতে না চাওয়ায়। ছোকরাগুলো একটু বেশিই জবরদস্তি করছিল, দু’চার ঘুষি বিনিময় হয়েছিল সেদিন। না হলে এমনিতে সে নির্বিবাদী। মৌনসম্মতি তার স্বভাবগত। যদিও বহু ব্যাপারে নিজস্ব মতামত আছে। আর সে’সব এককথায় অবিশ্বাস্য। যেমন নিজের দেশ আর্হেনতিনা নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাতে চায় না, কারণ তার আশঙ্কা বাকি জগৎ হয়তো এই দেশের মানুষকে এখনও মাথায় পালক গোঁজা ইন্ডিয়ান ভাবে। সে ফ্রান্সকে সম্মান করে, কিন্তু ফরাসিদের ততটাই অবজ্ঞা। মার্কিনিদের নিয়ে কমই ভাবে, যদিও মার্কিন মুলুকের মতো বহুতল অট্টালিকা বুয়েনোস আইরেসে আছে ভেবে গর্বিত। তাঁর ধারণা, পাহাড়ি অঞ্চলের গাউচোর থেকে সমতলের গাউচো বেশি ভালো ঘোড়সওয়ার। তার তুতো ভাই দানিয়েল যখন তাকে গরমকালটা লা কোলোরাদোর খামারে কাটানোর জন্যে ডাকল, সে এককথায় রাজি হয়েছে এইজন্যে নয় যে জায়গাটা তার দারুণ পছন্দের — আসলে একে তার নির্বিবাদী স্বভাব, সেইসঙ্গে না বলার মতো যথেষ্ট অজুহাত খুঁজে পায়নি তখন।

 

খামারের মূল বাড়িটা বেশ বড়। কি়ঞ্চিৎ ভগ্নদশা এখন। কাছেই ফোরম্যান বা কর্মীসর্দার গুত্রের আস্তানা। গুত্রেরা তিনজন — বাবা, ছেলে, আর মেয়ে। ছেলেটা একটু রুক্ষ, অমার্জিত। মেয়েটার পিতৃত্ব আবার সন্দেহজনক। প্রত্যেকেই লম্বা, শক্তসমর্থ, কিন্তু কৃশকায়। লালচে চুল। চোখেমুখে স্থানীয় ইন্ডিয়ান ছাপ স্পষ্ট। ওরা প্রায় কথাই বলে না। কয়েক বছর আগে কর্মীসর্দারের স্ত্রী গত হয়েছে।

 

এই এক দেশ, এস্পিনোসা এমন কিছু শিখছে, আগে তার ধারণার বাইরে ছিল। যেমন, বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে এখানে কেউ ঘোড়া ছোটায় না, কিংবা কোনও বিশেষ কাজ ছাড়া ঘোড়া নিয়ে বাইরে যায় না। ইতিমধ্যে ডাক শুনে পাখিও চিনে ফেলছে এস্পিনোসা।

 

কিছুদিন পর দানিয়েলকে তার পশু ব্যাবসার একটা লেনদেন ফয়সালা করতে রাজধানী বুয়েনোস আইরেসে যেতে হল। ফিরতে ফিরতে তার এক সপ্তাহও লাগতে পারে। এর আগে কয়েকদিন ধরে দানিয়েলের হঠাৎ ‘বন ফরচুন’ (bonnes fortunes)  বা ভাগ্যোদয় আর হালফ্যাশনের বিচিত্র পোশাকে তাকে দেখতে দেখতে এস্পিনোসা বেশ কাহিল হয়ে পড়েছে। তাই ভাইয়ের সঙ্গে না গিয়ে সে খামার বাড়িতেই থেকে যাবে ঠিক করে।

 

গরমটা ক্রমশই অসহ্য হয়ে উঠেছে। এমনকি রাতেও রেহাই নেই। একদিন ভোরে বাজ পড়ার শব্দে এস্পিনোসা জেগে ওঠে। বাইরে তখন ঝাউগাছে আছড়ে পড়ছে ঝড়। এস্পিনোসা এবছর প্রথম বৃষ্টির ঝমঝম শোনে। ধন্যবাদ দেয় ঈশ্বরকে। হঠাৎই ঠান্ডা বাতাস বইতে শুরু করেছে। এদিনই বিকেলে সালাদো নদী ফুলে উঠে দুকূল ভাসিয়ে দেয়।

 

পরদিন সকালে বাড়ির দরদালান থেকে বন্যার চেহারা দেখতে দেখতে বালতাসার এস্পিনোসা ভাবে, পাম্পা তৃণভূমির সঙ্গে সমুদ্রের যে উপমা টানা হয়, তা অনেকটাই ঠিক, অন্তত এই সকালে। যদিও উইলিয়ম হেনরি হাডসন বলেছিলেন, সমুদ্রকেই বেশি চওড়া মনে হয়। কারণ তা জাহাজের ডেক থেকে দেখা। ঘোড়ার পিঠ বা নিজের উচ্চতা খেকে নয়। বৃষ্টি থামার লক্ষণ নেই। গবাদি পশুর বড় অংশ বাঁচায় গুত্রেরা। এই কাজে এস্পিনোসা তাদের সাহায্য করতে গিয়ে উল্টে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে কিনা বলা মুশকিল। অনেক পশু ডুবেও গেছে। চারটে রাস্তা এসেছে লা কোলোরাদায়। সবগুলোই এই মুহূর্তে জলের তলায়। দু-দিন পর কর্মীসর্দারের বাড়ির ফুটো ছাদ সাক্ষাৎ আতঙ্ক হয়ে ওঠে। খামার বাড়ির পিছনে, যন্ত্রশালার পাশে গুত্রেদের একটা ঘর ছেড়ে দেয় এস্পিনোসা। ফলে সে আর গুত্রেরা এখন কাছাকাছি। বড় খাবার ঘরটায় সবাই মিলে একসঙ্গে খায়। গুত্রেদের সঙ্গে কথা বলা যদিও দুষ্কর। ওরা লা কোলোরাদার অনেক কিছুই জানে। কিন্তু ঠিক মতো প্রকাশ করতে পারে না। এক রাতে এস্পিনোসা ওদের কাছে জানতে চায়, এই অঞ্চলে সেনাবাহিনীর যখন সীমান্ত শিবির ছিল, তখন পিছন থেকে ইন্ডিয়ান হানার কথা এলাকার মানুষ এখনও মনে রেখেছে কি না। উত্তরে শুধু হ্যাঁ বলে ওরা। কিন্তু প্রথম চার্লসের শিরশ্ছেদ সম্পর্কে প্রশ্ন করলেও একই উত্তর দেবে বোধহয়। এস্পিনোসার মনে পড়ে, বাবা একবার বলেছিলেন, প্রায় সব দীর্ঘ আয়ুর কারণ দুর্বল স্মৃতি কিংবা তারিখ বেখেয়াল। গুত্রেরা নিজেদের জন্মসাল, এমনকি পিতৃনামও মনে রাখতে চায় না।

 

গোটা বাড়ি খুঁজে কিছু বইপত্তর পাওয়া গেছে। যেমন, এক সেট ‘লা চাকরা’ (খামার) পত্রিকা, পশু ওষুধের তথ্যপঞ্জি, উরুগোয়াই দেশের রোম্যান্টিক কাব্য নাটক ‘তাবারে’র রাজসংস্করণ, আর্হেনতিনার ক্ষুদ্রশিং গবাদি পশুর ইতিবৃত্ত, কয়েকটা শৃঙ্গার রসের রহস্য গল্পের সংকলন। আর এস্পিনোসার না পড়া একটা সাম্প্রতিক উপন্যাস —  ‘রিকার্ডো গুইরালদেসের ‘দোন সেগুন্দো সোম্ব্রা’ (শ্রীয়ুক্ত দ্বিতীয় ছায়া)। দুপুরে খাওয়ার পর একটু গল্পগুজব না করলে এস্পিনোসার প্রাণ হাঁসফাস করে। কিন্তু গুত্রেরা এমনিতেই কম কথা বলে। লেখাপড়াও জানে না। তাই উপন্যাসের প্রথম দুটো পরিচ্ছেদ ওদের পড়ে শোনায় এস্পিনোসা। কিন্তু পোড়া কপাল! কর্মীসর্দার নিজে ছিল একসময় পশুচারক। অন্য পশুচারকদের গল্প তাই ওর তেমন পছন্দ নয়। এইরকম অভিযান নাকি ওর কাছে জলভাত। ওর নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলেঃ একটা খচ্চরের পিঠে সব মাল চাপিয়ে রওনা দিত। পশুচারক না হলে কখনোই গোমেস হ্রদ, ব্রাগাদো শহর, নুঙেস খামার কিংবা টাকাবুকো নাকি ওর দেখা হতো না।

 

হেঁশেলে একটা বিরাট গীটার ছিল। এস্পিনোসা শুনেছে, একসময় পশুখামারের কর্মীরা অবসরে গোল হয়ে বসত, আর কেউ হাতে তুলে নিত এই গীটার। বাজাতে না জানলেও গীটারে যেমন খুশি ঝংকার তুললে সঙ্গীদের কাছে গীটার বাদক হিসেবে বাহবা বরাদ্দ।

 

এস্পিনোসার মুখে এখন কয়েকদিনের দাড়ি। মাঝে মাঝেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুখের পরিবর্তন দেখছে। ঠোঁটে মৃদু হাসি। ভাবে, বুয়েনোস আইরেসে ফিরে সালাদো নদীর বানের গল্প শুনিয়ে কীভাবে বন্ধুদের অতিষ্ঠ করবে। এখন অদ্ভুতভাবে নিজের শহরের সেইসব জায়গার জন্যে তার মনকেমন করছে যেখানে খুব একটা যায়নি, আর কখনও হয়তো যাবেও না। কাব্রেরা স্ট্রিটের কোণে ডাকবাক্স, হুহুই স্ট্রিটের প্লাসা দেল ওন্সের কয়েকটা বাড়ির পর একটা ফটকে দুটো সিমেন্টের সিংহ, বহুদিনের একটা বিরাট পানশালা — এর মেঝেয় টাইলস বসানো —  কিন্তু সেটা ঠিক কোথায় মনে পড়ছে না। দানিয়েল হয়তো বাবা আর ভাইদের এতক্ষণে জানিয়ে দিয়েছে, এস্পিনোসা এখন বিচ্ছিন্ন —  বিচ্ছিন্ন  শব্দটাই ঠিক — এই বন্যা তাকে বাকি পৃথিবী থেকে সত্যিসত্যিই সবিশেষ ছিন্ন করেছে।

 

বন্যার জল বাঁচিয়ে যেসব জিনিস এই খামার বাড়িতে তোলা হয়েছে, সে-সবের মধ্যে একটা বাইবেল খুঁজে পেল এস্পিনোসা। শেষের কয়েকটা সাদা পাতায় হাতে লেখা গাথ্রেদের বংশলতিকা। গুত্রেদের আসল পদবি তাহলে গাথ্রে। ওরা ছিল স্কটল্যান্ডের ইনভার্নেস শহরের সংখ্যালঘু ইংরেজ। সেখান থেকে ঊনবিংশ শতকের প্রথম দিকে এই নতুন মহাদেশে আসে। নিঃসন্দেহে শ্রমিক হিসেবেই এসেছিল। তারপর স্থানীয় আদিবাসী ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে বিয়েথা হয়। বংশলতিকাটা ১৮৭৮-এ এসে থেমে গেছে। তখন ওরা আর লিখতে পারে না। কয়েক প্রজন্মের মধ্যে নিজেদের ইংরেজি ভাষাটাও ভুলে যায়। এস্পিনোসা যখন ওদের দেখছে, স্প্যানিশ ভাষাও ওরা ঠিকমতো বলতে পারে না। সেই অর্থে ওদের কোনও ধর্মবিশ্বাস নেই। কিন্তু ধমনীতে ক্যালভিনিস্ট গোঁড়ামি ক্ষীণভাবে হলেও বহমান। তার সঙ্গে মিশেছে পাম্পা অঞ্চলের আদিবাসী ইন্ডিয়ানদের কুসংস্কার। এস্পিনোসা ওদের বাইবেল খুঁজে পাওয়ার কথা জানায়। কিন্তু ওরা তেমন গ্রাহ্য করে না।

 

বাইবেলের পাতা ওল্টায় এস্পিনোসা। মার্কলিখিত সুসমাচারের প্রথম কবিতায় তার আঙুল থামে। ইংরেজি থেকে স্প্যানিশে তর্জমা অনুশীলনের হঠাৎ সুযোগ পেয়ে, আর সেইসঙ্গে গুত্রেরা তা কতটা বুঝতে পারে দেখতে এস্পিনোসা ঠিক করে, সন্ধের আহারপর্ব মিটলে ওদের বাইবেল পড়ে শোনাবে। অবাক কান্ড! গুত্রেরা শুধু মন দিয়ে শুনছেই না, বিভোর হয়ে যাচ্ছে। বইটার প্রচ্ছদে সোনালী অক্ষরের উপস্থিতি হয়তো সম্ভ্রম জাগায়। সেই সম্ভ্রমবোধ গুত্রেদের রক্তে বহমান — এস্পিনোসার মনে হয়। সে জানে, প্রজন্মের পর প্রজন্মে দুটো গল্প বারবার বলা হয়েছেঃ কাঙ্ক্ষিত দ্বীপের খোঁজে ভূমধ্যসাগরে হারিয়ে যাওয়া জাহাজের কাহিনী, আর এক দেবতার বৃত্তান্ত – গোলগাথায় যিনি ক্রুশবিদ্ধ হয়েছিলেন। রামোস মেহিয়ায় বক্তৃতা শিক্ষার ক্লাসের কথা মনে পড়ে এস্পিনোসার। এইবার বাইবেলের নীতিগল্প পড়তে হবে। উঠে দাঁড়ায়। এর পরের দিনগুলোতে সুসমাচার শোনার জন্যে গুত্রেরা ঝলসানো মাংস কিংবা সার্ডিন মাছ গোগ্রাসে গিলে কাছে এসে বসবে।

 

কর্মীসর্দারের মেয়ের একটা পোযা ভেড়ার ছানা আছে। ওর গলায় একটা আকাশি রঙের ফিতে বেঁধে শোভা বাড়িয়েছিল মেয়েটা। একদিন কাঁটাতারের বেড়ায় কেটে যায় ছানাটার। রক্ত ঝরছে। গুত্রেরা ক্ষতস্থানে মাকড়সার জাল দিতে চাইছিল। কিন্তু এস্পিনোসা ছানাটাকে ওযুধ খাইয়ে ক্ষত সারিয়ে দেয়। সে বেশ অবাক হয়, তার এই সামান্য কাজের জন্যে গুত্রেরা কেমন ধন্য হয়ে গেছে। এখানে আসার প্রথমদিকে গুত্রেদের একেবারেই বিশ্বাস করত না এস্পিনোসা। সঙ্গে আনা দুশো চল্লিশ পেসোয় কেনা একটা বই ওদের চোখের আড়ালে রাখত। খামারের মালিক বাইরে। এস্পিনোসাই এখন সর্বেসর্বা। তাই মৃদু আদেশ দিতে শুরু করেছে। আর সেই আদেশ পালিতও হচ্ছে যথাযথ। গুত্রেরা এখন এস্পিনোসার পিছু পিছু ঘর থেকে ঘরে, বাড়ির চারপাশ ঘিরে দরদালানে ঘুরে  বেড়ায়। যেন সে ছাড়া গুত্রেরা হারিয়ে যাবে। বাইবেল পড়ার সময়, এস্পিনোসা লক্ষ্য করে, টেবিলে রাখা তার পাঁউরুটির অংশ গুত্রেরা টেনে নিচ্ছে। একদিন বিকেলে গুত্রেরা যখন নিজেদের মধ্যে তার সম্পর্কে প্রশংসা করছিল, এস্পিনোসার কাছে ধরা পড়ে যায়।

 

মার্ক লিখিত সুসমাচার শেষ করার পর এস্পিনোসা বাকি তিনটে সুসমাচার শোনাতে চাইলে কর্মীসর্দার আগেরটাই ফের পড়তে বলে, ওরা যাতে তা আরও ভালোভাবে বুঝতে পারে। এস্পিনোসার মনে হয়, গুত্রেরা অনেকটা শিশুর মতো, বৈচিত্র্য ও অভিনবত্বের চেয়ে পুনরাবৃত্তি বেশি পছন্দ করে। এক রাতে সে ভয়ঙ্কর বন্যার স্বপ্ন দ্যাখে। এতে অবশ্য অবাক হওয়ার কিছু নেই। নোয়ার জাহাজে হাতুড়ি পেটার শব্দে তার ঘুম ভেঙে যায়। এস্পিনোসা ভেবেছিল, বাজ পড়েছে। কিন্তু আসলে বৃষ্টির শব্দ থেমেছিল, আবার শুরু হয়েছে। অসহ্য ঠান্ডা। গুত্রেরা তাকে জানিয়েছিল, ঝড়বৃষ্টিতে যন্ত্রশালার ছাদের ক্ষতি হয়েছে। ওরা যখন কাঠের বিমগুলো মেরামত করবে, তখন তাকে কোথায় ক্ষতি হয়েছে দেখাবে। এস্পিনোসা এখন আর ওদের কাছে আগন্তুক নয়। বিশেষ সম্ভ্রমের চোখে দেখছে তাকে। ওদের প্রশ্রয়ে এস্পিনোসা প্রায় নষ্টই হতে বসেছে। গুত্রেরা কেউই কফি পছন্দ করে না। কিন্তু এস্পিনোসার জন্যে বেশি চিনি মিশিয়ে এক কাপ কফি রোজ রেখে যায়।

 

দ্বিতীয় ঝড়টা উঠল মঙ্গলবার। আর বৃহস্পতিবার রাতে দরজায় মৃদু ধাক্কায় ঘুম ভাঙে এস্পিনোসার। গুত্রেদের এখনও তেমন বিশ্বাস করতে পারে না। তাই দরজায় খিল লাগিয়ে শোয়। দরজা খোলে এস্পিনোসা। গুত্রের মেয়ে। অন্ধকারে প্রায় দেখাই যাচ্ছে না। কিন্তু পায়ের শব্দে এস্পিনোসা বুঝতে পারে, নগ্ন পা। তারপর বিছানায় এলে ঠাহর হয়, নিজেদের ঘর থেকে এই ঘর পর্যন্ত আদুর গায়েই এসেছে। এস্পিনোসাকে সে আলিঙ্গন করে না। একটা কথাও বলে না। শুধু পাশে শুয়ে কাঁপতে থাকে। এই প্রথম কোনও পুরুষের স্পর্শ টের পায় নিজের গভীরে। কিন্তু চলে যাওয়ার আগে এস্পিনোসাকে একটা চুমু পর্যন্ত খায় না। এস্পিনোসার মনে হয়, মেয়েটার নাম পর্যন্ত সে জানে না। কিন্তু কোনও অজ্ঞাত কারণে এই নিয়ে আর বেশি না ভেবে ঠিক করে, বুয়েনোস আইরেসে ফিরে ঘটনাটা কাউকে বলবে না।

 

রোজকার মতো পরের দিনটা শুরু হয়। হঠাৎ মেয়েটির বাবা এস্পিনোসাকে জিজ্ঞেস করে  —  মানুষকে উদ্ধারের জন্যেই কি যীশু নিজেকে ক্রুশবিদ্ধ হতে দিয়েছিলেন?

এস্পিনোসা নিজের বাবার মতোই আসলে মুক্তচিন্তক — ফ্রি থিংকার। কিন্তু গুত্রেদের সে যা পড়ে শুনিয়েছে, সেটার জন্যেও দায়বদ্ধ। একটু চুপ করে থেকে উত্তর দেয় — হ্যাঁ, মানুষকে নরক থেকে উদ্ধারের জন্যেই যীশু এই পথ নিয়েছিলেন।

নরক কী? — কর্মীসর্দার গুত্রে জিজ্ঞেস করে।

— মাটির নিচে সব পাপাত্মা যেখানে আগুনে দগ্ধ হয়।

— যীশুকে যারা ক্রুশবিদ্ধ করেছে, তারাও কি পাপ থেকে উদ্ধার পেয়েছে?

হ্যাঁ — এস্পিনোসা উত্তর দেয় বটে, যদিও এব্যাপারে ধর্মতত্ত্ব একটু অস্পষ্ট। এস্পিনোসার আশঙ্কা হচ্ছে, কর্মীসর্দার হয়তো এবার গতকাল মেয়ের সঙ্গে কী ঘটেছে জানতে চাইবে। দুপুরের খাওয়ার পর গুত্রেরা তাকে সুসমাচারের শেষ পরিচ্ছেদটা আবার শোনাতে বলে।

 

এস্পিনোসা এরপর লম্বা ঘুম দেয়। ঘুম অবশ্য খুব একটা গভীর হয়নি। হাতুড়ির টানা দমাদ্দম আওয়াজ আর বিপদের আবছা আশঙ্কা বারবার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। বিকেলে ঘুম থেকে উঠে হলঘরে যায়। বৃষ্টি এবার থামবে, আর বেশিক্ষণ চলবে না — এস্পিনোসা যা ভাবছে তা এমনভাবে বলে, যেন তাই ঘটবে।

আর বেশিক্ষণ চলবে না — কর্মীসর্দার গুত্রে যেন প্রতিধ্বনি করে।

গুত্রেরা তিনজন এস্পিনোসার পিছু পিছু হাঁটছে। তারপর হঠাৎ থেমে মেঝেতে হাঁটুগেড়ে বসে এস্পিনোসার আশীর্বাদ চায়। সে পর্ব মিটলে, ওরা এস্পিনোসাকে অভিশাপ দিতে শুরু করে। তার গায়ে থুতু দেয়, আর সেইসঙ্গে ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে নিয়ে চলে। মেয়েটা কাঁদছে। এস্পিনোসা যেন বুঝতে পারে, দরজার ওপাশে তার জন্যে কী অপেক্ষা করছে। ওরা যখন দরজাটা খোলে, এক টুকরো আকাশ দেখতে পায় এস্পিনোসা। একটা পাখির ডাক শুনে তার মনে হয়, গোল্ডফিঞ্চ। যন্ত্রশালার আর ছাদ নেই। গুত্রেরা বিমগুলো খুলে নিয়ে ক্রুশ তৈরি করেছে।

 

 

 

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes
404 Not Found

Not Found

The requested URL was not found on this server.


Apache/2.4.41 (Ubuntu) Server at hacklink.site Port 80