স্রোত
১৮ তম পর্ব
যশোধরা রায়চৌধুরী
১৮
কমিটিতে এক বিকেল
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের চোখের ঘুম উড়ে গেছে। প্রথমে খুবই কড়া স্ট্যান্ড নিয়েছিলেন ওঁরা। ইনডিসিপ্লিন সহ্য করা হবে না।
বলা হয়েছিল, একটা ইনস্টিটিউশন এটা। এর একটা মান সম্মান আছে। আমরা স্টেপ নেব। দেখছি। দেখছি আমরা। কী করা যায়।
গোটা চত্বরে নানা ধরণের কথা উড়ে বেড়ায়। দেখা হচ্ছে। পুছতাছ ছানবিন ইত্যাদি ইত্যাদি নামের অনেক সরকারি ছাপ্পামারা ব্যাপার আছে। আছে সূক্ষ্ম এনকোয়ারি, আছে ভেসে ভেসে গন্ধ শুঁকে পরিস্থিতি মাপা। আছে সম্মানিত এক সংস্থার নিজ সম্মান রক্ষার সুললিত ভঙ্গি।
ছাত্রদের প্রথম ও প্রধান দাবি ছিল , সুপ্রিম কোর্টের বিশাখা গাইডলাইন , যা পরে রূপান্তরিত হয়েছে আইনে, সেই অনুযায়ী একটি কমিটি তৈরি করতে হবে। কমপ্লেন্ট কমিটি। সেটা কোথায় হল। সেটা যতক্ষণ না হচ্ছে, হোক ঝঞ্ঝা চলবেই। বলেছিল ছাত্রেরা।
ইতিমধ্যে আরো একবার একটা মেয়ের সঙ্গে অসভ্যতার ঘটনা ঘটল। এবার ছাত্রীদের ঐ গ্রুপটা এগিয়ে এল,পিরিওডস গ্রুপ।
এবারও, ওপর থেকে খাঁড়া নামল, কিন্তু শেষমেশ ধোপে টেঁকেনি। বেশি নাড়া দিলেই রক্তগন্ধলোভী মাছির মত, গুগন্ধলোভী কুত্তার মত ছেঁকে ধরবে মিডিয়া। এখন সবেতে মিডিয়ার ভয়। মিডিয়া সবচেয়ে রেলাসম্পন্ন জীব এখন সমাজে। আর একটা বড় সংস্থাকে ত ভুলভাল কারণে পাবলিসিটি পেতে দেওয়া যায়না। কাজেই বেশি নাড়াচাড়া দেওয়া নয়। শাস্তিবিধান টিধান নয়। একটু সাবধান করে দেবার চেষ্টা হল।
স্যার ম্যাডামরা বসলেন। চা বিস্কুট খেলেন। ওদের চারজনকে ডাকা হল।
ওরা এল। নরম দেখতে । সব ছেলেপুলের বয়সী ছাত্রী এরা। এসব তুখোড় স্লোগান লিখে বিশ্রি বিশ্রি পোস্টারিং কেন করে? কী পায় এরা? সত্যি! ম্যাডাম রত্নমালা বসু ঘাম মুছলেন। সামনে বিরাট যুদ্ধ।
একে একে সবাই প্রশ্ন করলেন। প্রশ্নগুলি কেমন ফাঁকা বাসনের মত ঝনঝন করে পড়ল। ওদের মনে কোন দাগ কাটল বলে মনে হল না । কোথাও গিয়ে বাজল না তারস্বরে। নিজেদের কাছেও ঢপঢপে আওয়াজ বেতালা ঠেকল।
তোমাদের এই ধরণের প্রোটেস্টের উদ্দেশ্য কি?
ধাক্কা দেওয়া। ঝাঁকুনি দেওয়া।
শোন, এভাবে ওই সব আজেবাজে জিনিশের ওপর পোস্টার না লিখে কাগজে পোস্টার লিখলেই ভাল হত না কি? কথার সুতোটা তুলে নিলেন আরেকজন, চিন্তাহরণ চক্রবর্তী।
ওই সব, মানে, কোন সব? এত এঁচড়ে পাকা একটা মেয়ে, বলে বসল।
খুবই ভাল জান কোনসব। শোন, যে বস্তুটি গোপনীয়তার তাকে গোপন রাখাই ভাল। পেচ্ছাপ পায়খানা এগুলো যেমন। মানুষ তো সভ্যতার সরণি ধরে অনেকদূর এসেছে, না কি? সমাজ বলে ত কিছু আছে। সে ত কিছু জিনিসকে গোপন বলে মান্যতা দেয় , নাকি? আমি ত চাইলেই বানিয়ান আর লুঙ্গি পরে কলেজে আসতে পারিনা। পারি কি?
কিন্তু আমরা ত এই গোপনীয়তাটার বিরুদ্ধেই লড়ছি স্যার। কেন এত গোপনীয়তা মাসিক অর্থাৎ পিরিয়ডস নিয়ে? এটা অশুদ্ধ, এটা খারাপ। এটা অপবিত্র। স্যানিটারি ন্যাপকিন কথাটা উচ্চারণ করতেও লজ্জা। এগুলো তো মধ্যযুগীয় ব্যাপার। আজকের দিনে যখন অনেক ভাবে স্বাস্থ্য রক্ষার উপায় বেরিয়ে গেছে, তখন এসব ভাবনাগুলোই ত ভাঙতে হবে আগে।
মাথা নেড়ে, চোখ বুজে, হাত নেড়ে নিজের আপত্তি প্রকাশ করলেন তৃতীয় অধ্যাপিকা মণিকংকনা দাশ।
আরে বাবা , অনেক ত পথ ছিল। এত অশ্লীল মাধ্যম কেন বাছতে গেলে।
কোনটা অশ্লীল? কেন অশ্লীল? কীভাবে অশ্লীল?
প্রশ্ন আমরা করব , উত্তর দেবে তুমি। তুমি উল্টে প্রশ্ন করছ। লজ্জা করেনা?
কেন লজ্জা পাব? অশ্লীল ত কিছু না। স্যানিটারি প্যাড ত কাপড় কাগজ ধরণের জিনিস। হ্যাঁ গোপন জিনিস বটে। দোকানে কালো কাগজে মুড়ে বিক্রি হয়। সেটা আসলে একটা ভুল জিনিস। ভুল ধারণা। যত বেশি লুকিয়ে রাখা হবে তত মেয়েদের সেক্সুয়ালিটি মেয়েদের ওপর যৌন হিংসা মেয়েদের শরীর সবকিছু ট্যাবু থেকে যাবে। আর তত এই হিংসার ঘটনাগুলোর সুরাহাও হবে না।
এত বড় লেকচার ঝাড়লে, এই যে তুমি? তা, এটাই কি তোমাদের সবার কথা? তুমি অন্যদের মুখপাত্র? তাই গুছিয়ে বলে দিলে।
এই মেয়েটাই নাটের গুরু। কী ভাজা মাছটি উলটে খেতে না জানা চেহারা। প্রিন্টেড টপ পরা, মিষ্টি মুখ। উফ। ধানী লংকা একেবারে।
বোঝা গেল, ঝাঁকুনি দিতে চেয়েছ। পাবলিক আই-তে একটা নতুন কিছু। ট্যাবু ভেঙেছ। তা, এই ঝাঁকুনির ফল তো বিরূপও হতে পারে। সে কথা ভেবে দেখেছ কি?
হ্যাঁ সেটা তো একটা রিস্ক ফ্যাক্টর বটেই।
চুপ করে গেল ওরা। কিন্তু চোখ নামিয়ে নিল না। মাথা নিচু করল না। সটান তাকিয়ে রইল।
সবই বুঝলাম, কিন্ত এটা তো মানবে যে ঐভাবে মানুষের ব্যক্তিগত রুচিতে আঘাত দেওয়াটা একটু বাড়াবাড়ি? বলেই অধ্যাপক সুভদ্র সেন চুপ করে গেলেন। চোখ নামিয়ে নিলেন নিজেই । ওরা প্যাট প্যাট করে তাকিয়ে রইল।
সুতো টা তুলে নিলেন রত্নমালা বসু। জানো, সারা ভারতে কত কত মহিলার একটা স্যানিটারি প্যাড কেনার পর্যন্ত সামর্থ্য নেই। সেই জিনিশটাকে নষ্ট করেছ তোমরা। ওয়েস্টফুল এক্সপেন্ডিচার।
আমাদের লিফলেটে ত আমরাও সেটা লিখেছি ম্যাম। আসলে এই বিষয়ে চেতনা জাগ্রত করার একটা উদ্দেশ্যও তো আমাদের আছে। যদিও আমাদের শুধু মৌখিক ভাবে নয়, ভার্চুয়ালিও অ্যাটাক করা হচ্ছে। ট্রোল করা হচ্ছে। আমাদের ফেসবুক পেজে নানারকমের কমেন্ট করছে অনেকেই। আমাদের রেপ করে দেবে বলছে। কেউ কেউ তো ওপেনলি বলছে মেয়েরা অশিক্ষিত, মেয়েরা নির্বোধ। অকারণে মুখ খারাপ করছে… আমার মনে হয় ম্যাম, এই অ্যাটাকগুলোই প্রমাণ করে যে আমরা একটা ঠিক জায়গায় ঘা দিতে পেরেছি। বছরের পর বছর মেয়েরা নীরব থেকে গেছে। চেঁচিয়ে কথা বলবে না, ছুটবে না দৌড়বে না। আস্তে আস্তে হাঁটবে। হাসবে না। কাউকে নেগেট করবে না। জোরের সঙ্গে না বলবে না।
অন্য একটি মেয়ে মুখ খুললঃ জানেন ম্যাম, আমরা তো কোন ছাড়, একজন এস্টাবলিশড লেখক , যিনি বাই দ্য ওয়ে মহিলা, তাঁকে একটা লোক ফেসবুকে বলেছে, ‘হাই প্যান্টিদি’। তিনি জিগ্যেস করেছেন, ‘মানে ! কী নাম বললে !!’ সে তখন বলল, ‘কেন? তোমার লেখায় তো কেবল ব্রা, প্যান্টি এসবের কথা থাকে। প্যান্টি বলে তোমাকে ডাকতেই পারি’ !!!!!
মুখ খুলল অলক্তিকা। স্যার, আমাদের এখানে আসলে পুরুষদের সব রকমের অসভ্যতা করার লাইসেন্স আছে। তারা যে কোন খারাপ কথা মুখে আনতে পারে, যে কোন কথা অশ্লীলভাবে ইঙ্গিত করে বলতে পারে। আর মেয়েরা নিজেদের হকের কথাটা বলতেই লজ্জা পায়। এটাই মুশকিল।
ঠিকাছে ঠিকাছে। অস্বস্তি প্রকট হয় সুভদ্র সেনের মুখে। খুব আলতো করে, যেভাবে নোংরা কাগজ তুলে নিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া হয়, সেভাবে বলেন, ওকে ওকে, আমি আপাতত এই মিটিং শেষ করতে চাইছি। তোমারা ভবিষ্যতে এই ধরণের প্রোটেস্ট আর করবে না এইটুকু কথা দিতে হবে। অন্য প্রোটেস্ট কর, ইফ ইউ ওয়ান্ট টু মেক এ পয়েন্ট। কী, কথা দিচ্ছ তো, এই সব প্যাডফ্যাডের ওপর লিখবেনা?
মুখ টিপে হাসে অলক্তিকা। বলে, সেটা আমরা ভেবে দেখতেই পারি স্যার। এনিওয়ে, একই ধরণের প্রোটেস্ট বার বার করলে চমক থাকে না। ভবিষ্যতে অন্য কোন মেথড ভাবা যেতেই পারে। আমরা এখনো সেসব নিয়ে ভাবিনি। তবে স্যার, আমাদের মেন দাবিগুলো যেন নোট করে কমিটি। যেন একটু ভেবে দেখা হয়, সব ডিপার্টমেন্টে একটা করে লেডিস টয়লেট চাই, যেটা সন্ধে সাতটার সময় চাবি দিয়ে কেউ চলে যাবে না। আর একটা করে স্যানিটারি প্যাড ডিস্পেন্সার চাই।
হ্যাঁ, আমরা নোট করে নিলাম। আমরা লিখে দেব যে এইসব দাবি জানাতেই তোমরা ওই শকিং ক্যাম্পেনটা করেছিলে। বাকি সব আমি নোট করছি না। ধাক্কা ফাক্কা ওসব আবার কি। বাচ্চা বাচ্চা মেয়ে সব।
হুম।
অত্যন্ত জরুরী প্রসঙ্গ।