
‘স্তব্ধতার থেকে বড় সাঙ্ঘাতিক শব্দ নেই মানুষের কাছে’
গৌতম বসু
মোহিত চট্টোপাধ্যায় ১৯৩৪-২০১২
সম্পূর্ণ বিস্মৃত কোনও কবির গুণকীর্তন কীভাবে শুরু করতে হয়, আমার জানা নেই। মোহিত চট্টোপাধ্যায়-এর ক্ষেত্রে একটি অতিরিক্ত বাধা এই যে, আমরা সকলেই জানি, তাঁকে বাদ দিয়ে বাংলার নাট্যসাহিত্যের ইতিহাস নথিবদ্ধ করা অসম্ভব। তিনি যে আবার জীবনানন্দ-পরবর্তী যুগের একজন অন্যতম প্রধান কবিও, এই সরল সত্য, দীর্ঘকাল ব্যাপী অনুল্লেখের ব্যবধানে, হঠাৎ, তাঁর কবিতা-লেখা ছেড়ে দেওয়ার আটচল্লিশ বছর পর প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা, অনেকের কানে প্রলাপের মতো শোনাতে পারে। বস্তুত, মোহিত চট্টোপাধ্যায়-এর কবিতার স্বল্পসংখ্যক গুণগ্রাহীদের প্রতি নিক্ষিপ্ত অধিকসংখ্যক পাঠকের প্রশ্নটি ─ ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’─ যে ন্যায়সঙ্গত, তা মানতেই হয়। সত্যই, এ-প্রশ্নের কোনও সদুত্তর নেই।
আমরা, অর্থাৎ স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রথম প্রজন্মের কবিতাপাঠকদের মধ্যে কেউ-কেউ, নিজেরাই মোহিত চট্টোপাধ্যায়-এর কবিতা আবিষ্কার করেছিলাম। আজ বুঝতে পারি, ওই আবিষ্কারের আনন্দে কিঞ্চিৎ পরিমাণে গৌরববোধও মিশে রয়েছে, কারণ কাজটি আদৌ সহজ ছিল না, তখন থেকেই তাঁর লেখা হারিয়ে যেতে শুরু করেছে। ১৯৭২ সালের পরে তিনি কবিতার সঙ্গে সমস্ত সংস্রব ত্যাগ করেন। অচিরে, তাঁর তিনটি বই, ‘আষাঢ়ে শ্রাবণে’, ‘গোলাপের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ এবং ‘শবাধারে জ্যোৎস্না’য় প্রকাশিত ১২৭ টি কবিতা সর্বসমক্ষে শূন্যে মিলিয়ে যেতে দেখা যায়। সেই থেকে, এই পঙ্ক্তিগুলি, এবং এইরকম অগণিত পঙ্ক্তি, আমরা এক গুপ্ত সমিতির সদস্যদের মতো আগলে রেখেছি:
‘বয়স বেড়েছে বিজন আমার
বাড়েনি সময়ে, শয়নে।
ভ্রমণ আমারে ডাকেনি বাহিরে
জেগেছি কি যেন চয়নে।
হল না তেমন বুকে আহরণ
এল না বাগান নয়নে!
#
পাখি উড়ে যায়;
প্রতিযোগিতায়
জ্যোৎস্নাও যায় ফাগুনে।
দুয়ারে রঙন
কে করে হরণ
ঘুমাল কে একা আগুনে!’
এতগুলি বছর পেরিয়ে আসবার পর, সেই প্রিয় কবিতাগুলি বাতাসে আবার ভাসিয়ে দিতে পেরে অনির্বচনীয় এক আনন্দ অনুভব করছি; মনে হচ্ছে, একটা ভারি পাথর যেন ভিতর থেকে নেমে যাচ্ছে। পাঠকের যৌবনের তাপ শীতল হয়ে এসেছে, লেখক বহুদিন প্রয়াত, কিন্তু তাঁর কাব্য আজও অমলিন, এ কি সামান্য কথা? আজ অল্প-অল্প বুঝতে পারি, আস্বাদন করবার শক্তিপুঞ্জেও, সময়, নীরবে হস্তক্ষেপ ক’রে থাকেন; আগে, কথায়-কথায় উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়তে পারতাম, কোন্ ঐশ্বর্যে আমার প্রয়োজন, আর কোন্ ঐশ্বর্য আমার কোনও কাজে লাগবে না, তা নিয়ে ভাববার এবং দু’টিকে পৃথক ক’রে বিচার করবার কোনও অবসর ছিল না। আজ, সমস্তই অবসর। নিত্যপ্রয়োজনীয় বইয়ের সংখ্যা হ্রাস পেতে-পেতে তলানিতে এসে ঠেকেছে। আজ মনে হয়, একজন পাঠক কোন্-কোন্ বই পড়বেন, তা নির্ধারণ করার প্রথম পদক্ষেপ হল, এইটুকু বুঝে নেওয়া, তিনি কী পড়বেন না। রুচির সঙ্কোচন? অসহিষ্ণুতা? স্বখাত অন্ধত্ব? হয়তো তাই। এতদিন বাদে, ইয়েট্স-এর সেই কবিতাটির ─ ‘Remorse for Intemperate Speech’ ─ সামনে এসে দাঁড়াই আর ভাবি, কবির উক্তিটি মর্মোদ্ধার করবার জন্য কত শত ভুলভ্রান্তি, কত নকল বিগ্রহ আমায় পিছনে ফেলে আসতে হয়েছে।
‘Out of Ireland have we come .
Great hatred, little room,
Maimed us at the start .
I carry from my mother’s womb
A fanatic heart.’
যে দেশের মানচিত্র এখনও আঁকা হয় নি, সেই দেশের পর্বতমালা ও উপত্যকার আভাস যদি না-ই পেলাম, তবে কী লাভ কবিতা পড়ে? এই জায়গা থেকে মোহিত চট্টোপাধ্যায় আমার জীবনে এক অপরিহার্য লেখক। মাত্র ১২৭টি কবিতার ভিতর দিয়েই অদেখা দেশের পর্বতমালা ও উপত্যকার উত্থান আমি দেখতে পাই। ‘স্তব্ধতার থেকে বড় সাঙ্ঘাতিক শব্দ নেই মানুষের কাছে’, তাঁর সেই লাইন আমায় নতুন ক’রে ভাবতে শেখায়, এবং এই ভাবেই, অমীমাংসায় দিন কাটে, বেলা ফুরায়। তীব্র ভাবাবেগের কম্পনে একসময়ে অস্থির হয়ে উঠতাম, আজ সেখানে দাঁড়িয়েই সৌন্দর্যপিপাসার রিক্তরূপ দেখতে পাই। তাঁর বলার কথাটি এবং ভাষাটি আর কারুর সঙ্গে মেলে না ব’লেই এত বছর তাঁকে পাঠ ক’রেও সন্দেহ জাগে, তাঁকে বুঝে-ওঠা এখনও বুঝি সম্পূর্ণ হল না। কবিতা, কয়েকটি ধ্বনির সুবিন্যাস বই অধিক কিছু তো নয়, সেই ধ্বনি-পর্যায়ক্রমে, কে জানে কীভাবে, বিভিন্নস্তরের মর্মার্থ জড়িয়ে গেছে, অর্থের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে স্মৃতিবিশ্ব ও দৈনিক কৃচ্ছ্রসাধন, আকাঙ্ক্ষা ও নির্লিপ্তি, মানুষের জ্ঞান ও নির্বুদ্ধিতা, তার প্রেম ও অপ্রেম, তার সমূহ পরাজয়; কবিতার অত্যাশ্চর্য গবাক্ষ দিয়ে মানুষ যতবার নিজেকে উপলব্ধি করার প্রয়াস পেয়েছে ,ততবার তার খণ্ডিত দৃষ্টির সম্মুখে পঞ্চভূতের আবির্ভাব ঘটেছে। মোহিত চট্টোপাধ্যায়-এর কবিজীবন স্বল্পদৈর্ঘ্যর, তিনি যখন কবিতা ছেড়ে আসেন, তখন তাঁর বয়স চল্লিশও বছরও স্পর্শ করে নি, অথচ, কি আশ্চর্য, কবিতার গূঢ় বার্তার সবটাই সূত্রাকারে সেখানে বাঁধা পড়েছে। এমন সিদ্ধি আমরা অন্যত্র দেখতে পেয়েছি বটে, কিন্তু কতবার?
‘ অগ্ন্যুৎপাত
#
শরীরে মায়ের দেওয়া রক্তে মাত্র দুই ফোঁটা অন্ধকার লেগে
এরকম অগ্ন্যুৎপাত ঘ’টে যাবে কখনো ভাবিনি।
হৃদয়ে উৎপন্ন কিছু উদ্ভ্রান্ত আঙুর
উড়ে যায় যেন লক্ষ শোকগ্রস্ত বেলুন ─
মুঠোর ভিতর ঘর্মপাতে উড়ে যায় শ্বাসরুদ্ধ পালিত কোকিল।
লোভ ছিল, সূর্যোদয়ে ভেসে যাব চাঁদের জোয়ারে
লোভ ছিল, চিঠি পাব গাছেদের হৃদযন্ত্রে শ্বাসকষ্ট হলে
লোভ ছিল, মোম জ্বলবে পৃথিবীর আলো কম হলে।
বজ্রপাত নেমে আসে বুক থেকে খ’সে পড়া শাদা প্যারাশুটে
ধ্বংস ক’রে অহংকারী সবুজ আমার;
সার্কাসে তাঁবুর নীচে কে যেন হঠাৎ ছুঁড়ে দিয়ে গেল
ট্রাপিজে ভয়াল দুলছি, নেট নেই মারাত্মক নীচে
নেট নেই প্রেমের তলায়
বাতাস কামড়ে ধ’রে দুলে যাচ্ছি কজন বাতাস!
অসম্ভব দৌড়ে যাচ্ছে বাগানের দিকে দ্রুত সশব্দে ফুলেরা
ভোরের আগেই ঠিক ফুটতে হবে,
বৃষ্টিতেও অন্ধকার রণপায়ে ভিজে ভিজে পালাচ্ছে প্রবল
ভোরবেলা শাদা জামা গায়ে প’রে রৌদ্র হতে হবে ─
আমরা ভুলেছি দৌড়, হেঁটে যাই শতাব্দীর মতন মন্থর,
রঙিন সাইকেল ভেঙে কে যেন চিৎকার করে চাঁদের ভিতর।
সকলের আঁকা মুগ্ধ প্রেমিকার ছবির মতন
হলুদ চুলের মেয়ে ভেঙে যায় অতসীর বনে!
শরীরে মায়ের দেওয়া রক্তে মাত্র দুই ফোঁটা অন্ধকার লেগে
এরকম অগ্ন্যুৎপাত ঘ’টে যাবে কখনো ভাবিনি।’
___
গৌতম বসু
মোহিত চট্টোপাধ্যায়-এর কবিতার বই /সঙ্কলনগ্রন্থ :
‘আষাঢ়ে শ্রাবণে’/ ভাদ্র ১৩৬৩ (অগাস্ট-সেপ্টেম্বর ১৯৫৬)/ ব্যুক রিভ্যু, কলকাতা।
‘গোলাপের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ /আষাঢ় ১৩৬৮ (জুন-জুলাই ১৯৬১)/ কৃত্তিবাস প্রকাশনী, কলকাতা।
‘শবাধারে জ্যোৎস্না’/ আষাঢ় ১৩৭২ (জুন-জুলাই ১৯৬৫)/ বীক্ষণ প্রকাশ ভবন, কলকাতা।
‘অঙ্কন শিক্ষা’/প্রকাশকাল অনুল্লিখিত/অনুভব প্রকাশনী, কলকাতা।
‘কবিতা সংগ্রহ’/ভাদ্র ১৪০০(সেপ্টেম্বর ১৯৯৩)/এস-পি পাবলিশিং, বারুইপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগণা।
চিত্র- পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায়
আবহমান পত্রিকা ও গৌতম বসুকে ধন্যবাদ বাংলা কবিতা দুনিয়ার র্যাকেটিয়ারিংয়ের নানান ভীষণ পাঁচিলের আড়ালে হয়তো কিছুকাল ঢাকা পড়ে যাওয়া এক নিখাদ কবির বিপজ্জনক দুনিয়ায় আমাদের ফের নিয়ে যাওয়ার জন্য, যেখানে দারুণ অগ্ন্যুৎপাত, আর যেখানে ‘নেট’-এর আশ্রয় আগে সুনিশ্চিত করে নিয়ে তারপর প্রেমের গ্যালারি-প্লে-র কোনও অবকাশ নেই। মোহিত চট্টোপাধ্যায় ব্যক্তিগতভাবে আমার প্রিয়তম কবিদের একজন। তাই এই আলোচনা দীর্ঘতর হলে — কালের, ইতিহাসের প্রেক্ষিতে কবিতাগুলি আরও একটু সুনির্দিষ্ট ভাবে চিহ্নিত হলে আমি আরও উপকৃত হতাম। Out of Ireland we have come… কোথা থেকে আসছেন মোহিত? তাঁর তীব্র উচ্চারণ? চর্চিত হওয়া দরকার। তবে সবার আগে তো তাঁকে পড়া দরকার, সেটা আমাদের মনে করিয়ে দেওয়ার জন্যই গৌতম বাবু ধন্যবাদার্হ। কেবল একটাই খটকা লাগল, সমর সেনের কবিতা নিয়ে শঙ্খ ঘোষের সাক্ষাৎকারের সময়েও সে খটকাটার কথা তুলেছিলাম একদা — ‘কবিতার সঙ্গে সমস্ত সংস্রব ত্যাগ করেন’। দুবার বলেছেন মোহিতের এই ‘কবিতা ছেড়ে’ আসার কথা। কবিতাকে কি সত্যিই কেউ ছেড়ে যেতে পারে? আমার কেমন মনে পড়ছে বছর সাতচল্লিশে আত্মহত্যা করা, পাকিস্তানের কবি সরওয়ত হুসেন-এর ক’টা পঙ্ক্তি: ‘‘কবিতা যে কোনও জায়গা থেকেই ছেড়ে যেতে পারে তোমাকে
/ মেঘের মতো /
বাতাসের মতো/
পথের মতো/
বাপের হাতের মতো।’’
শ্রী নীলাঞ্জন হাজরা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন, যা আমি আমার ছোট্ট আলোচনার বাইরে রেখেছিলাম,মূলত এই কারণে যে, এটি এক দুর্ভেদ্য প্রশ্ন । লেখা কি লেখককে পরিত্যাগ করে, না লেখক, লেখাকে ? এবং, এর কারণটাই বা কী ? আমার মনে হয়, এ-বিষয়ে লেখক হয়তো আলো ফেলতে পারেন । সমর সেন অথবা মোহিত চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে আমার কোনও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই, কিন্তু আরেকজন কবিতা-ছেড়ে-আসা কবিকে, যুগান্তর চক্রবর্তীকে, এই প্রশ্নটি করবার সুযোগ আমার হয়েছিল।তীব্র খেদের সঙ্গে একবার তাঁকে ব’লে বসেছিলাম,আপনার মাত্র দুটি কাজ, একটা কবিতার বই ,’স্মৃতি বিস্মৃতির চেয়ে কিছু বেশী’ এবং অন্যটি, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডায়েরীর সম্পাদনা, দুটিই কালজয়ী। কেন আপনি ওই ভাবে মাঝপথে থেমে গেলেন ? উনি অকপটে
জানিয়েছিলেন, উনি ভিতর থেকেই টের পাচ্ছিলেন যে লেখার স্পৃহা কমে আসছে। নিজেকে অনুকরণ ক’রে সারাজীবন লিখে যাওয়ার কোনও অর্থ তিনি খুঁজে পান নি। তাঁর সেই সততা আমাকে গভীর ভাবে স্পর্শ করেছিল । সরওয়ত হুসেন-এর লেখার সঙ্গে আমার পূর্বপরিচয় না থাকলেও বুঝতে পারছি এটি তাঁর উপলব্ধির কণ্ঠস্বর । বিনীত গৌতম বসু । পুঃ তরুণ পাঠকদের সামনে মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা পড়বার কোনও সুযোগ আজ নেই। সেই অচলাবস্থায় একটা ধাক্কা দিতে চেয়েছিলাম। এটূকূও ‘আবহমান’-এর জন্যই সম্ভব হল ।
এটুকুও । টাইপিঙের ভুল হয়ে গেছে।
এটুকুও । টাইপিঙের ভুল হয়ে গেছে।
আমার আগের লেখাটা উড়ে গেল !
গৌতমদার লেখাটি পড়লাম । পরের ব্যাখ্যাটিও । অসাধারণ।
অনেক ধন্যবাদ।