
সেলিমের কবিতাই ত্যক্ত জীবনের স্মারক
আমরা যে নতুন কথা বলতে চাই, সে কথাও আমাদের আবহমানের এক প্রবহমানতার মধ্যেই নিহিত আছে বলেই আমাদের ভিতর দিয়ে তা প্রকাশিত হয়। কথা হল, আমি তাকে ধরতে চাইছি কিনা। সেলিম মল্লিক তাকে ধরতে চান। ধরতে পারেন। চেতনা ও চৈতন্যের মধ্যে যে একটা সরু দূরত্ব রয়েছে, তার মধ্যেই অনেকের জীবনতরঙ্গ গোলোকধাঁধাঁর মধ্যে হারিয়ে যায়। বা, সে নিজেই তৈরি করে একটি গোলোকধাঁধাঁ। কিন্তু সেলিম সেই গোলোকধাঁধাঁ পেরিয়ে গেছেন।
গ্রন্থ- মানুষ আমার কেউ নয়/ সেলিম মল্লিক/ অহিরা/ ১২০ টাক
‘ত্যক্ত জীবনের আরক’ বলে একটি কবিতা আছে সেলিম মল্লিকের ‘মানুষ আমার কেউ নয়’ কাব্যগ্রন্থে। মনে হয় এই কবিতাটি তাঁর কাব্যব্যক্তিত্বের এক বিশেষ ধারাকেই চিহ্নিত করে। সেলিম মল্লিক এমন একজন কবি, যাঁর কবিতার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল, তা নিজস্ব ব্যক্তিত্বের ও নিজস্ব ভাষার আবহেই লেখা। দীর্ঘ কুড়ি পঁচিশ বছর ধরে কবিতা লেখার ফলে একধরনের ভাষাগত ও ভাবনাগত চেনা চেনা মুখের আদল তৈরি হয় প্রতিটি কবিরই কবিতায়। কিন্তু খুব কম কবিই পারেন, সেই চেনা মুখের আদল থেকে বেরিয়ে এসে অচেনা এমন সব জগতের নির্মাণ করতে, যা আমাদের পড়ার পর মনে হয়, আমার তো এই জীবনটাকেও দেখার কথা ছিল। দেখার কথা ছিল, অথচ দেখিনি, এমন খণ্ড খণ্ড চিত্রভাস্কর্য ও অন্তর্নিহিত দর্শনের ঝলকেই লেখা সেলিম মল্লিকের ‘ মানুষ আমার কেউ নয়’ কাব্যগ্রন্থটি। তিনি উল্লেখিত কবিতায় লেখেন ‘একটা লাল ফলের ভেতরে/আমাদের সাক্ষ্যাৎ হয়েছে– শাঁস খেতে খেতে / দুজনে এগিয়ে গেছি দুজনের দিকে,আর বেরিয়ে এসেছি/ ফলের বোঁটায় ফুটো করে।”
এই বার এই জগতের কথা আমরা তো শুনিনি আগে। এই জগতের মধ্যে একবার ঢুকে পড়লে পাঠকের পক্ষে বেরোনো অসম্ভব। এই গ্রন্থের আরও একটি বৈশিষ্ট্য হল, আপনি বইটি পুরো পড়ে ফেলতে পারবেন না। অসমাপ্ত থাকবে দীর্ঘদিন। এমনকি এক একটি কবিতাও অসমাপ্ত পড়ে থাকতে পারে। কারণ পড়তে পড়তে এমন অস্বস্তিকর প্রশ্নের মুখোমুখি এই গ্রন্থ দাঁড় করায়, যা আপনাকে ভাবাবে, আপনার জীবনকে মনে হবে ক্ষুদ্র। আপনি আমি প্রত্যেকেই খুবই ক্ষুদ্র, এ বিষয়ে কোনওরকম সন্দেহ নেই। কিন্তু তা প্রকৃত অর্থে অনুভব করার মধ্যে যে প্রশান্তি আছে, তার কাছে যাওয়ার আগে আপনাকে অতিক্রম করতে হবে অনেককিছুই। সেলিম মল্লিকের কবিতার মধ্যে কার প্রভাব ইত্যাদি নিয়ে কোনও তর্কে গেলাম না, কারণ সেলিম মল্লিক কেন প্রত্যেক কবিতাই আসলে আবহমানকে ধারণ করে থাকেন তাঁর সত্তার ভিতর। আমরা যে নতুন কথা বলতে চাই, সে কথাও আমাদের আবহমানের এক প্রবহমানতার মধ্যেই নিহিত আছে বলেই আমাদের ভিতর দিয়ে তা প্রকাশিত হয়। কথা হল, আমি তাকে ধরতে চাইছি কিনা। সেলিম মল্লিক তাকে ধরতে চান। ধরতে পারেন। চেতনা ও চৈতন্যের মধ্যে যে একটা সরু দূরত্ব রয়েছে, তার মধ্যেই অনেকের জীবনতরঙ্গ গোলোকধাঁধাঁর মধ্যে হারিয়ে যায়। বা, সে নিজেই তৈরি করে একটি গোলোকধাঁধাঁ। কিন্তু সেলিম সেই গোলোকধাঁধাঁ পেরিয়ে গেছেন।
তথাকথিত, যা দেখছি, তাকেই ছন্দে অন্ত্যমিলে বর্ণনা করে লিখছি, — এই বিষয়টিই একপ্রকার তৃতীয় বা চতুর্থশ্রেণির পদ্য। এরা ঘুরে মরে বাইরের স্তরে। অনেকটা বিয়ে বাড়ির বাইরের দিকটা আলোয় সাজানোর মতো তাদের কবিতা। নিমন্ত্রণ মিটে গেলেই সব অন্ধকার। তখন পরদিন সকালে বেরিয়ে পড়ে সেই বাড়ির হতশ্রী রূপ। তার আসলে কিছু বলারই ছিল না। কিন্তু এটা না বোঝে বিবৃতি দেওয়া কবিতার অতি দুঃস্থ কবিরা, বা বর্ণনা করার অতি নিম্নমানের পদ্যকারেরা। তারা বাজনা বাজায়। বাজনা শেষ হলেই তার আর অনুরণন থাকে না। কারণ তাঁর বা তাঁদের বলার কিছুই নেই। ভাবার কিছুই নেই। নিজেকে বিদ্ধ করার কিছুই নেই। তাঁরা কখনও স্পোকস পারসন, আবার কখনও এন্টারটেইনার। অবশ্যই এইসব কবিতার প্রয়োজন আছে। কিন্তু এই সব কবিতাকে কবিতা না বলে অন্য কিছু বললে কেমন হয়, এই প্রশ্ন মনের মধ্যে ঘোরে। এগুলিকে আমরা বলতে পারি ব্র্যান্ড মেকিং পোয়েমস। কোলরিজের প্রাইমারি ইমাজিনেশনের মধ্যেই এরা ঘোরাফেরা করেন। সেকেন্ডারি ইমাজিনেশনের ছায়াও জীবনে ঢোকে না। আলো তো দূরস্থান।
কিন্তু সেলিম মল্লিকের মতো অল্প কয়েকজন কবিই আছেন বাংলা ভাষায়, যাঁরা এই সেকেন্ডারি ইমাজিনেশনের আনন্দটাকে খুঁজে পেয়েছেন। গ্রেটার হিমালয়ে যাঁরা হেঁটেছেন একবার, তাঁরা কি আর নৈনিতালে গিয়ে স্ফূর্তি করতে পারেন? দার্জিলিঙে গিয়ে বলবেন তাঁরা হিমালয় ঘুরে এলাম? তাঁদের যেতে হবে দেবপ্রয়াগ ছাড়িয়ে। যেতে হবে সান্দকফু। যেতে হবে কেদার। একজন কবি যদি একবার স্পর্শ পান সেই গভীর ইঙ্গিতের, তিনি আর সেই জগতের থেকে বেরোতে পারবেন না। সেলিম মল্লিক এমনই কবি। ‘মানুষের মধ্যে বাঁচতে চাই না” কবিতায় সেলিম লিখছেন, ” ঘুমন্ত গাছের মধ্যে গিয়ে/ আমরা শুয়ে থাকি– শুয়ে থাকি/ আমাদের নিজস্ব সবুজ বিছানায়,/ আমাদের আয়ু ক্ষীণ– তা জেনেও/ সময় বিনষ্ট করি তারা গুনে গুনে’/ফাল্গুনের হাওয়া ধরতে চেয়ে।/ আর আমরা মানুষের মতো বাঁচতে চাই না এখন।”
সেলিমকে ধন্যবাদ জানাই। একজন কবিতাপ্রয়াসী এবং একজন পাঠক হিসেবে এই স্তর বা উচ্চতা বাংলা কবিতার খুবই প্রয়োজনীয়। আর এই কাজ তিনি ধারাবাহিক ভাবেই করে যাচ্ছেন। বাংলা কবিতা ঋণী থাকবে তাঁর কাছে।
হিন্দোল ভট্টাচার্য