
সিপিয়া রঙের গলি – দশম পর্ব
অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায়
“সামবডি’জ মি”
নরম, রোমশ, ছোট্ট কালো গলাটা হাঁড়িকাঠে ঢুকে যাওয়ার পর আর দেখা গেল না। সাদা ধুতি-গেঞ্জি পরে কোমরে নতুন গামছা বাঁধা বেঁটেখাটো মানুষের ভিড়ে হারিয়ে গেল দু’ভাগ হওয়া শরীর। ‘জয় মা, জয় মা’ রবে মধ্যরাতের শহর মুখরিত হল। দু’টি শক্ত সমর্থ হাত সমস্ত ভিড়ের মাথা ছাড়িয়ে আমাকে তুলে ধরে বলি-দৃশ্য দেখিয়ে আনল। স্তূপীকৃত মাথার ভিড়ে আরেকটি ছোটো কালো মাথা যোগ হল। সেদিন আমার শহর সারারাত জেগেছিল।
আমি জানতাম রাস্তা পাল্টে যায়। বোশেখ মাসের কিছু সন্ধ্যায় চিরচেনা রাস্তাটা পাল্টে যায়, সারা শহর জাগে, ঘরে কুটুম্ব আসে, ও বলি দেখা যায়। ভাগীরথী-হুগলী নদীর পশ্চিমে প্রাচীন জনপদ কোন্নগর, ভালবেসে বলি আমার গঙ্গাপাড়ের শহর, সেই শহর তার সমস্ত নির্জনতা ঝেড়ে ফেলে মধ্যরাতে জেগে ওঠে। সেইসময় মা আসেন।
প্রথম রাস্তা চিনতে শিখে মেলা থেকে কেনা খেলনাগাড়ি আমার হাতের সুতোর টানে অনেকটা পথ অতিক্রম করলে দেখা যেত সাদা হুগলী নদী। গঙ্গাপাড়ের থেকে রাস্তা চলে গেছে শকুন্তলা কালী মন্দিরের দিকে। কুমোরের ছোট ছোট ঘর, মাটি, জল, ত্রিপল ঘেরা রহস্যময় জায়গাটায় সূর্যাস্তের শেষে শকুন্তলা রক্ষাকালী মায়ের মূর্তি তৈরি হয়। কথিত আছে, বৈশাখের কৃষ্ণা তৃতীয়ার পরের শনিবার শকুন্তলা রক্ষাকালী মায়ের পূজা করত ডাকাতের দল। ছাগবলি, নরবলি হত। জঙ্গলে ঢাকা গ্রামে প্রায়শই ঠগিদের উপদ্রব লেগে থাকত। সেই সময় থেকে আজও মা শকুন্তলা সূর্যের মুখ দেখেন না। সূর্যাস্তের পরে কাঁধে চড়ে মা আসেন। চৌকো মফস্বল শহরটা ভেঙে পড়ে গঙ্গা ও মন্দিরের মাঝের রাস্তায়। সারারাত পূজা ও বলি শেষে সূর্যোদয়ের আগেই মায়ের বিসর্জন হয়। আপাত নিরিবিলি শান্ত শহরটা মেলার কারণ পায়।
একটিমাত্র বলি-দৃশ্য শহরটাকে অন্যভাবে চিনতে শিখিয়েছিল। জাহাজবাড়ির মোড়ে দাঁড়িয়ে বুঝেছিলাম, এই শহর একটা পর্দা মাত্র। কিংবা রঙিন কোনও গালিচা। গালিচা সরালেই অন্য পৃথিবী চলছে।
আমার সীমানা ছিল ছোটো। নদীর ধারে বারোটি শিবমন্দির, দিনেমারদের জাহাজঘাটার ধ্বংসস্তূপ আর কিছু প্রাচীন বাড়ির নোনা ধরা দেয়াল যার ইতিহাস জানতাম না। শোনা যায় ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে রচিত বিপ্রদাস পিপলাইয়ের ‘মনসামঙ্গল’ কাব্যে কোন্নগর গ্রামের উল্লেখ পাওয়া যায়। মুকুন্দরামের ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যে ধনপতি সদাগর নদীতীরে এই ভৌগলিক অবস্থান পেরিয়ে যাওয়ার সময় ‘কুচিনান’ নামের একটি জনপদ দেখতে পান। অনেকের মতে এই কুচিনান হলেন পর্তুগীজ গভর্নর নান দ্য কুনাহ যিনি ১৫৬০ থেকে ১৫৭০ খ্রিস্টাব্দে কাছাকাছি অঞ্চলে বাস করতেন। ভিন্ন মতে জানা যায় কুমার রাজার গড় থেকে অপভ্রংশে ‘কোনার গড়’ এবং তা থেকে ‘কোন্নগর’ নামের উৎপত্তি।
এই যে আমার জন্মশহর আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিবে কিছু এলোমেলো ধুলোর মতো আখ্যান, তা আমি জানতাম। শৈশব এক আশ্চর্য সময়, যেখানে জাহাজঘাটার ধ্বংসের সামনে মুখে মুখে গল্প বানিয়ে বিকেল কাটাতাম।
গল্পের ভাবনা আমাকে নিয়ে যেত একটি অসামান্য সামাজিক মিশ্রণে। সমস্ত বিদেশী শক্তির উপনিবেশ গঠনের ফলে ইতিহাসে হুগলী জেলার আলাদা একটি স্থান রয়েছে। ‘হুগলী জেলার ইতিহাস’ থেকে কোন্নগরের প্রাচীনত্ব বিষয়ে জানা যায়। ফ্রেডরিক নগর (অধুনা শ্রীরামপুর) যাওয়ার আগে সামুদ্রিক জাহাজ সারাইয়ের জন্য কোন্নগর বিশেষ প্রসিদ্ধ ছিল। উনবিংশ শতকেও এই জাহাজঘাটা অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্রস্থল ছিল। কথিত আছে, হাতির কুল ঘাটের কাছে একটি বিরাট পুকুর খনন করে খাল কেটে গঙ্গা থেকে জাহাজ নিয়ে আসা হত ও সারাই হত। পরবর্তীকালে ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে এই বিরাট পুকুর বুজিয়ে দেশের প্রথম জুতোর কোম্পানি বাটা নির্মাণ করেন থমাস বাটা।
তদানীন্তনকালীন রক্ষণশীল ব্রাহ্মণদের বিরোধিতায় এই কোম্পানি পরে বাটানগরে সরে গেলেও প্রথম ইতিহাস আজও রাখা আছে নদীর ধারের এই ছোট্ট জনপদে।
দুপুরের রোদ গায়ে লাগত না। দরজা বন্ধ রেখে প্রায়ই পালিয়ে আসতাম নদীর ধারের পুরনো পাড়াগুলিতে। আজ যেখানে ধ্বংসের শেষ চিহ্ন, সেই ইমারতও গড়ে উঠেছিল কোনও রাজত্বের ধ্বংসের ওপরেই। কুমার রাজাদের ইমারতের স্তূপে এই জাহাজঘাটা তৈরি হয়েছিল। তারপরে সেখানে অয়েল মিল, ও কারখানা তৈরি হয়। আমার বেড়ে ওঠার শূন্য দশকে শহরটা দ্রুত পাল্টে যাচ্ছিল। বদল সময়ের ধর্ম, এই সহজ কথা না বোঝার অবুঝ বয়সে অভিমান বাড়ত। পথেঘাটে মাঠে ঘুরে রুলটানা খাতায় লিখে রাখার মতো গল্প খুঁজতাম। শহরটা আশেপাশেই শ্বাস নিত।
তখন আমার শহরে চাইলেই যা খুশি হাজির করতে পারতাম। ঘোষালদের জমিদারবাড়ির কাছে যে ইস্ত্রিওয়ালার গুমটিতে সন্ধেবেলা আলো জ্বলে উঠত, তার পিছনেই ইতালির রাজপ্রাসাদ এনে রাখার মজা দেখতাম ভরদুপুরে। শীত শেষ হয়ে আসত শহরে। সময়টাকে মনে হত রাজেশ্বরিতলার কাছে গরাদ দেওয়া পাবলিক লাইব্রেরী যেন। ভিতরে ঝুরঝুরে সিমেন্ট-বালির গন্ধ, পুরনো চারটে বেঞ্চ, ছ’টা আলমারি, লম্বা একটা টেবিল। বই নিয়ে ফেরত না দেওয়া কিশোরের মতো শীত ছেড়ে যাচ্ছে। সময়টার রং রেখেছিলাম যেন বহু পুরনো চুনকাম করা দেয়ালে নিভু নিভু টিউবের আলো।
এই পরীক্ষার গন্ধ-হাওয়ায় মনে পড়ে ছেলেবেলায় এই পথেঘাটে যাবতীয় বাঁদরামি করে বেড়ানোর সময় একটি নাম খুব শুনতাম। শিবচন্দ্র। নদীর ধারের সমস্ত পাড়ার প্রায় সব শিশুই ‘শিবচন্দ্রে’ পড়ত। ব্যতিক্রম ছিলাম বোধহয় একা আমিই। মোড়ের মাথায় ছোট্ট একতলা ইস্কুলে যেতাম, বাকি সময়টা শহরের গালিচা তুলে ফ্যালার ফন্দি আঁটতাম। শিক্ষাবিদ শিবচন্দ্র দেব ছিলেন ডিরোজিওর ‘নব্যবঙ্গ’ দলের সদস্য ও কোন্নগর শহরের অন্যতম এক রূপকার। তাঁর হাত ধরেই প্রথম ইংরেজি শিক্ষার বিদ্যালয় গড়ে ওঠে এই শহরে। তাঁর উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতার জোরেই রেলস্টেশন তৈরি হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পদধূলিধন্য কোন্নগর ব্রাহ্মসমাজ গঠিত হয় শিবচন্দ্র দেবের উদ্যোগেই। অরবিন্দ ঘোষের পৈতৃক ভিটে, প্রেমেন্দ্র মিত্রের পৈতৃক ভিটে, অবনীন্দ্র নাথ ঠাকুরের বাগানবাড়ি, ভাষা শহীদ সফিউর রহমানের ভিটে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে নিরিবিলি ছোট্ট শহর।
তখন সদ্য কৈশোরে পা দিয়েছি, অন্যরকম শহর দেখাতে বাবা আমাকে নিয়ে হাঁটতে শুরু করত। রেললাইনের ধার বরাবর হেঁটে যেতাম ধর্মডাঙার পথ ধরে চটকলের দিকে। সেখানে আস্ত একটি ভারতবর্ষ আজও একসাথে বসবাস করে। খুপরি ঘর, একতলা টানা বারান্দার চুন-সুরকির ঘর, মাজার-মন্দির, ছটপুজো, বড়দিন, বশীকরণ, পীরবাবা, অন্ধকার তেলেভাজার দোকান, আর আমার চোখের সীমানার বাইরে দাঁড়ানো কতরকম পরব নিয়ে, ভারতবর্ষের অভাব নিয়ে চটকল দাঁড়িয়ে রয়েছে। এমন কোনও জাতি বা ধর্মের মানুষ নেই যাকে চটকলে পাওয়া যাবে না। প্রথম সুউচ্চ হাউসিং কমপ্লেক্সের পিছে মুখ লুকিয়ে, রেললাইন থেকে উঠে আসা রহস্যময়তা নিয়ে চটকল আজও জেগে আছে। সেই রাস্তাটাও এগিয়ে যায় গঙ্গাতীরের দিকে। যেতে যেতে ধীরে ধীরে রূপ পাল্টে ফ্যালে। নির্জনতার স্বভাবে ফিরে আসে। আর কিছুদিন পরেই গোটা বিশ্ব খুলে যাবে চোখের কাছে। তার আগে একমাত্র কন্যাকে নিয়ে বাবা হাঁটত শহরের সব রং চিনিয়ে দেবে বলে। শহরের কুখ্যাত মস্তানদের শিউরে ওঠা গল্প বলতে বলতে বাবা হাঁটত। আমরা পৌঁছে যেতাম দামোদর রাজমিস্ত্রির সবুজ খুপরিতে, খাটিয়ায় বসতাম জনতা স্টোভে বানানো কেরোসিন গন্ধওয়ালা দুধ-চা খাব বলে। চটকল ছাড়িয়ে হেঁটে হেঁটে চলে যেতাম বাগখালের (প্রাচীন বাঘের খাল, এখন অপভ্রংশে বাগখাল) দিকে। সেখানে ব্যাটারি সারানো গ্যারেজকর্মী একঠোঙা কাঠিভাজা কিনে অপেক্ষা করতেন আমাদের জন্য। একই পথে বাগানবাড়ি, ব্রাহ্মসমাজ, গ্রন্থাগার। অথচ কত দূরে! আমি শিখেছিলাম, সব রং না জানলে রং আলাদা করা যায় না, দূরত্ব না বুঝলে দূরত্ব মেটানো যায় না।
ভরা কৈশোরে শহরটার যেকোনো কোণে গল্প খুঁড়ে আনতে যেতাম আমি। সেইসব এলোমেলো কাঁচা গল্পের ভাবনা একদিন আমাকে আলোর নীচে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। সেই সন্ধেয় বৃষ্টি নেমেছিল। বৃষ্টির চোটে বৈশাখের শকুন্তলা কালীবাড়ির মেলা ধাক্কা খেয়েছিল। ত্রিপল চাপা মাঠঘাট, দোলনা, খেলনার মাঝে এক কোণে দাঁড়িয়ে ফের শহরে একটা মরুভূমি রাখার বুদ্ধি খেলছিল মাথায়। বৃষ্টি অল্প ছিয়ান দিলে পর মিলন সমিতি ক্লাবের পাশের খাবারের দোকান থেকে রেডিও চ্যানেলের আওয়াজ ভেসে এল। একটি গান। আমার জন্মশহরের বৃষ্টি আমাকে একটি গান চেনাল। ছেলেটি কী অদ্ভুত কান্নার জলে ছোপানো মায়াময় গলায় গাইছিল “somebody can’t breathe, without you it’s lonely, somebody hopes that one day you will see… that somebody’s me…”
আমার শহর আমাকে চেনাল, প্রেম আসছে। মরুভূমির পূর্ব প্রস্তুতি মাত্র।