সাবিনা ইয়াসমিন -এর কবিতাগুচ্ছ
আহরণ s
আগুন হতে হতে আমি কীভাবে বরফ হয়ে গেলাম,
সে কাহিনী তোমাকে শোনানো হয়নি।
বরফ হতে হতে কীভাবে মরুভূমিতে পরিণত হলাম,
সে ও এক গল্প কথা।
মরুভূমিতে আমার তেমন কোনো কাজ ছিলনা।
তাই আমার কোনো ক্লান্তি ঘুম খিদে তৃষ্ণা কিছুই ছিল না।
সবাই যেদিন পণ করল, আমায় ছুটি দেবে,
সেদিন আমি একটি স্বপ্নের জন্ম দিচ্ছিলাম।
স্বপ্নটির হাতে কতগুলো চারা গাছ ছিল,
দৌড়চ্ছে স্বপ্ন, হাতে চারাগাছ নিয়ে দৌড়চ্ছে,
যেখানে থামল দেখল, গাছগুলো তখন একেকটা মহীরুহ।
মহীরুহের নীচে স্বপ্ন বসে ভাবছে একটু জিরিয়ে নিই –
কিন্তু পরক্ষণেই উঠে দাঁড়িয়ে ভাবল, বিশুদ্ধ অক্সিজেন পেতে হলে
আরও অজস্র গাছ নিয়ে এরকম দিগন্ত বিস্তৃত দৌঁড়তে হবে।
ছিটকে বহুবার মুখ থুবড়ে পড়তে পড়তে উঠে আবার দৌড়তে হবে।
দৌড়তেই হবে।
বিশুদ্ধতার জন্ম দিয়ে তবেই বোধহয় থামতে হবে ।
জঠর
আকাশের জঠর থেকে এইমাত্র যে সূর্যের জন্ম হল
তাকে নিয়ে এখন আমার দরকষাকষি চলছে।
সূর্য নিলামে উঠছে। নিলামে উঠেছ পাতাল নামক মাতৃগর্ভটিও।
চড়াদামে এই দুটোই কিনে নিতে পারবেন যিনি, সেই সাথে পাবেন,
মাটি বাতাস এবং জল সম্পূর্ণ বিনামূল্যে।
বিনামূল্যে কথাটি কেউ শোনে নি ? শুনেছে নিশ্চয় !
না শুনে থাকবে কী করে? বোবা কালা সেজে আর কতদিন ?
‘যেমন খুশি তেমন সাজো’র এই মেহফিল এ সবাইকে শুনিয়ে দেওয়া হবে ঠিকই
নানা ভাবে। নানা সুকৌশলে।
আমি এই বোবা ও কালাদের ওপরেও ধরেছি বাজি আমার।
মনে ও মগজে পঙ্গু যারা তারা পাবেন বিশেষ সুবিধা সহ বিশেষ বিশেষ ছাড় !
‘ছাড়পত্র’ কবিতাটি মনে আছে কারো? বিশেষ করে ওই কটা লাইন ?
“যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি—“
এই কটা লাইন ঘুমোতে দেয় না। সারা রাত জাগিয়ে রাখে।
দিকভ্রষ্ট করিয়ে ছাড়ে! আছড়ে পিছড়ে মারে আমাকে দিনের শেষে !
তাই ঠিক করেছি সমস্ত কবিদের জঠর এবং জঠরজ্বালা সব কিনে নেব আমি।
কবিদের চেয়ে সস্তা আর কী হতে পারে! এই বাজারে।
একেকটা সূর্য কবিদের হৃৎপিণ্ডে বসিয়ে দিয়ে বলব,
‘সূর্য পোড়া ছাই’ হওয়ার আগে তোমাদের কী আর জ্বলে উঠতে নেই !
নিভে গেছ ! একেবারেই কী নিভে গেছ —- চিরতরে ?
আমি তোমাদের জঠর জননী বলছি !
চিনতে পারছ – আমাকে ?
জরিপ
দু’একটা সস্তা কথোপকথন শেষে তোমার ভ্রুর মাঝখানে থেকে যাওয়া
একটা তীর্যক বিরক্তির পরও তোমাতে আমি ঠাঁই তাকিয়ে থাকি,
কখন একটুখানি প্রত্যাশা জেগে উঠবে তোমার কপালে তা দেখব বলে।
প্রতাশ্যা জেগে ওঠে শেষ অব্দি। জেগে ওঠে বিষাক্ত ছোবলের সাথে।
ছোবল এবং প্রত্যাশা অপরিহার্য এই দুই অথচ এক অথচ তুমি অথচ আমি
কাউকেই আর আলাদা করা যায় না যতক্ষণ শ্বাস চলে।
হঠাৎ প্রত্যাশা কুয়াশা হয়ে গেলে,
ছোবলগুলো সব ঘুরে বেড়াতে থাকে চারপাশ জুড়ে ফণা তুলে সারাক্ষণ !
অত্যন্ত ধৈর্য্যের সাথে সহ্যের শেষ সীমানায় পৌঁছেও
অতি যত্নসহকারে দুধ ভাত মেখে ফণাগুলোর সামনে তুলে ধরি।
ওদের কমজোর আমার একদম ভালোলাগে না!
আয়না
যতবার তার সামনে দাঁড়াই,
সব ভুল দেখি, মিথ্যে দেখি। তবু দেখি।
অন্যদের যেমন সরাসরি দেখতে পাই, খুঁত নিখুঁত দেখতে পাই,
সুন্দর অসুন্দর দেখতে পাই তেমন করে
নিজেদের দেখার সুযোগ আমাদের নেই একমাত্র আয়না ছাড়া।
এই নেই’এর সাথে এতো মসৃণ বোঝাপড়া আমদের যে,
কোন দুঃখ করিনা তার জন্য।
যা সত্য, যা ঠিক তার কাছে পৌঁছাতে নাপারার জন্যও
কোনো মন খারাপ নেই আমাদের ।
আয়নার কাছে গিয়ে ডান কে বাম, বাম কে ডান দেখি আর খুশি হই।
আমি, একমাত্র আমিই সব থেকে সুন্দর শ্রেষ্ঠ মহান
মনে করি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে যখন যতবার সুযোগ পাই।
তাই, যা দেখার কথা নয় সেগুলো দেখি,
যেগুলো দেখার কথা সেগুলো দেখা হয়ে ওঠেনা আর।
আয়না আমাদের বাঁচিয়ে দিল অনেকরকম ভাবে।
অন্যদের দেখতে দেখতে নিজেদের দিকে আর দেখা হল কই।
সময় হল কই দেখার নিজেদের !
আয়না বেঁচে থাক। আয়নার ওপারের সবকিছুই খুব সুন্দর। স্বর্গের মতো সুন্দর।
আয়নার এপারেরগুলো একেবারেই পাতে দেওয়া যায় না !
গঙ্গাস্নান
যাতেই হাত দিই চোখ দিই মন দিই সব নষ্ট।
আমি নষ্ট। তুমি নষ্ট। কষ্ট হয়। এতোটা নষ্ট না হলেই ভালো হত ভেবে
কষ্টটাকে নদীতে স্নান করাতে নিয়ে যাই। কষ্ট আর নদী থেকে ওঠে না।
এদিকে আমাদের নষ্ট হওয়াও চলতে থাকে অবিরাম।
এই ঘটনার কয়েক শতাব্দী পর নষ্ট একদিন সপরিবারে সদলবলে
গায়ে গতরে প্রভাবে প্রতিপত্তিতে কষ্টের দিকে এগিয়ে এল,
কষ্টও কম যায়না সোজা ঢুকে পড়ল নষ্টের বুকের ভেতর
আর অমনি চোখের সামনে ভেসে উঠল গঙ্গাসাগর।
গঙ্গাসাগরে আমাদের একবার করে সবার গঙ্গাস্নান দরকার বটে !