সম্রাটের সমীপে একটুকরো মূর্খামি
: কুন্তল মুখোপাধ্যায়
বাংলা ভাষায় অলোকরঞ্জন একজন সম্রাটের নাম । তিনি একটি উপভাষার জন্ম দিয়েছেন । যে বাংলায় লিখতেন তা সম্পূর্ণ আলাদা একটি উপভাষা । বাংলারই এই উপভাষার যে রাজ্য তার সম্রাটের নাম অলোকরঞ্জন । একদিন যখন ভাষার সীমান্ত নিয়ে আলোচনা হবে যেমন উত্তরবঙ্গের ভাষা ,বাঁকুড়া পুরুল্যা বীরভূমের ভাষা , তেমনি হবে কমলকুমারের বাংলা , অলোকরঞ্জনের ভাষা। তাঁকে পড়ার সময় মনে হত সম্পূর্ণ অন্য কিছু একটা পড়ছি আমি। স্বকর্ণে শুনিনি তাঁকে , কিন্তু যাঁরা শুনেছেন তাঁরা আমায় বলেছেন ওই ভাষাতে তিনি বলতেনও । এটাই বিস্ময়কর। এই মেধাবী নির্মাণের আরও গভীরে তন্নতন্ন আলোচনা করবেন নিশ্চই ভাষা-গবেষকেরা একদিন , তবে বাংলা ভাষার ছাত্র হিসেবে আমি তাঁর অসাধারণ শব্দঝুলির ভিতরে ঢুকে পড়তে চেয়েছি । না , আমার আহামরি গদ্য রয়ে গেছে সংবাদপত্রের । তাঁর লেখা পড়ে কিছুই শিখতে পারিনি । কিন্তু সেটাও আমার এ-লেখার বিষয় নয় ।এই লেখায় অন্য একটি বিস্ময় নিয়ে ভাবতে চাই আমি। সেটি একটি কবিতার লাইন ।
“আমি যত গ্রাম দেখি মনে হয় মায়ের শৈশব” এই লাইনটি যতবার আমি পড়ি দিশেহারা হয়ে যাই । অপার্থিব মনে হয় । ছুঁয়ে দেখি আমি । আসলে অলোকরঞ্জনের জন্মদিন ছিল সেদিন ( আমি কবির চলে যাওয়ার দিনটিকে তাঁর জন্মদিন বলে ভাবতে চাই । প্রকৃত প্রস্তাবে প্রকৃত কবিদের দুইবার জন্মদিন হয় ) । তারও অনেক আগে এই কবিতাটি আমার কাছে ছিল একটি জীবন্ত এনিগমা । অর্থেরও অনেক আগে একটা কবিতার হাওয়া এসে এলোমেলো করে দিয়েছিল সেইদিন যেদিন প্রথম এই লাইনটি পড়েছিলাম । সেইদিন থেকে আমি যখনই গ্রামের বাইরে যাই অথবা দূর প্রান্তর থেকে অনেকানেক গ্রাম দেখি ,মনে হয় এই লাইনটি দাঁড়িয়ে থাকে আমার সামনে । প্রেতাত্মার মতো । কী আছে এই বাক্যটিতে ? কী সেই রহস্য ?
ছাত্রবন্ধু হতে যাব না । বিশেষত যখন জানি যে কবিতার ভাষ্যকারই কবিতার একমাত্র জল্লাদ । আমি শুধু অনুভব করার চেষ্টা করব। মায়ের শৈশব বহুদিনের ।গ্রাম দেশও বহুদিনের !তারা রয়ে গেছে একই রকম । পৃথিবীতে অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়েছে , কিন্তু গ্রামের পরিবর্তন হয়নি । এটাই হয়ত বলতে চেয়েছে কবিতাটি , তুমি বললে ।
তাই কী ? এটাই কি বলতে চায় এই বাক্যটি ?মূলত মাতৃতান্ত্রিকতায় বিশ্বাসী ছিলেন অলোকরঞ্জন । তাহলে কি গ্রামই তাঁর কাছে মাতৃরূপ ? আর মাতৃরূপ তো মঙ্গলদীপ ! তাহলে শৈশব ? মায়ের শৈশব ? সে কি তাহলে আমাদেরই উৎসের প্রাথমিক স্তর ? গ্রাম কি তাই ? তবে যে শৈশব বলতে একটি অতিচেতনা বা অচেতনা বুঝি ! শৈশব কি আশ্চর্য সুন্দর নয় ? তাহলে কি এখানে সৌন্দর্যের কথাই বলতে চেয়েছেন ? কিন্তু কার সৌন্দর্য ?
আমরা কি এই প্রজন্মের অনেকে মায়েদের শিশুবয়সের গ্রূপছবি দেখেছি ? সেইসব সাদাকালো হলুদ-লাগা ফ্যাকাশে এনিমিক ছবিগুলি ? যেখানে একা একটি মেয়ে কাজল পরে দাঁড়িয়ে রয়েছে অথবা তার সাদাকালো বর্ডার দেওয়া টেপফ্রক ? হাসিমুখ ? তার সৌন্দর্য এই গ্রাম ? এখানে সময় কি একটা বড় ভূমিকা নিচ্ছে ? কাজল পড়া গ্রাম ?
কী গ্রাম ? একি সময়ের গ্রাম ? সময়ের কোনো নির্দিষ্ট বিন্দু যা স্থির হয়ে আছে শৈশবের মতো ? দেখা যাচ্ছে, বাক্যটিতে যে একটি অব্যয় এসে বসেছে গ্রাম শব্দটির সামনে ! আর বিভ্রম সৃষ্টি করে ফেলেছে সেই শব্দটি । যত গ্রাম দেখি । একের বেশি অথবা যতবার যত যত গ্রাম !! যত গ্রাম সবই মায়ের শৈশব ? চেতনে বা অবচেতনে প্রসারিত হয়ে যাচ্ছে শ্যামল ছায়াময় গ্রাম ?
নরম একটা স্বপ্নময় অবাচ্যে ছড়িয়ে গেছে এই বাক্যটি । আমাকে বিস্মিত ক’রে বারবার আমার হাত থেকে পিছলে গেছে এই বাক্যটি । যেমন সুর ধরে রাখতে পারি না । তার কোন অর্থ নেই । অনুভব আছে । সেইরকম এই বাক্যটি মনের এমন এক তন্ত্রে সুরারোপ করে যেখানে কোনো অর্থ নেই , ছাত্রবন্ধু নেই , ক্লাসনোটস নেই ।
“আমি যত গ্রাম দেখি/মনে হয় মায়ের শৈশব
আমি যত গ্রামে যত মুক্তক পাহাড়শ্রেণী দেখি/মনে হয় প্রিয়ার শৈশব/পাহাড়ের হৃদয়ে যত নীলচে সবুজ ঝরনা দেখি/মনে হয় দেশ গাঁয়ে ছিল কিন্তু ছেড়ে আসা প্রতিটি মানুষ/
ঝরনার পরেই নদী, নদীর শিয়রে/বাঁশের সাঁকোর অভিমান/যেই দেখি, মনে পড়ে, /নোয়াখালি,শীর্ণ সেতুআর সে-নাছোড় ভগবান।”
পরের লাইনে এসে দেখি বাইরের নদী পাহাড় গাছ সমস্তই আত্মীয় , এমনকী বাঁশের সাঁকোরও ‘অভিমান’ হয় ! বিশ্বচরাচর কবির আত্মীয় । কবি সোমেন মুখোপাধ্যায়ের কাব্যগ্রন্থ “কাঁঠালপাতা বন্ধুপাতা” । অথবা “বান্ধবীগাছ” ।নিবিড় ছড়ানো আত্মীয়তা ।সমস্ত কবিতাটা পড়লে এই লাইনটা যেন খানিকটা স্পর্শ করা যায় । আর এই লাইনটা এই কবিতার মধ্যে এসে অর্থের মধ্যে সীমায়িত হয়ে যাচ্ছে ।
আমি , তাই , সম্রাটের কাছে তাঁর কবিতার এই লাইনটি কবিতার শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিতে চাই ।
অসামান্য। অনবদ্য।
একজন কবির পক্ষে ছাড়া “আমি যত গ্রাম দেখি মনে হয় মায়ের শৈশব” এইভাবে দেখা অসম্ভব। ভোরের নরম আলোর মতো এই লেখা। কুন্তল মুখোপাধ্যায়-কে অসংখ্য ধন্যবাদ।
“আমি যত গ্রাম দেখি মনে হয় মায়ের শৈশব” এই লাইনটিকে একজন কবি ছাড়া আর কারও পক্ষেই এমনভাবে অনুভব করা সম্ভব নয়। মায়াময় এই লেখার জন্য কুন্তল মুখোপাধ্যায়-কে আন্তরিক ভালবাসা।
খুব ভাল লাগলো
বিরল অনুভূতির বিশেষ প্রকাশ। খুব খুব ভালো লেখা।
“সেইদিন থেকে আমি যখনই গ্রামের বাইরে যাই অথবা দূর প্রান্তর থেকে অনেকানেক গ্রাম দেখি ,মনে হয় এই লাইনটি দাঁড়িয়ে থাকে আমার সামনে। প্রেতাত্মার মতো।”
কেবল’প্রেতাত্মার মতো’এই শব্দবন্ধ এই অনন্য অনুভূতির সঙ্গে কেমন যেন বেমানান ঠেকছে আমার কাছে।