শৌভ চট্টোপাধ্যায়-এর কবিতাগুচ্ছ
ধ্বংসের দিকে ফেরানো একটি মুখ
১
ধ্বংস হইতেছিল নগর, বন্দর, বিপণি ও অট্টালিকাসমূহ
ধ্বংস হইতেছিল অসহায় বৃক্ষরাজি, পশুপক্ষী ও মনুষ্যকূল
ধ্বংস হইতেছিল সকল অহঙ্কার ও স্বাধীনতা
ধ্বংস হইতেছিল সকল অধীনতা ও অপ্রেম
“পরে আমি দৃষ্টি করিলাম, আর আকাশের মধ্যপথে উড়িয়া যাইতেছে, এমন এক ঈগল পক্ষীর বাণী শুনিলাম, সে উচ্চ রবে বলিল, অবশিষ্ট যে তিন দূত তূরী বাজাইবেন, তাঁহাদের তূরীধ্বনি হেতু, পৃথিবীনিবাসীদের সন্তাপ, সন্তাপ, সন্তাপ হইবে।“
অপার বিস্ময়, মুগ্ধতা ও ঐশ্বর্য নষ্ট হইয়াছিল
এই আলো, এই অন্ধকার নষ্ট হইয়াছিল
সকল পূর্ণতা, সকল শূন্যতাও নষ্ট হইয়াছিল
যাহা সম্ভব, যাহা অসম্ভব, সমুদয় নষ্ট হইয়াছিল
“এই সকল আঘাতে যাহারা হত হইল না, সেই অবশিষ্ট মনুষ্যেরা আপন আপন হস্তকৃত কর্ম্ম হইতে মন ফিরাইল না, অর্থাৎ ভূতগণের ভজনা হইতে…আর তাহারা আপন আপন নরহত্যা, আপন আপন কুহক, আপন আপন ব্যাভিচার ও আপন আপন চৌর্য্য হইতেও মন ফিরাইল না।“
ভাঙিয়া পড়িল দীর্ঘ ও অবিচ্ছিন্ন এক পরম্পরা
ভাঙিয়া পড়িল সযত্নলালিত বিশ্বাস ও অবিশ্বাস
ভাঙিয়া পড়িল এই অবতল আকাশ ও তারাদল
ভাঙিয়া পড়িল আমাদিগের ভাষা ও নৈঃশব্দ
“পরে আমি এক নূতন আকাশ ও এক নূতন পৃথিবী দেখিলাম; কেননা প্রথম আকাশ ও প্রথম পৃথিবী লুপ্ত হইয়াছে; এবং সমুদ্র আর নাই।“
২
যেখানে সমুদ্র ছিল, এখন সেখানে শুধু কাদা আর বালি—বিষাক্ত, চটচটে, ধোঁয়া-ওঠা। উত্তাপ বলতে, কেবল এটুকুই। আর সবকিছু, চারিদিক, খুব দ্রুত ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। সূর্যহীন, নষ্ট ফলের মতো কালো, কুঞ্চিত আকাশ। মেঘ? না কি, অন্ধকার জমে-জমে এমন হয়েছে?
দিগন্ত-অবধি ছড়ানো এই উৎকট শূন্যের কিনারায়, কয়েকজন মানুষ (মানুষই তো?), নিচু হয়ে কী যেন খুঁজছে। তাদের হাতের আলো, বেশিদূর পৌঁছয় না। তাদের মুখ, রবারের মুখোশে ঢাকা।
“সময় ফুরিয়ে আসছে। দেখ, কী ভীষণ ঠাণ্ডা আর কঠিন এই মাটি।“
“আমরা কি পারব, ফিরে যেতে?”
“সময় এক বিভ্রমমাত্র। তুমি শান্ত হও।“
৩
সময়কে ভাঙতে ভাঙতে, অবশেষে,
এমন হল, যে আমাদের পায়ের তলায়
দাঁড়াবার জায়গাটুকুও আর রইল না।
ব্যাপ্তিহীন, স্থিতিহীন সেই অনুপল
যখন ছিলা থেকে নিক্ষিপ্ত শর,
গন্তব্যে পৌঁছনোর বদলে, নিরালম্ব
শূন্যতায় ভেসে থাকে, আর তার ফলে
ক্রমশ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে
গতির ধারণা, গন্তব্যের ধারণা, এমনকী
সময়ের ধারণাও।
এমন এক মুহূর্ত, যখন স্মৃতি ছাড়া,
আর কোনোকিছুকেই আমরা
পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারি না।
৪
এই নুড়ি-পাথর, শুকিয়ে-আসা ঝর্ণার খাত,
বিচিত্র সব গুল্ম আর উদ্ভিদ, এদের কাউকেই আমি
পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারি না। মনে হয়,
স্মৃতির ভেতর থেকে উঠে আসছে এক অলৌকিক ছায়া,
আশ্চর্য সব আকার আর রঙ।
ধর্মকীর্তি, তবে কি আপনার কথাই
সত্যি বলে মেনে নিতে হবে? বস্তুর নগ্নতার সামনে
আমরা কি চিরকালই আমাদের ভাষা
হারিয়ে ফেলব? আর, ভাষা দিয়ে বানানো যা-কিছু,
অর্থহীন এই শব্দের মিনার, সামান্য ছোঁয়ায়
সে-সবও কি জ্বলে উঠবে দাউ-দাউ করে?
ভন্তে, আমাকে বলুন—ধ্বংস কী? সৃষ্টি কাকে বলে?
যখন, মানুষের চেতনাই তার শৃঙ্খল, আর ভাষা
এক অনিবার্য পরাজয়ের স্মারক
যখন তার নিজের ছায়াই, বারবার, তার পথরোধ করে!
৫
যখন মানুষের ছায়াই, ধীরে ধীরে,
পালটে দিতে থাকে দৃশ্যপট,
এমনকী, যাবতীয় খেলার নিয়ম, তখন
কোথায় নিশ্চয়তা, কোথায় বা গন্তব্য?
ব্রাসেলস, ১৯২৭। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। লেওপোল্ড পার্কের ভেতর, একটা ঝাঁকড়া চেস্টনাট গাছের তলায় দাঁড়িয়ে আছেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। কিছুটা অন্যমনস্ক। সামনে, ঝিলের জলে, একজোড়া রাজহাঁস ভেসে বেড়াচ্ছে। আইনস্টাইন দেখেও দেখছেন না। তাঁর হাতের পাইপটি কখন যে নিভে গেছে, তিনি টেরও পাননি! ছায়ার মধ্যে মিশে গিয়ে, এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছেন, চট করে কারোর চোখেই পড়বে না। তিনি বোধহয়, খানিকক্ষণ, একা থাকতে চাইছেন।
এবং তাঁর মুখ, ভালো করে লক্ষ করলে বোঝা যায়, বিষণ্ণ ও চিন্তাক্লিষ্ট। যে আশ্চর্য সুন্দর ও সুষমামণ্ডিত ইমারতটি—পদার্থবিদ্যার, এই ব্রহ্মাণ্ডের—তিনি তিলে-তিলে নির্মাণ করেছেন, অবশেষে, তা কি ধূলিসাৎ হতে চলেছে? তবে কি তাঁকেও মেনে নিতে হবে, বিজ্ঞান আসলে এক ছেলেখেলাই শুধু? নাছোড় কোনো জুয়াড়ির ভাগ্যপরীক্ষার হাস্যকর প্রয়াস? কে জুয়া খেলছে?
আস্তে আস্তে মাথা নাড়ছেন তিনি। নিজের সঙ্গেই কথা বলছেন, মনে মনে।
তাছাড়া, যে-বাস্তবকে তুমি নিজের থেকে আলাদা করে ভাবতে পার না, তোমার অংশগ্রহণ ছাড়া যে-জগৎ শুধু এক অনিশ্চিত সম্ভাবনামাত্র, তাকে বাস্তব বলে মেনে নেবে কোন আহাম্মক! হাঃ—
গাছের গুঁড়িতে ঠুকে-ঠুকে, পাইপ সাফ করার পর, আবার তামাক ভরলেন তাতে। কাল রাত্রিবেলা, ঘুমোবার আগে, অনেকক্ষণ বেহালা বাজিয়েছেন—বাখের তিন নম্বর পার্তিতা। কী আশ্চর্য সেই সঙ্গীতের গঠন, তার স্থাপত্য! এর মধ্যেও তো একটা নিয়ম আছে, এক অলঙ্ঘ্যনীয় সুষমা রয়েছে। শুধুমাত্র এই সুষমা ও সামঞ্জস্যের অভাবের কারণেই, বাখ আর মোৎজার্টের পাশে, হ্বাগনারকে দুর্বল মনে হয়। এখন, সেই নিয়মকেই যদি আমরা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিই, উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি…
কী চাইছে বোর আর হাইজেনবার্গ? ওদের উদ্দেশ্যটা কী?
রাত্রি হয়েছে। রাস্তায় লোকজন বিশেষ নেই। বেশ হাওয়া দিচ্ছে এখন…
৬
হাওয়া দিচ্ছে। যদিও তার ফলে, শুশ্রূষা দূরস্থান, বরং, সমস্ত শরীর আনচান করে ওঠে। আর, সেই এক বিচিত্র, অস্বস্তিকর গন্ধ—পোড়া ধাতুর, ফুটন্ত গন্ধকের। তিনজন মানুষ, অন্ধকার ঠেলে, ঘরে ফিরছিল। অবিশ্যি, ঘর বলে আদৌ যদি কিছু থেকে থাকে। যদি, মাটি খুঁড়ে বানানো গর্তটিকে, বাস্তবিক, ঘর বলে মেনে নেওয়া যায়।
সবার পেছনে যে-লোকটি হেঁটে আসছিল, সে বলল, “আর কতদিন?” দ্রুতবেগে হাঁটার ফলে, বোধহয় সামান্য হাঁপ ধরেছিল তার। গলা শুনে মনে হল। আর তার গায়ের শার্টটির রঙ, হতে পারে, নীল।
সবার সামনে, হনহন করে হাঁটছিল যে-মানুষটি, সম্ভবত একটি মেয়ে, ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, “তুমি প্রস্তুত?“
“এভাবে, ইঁদুরের মতো, নিজের রক্ত আর বমির মধ্যে ঘাড় গুঁজে মরার চেয়ে—“
“কিন্তু, গোটা ব্যাপারটাই তো একটা অনুমান, একটা ধারণা!” মাঝখানের লোকটি, খানিক উত্তেজিত স্বরেই, বলে ওঠে।
“সময় তো নিজেই একটা ধারণা। গতি ছাড়া, পরিবর্তন ছাড়া, সময়ের আর কোনো অর্থ আছে কি?”
“স্মৃতি?”
“সেখানেই তো ফিরতে চাইছি।“
“তোমাদের তত্ত্বকথা রাখ। সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়ার আগে, আমি এই অন্ধকার থেকে, এই কাদায় আর বালিতে ঢেকে যাওয়া দুর্গন্ধময় শূন্যতা থেকে, এই অসহ্য নৈঃশব্দ থেকে, অন্তত একবারের জন্য হলেও, মুক্তি চাই।“
“আর তোমার শরীর? যখন ঠান্ডায়, আস্তে আস্তে, জমে যেতে শুরু করবে?”
“অথচ, ভূমধ্যসাগরীয় কোনো বন্দরের নির্মেঘ আকাশের তলায়, ও হয়তো তখন রোদ পোয়াচ্ছে!” মেয়েটি শব্দ করে হেসে ওঠে।
“আসলে, পালিয়ে যাচ্ছ।“ মাঝখানের লোকটিও হেসে ওঠে এবার। একটা খটখটে, শুকনো হাসি।
“পালিয়ে যাচ্ছি? না কি ফিরছি?“