শুধু রবীন্দ্রচর্চার জন্যই নয়, খননের জন্যও গ্রন্থ দুটি বাঙালি জাতির সম্পদ  <br />হিন্দোল ভট্টাচার্য

শুধু রবীন্দ্রচর্চার জন্যই নয়, খননের জন্যও গ্রন্থ দুটি বাঙালি জাতির সম্পদ
হিন্দোল ভট্টাচার্য

পূর্ণেন্দুবিকাশ সরকারের সংকলন ও সম্পাদনায় 'গীতবিতান তথ্যভাণ্ডার যেমন বাংলা সাহিত্য এবং সঙ্গীতের ইতিহাসে এক অনস্বীকার্য সংযোজন, তেমনই সাম্প্রতিক কালে প্রকাশ পাওয়া 'রবীন্দ্রগানের অন্তরালে'। এই দুটি গ্রন্থ নিয়ে সমালোচনা করা এক অর্থে অসম্ভব। কারণ দুটি গ্রন্থ বাদ দিয়ে রবীন্দ্রচর্চা আগামী দিনে অসম্ভব। বরং, এ কথা বলাই যায়, বাংলা সাহিত্যে বহুদিন পর এমন গবেষণা নির্ভর দুটি বই প্রকাশিত হলো, যে বইদুটি বাঙালি জাতির সম্পদ হিসেবে থেকে যাবে।

“সাহিত্যের চিত্রপটে স্থিতি অপেক্ষা গতি আঁকা শক্ত। যাহা পুরাতন, যাহা স্থির, যাহা নানা দিকে নানা ভাবে সমাজের হৃদয় হইতে রসাকর্ষণ করিয়া শ্যামল সতেজ এবং পরিপূর্ণ হইয়া দাঁড়াইয়া আছে–তাহাকে সত্য এবং সরসভাবে পাঠকের মনে জাজ্বল্যমান করিয়া তোলা অপেক্ষাকৃত সহজ। কিন্তু যাহা নূতন উঠিতেছে, যাহা চেষ্টা করিতেছে, যুদ্ধ করিতেছে, পরিবর্তনের মুখে আবর্তিত হইতেছে, যাহা এখনো সর্বাঙ্গীণ পরিণতিলাভ করে নাই তাহাকে যথাযথভাবে প্রতিফলিত করিতে হইলে বিস্তর সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ অথবা ঘাতপ্রতিঘাত-ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়া বিচিত্র নাট্যকলা প্রয়োগ আবশ্যক হয়। কিন্তু সেরূপ করিতে হইলে রচনার বিষয় হইতে রচয়িতার নিজেকে বিশ্লিষ্ট করিয়া লইতে হয় –

অত্যন্ত কাছে থাকিলে, মণ্ডলীর কেন্দ্রের মধ্যে বাস করিলে সমগ্রের তুলনায় তাহার অংশগুলি, ব্যক্তির তুলনায় তাহার মতগুলি, কার্যপ্রবাহের তুলনায় তাহার উদ্দেশ্যগুলি যেরূপ বেশি করিয়া চোখে পড়ে, তাহাতে রচনা সত্যবৎ হয় না, তাহার পরিমাণ সামঞ্জস্য নষ্ট হইয়া এবং বাহিরের নির্লিপ্ত পাঠকদের নিকটে কিরূপে বিষয়টিকে সমগ্র এবং সপ্রমাণ করিতে হইবে তাহার ঠাহর থাকে না।” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং একটি গ্রন্থ আলোচনায় উপরোক্ত কথাগুলি লিখেছিলেন। কিন্তু কথা যখন রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি নিয়ে সংকলনের আলোচনার, তখন তা দাবি করে আরও নিখুঁত এক পর্যবেক্ষণের। বর্তমান সময়ে, সময় নিয়ে, নিখুঁত ভাবে কাজ করার মানুষ কম। কারোর সে ধৈর্যই নেই, যে ধৈর্য মানুষকে কারো সৃষ্টির অন্তরে প্রবেশ করিয়ে তাকে গভীরতার স্বাদ এনে দিতে পারে। কারণ আমরা প্রত্যেকেই হয়ে পড়েছি বিশেষ ভাবে ক্ষণিকের আনন্দপ্রত্যাশী। কিন্তু ক্ষণিকের উত্তেজনা এবং সাহিত্যের অনুসন্ধানী চেতনা দুটি আলাদা বিষয়।
যখন সমসময়ের দিকে তাকালে একপ্রকার চিন্তার দৈন্যই চোখে পড়ে, তখন গত কুড়ি বছর ধরে ব্যক্তিগত সমস্ত প্রতিকূলতার পাশ কাটিয়ে, পেশায় চক্ষু চিকিৎসক পূর্ণেন্দুবিকাশ সরকার কাজ করে চলেছেন রবীন্দ্রনাথের রচনাগুলিকে সংকলিত করার জন্য অথবা, রচনার অন্তরালে থাকা ইতিহাসগুলিকে এক জায়গায় নিয়ে আসার জন্য। একটি জাতির জন্য শুধু না, একটি ভাষার জন্য এই কাজ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কাউকে না কাউকে এই কাজ করতেই হতো। কিন্তু এই কাজ করার লোকের সম্ভাবনা ক্রমে কমে আসছিল। পূর্ণেন্দুবিকাশ সরকারের মতো মানুষজন হলেন সেই আশাবাদের মতো। যে আশাবাদ আমাদের নিশ্চিন্ত করে, এখনো অজ্ঞাতবাসে থেকে নিভৃতে সাধনার মতো কাজ করে চলা যায়।
প্রায় ৯০০পৃষ্ঠার গীতবিতান তথ্যভাণ্ডার তেমনই একটি গ্রন্থ। যার ভূমিকাতে স্বয়ং শঙ্খ ঘোষ লিখছেন, ” সেই একই অতন্দ্র নিষ্ঠায় আর শ্রমে এবার তিনি মুদ্রিতাকারে উপহার দিতে চলেছেন এই ‘গীতবিতান তথ্যভাণ্ডার’। রবীন্দ্রনাথের গানের প্রসঙ্গে জ্ঞাতব্য সমস্ত রকম তথ্য নিয়ে। এর মধ্যে আরও দুটি সমৃদ্ধ কাজ প্রকাশিত হয়েছে সুভাষ চৌধুরীর ‘গীতবিতানের জগৎ’ (২০০৪) এবং প্রবীর গুহ ঠাকুরতার ‘গীতবিতান মহাকোষ’ (২০০৮/১৩)। কিন্তু সে দুটি ঐশ্বর্যময় বইয়ের পরেও পূর্ণেন্দুবিকাশের এই কাজটির কিছু গুরুত্ব থাকে এর পদ্ধতিগত কারণেই। গান বিষয়ের বিভিন্ন তথ্যকে যেভাবে তিনি কয়েকটি সারণির মধ্যে বিন্যস্ত করেছেন এখানে, তাতে এক লহমাতেই নানা খবর পাঠকের গোচরে আসে–এ একটা মস্ত সুবিধে।” গীতবিতান তথ্যভাণ্ডার নিয়ে আলোচনা করা যায় না এই কারণেই, যে, এই গ্রন্থ নিজেই এক মহাসমুদ্রের মতো। পূর্ণেন্দুবিকাশ নানা গানের জন্য এক অভিজ্ঞ নাবিকের ভূমিকা পালন করেছেন। বলা হয়, মহাভারতকে পুরো পড়া কখনোই যায় না। সারাজীবন ধরে পড়তে হয়। ঠিক তেমন ভাবেই, ‘গীতবিতান তথ্যভাণ্ডার’ পাঠক বা রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে যাঁরা চর্চা করতে চান, তাঁদের কাছে এক মহাগ্রন্থ। বলা যেতে পারে রবীন্দ্রনাথের গানের ইতিহাসের এমন এক নির্ভরযোগ্য সংকলন আমরা আগে পাইনি। এর আগে সমীর সেনগুপ্ত কাজ করেছেন অনেক। কিন্তু পূর্ণেন্দুবিকাশ অক্লান্ত পরিশ্রম করে আভিধানিক নিষ্ঠায় সম্পাদনা করেছেন এমন একটি গ্রন্থ।

রবীন্দ্রনাথের গানের তথ্যগুলি থেকে ইতিহাসের কাছেও আমরা পৌঁছে যেতে পারি সহজেই। এক একটি গ্রন্থ এভাবেই ইতিহাস হয়ে যায়। বাঙালির কাছে শুধু নয়, বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসেও কোনও একজন লেখকের রচনা নিয়ে এমন সংকলন আগে কখনো হয়েছে কিনা, আমার অন্তত জানা নেই।
‘গীতবিতান তথ্যভাণ্ডার’-এর এই মহাকাব্যিক কাজের পাশেই তাঁর সাম্প্রতিক গ্রন্থ ‘রবীন্দ্রগানের অন্তরালে’। এই গ্রন্থ রবীন্দ্রনাথের দুই শতাধিক গানের ইতিহাস, সেগুলির সঙ্গে যুক্ত প্রচুর অ্যানেকডটকে আমাদের সামনে হাজির করে। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি নিয়ে চর্চায় ইতিহাসের এই খনন আমাদের বিস্মিত করে। এই ইতিহাসগুলি তিনি যে আবিষ্কার করেছেন তাই-ই নয়, ইতিহাসগুলিকে প্রাসঙ্গিক করে তুলেছেন রবীন্দ্রনাথের গানকে সম্পূর্ণ রূপে বোঝার জন্য। আমরা তো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রবীন্দ্রনাথের গান বা কবিতার ক্ষেত্রে খনন করে দেখতে পারি না। আমরা বিস্ময়ে মোহিত হই। কিন্তু শুধু সুর বা কথার একাংশ দিয়ে বিস্ময়ে মোহিত থাকাটাই কাজের কথা নয়। বরং, কেন বিস্মিত হলাম, এই গানের উৎস কী, কীভাবেই বা রবীন্দ্রমননে ও কলমে এই গান এলো, এ সম্পর্কে আমাদের চেতনাকে শিক্ষিত করাই উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। আর সেই কাজটিই করেন পূর্ণেন্দুবিকাশ তাঁর ‘রবীন্দ্রগানের অন্তরালে’ নামক বইটির মাধ্যমে। রবীন্দ্রগানকে যাঁরা আত্মস্থ করতে চান, তাঁদের এই ৫৫০ পৃষ্ঠার গ্রন্থটিকে সংরক্ষণ করতেই হবে। একটি সহজ উদাহরণ দিলে হয়তো বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে। ‘তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা’ গানটি সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে পূর্ণেন্দুবিকাশ লিখছেন, ” পাণ্ডুলিপিতে তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা’গানটির সুরনির্দেশ ছিল রাগিণী ছায়ানট। তিন মাস পরে কলকাতার একান্নতম মাঘোৎসবের (১১ মাঘ ১২৮৭) সময় গানটির কিছু ব্যক্তিগত হৃদয়াবেগের স্পর্শ ( আঁধার হৃদয়মাঝে দেবীর প্রতিমা-পারা ইত্যদি) বাদ দিয়ে, কয়েকটি নতুন শব্দ যুক্ত করে এটিকে ব্রহ্মসঙ্গীতের রূপ দেওয়া হয়েছিল।” আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই গ্রন্থের একটি সম্পদ। তা হলো এখান থেকেই আমরা সূত্র পাচ্ছি স্বামী বিবেকানন্দের রবীন্দ্রনাথের গান সম্পর্কে প্রীতির। ‘শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃততে উল্লেখ করা হয়েছে যে আলোচ্য গানটি স্বামী বিবেকানন্দ শ্রীরামকৃষ্ণকে অন্তত দুবার (৩১ আষাঢ় ১২৯২ এবং ৯ কার্তিক ১২৯২) গেয়ে শুনিয়েছিলেন।”
এমনই সব সময়ের অন্তরালে হারিয়ে যাওয়া বা নিভৃতে থেকে যাওয়া অসংখ্য তথ্য অত্যন্ত নিষ্ঠাসহই সহজ ও সাবলীল ভাষায় এমন ভাবেই বর্ণনা করা হয়েছে এই গ্রন্থে, যে বিস্মিত হতে হয়। এই গ্রন্থও রবীন্দ্রসুরের প্রেমিক এবং পাঠকের কাছে বাইবেলের মতো। চিরসঙ্গী হয়ে থাকবে আমাদের। এই গ্রন্থের আরও একটি বৈশিষ্ট্য সনাতনের সঙ্গে আধুনিকতার মেলবন্ধন। প্রতিটি গানের ইতিহাসের পরে অধ্যায়ের শেষে গানগুলির কিউ আর কোড দেওয়া আছে। আজকের পাঠক সেই কিউ আর কোড তাঁদের স্মার্ট ফোনে স্ক্যান করলেই শুনতে পাবেন সেই সব গান। অর্থাৎ গানটি শোনার আগে গানটি সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ইতিহাসের কাছে পৌঁছতে পারছেন পাঠক। এবং তার পর গানটি শুনতেও পাচ্ছেন।
স্বভাবতই এই দুই মহাগ্রন্থের কাজ তো আর একদিনে হয় না। কমপক্ষে দুই দশক ধরে এই কাজগুলি করেছেন ডক্টর পূর্ণেন্দুবিকাশ সরকার। ‘গীতবিতান তথ্যভাণ্ডার’ এবং ‘ রবীন্দ্রগানের অন্তরালে’- এই দুটিই গ্রন্থ সিগনেট প্রকাশ করেছেন অত্যন্ত যত্নে। যেমন প্রচ্ছদ, তেমন প্রোডাকশন। কারণ এই দুটি গ্রন্থই দীর্ঘদিন ধরে রাখার বই। বিভিন্ন প্রজন্মে পাঠক বিভিন্ন সময়ে এই গ্রন্থ সংগ্রহ করবেন আশা করা যায়। রবীন্দ্রগবেষক তো বটেই, সাধারণ রবীন্দ্রপ্রেমিক ও পাঠকও এখন রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে পড়াশুনো করতে চাইলে এই দুটি বই ছাড়া হবে না। বলা যেতে পারে, রবীন্দ্রনাথের হাত ধরেই আমাদের জীবনে প্রবেশ করল এই দুই মহাগ্রন্থ। যা শুধু গবেষণার কঠিন শব্দে পরিপূর্ণ নয়। বরং যে গ্রন্থদুটিতে রয়েছে তথ্যের নিখুঁত বিবরণ এবং ইতিহাসের বিশুদ্ধ কাহিনি। এর আগে সমীর সেনগুপ্ত-র কাজ আমাদের কাছে রয়েছে। কিন্তু সে সব কাজ তো অসমাপ্ত রেখেই তিনি চলে গেলেন।
পূর্ণেন্দুবিকাশ সরকারকে বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে প্রণাম ও আন্তরিক ধন্যবাদ এই গবেষণামূলক কাজের জন্য। হ্যাঁ, তাঁর গদ্যভাষাও মন ছুঁয়ে থাকে।

গীতবিতান তথ্যভাণ্ডার, সিগনেট প্রেস, সংকলন ও সম্পাদনা- পূর্ণেন্দুবিকাশ সরকার, মূল্য-১৫০০/- প্রচ্ছদ- কাকলি গুহ
অনলাইন- https://pages.razorpay.com/pl_FdKjyTho92KMIj/view

রবীন্দ্রগানের অন্তরালে, সিগনেট প্রেস, প্রচ্ছদ-রৌদ্র মিত্র, ১০০০ টাকা
অনলাইন– https://www.anandapub.in/#/book-detail/4525

লেখাটি ভালো লাগলে, আবহমানের জন্য আপনার ইচ্ছেমতো অবদান রাখতে পারেন
এই কিউ আর কোড স্ক্যান করে ফোন পে-র মাধ্যমে।
এই অবদান একেবারেই বাধ্যতামূলক নয়। ফোন পে বা গুগল পে- 9051781537
স্ক্যান করার জন্য কিউ আর কোড–

CATEGORIES
Share This

COMMENTS Wordpress (0)

demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes
Just a moment...

Checking your browser

This process is automatic. Your browser will redirect to your requested content shortly.

Please allow up to 5 seconds…

DDoS protection by Cloudflare
Ray ID: f9ec53c076b52751