রাহুল দাশগুপ্ত-র কবিতা
১
একজন সংবেদনশীল মানুষের কাছে
প্রতিটি মুহূর্তই সঙ্কটের
সে কোমল করে এই পৃথিবীর দিকে তাকায়
নরম করে সবকিছু স্পর্শ করতে চায়
চেনা দৃশ্যকে পাল্টে পাল্টে তৈরি করে নেয়
নিজস্ব, ব্যক্তিগত দৃশ্য
সে সহজেই বিপন্ন হয়, ব্যথা পায়, বিস্মিতও হয় সহজেই
আত্মরক্ষা পারে না
সে জীবনকে খুঁজে নেয়, পাল্টে দেয়, উদ্ভাবন করে
ভালোবাসার রহস্যের ভেতর রক্তাক্ত করে নিজেকে
মেধা, সৌন্দর্য ও প্রজ্ঞার স্থাপত্যে মুগ্ধ হয়
একটি শিশুর মধ্যে দেখে আবহমান
যে নারী আগলে রেখেছে তাকে
তার দীর্ঘশ্বাসে অভিভূত হয়
এভাবেই একজন সংবেদনশীল মানুষ নির্মাণ করে চলে শিল্পকে…
২
প্রকৃত শোকের কাছে সবকিছু তুচ্ছ হয়ে যায়।
রোজকার জীবনের শীত, গ্রীষ্ম, মামুলি ঋতুরা
প্রকৃত শোকের আছে নিজস্ব উচ্চতা, সম্মোহন
ধ্যানের স্তব্ধতা আর আত্মার গভীর উচ্চারণ
প্রকৃত শোকের কাছে মাথা নত হয় অনায়াসে
ছড়ানো-ছিটানো যত লোভ, সব অর্থহীন লাগে
প্রকৃত শোকের আছে বেদনার গোপন আহ্লাদ
সুরের নিবিড় স্পর্শ, প্রার্থনার মতো মন্ত্রধ্বনি
প্রকৃত শোকের কাছে যেতে হয় খুব সাবধানে
অতর্কিত যাতায়াতে সে তবু চমকে দিতে পারে
প্রকৃত শোকের আছে স্বীকারোক্তি, উচ্ছ্বাস, প্রেরণা
প্রকৃতির মতো খুব গভীর, বিস্তৃত নীরবতা
আমি যাই তার কাছে, প্রকৃত শোকের কাছে, দেখি
আয়নার মুখোমুখি সে আমাকে বসিয়ে দিয়েছে
আমি দেখি আমাকেই, উন্মোচিত, ক্ষতচিহ্নে গড়া
নিরাসক্ত তার মুখ, প্রকৃত শোকের, ছায়া ভরা…
৩
স্বর্গের পাশে শুয়ে আমি নরকের চিন্তা করছিলাম
ওই নরক ছেড়ে এসেছিলাম একদিন, তবু ভুলতে পারিনি
তারপর যত এগিয়েছি জুটে গেছে আরও কত নরক
নরক বেড়েই চলেছে আর ছড়িয়ে পড়েছে চতুর্দিকে
এখন যেদিকে তাকাই কিছুতেই এড়াতে পারি না তাকে
যে রাস্তায় নামি এসে হাত ধরে কোনও না কোনও নরক
নরকের স্পর্শে, ঘ্রাণে, সম্মোহনে আমার শ্বাসকষ্ট হয়
অথচ স্বর্গ শুয়ে থাকে আমার পাশে, এমনকি পাশের ঘরেও
নরকের তাণ্ডবে দুশ্চিন্তায় কাটে তার সারাদিন
চোখের নিচে কালি, কপালে কুঞ্চন, গালে আবছা জলের দাগ
নরকের সঙ্গে যুঝতে যুঝতে সে এখন ক্লান্ত, সমস্ত গ্লানি মুছে
তার নীরব চোখের পাতায় জোছনা বিছিয়ে বসে থাকে পবিত্রতা…
৪
অজস্র মৃত কবিতাকে বহন করে চলেন
একজন কবি
ঠিক যেমন অন্য কবিরাও করেন
ওইসব কবিতার কোনও পুনর্জন্ম নেই
ওরা কোনওদিনই কবিতা হয়ে উঠবে না
অথচ হারাবেও না কোনওদিন
একজন কবি সারাজীবন বহন করে চলেন
অজস্র মৃত কবিতাকে
তারা মৃত, কিন্তু পরিত্যক্ত নয়
কবি তাদের ত্যাগ করতে পারেন না
কারণ মৃত হলেও একদিন তাদের জন্ম হয়েছিল
কবিতা না হয়ে উঠলেও তারা হয়ে উঠতে পারত
একেকটি পরিপূর্ণ কবিতা
কবি তাদের পরিত্যাগ করতে পারেন না
কবি তাদের বহন করে চলেন
মমতায়…
অসাধারণ!