রামরাজত্ব না রামমন্দির– আপনারাই ঠিক করুন
সুদেষ্ণা মৈত্র
ফুলহিঁ ফরহিঁ সদা তরু কারন।
রহহিঁ এক সোঁগ গজ পঞ্চানন।।
খগ মৃগ সহজ বয়রু বিসরাই।
সবহ্নি পরস্পর প্রীতি বড়াই।। (রামচরিতমানস)
একসাথে মিলেমিশে থাকার এই মহৎ ভাবনাকে বুকের ভিতর ধারণ করে একটা সাধারণ গরিব গুর্বো ছুটে চলেছে। বিশ্বাস, ন্যায় আর সত্যের জয়ের ওপর দাঁড়িয়ে তার মহানায়ক রাম। ছেলেটি ওই আদর্শবানকে মাথায় নিয়ে তাৎমাটুলি-ধাঙড়টুলি-কোয়েরীটোলা পেরিয়ে এই বৃহত্তর ভারতবর্ষের যেখানেই পা রাখছে, সেখানেই ফুটে উঠছে বিশ্বাসভঙ্গের ইতিহাস। জাতপাতের বিবাদ। অপমান আর অবদমনের চিৎকার। ছেলেটা আস্তে আস্তে রেগে যাচ্ছে, মুখ ফেরাচ্ছে রামরাজ্য থেকে, রামের মহানায়কত্ব থেকে। আমরা যেভাবে মুখ ফেরাই আদানি-আম্বানিদের দুঃখ বা সুখ দেখে। ছেলেটিকে আমরা চিনি। এমন হাজার হাজার ছেলেকে আমরা চিনি, যারা আজও ধর্মের নেশায় কাতর ঢুলুঢুলু চোখে রাম হতে চায়। তারপর জীবনযুদ্ধে প্রবল সংঘর্ষে বিশ্বাসহীন এক সমাজের পেষণে নিতান্ত ঢোঁড়া সাপ হয়ে থেকে যায়। এই ভালোবাসা আর বিশ্বাসহীনতার পাঠ নিতে নিতে যতবার ‘রামায়ণ’এর কাছে এসে দাঁড়িয়েছি, বারবার এক পিতৃতন্ত্রের ধ্বজা শরীরটাকে কামড়ে ধরেছে। পৌরুষে আঘাত লাগলে ‘নিজস্ব নারী’ রক্ষার্থে দূরদেশে গিয়ে হিরোইজম আমাদের ভারতীয়দের প্রাচীনতম অবলম্বন। আবার লোকলজ্জার খাতিরে নারীকে গলা টিপে হত্যা করা কিম্বা অগ্নিপরীক্ষা( মতান্তরে হত্যা) দিতে বাধ্য করাও রামকনসেপ্ট, যার উদযাপন চলে হরিয়ানায়, রাজস্থানে, এবং ভারতীয় পুরুষবীর্যবানদের অন্দরে অন্দরে। সেই রামরাজ্য এখন জাঁকজমকপূর্ণভাবে প্রকাশ করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী (প্রতিটি রঙ্গমঞ্চে তাঁর পোশাকের চমক লক্ষ্যণীয় বলে তাঁকে পরিধানমন্ত্রী বলেও নাকি ডাক দিচ্ছে নিন্দুকের দল)। তিনি রামমন্দির স্থাপনের যৌক্তিকতায় ন্যায়বিচার ও সাম্যের গান শোনাচ্ছিলেন। শুনতে শুনতে দেখতে পাচ্ছিলাম কেমন ‘সীতারাম’ থেকে ‘শ্রীরাম’ হয়ে উঠছে ‘আচ্ছে’ ভারতের ‘আচ্ছে’ সমাজ। এখন ভারতের প্রায় সর্বত্র রামরাজ্য বিরাজমান বলেই আমার ধারণা। গত একমাসে ধর্ষিত কিশোরীর সংখ্যা ৭। নভেম্বরে খবরে প্রকাশিত ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১৩টি, তারমধ্যে চারটিতে সরাসরি জড়িত শাসকদল। গত ছয় মাসে ধর্ষণের খবর ৪৮টি। দিল্লি, আগ্রা, উত্তরপ্রদেশ, ব্যাঙ্গালোর, পশ্চিমবঙ্গ, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, হরিয়ানা, ছত্তিশগড়,বেনারস, গুরুগ্রাম এমন অজস্র জেলায়, শহরে রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ছে নারীদের দমিয়ে রাখার কনসেপ্ট। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এখন টার্গেট কিশোরী। কারণ, ন্যায়রাজ্য নিয়ে কথা বলার মতো স্বর তারা সেই বয়সে তৈরি করতে পারবে না, পারলেও তাকে সহজেই অ্যাসিড ঢেলে বা জিভ কেটে কিম্বা কড়াইয়ের তেলে ভেজে অথবা অগ্নিসংযোগে মুছে দেওয়া সহজ। আমরা যে দেশে বাস করি সেখানে ধর্ষকের হয়ে কোর্টচত্বরে মিছিল করে আইনজীবীরা। উন্নাও আসামী নেতা হওয়ার সুবাদে সহজেই ছাড়া পেয়ে যায় বিয়ের ভোজ খেতে যাবে বলে। বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভিতরেই ভিডিও করার ভয় দেখিয়ে, বন্দুক ঠেকিয়ে নগ্ন হতে বলা হয় ও ধর্ষণ চলে শাসকঘনিষ্ঠ ধর্ষকের দ্বারা। নারীসুরক্ষামন্ত্রী থেকে প্রধানমন্ত্রী প্রায় সকলে তখন রামরাজ্যের ভিতর প্রবেশ করে যাওয়ায় অন্যায় ও অবক্ষয়ের কোনোকিছুই দেখতে পান না। এ এমনই এক স্বর্গরাজ্য। আপনার শরীরে ক্ষত থাকলেও, আপনি এই আফিমের ভিতর প্রবেশ করলে ভুলে যাবেন বাস্তুহারার কথা। ভুলে যাবেন বাড়িতে চাল নেই। ভুলে যাবেন নিজেকে নাগরিক হিসেবে প্রমাণ করার মতো রঙবেরঙের কাগজ নেই। একটা ইঁটকাঠপাথরের দেওয়ালের সামনে মাথা ঠুকে ঠুকে ‘সব পেয়েছির দেশ’ লাভের এই মাদকাসক্তি মারিজুয়ানার চেয়েও ভয়াবহ। চারপাশে খুন, হত্যা, ভিক্ষাবৃত্তি আর মৌলিক অধিকার হননের রাজনীতি থেকে চোখ সরিয়ে দেওয়ার এই বিশ্রী রকমের ‘ভগবান-ভগবান’ খেলা মানুষের কাছে ধর্মকে এমনভাবে আঁকড়ে ধরতে শেখাচ্ছে যে মানুষ বঞ্চনা, শোষণ ও অপমানের চরম পর্যায়ে পৌঁছেও ভাবতে থাকবে, এটাই সুখ, এটাই রামরাজ্য, এটাই ভবিতব্য। ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’ স্লোগানের নিচে যত রক্ত জমে আছে, তার দ্বারাই যেন গড়ে উঠছে এই অনশ্বর ‘রাম’। যার পৌরহিত্যের ভার স্বয়ং রাষ্ট্রের ওপর। একমুখে ন্যায়ের স্তম্ভ প্রতিষ্ঠার বুলি, অপরপ্রান্তে ক্ষমতাতন্ত্রের একপেশী ঔদ্ধত্য এই দুইয়ের ওপরেই দাঁড়িয়েছিলেন রামায়ণের রাম। আমাদের ভারতও দাঁড়িয়েছে এই দুইয়ের ওপরেই। সম্প্রতি একাধিক ঘটনা সেই কথাই স্মরণ করায়। রেসলিং খেলোয়াড়দের কথা ভুলে গেলে চলবে? সাক্ষী মালিককে মনে আছে? যৌনহেনস্থা ও ধর্ষণের পরেও কীভাবে সভাপতিকে বহাল তবিয়তে রেখে দেওয়া হয়, কীভাবে দেশের ন্যায়বিচারে ধর্ণাধারীর মুখে জলকামান ছোঁড়া হয়, এই দৃশ্যও রামরাজ্যেরই। শম্বুক হত্যার কলঙ্ক থেকে পালানো বা হাত ধুয়ে ফেলা এত সহজ কি? রাষ্ট্র যাকে দুর্বল করে ঘোষণা করবে, তার ওপর অত্যাচার চালানোর পূর্ণ অধিকার থাকে রাষ্ট্রের, আমরা এই শিক্ষাই পেয়ে এসেছি আমাদের মহাকাব্য থেকে। তাই মধ্যযুগের কবি চন্দ্রাবতী যখন রামের বোন কুকুয়া’কে সৃষ্টি করেন তাঁর নিজস্ব কপ্লিত রামায়ণে তখন আসলে সীতার দোসর টেনে এনে সমাজটাকে দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন কবি। যে সমাজ প্রকাশ্যে সীতা বা কুকুয়াদের সাম্রাজ্যপতনের কারণ হিসেবে নির্ধারিত করে দেয়। এই নির্ধারণের ওপরেই দাঁড়িয়ে এখন আমাদের ভারতবর্ষ। যেখানে অলৌকিক পিতৃদেবের জন্মস্থান নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। তারপর চলে তার প্রতিষ্ঠাদিবস। এরপর সেই রামের মুখ দিয়েই উচ্চারিত হবে অজস্র দৈববাণী যার জন্য বিশেষ স্ক্রিপ্টরাইটার নির্ধারিত হবে রাষ্ট্র দ্বারাই। মানুষের আর কি! ছেঁড়া কাঁথা, ভুখা পেট, বুকভর্তি অশিক্ষা আর চামড়াভর্তি ফুসকুড়ি নিয়ে আচ্ছে দিনের আশায় রামরাজ্যের মাটিতে গড়াগড়ি খাবে।
একদম ঠিকঠাক কথা।
একদম ঠিকঠাক।