রাত্রিপদাবলী ।। মৃন্ময় চক্রবর্তী
১
অন্ধপদরেখা
নাছ-দুয়োরে থামল এসে গোরুরগাড়ি
সেই সে কবেই দরজা আমার খোলাই এমন
ভেতরবাগে মাটির সিঁড়ি যাও দোতলায়
কে তুমি যে অনন্তকাল এমনি আসো!
এই মনে হয় অন্ধকারে জ্বলল আলো
মাটির দাওয়া, ছাউনি খোড়ো উঠল জেগে
কিন্তু দেখি জ্বলছে ও জিভ, রাতের কেশর।
তবুও এই অন্ধদুয়োর বুকের সিঁড়ি,
না ফুটিয়ে চরণরেখা ঘোর আঁধারে
যাও পেরিয়ে চতুর্দশী আলোকমেয়ে।
২.
তোতার আনন্দ গান
তোতা বন্ধু আমার। সে বিড়ি ধরায় গানের আগে।
বেলা পড়ে গেছে। আজ ভাত নেই। তবু গান হবে।
এইভাবে নষ্ট সুর তাল ঠোকে উরুতে, চটাম।
তোতা সাধুর মাটির দোতলা। সিঁড়ি ওঠে আকাশ, মাচায়,
সামান্য ভিক্ষার ঘরে, সাতকুল ভেসে যাওয়া জলে।
সাধু গায়, মজল আমার মন ভ্রমরা…
দেখি, ঘাটপুকুরের বাঁশবন, ছায়ার ভেতর থেকে উঠে আসে দিগধাউড়ি স্বর্ণচাঁপা সাঁঝ।
এই কি তবে সেই শ্যামালোক? এই কি সেই অশ্রুতপূর্ব?
দেখি, তার চাঁদের মতো স্তন, দেখি তার অঘোর জঘন স্তম্ভময়,
দেখি, তার চুল কৃষ্ণমহাকাশ, অপার শস্যে পূর্ণ হয়ে আছে।
তোতাসাধু গায়, চরণ কালো ভ্রমর কালো
কালোয় কালো মিশে গেল, সুখ দুঃখ সমান হল,
আনন্দ সাগর উছলে!
ভিক্ষা দাও ভিক্ষা দাও! এমন গানের দেশে অন্ন দাও দুটো!
৩.
এ ভুঁয়ে ফুটিয়ো বাসনা
অন্নপূর্ণা সাইকেলে চেপে এল। যাও, দেখো গে তেঁতুলতলায়!
মেটে মুদির গন্ধছায়া ভুলে ছুটে গেল ভিখু ভোলাদাস।
জটা খুলে গেছে, রোগা সাপ পিছন পিছন তালকানা।
দ্যাখ দ্যাখ, অন্নপুন্না এল এই বাগে!
মেঠো পথ ক্লান্ত করেছে বড়ো। মেছো কেরিয়ারটাও দেঁতো কম নয়।
ঠারো টোপর সামলে এসো ঠাকুর।
এ-বাগে ফসল আছে, তবুও শোলা ডুবে যায়।
বেনে সরকার ধানের ঢেকুর তোলে, দ্যাখোনি?
সে তো তোমারই জলপড়া!
এসো, পা ধোও, সোনাজল পুকুরে ছড়াও। দুএকটা কাজলপুঁটিও দিয়ো চাঁদনিতে।
এই দেখো হাঁড়ি, মাটির মরাই, খাঁ খাঁ চোত-মাস।
এ ভুঁয়ে ফুটিয়ো বাসনা,
দু-খণ্ড আগুন দিও ত্রিশূলে, বাঘছালে!
৪.
পাথর পাষাণ হয়ে আছে
শরীরে তার জল, শরীরে তার মাটি।
তার বুকে আপনজনেরা বুনে খেয়েছে বীজ,
পিঠে দাঁড়িয়ে পেড়ে নিয়েছে সোনা।
সে বোবা, সে নির্বোধ
সারারাত নক্ষত্রের নিচে শুয়ে পাহারা দিয়েছে অনাত্মীয় খেত।
এখন রাত্রিসাধকেরা তাকে এনেছে পাতালে
হাড়িকাঠে মাথা রেখে পড়ে আছে অচল সন্ন্যাসী।
চারদিকে রসাতল, জড় অন্ধকার
কোথাও জাগ্রত নয় কালিকাস্বদেশ,
পাথর পাষাণ হয়ে আছে।
৫.
আঁধার-কিরীট
মাথার উপর অন্ধকার একমুঠো আলো-চাল ছড়িয়ে রেখেছে। কী খিদে এই পৃথিবীতে ! আর এই আঁধার-কিরীট।
দেউল ঈশ্বরহীন পড়ে আছে। গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে পুতুল-পূজক। শিবার চতুর চোখ মাঠের নিশির গায়ে জ্বলে আর নেভে।
এই যে আঁধার-দেবতা, তার পায়ে পড়ে থাকা খিদের সাধনা, আলো ফুটলেই ভেঙেচুরে যায়। অহি, নকুলের নখে ছিন্ন করে ছন্দ-ঋক সব।
এ কি তোমারই খেলা, রাত্রি? অনন্ত আঁধার ছিদ্রে সামান্য শস্যের উচাটন, গ্রামে জনপদে রক্তপাত, ভাগের ঠাকুর ; এই তবে ধর্ম ইচ্ছাময়ী?
গোরুরগাড়ির চাকা মাঠের ভেতর ঘুরে চলে। ধুলো ওড়ে কৃষ্ণরজনীর। দূরে মানুষের পরিত্যক্ত গ্রাম, দেয়ালে ঘুঁটের আলপনা নিয়ে ধীরে মুছে যায়। রাজা রামকৃষ্ণ ভাগীরথীর অনন্ত প্রবাহে মিশে যান। আকুল সংগীত তাঁর অন্ধপক্ষে জেগে থাকে দীপালোকহীন। মীরজাফরের চরণামৃত পান কর্কটক্রান্তিটুকু পেরোতে পারে না !