রণজিৎ অধিকারীর পাঁচটি কবিতা
এইখানে চুপ তারা
প্রায়ই শব্দগুলো ঠিকঠাক জায়গায় থাকে না,
কোনো গাঢ় চিন্তার ভেতর থেকে যখনই আঁকড়ে ধরতে চাইবে,
নিদেন নাগাল পাওয়ার জন্য তাকাবে জগতের এদিক-ওদিকে, পাবে না।
ডিমের খোসা ভেঙে চিন্তার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে
তুমি খুঁজতে চাইবে;
কখনো দেখা যাবে, একটা শব্দের টুকরো
লেখার টেবিলের কোণে লেগে আছে, তার বিভক্তি নেই ;
হয়তো কোনো পুরোনো উপন্যাসে একটা অনুচ্ছেদের
মাঝামাঝি পেয়েছিলে শব্দটা, মনে নেই আর …
গায়ে ছ্যাতলা উঠে ওই ঘুপচি কোণে পড়ে আছে কেউ,
যেন কতদিন গায়ে রোদ পড়েনি!
অভিধান খুলে দেখা গেল সারি সারি শবদেহের মতো
শব্দ সাজানো,
নিঃসাড়ে যেন চলমান জগৎ থেকে পালিয়ে এসে এইখানে চুপ তারা।
তুমি এই সংশয়ের ভেতরে আমৃত্যু থেকে যাবে —
ছড়িয়ে থাকা ওই নিষ্প্রাণ শব্দগুলিকে
কীভাবে চৈতন্যে জারিয়ে নেবে কিংবা
চিন্তা ভেঙে বেরিয়ে এসে ঠিক ঠিক শব্দ
খুঁজে ফিরে যাবে বৃত্তের ভেতরে ?
অনন্তকাল
যখনই কিছু লিখতে শুরু করি,
অনন্ত কাল আমাকে ছুঁয়ে থাকে।
একজন দুঃখী মাতাল, ভাঙা নৌকা, পরিত্যক্ত ঘর —বিচ্ছিন্ন করে এদের কোন্ অর্থ আছে?
দুঃখে ও যন্ত্রণায় দুমড়েমুচড়ে যাওয়া কোনো আত্মাও
যখন আমার লেখার ভেতর আসে — সেও
অনন্তকালকে ছুঁয়ে আছে দেখতে পাই।
সৃষ্টি —হয়তো একটা দীর্ঘ কবিতার মতো,
যার শেষ অংশটা বেড়ে যেতেই থাকে ;
সময় মাঝে মাঝে এসে ছন্দ বদলে দেয়,
ইচ্ছেমতো লয় বাড়া-কমা করে দিয়ে যায়
আর কবিতায় শেষ শব্দগুলো জুড়ে দিই আমরা!
যখনই আমি কিছু লিখতে শুরু করি,
ভাবি — অনন্ত কাল আগে শুরু হওয়া
একটা দীর্ঘ কবিতার শেষ শব্দগুলো জুড়ে দিচ্ছি
কিন্তু জানি যে কবিতাটা কখনো শেষ হবে না।
অর্থ
গাড়িগুলি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির সামনে,
ঠায়।
আজ রবিবার — কথাটার কোনো মানে নেই।
গ্রীষ্ম পেরিয়ে এই বর্ষা ঢুকে পড়ল হুটোপুটি করে —
এরও কোনো বড়ো অর্থ নেই।
শুধু মৃত্যুভয়ই জীবনকে যেন খুব অর্থ দিয়েছে ;
ভিড় নেই তবু অক্লান্ত সিগনাল পৃথিবী জুড়ে।
ভালোবাসা কি নিজেকেই চিনতে শুরু করা?
তোমার চোখের দিকে একদিন তাকাব,
তাকিয়েই থাকব —কথাটা বুকের ভেতর নড়ে ওঠে।
কেউ ভেবে পায়নি —পৃথিবী খুব একা —এত সমুদ্র,
জলোচ্ছ্বাস, আগুন, পর্বতের শিরা, কীট, পাখি,
মানুষ এত মানুষ এসেও সে-একাকিত্ব দূর হয়নি।
গাড়িগুলি ঘরের সামনে দাঁড়িয়েই থাকে, চুপ।
কোনো সাড়া না দিয়েই সময়কে পেরিয়ে যেতে দিই;
যেদিন তোমার চোখের দিকে তাকাব,
তাকিয়েই থাকব…
উপরিতল বরাবর
উপরিতল বরাবর আমাদের অভিযান
আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছিল ক্রমেই,
আর একের পর এক মোড় কিংবা চত্বরে এসে
মিলিত হচ্ছিলাম আমরা।
কখনো এক যৌন রোমাঞ্চ অগভীর কুয়াশার মতো
ঘিরে রাখছিল আমাদের, কখনো আমরা
আবৃত্তি করছিলাম পুরোনো হয়ে আসা কণ্ঠস্বরে পুরাণের মতো প্রাচীন প্রেমের কথাগুলোই।
আলো ও অন্ধকারের উপরিতল,
পাথর ও বরফের উপরিতল,
গোলক ও ঘনক্ষেত্রের উপরিতল…
কিন্তু আমরা কখনোই দেখে নিতে পারিনি
আলো ও ঘনকের ভেতরটা,
পাথর ও অন্ধকারের,
আমার ও তোমার ভেতরের আরো আরো তলগুলো
কোণ
দুই বিপ্রতীপ কোণ —পরস্পরের মুখাপেক্ষী হয়েও
তারা স্বাধীনতা ভোগ করে অনন্তকাল,
একটা বিন্দুতে ঠেস দিয়েও তারা নির্বিকার!
সংলগ্ন বাহুগুলি একে অপরকে অস্বীকার করেই ক্রমে ইহজগৎ পেরিয়ে বহুদূর চলে যেতে থাকে…
যেন সে-যাত্রার কোনো শেষ নেই!
জলে রোদে ক্ষয়ে যায় প্রান্ত,
একদিন শ্যাওলা জমে কোণে…
অনেকগুলো প্রলয় যেমন কম্প বা আগুনের উৎপাত
হয়তো কেউ তিরিশ হাজার বছর আগের,
তেরো লক্ষ… হয়তো তার ছাই পুরু হয়ে জমে আছে
আজও গভীরে গোপনে ;
কিন্তু কোনো কিছুই টলাতে পারে না কোণ দুটিকে।
গোঁ ধরে থাকা তাদের ভালোবাসা, জাগতিক
রৌদ্র ও ছায়া, উচ্ছ্বাস ও ঠান্ডা ছাই,
সমূহ সম্ভাবনার নিচে
তারা আজও পরস্পরের মুখাপেক্ষী ও স্বাধীন।
ছড়িয়ে দেওয়া পায়ের মতো বাহু দুটি
ইহজগৎ পেরিয়ে বহুদূর চলে গেছে।
অসাধারণ স্যার।পরস্পর-বিপরীতমুখী ধারনাগুলো পাশাপাশি বসানোর মাধ্যমে অসাধারণ সুন্দর এক-একটি চিত্রকল্পের ব্যবহার সমস্ত লেখাগুলোকে অনন্যসুন্দর করে তুলেছে ।
অসাধারণ স্যার। পরস্পর বিপরীতমুখী ভাবনাগুলো কাছাকাছি বসানোর মাধ্যমে অনন্যসাধারণ চিত্রকল্পের ব্যবহার সমস্ত লেখাগুলিকে অনন্যসুন্দর করে তুলেছে। শুধু নতুন ভাবনাই নয়,সুন্দর শিল্পীসত্তার পরিচায়ক আপনার সমস্ত লেখাগুলি
সাবলীল অথচ গভীর। দুষ্প্রবেশ্যতা নেই, আবার সহজিয়া ধারারও বলা যাবে না। রণজিতের এই পর্বের লেখাগুলি পড়ে আমি তৃপ্তি পাই। শুভেচ্ছা কবিকে।
স্থান, কাল আর জ্যামিতি। অনুভূতিগুলি সেদিক থেকে এসে সেদিকেই ছড়িয়ে পড়েছে। অন্যরকম। ভাল লাগল।
চমৎকার লেখা। খুব সুন্দর।