যে ছাই সূর্য-পোড়া, যে জন্ম কবির :
পার্থজিৎ চন্দ

কবির জয়যাত্রা কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত?

কবির বিজয়পতাকা কোন সীমান্তের কাছে পোঁতা থাকে?

অগণন তারকা আর ছায়াপথের নীচে ধূমকেতুর লেজের ঝাপটায় সে পতাকা কি পতপত করে ওড়ে?

অন্ধকার, কালো এক অতিকায় ভ্যাকুয়াম-ক্লিনারের পেটের ভিতর যখন ঢলে পড়ে চাঁদ-তারাদের দল, তখনও কি দূর লাইটহাউসের মতো জ্বলে থাকে সে পতাকা! থাকে, অনিবার্য ভাবে থাকে; অন্তত ‘সূর্য-পোড়া ছাই’-এর পর সে থাকা অনিবার্য আর ‘বাস্তব’ হয়ে ওঠে আমার কাছে।

উনিশ’শো নিরানব্বই সালে প্রকাশিত হয়েছিল জয় গোস্বামীর ‘সূর্য-পোড়া ছাই’। তারপর থেকে যতবার লেখাগুলির কাছে ছুটে গেছি ততবার জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে গেছি। ভস্মে পরিণত হয়েছি শুধুমাত্র আরেকবার ফিনিক্স-জন্ম পাবো বলে। আমার সঙ্গে ‘সূর্য-পোড়া ছাই’এর পবিত্র মৃত্যুসম্পর্ক স্থাপিত হয়ে গেছে সেই কবেই।

জয়ের কবিতার সঙ্গে দীর্ঘ যাপনের শুরুর দিনগুলিতে এক অসহায়তায় আক্রান্ত হয়েছিলাম। বারবার কবিতার মধ্যে ফুটে উঠছে ভয়ংকর ভাবে অসহায়, রুগ্ন এবং অতি-সংবেদনশীল এক কবির ছায়ামূর্তি। যতবার জয়ের কবিতার কাছে ছুটে যেতাম দেখতাম, এই কবিকে পিষে দিয়ে চলে যাচ্ছে এক অতিকায় কৃষ্ণবর্ণ ভারী ‘প্রাগৈতিহাসিক’ স্টিমরোলার। মৃত্যুখাদের খুব কাছে অসহায় ভাবে ঝুলে রয়েছেন কবি।

কিন্তু তাঁকে ধ্বংস করা যাচ্ছে না, সমস্ত পরাজয়কে তিনি অতিক্রম করে উঠে দাঁড়াচ্ছেন, ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন। নীলাভ এক তারার আলোর অনতিক্রম স্পর্ধা জেগে রয়েছে এই ঘুরে দাঁড়ানোর মধ্যে।

‘বাস্তব’ নামে একটি ধারণা – যা প্রায়শই খণ্ডিত এক ধারণামাত্র- সেখানে যা কিছু অসম্ভব তাকেই স্বপ্নে সার্থক করে দিচ্ছেন কবি। সেই স্বপ্ন-সম্ভাবনার ক্ষেত্রটিতে তিনি অমিত-শক্তিশালী, সেখানে তিনি ‘দানবীয়’ এক শক্তির অধিকারী।

জয়ের কবিতায় এই ‘পোয়েট-পারসোনার’ ছবি বারবার ফিরে আসে, ‘সূর্য-পোড়া ছাই’এর শেষ কবিতা, যেটিকে পৃথক ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে ‘উপসংহার’ নামে, সেখানেও এই পোয়েট-পারসোনার ছায়া দীর্ঘ হয়ে আছে।

কবিতাটির শুরুতেই জয় জানিয়ে দিচ্ছেন সূর্য ফুটে উঠছে কবির মাথার পিছনে। অকল্পিত দক্ষতায় জয় নির্ধারণ করে দিচ্ছেন কবির ক্ষেত্রটিকে…কসমিক ডিজাইনটিকে পশ্চাতে রেখে জয় পোয়েট-পারসোনাকে এনে দাঁড়ি করিয়ে দিচ্ছেন সেন্টার-স্টেজে। এবার তার এক মহালীলার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে লিখে যাবার সময় শু্রু হচ্ছে যেন।

যে জন্মের সঙ্গে সংলগ্ন হয়ে রয়েছে নক্ষত্রের সহোদর হবার প্রভা সে-জন্মের সিদ্ধি ও দ্যুতির কাছে ম্লান হয়ে আসে যশ-আকাঙ্খা। নীচু এক বাস্তবতাকে পরিত্যাগ করে মহাজাগতিক পাখি উড়ে চলেছে ছায়াপথ থেকে ছায়াপথে। তার ঠোঁটের সামনে সমস্ত স্বপ্ন-সম্ভাবনা ভাঁড়ার উজাড় করে দিতে চায়। কিন্তু সে কোনও দিকে দৃকপাত করছে না, বোধি চেতনা ও শিল্প-সাহসের অন্নপূর্ণা-শিখরে আরোহন করে উড়ে যেতে যেতে সে শুধু চুপ করে দেখে চলেছে সৃষ্টির জরায়ুর ভেতর ঘটে যাওয়া খেলাটিকে।

‘উপস্ংহার’এর দ্বাদশ লাইনটিতে দু’মাত্রার একটি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, ‘পূর্ণ’। কবি নিশ্চুপ থেকে দেখছেন সূর্য ফেটে সূর্য-ধ্বংস শেষ ঝরে পড়ছে ছাই। এই ‘ছাই’ শব্দটির আগে জয় বিশেষণ হিসাবে ব্যবহার করলেন ‘পূর্ণ’কে। তবে কি সৃষ্টির একটি পর্বের ধ্বংস সম্পন্ন হয়ে গেল? সৃষ্টি যেমন পূর্ণতা সন্ধানী, ধ্বংসও যেন ঠিক সে-পথ ধরে পূর্ণকেই খুঁজে চলেছে। চক্রাকার সম্পন্ন হয়েছে ধ্বংস, মহাবিস্ফোরণ থেকে এই ধ্বংস পর্যন্ত সবটুকুকেই প্রত্যক্ষ্ করেছেন কবি।

কিন্তু একটি ধ্বংসের পর তো আরেকটি সৃষ্টি মাথা তুলে দাঁড়াবেই।

এক সূর্যের ছাই থেকে জন্ম নিচ্ছে হাজার হাজার সূর্য।

এরপর জয় চকিতে ও অনায়াসে চলে গেলেন ‘মহাভারত’এর শুরু পর্যায়ে। ব্যাসদেব তপোবনে মহাকাব্য লেখার প্রস্তুতি গ্রহণ করছেন, কিন্তু বিশ্বক্ষেত্রে একজনও উপযুক্ত লেখকের সন্ধান পাচ্ছেন না। সে সময়ে স্বয়ং ব্রহ্মা তপোবনে আবির্ভূত হয়ে গণনায়ক গণেশকে স্মরণ করবার পরামর্শ দেন। গণেশ কেবলমাত্র একটি শর্ত দিয়েছিলেন, লেখার সময়ে লেখনীর ক্ষণমাত্র বিশ্রাম তিনি সহ্য করবেন না। ব্যাসদেব কৌশলে এই শর্তটিকে মেনে নিয়েছিলেন, তিনি শর্ত দিয়েছিলেন – অর্থবোধ না-করে গণেশ একটি বর্ণও লিখতে পারবেন না। মহাভারতে ‘অষ্ট সহস্র অষ্ট শত’ শ্লোক ব্যাসকূট-রূপে ছড়িয়ে রেখেছিলেন ব্যাসদেব যার অর্থ-উদ্ধার কেবলমাত্র তিনি ও শুকই পারেন। সঞ্জয়ের সম্পর্কে স্বয়ং ব্যাসদেবও নিশ্চিত ছিলেন না।

এই কবিতাটি পড়তে গিয়ে মহাভারতের লিখনে গণনায়ককে স্মরণ করবার অতি-জানা কাহিনীটির অবতারণা করবার পিছনে একটি কারণ আছে। কবিতাটি পড়তে গিয়ে একদিন বিদ্যুতের মতো মনে হয়েছিল গণেশ আসলে অবিচ্ছিন্ন সৃষ্টির প্রবাহ। তার কোনও বিরাম নেই, তার কোনও বিশ্রাম নেই… স্রষ্টার কাছে থেকে সে ক্ষণিকের জন্যও বিচ্যুত হতে চায় না। প্রতিটি মুহূর্ত স্রষ্টাকে গ্রাসের মধ্যে ধরে সে চলেছে, যেন এক মহাজাগতিক অজগরের অনন্ত গলাধঃকরণ প্রক্রিয়া।

কবিতাটির সামনে বসে দেখতে পাওয়া যায় গণনায়ক লিপিবদ্ধ করছেন, তাঁর লেখনি থামছে না।

কবিতাটিতে যা বলা নেই, সেই ব্যাসকূটের কথাও মনে হয়। তাহলে কি সৃষ্টির সবটুকু উদ্ধারের সম্ভবনারহিত! এমন এক অতল ও দুর্জেজ্ঞ রহস্য থাকবেই যার মুখ শুধুমাত্র উন্মোচিত হবে স্রষ্টার কাছেই!

দেখতে পাওয়া যায় চক্রাকারে ফুটে উঠছে ব্রহ্মাণ্ডজগৎ।

কবিতাটিতে বারবার এই চক্রের আদল ঘুরেফিরে এসেছে। একটি বিন্দু থেকে সৃষ্টি শুরু হয়ে চক্রাকারে আবর্তিত হয়ে চলেছে, চক্রাকারে সৃষ্টি ও ধ্বংসের প্রক্রিয়া চলেছে। এবং এই চক্রের ঠিক মাঝখানে বসে আছেন কবি।

কবি বিবরণ দিচ্ছেন এই মহারহস্যের, তিনি শরীরে পাচ্ছেন আলোর গতি।

‘ঈশ উপনিষদ’এর ‘স পর্যগাৎ…’ শ্লোকে ব্রহ্মের মাতরিশ্বা বা সৃজনশক্তি স্বতস্ফূর্ত বলে মনে করা হয়েছে। ব্রহ্ম নিজের গতিতে, সহজ ছন্দে সৃষ্টির প্রবাহের মধ্যে দিয়ে আত্মপ্রকাশ করেন। সর্বোপরি তিনি কবি… ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমানদর্শী।

‘কেন উপনিষদ’এর ‘ন তত্র চক্ষুর্গচ্ছতি…’ শ্লোকে বাক’কে ব্রহ্মের সঙ্গে একাত্ম করে দেখা হয়েছে, ‘ব্রহ্ম যখন সেই শব্দ এবং শব্দের উৎপাদক শ্রবণেন্দ্রিয়ের আত্মস্বরূপ তখন স্বীয় আত্মার প্রতি শব্দ গমন করিতে পারে না, যেমন অগ্নি অন্য পদার্থের ধারক ও প্রকাশক হইলেও নিজেকে দগ্ধ অথবা প্রকাশিত করিতে পারে না…’

-কবি সেই ব্রহ্মের মুখ…তার শরীরে আলোর গতি; তিনি সব কিছুকে অতিক্রম করে ফুঁড়ে চলে যাচ্ছেন।

কবিতাটি শেষ করে একটি প্রশ্ন ঘনিয়ে উঠতে পারে, কবিতাটির শুরুতে যে জবাকুসুম সংকাশ সেখান থেকেই কি কবির উড়ান শুরু হয়েছিল? নাকি এক তুরীয় মুহূর্তে যখন তিনি সব কিছু ফুঁড়ে চলে যাচ্ছেন তখন সে-যাত্রার শুরু?

তীব্র গতিতে এ প্রশ্ন পাক খেতে থাকে। শেষ পর্যন্ত কবির উড়ানটিকে দেখা যায়…সে-উড়ান শুরু হয়েছে জবাকুসুম সংকাশের মতো সিদ্ধির তার মাথার পিছনে ফুটে ওঠার সময় থেকেই। ঠিক সেই মুহূর্তে কবি উপলব্ধি করেছিলেন ‘আমি এই সকল’ এবং ‘এই সকলই আমি’। তাঁর ডানায় ভর করেছিল এক অনন্ত স্বাধীনতার আলো। তিনি নিজেকে সৃষ্টি করতে করতে এবং নিজেকে ধ্বংস করতে করতে উড়ে যাচ্ছেন, প্রকৃতপক্ষে ‘সৃষ্টি’ ও ‘ধ্বংস’ শব্দ দুটিও ভীষণ আপেক্ষিক হয়ে পড়েছে সে অবস্থায়। কারণ কবি এবার ‘অক্ষরজন্ম’ পেয়েছেন, তার কোনও ক্ষয় নেই…শুধু আলো-অন্ধকার ভেদ করে চলে যাবার অনায়াস ক্ষমতা আছে।

আচার্য পিপ্পলাদ ও তাঁর ছয়জন শিষ্যের যে ছটি প্রশ্ন তার চতুর্থটিতে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য পঞ্চভূতের অন্তরালে লুকিয়ে থাকা সূক্ষরূপকে ‘তন্মাত্র’ নামে ভূষিত করা হয়েছে। সৃষ্টিপ্রক্রিয়ায় এই সূক্ষরূপ স্থূলরূপে বিবর্তিত হয়।

কবিই একমাত্র সেই ঐশ্বরিক ‘দানবীক’ শক্তির অধিকারী, যে এই রহস্যের ভিতর স্বাধীন…অমিত শক্তিশালী।

উপসংহার

সিদ্ধি, জবাকুসুম সংকাশ

মাথার পিছনে ফেটে পড়ে

দপ করে জ্বলে পূর্বাকাশ

রাত্রির মাথায় রক্ত চড়ে

সিদ্ধি, মহাদ্যুতি-তার মুখে

চূর্ণ হয় যশের হাড়মাস

হোমাগ্নিপ্রণীত দুটি হাত

আমাকে সংযুক্ত হয়, বলেঃ

বল তুই এই জলেস্থলে

কী চাস? কেমনভাবে চাস?

আমি নিরুত্তর থেকে দেখি

সূর্য ফেটে পড়ে পূর্ণ ছাই

ছাই ঘুরতে ঘুরতে পুনঃপুন

এক সূর্য সহস্র জন্মায়

সূর্যে সূর্যে আমি দেখতে পাই

ক্ষণমাত্র লেখনী থামছে না

গণেশ, আমার সামনে বসে

লিপিবদ্ধ করছেন আকাশ

চক্রের পিছনে চক্রাকার

ফুটে উঠছে ব্রহ্মাণ্ডজগৎ

এ দৃশ্যের বিবরণকালে

হে শব্দ, ব্রহ্মের মুখ, আমি

শরীরে আলোর গতি পাই

তোমাকেও এপার ওপার

ভেদ করি, ফুঁড়ে চলে যাই…

Attachments area

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (1)
  • comment-avatar
    ABHIJIT GHOSH 4 years

    Khub bhalo lekha Parthada

  • demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes