যে কথা এখন বলা কাজ
সন্দীপন চক্রবর্তী
কবিরাই সমাজের সবচেয়ে সংবেদী অংশ! আর সমাজ ও রাষ্ট্রের পরিচালনায় থাকা ধান্দাবাজ শাসকশ্রেণী দাবড়ে, চাবকে, জবরদস্তি করে, নিজের মতে চালাতে চায় যে সাধারণ মানুষকে; প্রতিবাদ তো দূরের কথা, তারা তাদের নিজেদের যন্ত্রণার কথা, কষ্টের কথা বললেও তখন সেটাকে দেগে দেওয়া হয় দেশদ্রোহিতা বা সমাজদ্রোহিতা হিসেবে! ফলে সেটুকুও বলার সুযোগ বা অধিকার পায় না তারা অনেকসময়েই। সেই যন্ত্রণাবিদ্ধ মানুষের হয়ে তখন ভাষাধারণ করেন কবি। তাই সে কবির কবিতাও তখন শাসকের চোখে হয়ে ওঠে এক 'পাপ', ক্ষমতার বিরুদ্ধে এক দ্রোহ।
মুখে যদি রক্ত ওঠে
মুখে যদি রক্ত ওঠে
সে-কথা এখন বলা পাপ।
এখন চারদিকে শত্রু, মন্ত্রীদের চোখে ঘুম নেই
এসময়ে রক্তবমি করা পাপ; যন্ত্রণায় ধনুকের মতো
বেঁকে যাওয়া পাপ; নিজের বুকের রক্তে স্থির হয়ে শুয়ে
থাকা পাপ।
একেবারে এখনকার সময়েই দাঁড়িয়ে, আমাদের চারপাশের যা হাল-হকিকত দেখছি, তাতে এই কবিতা কি একেবারেই সমসাময়িক মনে হয় না? কিন্তু না, প্রায় অর্ধেক শতাব্দী আগে এই লেখা লিখে গেছেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। যখন এ কবিতা লিখেছেন তিনি, তখনও কিন্তু ‘কোনটা কবিতা হলো আর কোনটা হলো না — এটা ভেবে দেখার সময়’ ছিল না বলে মনে হচ্ছিল তাঁর। ফলে ‘কাব্যগুণহীন জার্নালিজম’ দিয়েই পুলিশি তাণ্ডবের প্রতিবাদ করতে চাইছিলেন তিনি। এবং বস্তুত এভাবেই ‘গড়ে তুলছিলেন নতুন এক antipoetry-র কাব্যভাষা’।
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা নিয়ে বলতে গিয়ে শঙ্খ ঘোষ যথার্থভাবেই দেখিয়েছেন যে, ‘কবিতা বলতে কী বোঝায়, এ নিয়ে স্পষ্ট বা অস্পষ্ট কোনো সংজ্ঞার্থ বা প্রত্যাশা থেকেই যায় আমাদের মনে, … সেটারই এক অলক্ষ্য প্রয়োগ করি আমরা, ব্যবহার করি বিচারের একটা প্রচলিত মান। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার একটা ঐতিহাসিক ভূমিকা এই যে, পাঠককে তিনি বাধ্য করেন সেই মান ভেঙে ফেলতে, তাঁর কবিতাবিচারের জন্য তৈরি করে নিতে হয় নতুন কোনো মান। প্রধানত ইঙ্গমার্কিন আধুনিকতার বোধ থেকে জেগে উঠছিল তিরিশের যে কবিতাবিষয়ক ধারণা, সরিয়ে দিতে হয় তার চাপ। কী কবিতা, তার কোনো প্রাক্তন বিবেচনা থেকে পাঠক তখন আর এই কবির রচনা পড়বেন না, এই কবির রচনা থেকেই তৈরি হয়ে উঠবে ‘কবিতা কী’ প্রশ্নের নতুন একটা উত্তর। এই অর্থে, পৃথিবীর অন্য অনেক দেশের কবির রচনার মতো, তাঁর কবিতা এসে পৌঁছয় এক আধুনিকোত্তর যুগে’।
এই কবিতা ‘পড়তে পড়তে পাঠক কেবলই ঘূর্ণির মতো ঘুরতে থাকবেন এই পাঁচ-দশ বছরের’ কলকাতা, তথা রাজ্য এবং দেশের ‘গ্লানিময় ইতিবৃত্তে, সমস্ত ভারতবর্ষের নিরন্তর পচন-লাঞ্ছনায়। আর সেই পটভূমি মনে রাখলে এই অসমান ঊষর আঘাতময় শিল্পধরণকে মনে হয় অনিবার্য, অনিবার্য মনে হয় এর আপাতশিল্পহীনতা।’ এই ধরণের প্রয়োগ, আমরা পরে দেখতে পাবো, শঙ্খ ঘোষ নিজেও তুলে আনছেন তাঁর অনেক কবিতায়।
আসলে, কবিকে তো বাঁচতে হয় ক্ষমতাপাগল রাজনীতির নেতা পরিচালিত এই ব্যবস্থার প্রত্যহেই, যা তাকে ফালাফালা করে দেয়। রক্ত চুঁইয়ে নামে আর্তনাদ। কিন্তু সে আর্তনাদেরই আরেক পিঠে জেগে থাকে ‘গহন কান্না’। আর সে কান্নার উৎস হলো ভালোবাসা। ফলে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় একদিকে যেমন এই লেখা লিখছেন, আরেকদিকে তেমনই এর প্রতিরোধ হিসেবে লিখে রাখছেন এই সাবধানবাণী — ‘তোমার কাজ আগুনকে ভালোবেসে উন্মাদ হয়ে যাওয়া নয় / আগুনকে ব্যবহার করতে শেখা / অস্থির হয়ো না / শুধু, প্রস্তুত হও।’
কবিরাই সমাজের সবচেয়ে সংবেদী অংশ! আর সমাজ ও রাষ্ট্রের পরিচালনায় থাকা ধান্দাবাজ শাসকশ্রেণী দাবড়ে, চাবকে, জবরদস্তি করে, নিজের মতে চালাতে চায় যে সাধারণ মানুষকে; প্রতিবাদ তো দূরের কথা, তারা তাদের নিজেদের যন্ত্রণার কথা, কষ্টের কথা বললেও তখন সেটাকে দেগে দেওয়া হয় দেশদ্রোহিতা বা সমাজদ্রোহিতা হিসেবে! ফলে সেটুকুও বলার সুযোগ বা অধিকার পায় না তারা অনেকসময়েই। সেই যন্ত্রণাবিদ্ধ মানুষের হয়ে তখন ভাষাধারণ করেন কবি। তাই সে কবির কবিতাও তখন শাসকের চোখে হয়ে ওঠে এক ‘পাপ’, ক্ষমতার বিরুদ্ধে এক দ্রোহ।
আর এই সময়ে দাঁড়িয়ে, শুধুই কি আমাদের দেশ? গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দিকে যদি তাকাই, রোহিঙ্গা হত্যা, বাংলাদেশে মৌলবাদের দাঁত-নখ, পাকিস্তান আর আফগানিস্তানের অবস্থা…খুব কি আলাদা? অথবা যদি বৃত্তটা আরও বড় ক’রে দেখি? আইসিসের উত্থান, সিরিয়া আর প্যালেস্টাইনের অবস্থা, ব্রেক্সিট, আমেরিকায় ট্রাম্পের উত্থান…সব মিলিয়ে বেশ উদ্বেগজনক! আবার ইতিহাসে এই যে প্রথম এরকম ঘটছে, তাও তো নয়! আগেও কি ঘটেনি? ইতিহাস ফিরে ফিরে আসে। আর তার সঙ্গেই প্রাসঙ্গিক হয়ে ফিরে ফিরে আসে এইসব কবিতা। সেখানেই এই কবিতার মাহাত্ম্য।