মেরু-নিশীথের নাবিকেরা ষষ্ঠ পর্ব
পার্থজিৎ চন্দ
জেগে’ থাকবার মধ্যে যে গাঢ় বেদনার ভার রয়েছে তার করাল থাবা থেকে মুক্তি পেতেই যে মানুষটি অশ্বথের কাছে একগাছা দড়ি হাতে চলে গিয়েছিল সে নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু চারদিকে জীবনের সফেন স্রোতের মধ্যে বাঁচতে বাঁচতে কেন একজন মানুষকে আক্রমণ করে সে ভার? কেন ‘সুপক্ব যবের ঘ্রাণ হেমন্তের বিকেলের’ অসহ্য হয়ে ওঠে একজন মানুষের কাছে?
একদিন অবনী পালিতের মৃত্যু ঘটেছিল; কিন্তু মৃত্যুর আগে ঘটে গিয়েছিল বেশ কিছু অনিবার্য ঘটনা। অথবা এমনও বলা যায়, অনিবার্য ঘটনাগুলি ঘটেছিল বলেই এক বিশেষ ধরণের ‘মৃত্যু’ ঘটেছিল অবনী পালিতের। অনিবার্য বিষয়ের একটি, রক্তে ক্রমশ বিষ মিশে যাওয়া। আলট্রামেরিন ব্লু… কোবাল্ট ব্লু রঙের বিষ মিশে যাওয়া। ক্রমশ এই মিশ্রণের ফলে রক্তের রঙ রূপান্তরিত হতে শুরু করেছিল নীল রঙে।
যেন আদিম এক সমুদ্র… নীল… অতিকায় নীল। ঝকঝক ও ধকধক করছে সূর্য… সমুদ্রের অনেকটা ভিতর পর্যন্ত প্রবেশ করে সে রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে নীল বিষে। অথবা মন্থিত হয়ে চলেছে সমুদ্র… সাপ তার সমুদ্রসমান বিষ ফেলে রেখে গেছে। এবার সেখান থেকে বিষ-নীল রঙ উঠে এসে প্রবেশ করছে রক্তে।
অবনী পালিত বাংলার নীলিমা ছেড়ে ভূমধ্যসাগরের দিকে চলে গিয়েছিল বহুদিন আগে, সময়ের ঘড়ি-ধারণা এখানে অবান্তর। কারণ যে প্রেক্ষাপট নির্মাণ করছেন জীবনানন্দ সেখানে সময়-ধারণাটিই ফিকে হয়ে আসছে। ফলে অবনী পালিতের ভূমধ্যসাগরের দিকে যাত্রা শুরু হয়েছিল কবে তা সময়ের নিরিখে অনির্দিষ্ট, ‘ভূমধ্যসাগরপারে কবে যে সে গিয়েছিল – কোনো এক বৈশাখের ভোরে’। কিন্তু প্রথম পঙক্তি’তেই জীবনানন্দ স্থির করে দিচ্ছেন অবনী পালিতের মূল প্রোথিত হয়ে থাকবে বাংলায়। অবনী পালিত ভূমধ্যসাগরপারে যাবে, কিন্তু সে সঙ্গে বহন করে নিয়ে যাবে তার বাংলাকে।
অবনী পালিতের ‘অবনী পালিত’ হয়ে ওঠা ও মৃত্যুর জন্য সব থেকে আগে প্রয়োজন নিভৃত এক ‘স্পেস’। সে স্পেসের মধ্যে ঘুরে ঘুরে ক্রমশ মৃত্যুকে আহ্বান করবে অবনী পালিত; ‘অগণন লস্করের’ মধ্যে সে আবিষ্কার করবে, অবিশ্বাস করতে শুরু করবে ‘নিজের এমন নিচে নিরয়ে গমন’ এবং ‘অগণন লস্করের এরকম হিরন্ময় আগুনের প্রবাহের থেকে / কী করে প্রসূত হয় নরকের শূকরের মতো কালিমায়’।
অবনী পালিতের জন্য এই স্পেস নির্মাণ করে দিয়েছিলেন জীবনানন্দ, তিনি লিখছেন, ‘বন্ধুরা জানেনি কেউ – গুহার ভিতর থেকে গ্যানেট যখন নিরুদ্দেশে
উড়ে যায় – সবের বিস্মিত চোখে নিজেকে সে সেরকম করে
উড়ায়ে অনেক দূর নিয়ে গেল (ভেবেছিল হয়তো বা) – তবু তাকে
দেখেনিকো কেউ দেখিতে চায়নি কেউ হাঁড়ির ভেতরে
মুখ দিতে গিয়ে বিড়ালের চোখে ঘুম আসে
তার কথা মনে হলে – ’ (অবনী পালিতের মৃত্যু)
-অবনী পালিতের চারপাশে ক্রমশ নির্মিত হচ্ছে নির্জনতার বর্ম; সামাজিকতার ঠুনকো পরিসর ছেড়ে সে হয়ে উঠছে উড়ে যাওয়া এক পাখি। কিন্তু তার উড়ে যাওয়াটি কি প্রকৃত-ই তাকে ‘দূরে’ নিয়ে যেতে সমর্থ হয়েছিল? স্থানিক অবস্থান কি এক সময়ে গৌণ হয়ে আসে শিল্পীর কাছে? আদপে কি এটিই সত্যি যে শিল্পের থেকে শিল্পী দূরে উড়ে যেতে সমর্থ হন না কোনওদিন! সে ইঙ্গিত স্পষ্ট হয়ে উঠছে, কারণ জীবনানন্দ লিখছেন, ‘(ভেবেছিল হয়তো বা)’।
এরপরের অংশ, যেখানে অবনী পালিতের অভিযাত্রাটিকে আরও বিস্তৃতভাবে আমাদের সামনে তুলে আনছেন জীবনানন্দ, অতি-গুরুত্বপূর্ণ।
অবনী পালিত’কে কি অক্টোপাশের মতো ঘিরে ধরতে শুরু করেছিল নিঃসঙ্গতা ও শূন্যতা? এ শূন্যতা কি শিল্প ও শিল্পীর অনিবার্য অর্জন ও নিয়তি? এ শূন্যতাকে পেরিয়েই কি শুরু হয় শিল্পীর সফর? তিনি লিখছেন, ‘- অতএব বোম্বাইয়ের শূন্য টার্মিনাসে / পিছনে সে রেখে গেল একান্ত জিরোর মতো ঢেউ’।
শিল্পের ক্ষেত্রে ‘স্কুলিং’ কতটা প্রয়োজনীয়? শিল্পের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত স্কুলিং কি ঘাতক হয়ে ওঠে একদিন?
অবনী পালিতের ক্ষেত্রে বিষয়টি প্রায় তার কাছাকাছি ঘুরতে শুরু করে, কারণ আমরা পেয়ে যাচ্ছি, ‘বিশ্রী এক চিত্রকর – স্কুলহীন – নিষ্প্রাণ গল্পিক অনর্গল / জাহাজের দুলুনিতে যখন চতুর্দিকে নক্ষত্রের নীলাভ সিলিঙ / কেঁপেছিল – চুলের ভিতরে তার জেগেছিল ছাগলের শিঙ’। এ অংশটি পড়বার পর কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকতে হয়, আবার পাঠের কাছে ফিরে যেতে হয়; আবার স্তব্ধ হয়ে থাকতে হয়। ক্রমশ একটি প্রশ্ন আচ্ছন্ন করে ফেলে – স্কুলহীন হবার কারণে বিশ্রী এক চিত্রকর ‘হয়ে ওঠার’ পথটিই কি তাকে সমর্থ করে তোলে নক্ষত্রের নিলাভ সিলিঙের পরেই চুলের ভেতর জেগে ওঠা ছাগলের শিঙ আবিষ্কার করতে? স্কুলিঙের পরিশীলন কি তাকে এ গ্রটেস্ক, মৌলিক বিষয়টির থেকে দূরে টেনে নিয়ে যেত?
এরপর অবনী পালিত ঢুকে পড়েছিলেন সমুদ্রে ভাসা এক ইনফার্নোর মধ্যে, একটি জাহাজ, ধিকধিক করে জ্বলতে থাকা তুষের আগুন বুকে নিয়ে দুলে চলা একটি জাহাজের জরায়ুর ভেতর বসে অঙ্গার দাঁতে চেপেছিল অবনী পালিত।
তারপর একদিন, বহুদিন পর ভূমধ্যসাগরপারে এক সকালে একটি ছবি আঁকার প্রগাঢ় বাসনার মধ্যে এসে বসেছিল কয়েকটি মাছি। যাবতীয় জাগতিক বিষয়ের অতিকায় ছায়া লম্বা হয়ে উঠেছিল ক্যানভাসে।
অবনী পালিতের মৃত্যু ঘটেছিল; কিন্তু মৃত্যুর কারণ নিয়ে দ্বন্দ্ব ঘোচেনি। এ মৃত্যু কি শিল্পের কাছাকাছি বসে থাকা শিল্পীর অনিবার্য ‘শারীরিক’ মৃত্যু? না কি এ মৃত্যু এক ব্যক্তিমানুষের শিল্পের কাছে থেকে দূরে চলে যাবার কারণে ঘনিয়ে ওঠা?
অবনী পালিত বাংলার পাললিক মৃত্তিকার গন্ধ-মাখা, কিন্তু তার মৃত্যুর দু’-দিকে অবস্থান করছেন দু’-জন।
একজন জীবনানন্দ এবং অপরজন ক্লদ মোনে।
প্রায় লক্ষ্য’ই করা যাবে না এমন সাবধানে ও সংযমে জীবনানন্দ লিখে রাখলেন, ‘মানে বা মোনে-র মতো শিল্পীকে মরে গেছে দেখে খুন-খুন হয়ে হাসে’। বাংলার জলে ফুটে থাকা কলমি-শালুকের মধ্যে কি জীবনানন্দ আবিষ্কার করেছিলেন ক্লদ মোনে’কে? অথবা মোনে’র কোবাল্ট-নীল কি প্রবেশ করেছিল ঠিক একই পথ ধরে জীবনানন্দের রক্তে? একের পর এক ওয়াটার-লিলির সামনে বসে মনে হয় মৃত্যুর বেশ কয়েকটি রঙ আছে; তার মধ্যে একটির রঙ অতি-অবশ্যই নীল। এ মৃত্যু জীবনের কাছে ঘুরে বেড়ায়, তার সঙ্গে খেলা করে,
‘কোথাও মাঠের কাছে – যেইখানে ভাঙা মঠ নীল হয়ে আছে
শ্যাওলায় – অনেক গভীর ঘাস জমে গেছে বুকের ভিতর,
পাশে দীঘি মজে আছে…’ (কোথাও মঠের কাছে / রূপসী বাংলা)
-জীবনানন্দ মৃত্যুর এই ‘নীল রঙ’টিকে চিনতেন ও জানতেন; কিন্তু সে নীলের দিকে তাঁর বারবার ঢলে পড়ার পিছনে কি রয়ে গেছে মোনে’র অমোঘ ‘নীল’? না কি এ নীল পৃথিবীর দু’-প্রান্তে দু’-জন মানুষ’কে তাড়া করে বেড়ানো মৃত্যু ও তার ‘নিছক’ সমাপতন?
জীবনানন্দের কবিতায় ‘আশ্চর্য’ সব উপাদানের সম্মিলন আজও বহুলাংশে অনাবিষ্কৃত। মোনে’র কথা তিনি নিজেই কবিতায় উল্লেখ করেছেন; এর মাধ্যমে কি তিনি পথ খুলে দিয়েছিলেন, ইঙ্গিত করেছিলেন যে তিনিও আসলে এক ‘কুহক-চিত্রকর’… ক্লদ মোনে থেকে পল সিজান… তিনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন এক বিস্তীর্ণ সাভানার মধ্যে?
‘আট বছর আগের একদিন’ ১৩৪৪ এর চৈত্রে ‘কবিতা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। কবিতাটি শুরু হয়েছে ‘শোনা’ কথা থেকে; এই আকস্মিকতা ছাড়া বিষয়টি শুরুই হতে পারত না।
‘জেগে’ থাকবার মধ্যে যে গাঢ় বেদনার ভার রয়েছে তার করাল থাবা থেকে মুক্তি পেতেই যে মানুষটি অশ্বথের কাছে একগাছা দড়ি হাতে চলে গিয়েছিল সে নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু চারদিকে জীবনের সফেন স্রোতের মধ্যে বাঁচতে বাঁচতে কেন একজন মানুষকে আক্রমণ করে সে ভার? কেন ‘সুপক্ব যবের ঘ্রাণ হেমন্তের বিকেলের’ অসহ্য হয়ে ওঠে একজন মানুষের কাছে?
আলবেয়ার কামু তাঁর ‘মিথ অফ সিসিফাস’-এ লিখছেন,
‘There is but one truly serious philosophical problem, and that is suicide. Judging whether life is or is not worth living maounts to answering the fundamental question of philosophy. All the rest – whether or not the world has three dimensions, whether the mind has nine or twelve categories – comes afterwards’
– দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় ‘আত্মহত্যা’ হতে পারে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও তাঁর একটি কথার সঙ্গে দ্বিমত হবার অবকাশ নেই, ‘what is called a reason for living is also excellent reason for dying’
– সমস্ত ‘কারণ’ অতিক্রম করে এখান থেকে হয়তো জন্ম নিতে থাকে ‘বিপন্ন বিস্ময়’।
‘আট বছর আগের একদিন’ আসলে জীবনের সমস্ত ‘কারণ’কে অতিক্রম করে গিয়ে জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে গড়ে ওঠা ধূসর পাঁচিলটিকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবার শিল্প। জীবনানন্দ বারবার ইশারা রেখে গেছেন একমাত্র মানুষের স্নায়ুর ভেতরেই সম্ভবত লুকিয়ে থাকে, জন্ম নিতে থাকে সে বিপন্ন বিস্ময়। গলিত স্থবির ব্যাং আরো দুই মুহূর্তের ভিক্ষা প্রার্থনা করে, রক্ত ক্লেদ থেকে রৌদ্রের দিকে মাছি উড়ে যায়, দুরন্ত শিশুর হাত থেকে জীবনের আরও দু-একটি প্রহর ছিনিয়ে নেবার জন্য প্রাণপণ লড়াই করে চলে ফড়িঙ। কিন্তু মানুষের মাথার ভেতর, স্নায়ুর ভেতর আরও অনেক অন্য খেলা। এমনকি কোনও ‘ইন্সটিংক্ট’ও তার আত্মহত্যাকামী সত্তাটিকে অধিকার করতে পারে না। এ কবিতাটিতে অশ্বথের দিকে চলা যাওয়া মানুষটির যৌনতা ছিল, জীবনানন্দের কবিতার ক্ষেত্রে দুর্লভ সুস্থির নারী ছিল; কিন্তু সবকিছুর উপরে স্থির হয়েছিল আত্মহত্যার অনিবার্যতা।
কবিতাটির রুদ্ধশ্বাস চলনের মধ্যে একটি বিষয় আমাদের নজর এড়িয়ে যায়; অনন্ত প্রশ্নের সঙ্গে ছুটে চলেছে অব্যর্থ কিছু ‘উত্তর’ ও আপাত-সমাধান। কবিতাটির শরীরে ছেয়ে থাকা কূট প্রশ্নের পাশে অবস্থান করে এসব আপাত-সমাধান তীব্র কনট্রাস্ট তৈরি করছে। যেন এক মহাস্থপতি প্রথমে নির্মাণ করছেন প্রকাণ্ড স্ট্রাকচার… নিজেই বিস্মিত হচ্ছেন তার দিকে চেয়ে। সে বিস্ময় থেকে উদ্ভুত প্রশ্নের উত্তর ও আপাত-সমাধান মিলে তৈরি হচ্ছে grandeur।
একদম প্রথম দিকে প্রশ্ন ছুটে গিয়েছিল, ‘প্রেম ছিল, আশা ছিল – জ্যোৎস্নায়, – তবু সে দেখিল / কোন ভূত? ঘুম কেন ভেঙে গেল তার?’
কামু প্রশ্ন তুলে দিয়েছিলেন, ‘Does the Absurd dictate death?’
সে অ্যবসার্ডিটির সামনে বিমূঢ়ের মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন জীবনানন্দ বেশ কিছুটা সময়; এটা সত্যি। কিন্তু এটিও সত্যি, তিনি অতি-সংগোপনে কিছু reasons-কেও খুঁজে চলেছিলেন, কারণ একই কবিতায় তিনি লিখছেন,
‘আনি – তবু জানি
নারীর হৃদয় – প্রেম – শিশু – গৃহ – নয় সবখানি;
অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয় –
আরো এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে;’
-কী সেই বিস্ময় তিনি চিহ্নিত করতে পারছেন না (বা হয়তো চাইছেন না)। তিনি একের পর এক যে সব ‘ফ্যাক্টরস’গুলিকে বাতিল করতে করতে অগ্রসর হচ্ছেন সেগুলিই এক একটি reason।বিমূঢ় অবস্থা থেকে সচেতনতার স্তরে গিয়ে তিনি একে একে তাদের বাতিল করে দিয়ে নিজেকে আরও বিমূঢ় করে তুলছেন। এ এক অনন্ত খেলা। অথবা সে বিস্ময়টিকে চিহ্নিত করা সম্ভবপর নয়; কারণ একবার চিহ্নিত হয়ে গেলে সে আরও অধিকতর জটিল বিস্ময়ের জন্য দেবে।
কিন্তু যে অবনী পালিতের মৃত্যু দিয়ে এ লেখার শুরু হয়েছিল, যে মৃত্যুর দু’-দিকে অবস্থান করছিলেন জীবনানন্দ ও ক্লদ মোনে, ‘আট বছর আগের একদিন’-এ এসে আরেকটি মৃত্যুর (আত্মহত্যা) একপ্রান্তে ক্লদ মোনে’র জায়গাটিতে কি এসে বসলেন পল সিজান?
প্যারিসের উত্তরে একটি ছোট শহরে বসে পল সিজান ১৮৭৩ সালে এঁকেছিলেন একটি ছবি; ছবিটির নাম The House of Hanged Man।
ছবিটির ডান-দিকে অনুচ্চ টিলা, সারফেস একটু ডিপ হয়ে ধারণ করে রয়েছে একটি বাড়ি। হলুদ, ধূসর ও সবুজের শান্ত সন্ত্রাস; ক্যানভাসের ডান-দিক থেকে একটি রাস্তা চলে গেছে বাম-দিকে। রয়েছে আরও অনেকগুলি পথের ইশারা।
বাড়িটির পিছনে গাছ, কিন্তু সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে দুটি শীর্ণ পাতাঝরা বৃক্ষ ক্যানভাসের আরও গভীরে দিগন্ত ও টিলার ইশারা। চিমনি। জানালা ও দরজার ইশারা। ক্যানভাসে আলোর অভাব নেই; কিন্তু এই আলো-ভাসা ক্যানভাসে যেন ওঁৎ পেতে রয়েছে হলুদ-মৃত্যু। ‘অকারণ’ মৃত্যুর স্তব্ধতা নিয়ে স্থির হয়ে রয়েছে চরাচর। শান্ত, অতি-শান্ত এক মৃত্যু ঘটে গেছে বলে মনে হয় কোথাও। ছবিটি দেখতে দেখতে হঠাৎ আবিষ্কার করা যায়, দূরের যে ঘরবাড়ি, অস্পষ্ট ঘরবাড়ি তার মাথার উপর, চিমনির কাছ বরাবর লালাভ স্ট্রোক।
যেন সেখানে যৌনতা ও জীবনের সহজ উৎসব এখনও খেলা করছে, ‘বিপন্ন বিস্ময়’ থেকে দূরে অবস্থান তাদের। ঠিক ‘আট বছর আগের একদিন’ যে জুড়ে যে চিত্রনাট্য, যা অভিনীত হয়ে চলেছে কবিতাটি জুড়ে, এখানেও ঠিক একই চিত্রনাট্য। সে রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা করছে অভিনীত হবার জন্য।
ছবিটির মধ্যে চূড়ান্ত দুষ্প্রবেশ্যতা নেই; কিন্তু মরবিডিটির সুউচ্চ মিনার রয়েছে। আকাশ-চাঁদোয়া নীল, সে যেন ধীরে ধীরে নিজের নীল রঙটুকু শুষে নিতে চাইছে।
ছবিটিতে কোনও মানুষ নেই, মানুষের ঘরবাড়ি রয়েছে। প্রকৃতি রয়েছে; পারপারহীন মৃত্যু রয়েছে। জীবনের গাঢ় প্রকাশের কাছে, একই সূত্র মেনে রয়েছে মৃত্যুর স্তব্ধতা।
সিজানের তুলির অসম্ভব শক্তিশালী স্ট্রোকের সামনে দাঁড়িয়ে, ছবিটির নামের ভেতর লুকিয়ে থাকা রহস্যের দিকে তাকিয়ে বারবার মনে হতে বাধ্য, কেন সে মানুষের মৃত্যু এ বাড়ির ভেতর ঘটে গিয়েছিল?
কোনও উত্তর যে পাওয়া যাবে না সেটা নিশ্চিত; শুধু সেই ‘অবনী পালিতের মৃত্যু’ কবিতায় উল্লেখিত গ্যানেট ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে উড়ে যাবে মাঝরাতে।
‘অবনী পালিতের মৃত্যু’, ‘দ্য হাউস অফ হ্যাংগড ম্যান’, ‘আট বছর আগের একদিন’ অনতিক্রমনীয়। তারা বারবার তাদের রহস্য নিয়ে ঘুরে বেড়াবে আমাদের কাছে। শুধু আমাদের মতো মরজগতের মানুষের মনে প্রশ্ন জাগবে মাঝেমাঝে – দ্য হাউস অফ হ্যাংগড ম্যান ছবিটির অস্তিত্ব সম্পর্কে কি অবগত ছিলেন জীবনানন্দ? না কি জীবনের বিপন্ন বিস্ময়ের রূপ এমনই শাশ্বত, যা একইভাবে ছুঁয়ে থাকে সিজান ও জীবনানন্দ’কে!