‘মুখোমুখি শঙ্খ ঘোষ- অগ্রন্থিত-অপ্রকাশিত’ – আশ্চর্য আয়োজন
পার্থজিৎ চন্দ
গতবছর অগাস্টে (২০২২) প্রকাশিত হয়েছিল ‘পাঠকই কবিতা’র বিশেষ সংখ্যা ‘মুখোমুখি শঙ্খ ঘোষ’। সম্পাদনা করেছেন বিশিষ্ট কবি সন্দীপন চক্রবর্তী। এই বইটি সাম্প্রতিক সময়ে আমার সঙ্গী হয়ে উঠেছে। শঙ্খ ঘোষের প্রায়-দুর্লভ সাক্ষাৎকারগুচ্ছ-বিচিত্র সব বিষয়ে তিনি সারজীবন যা বলেছেন, যা বিশ্বাস করেছেন, যে দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, যে মনন ও প্রজ্ঞার ঐশ্বর্য রেখে গেছেন- সন্দীপন দু-মলাটের ভেতর তিনশো-আটান্ন পৃষ্ঠার পরিসরে তা আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন। বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের একজন হয়ে প্রথমেই এমন একটা অসামান্য কাজের জন্য সন্দীপন’কে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে রাখি।
শঙ্খ ঘোষের কবিতার মূল্যায়ন করার জায়গা এটি নয়; শুধু বলে রাখা জরুরি, তাঁর মতো উচ্চতার কবি ও চিন্তকের অভিন্নতা বাঙালির কাছে দিনে দিনে দুর্লভ হয়ে আসছে। একই সঙ্গে সূক্ষ্ম অনুভূতি ও অকাট্য যুক্তি, মৌলিক স্রষ্টা ও বিশেষজ্ঞ পাওয়া কঠিন। আমাদের সৌভাগ্য যে আমরা অত্যন্ত সংকটের সময়ে শঙ্খ ঘোষ’কে পেয়েছিলাম।
এই ‘পেয়েছিলাম’ শব্দটি লেখার সঙ্গে সঙ্গে একবার থমকে যাই, কেন ক্রিয়াপদের অতীতরূপের ব্যবহার হল? এই যে সাক্ষাৎকারগুলি একের পর এক পড়ে চলেছি; এই যে এক একটা রত্নখনির সন্ধান পাচ্ছি প্রায়-প্রতিদিন সেখানে কি তিনি চিরজীবিত নন? তিনশো আটান্ন পৃষ্ঠার এই গ্রন্থটি পাঠ করার মধ্যে দিয়ে কি অনুধাবন করা সম্ভবপর নয় যে আলো-অন্ধকারের ভেতর অন্তত একজন মানুষ… স্রষ্টা… জাগ্রত ছিলেন?
সংখ্যাটিকে পাঁচটি অংশে বিভক্ত করেছেন সন্দীপন, অত্যন্ত সুচিন্তিত এই বিভাজন। এখানে শঙ্খ ঘোষের নিজের ‘নেওয়া’ সাক্ষাৎকার রয়েছে চার’টি, শঙ্খ ঘোষের সাক্ষাৎকার রয়েছে ছাব্বিশ’টি।
শঙ্খ ঘোষের রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে দেওয়া সাক্ষাৎকার রয়েছে ছয়’টি। আর রয়েছে তিনটি ইংরেজি’তে দেওয়া সাক্ষাৎকার, এবং একটি অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকার।
সম্পাদক প্রথমেই উল্লেখ করেছেন, সাক্ষাৎকারগুলিকে যথাসম্ভব কালানুক্রমিকভাবে বিন্যস্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে।
এই সংখ্যাটি শুরু হচ্ছে যে সাক্ষাৎকারটি দিয়ে তা বেশ মজার; আসলে এমন ঘটনা ঘটেনি বাস্তবে। কিন্তু মানুষ যতদূর কল্পনা করতে পারে ততদূরই বাস্তবতার সীমানা। এখানে শঙ্খ ঘোষ সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন রবীন্দ্রনাথের। সাড়ে-চারপাতার এই কাল্পনিক সাক্ষাৎকারে শঙ্খ একাধারে প্রশ্নকর্তা ও উত্তরদাতা, বলাইবাহুল্য। কিন্তু আশ্চর্যের, এটি পড়তে গিয়ে কোনও সময়েই রবীন্দ্রনাথের উত্তরগুলি ‘আরোপিত’ মনে হয় না। যে গদ্যরীতি’তে রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ লিখিত, নাটকের সংলাপ লিখিত ঠিক সেই রীতিতে উত্তর দিচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ। যেমন ‘শঙ্খ’র একটি প্রশ্নের উত্তর ‘রবি’ বলছেন, ‘…ওকে একবার লিখেছিলুম, যেসব কথা একবার বলা হয়ে গেছে তাতে জল মিশিয়ে আবার নূতনভাবে পরিবেশন করা একরকমের সাহিত্যিক দুর্নীতি।’ যখন মনে হয় এ সাক্ষাৎকার ‘প্রকৃত’ হলে ঠিক এ কথাগুলিই বলতেন রবীন্দ্রনাথ, তখন আরেকটি প্রশ্নের উত্তরের দিকে নজর পড়তে বাধ্য। অযোধ্যা ও রাম নিয়ে প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে তিনি উত্তেজিত, বলছেন, ‘একটা দেশ, যুগ-যুগ ধাবিত যাত্রী নিয়ে এই আশ্চর্য একটা দেশ্, সেখানে মানুষের আজ এমনই মতি হল যে সকলের হৃদয়ের রামকে এনে বসাতে হল ইটকাঠের খাঁচায়? আর, সেইজন্যে তোমাদের চোখের সামনে ওরকম একটা গরিমাময় স্থাপত্যকে চূর্ণ করে দিল নিমেষে? এও যদি বর্বরতা না হয় তো বর্বরতা আর কোথায় আছে?’
তাঁর বিভিন্ন সময়ে দেওয়া সাক্ষাৎকারগুলির সবকটিই একাধিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ। বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও চিন্তকদের অধিকাংশের মধ্যে চিন্তার ধোঁয়াশাই প্রধান সাদৃশ্য। সেখানে শঙ্খ স্বচ্ছ, যুক্তিপূর্ণ। তাঁর যুক্তির সঙ্গে কোনও বিরল মুহূর্তে দ্বিমত পোষণ করা গেলেও ব্যক্তি-অবস্থান থেকে তাঁর যুক্তি ও ‘দেখা’র ঋজুতা নিয়ে কোনও প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। প্রিয়লাল রায়চৌধুরী’র নেওয়া ‘আবৃত্তি’ বিষয়ে একটি সাক্ষাৎকারে তার নজির পাওয়া যায় আবার। পর পর তাঁর দুটি উত্তরের কিছুটা উদ্ধৃত করা যাক, আধুনিকতা ইত্যাদি বিষয়ে বলতে গিয়ে তিনি স্পষ্ট বলছেন, ‘পুরানো দিনের কবিতায় প্রগলভতা, বাড়িয়ে চলার প্রবণতা এতটাই ছিল যে কোনো কোনো কথা মন ছুঁয়ে গেলেও শেষপর্যন্ত তা আর মনকে ধরে রাখতে পারে না। রবীন্দ্রনাথের একটা বড়ো অংশের লেখায় এই অসুবিধেটা আছে। কবিতায় অনেক সময় তিনি বাড়িয়ে চলেন। তাঁর গানে এটা নেই, তাই তাঁর গান অনেক বেশি আধুনিক লাগে’।
রবীন্দ্রনাথ’কে নস্যাৎ করে দেওয়া অথবা ‘দেবতা’ বানিয়ে তোলা বহু গুরুগম্ভীর সন্দর্ভ লিখিত হয়েছে; কিন্তু কোথাও এত স্পষ্টভাবে এ কথাটি পাওয়া যায় না। এ সাক্ষাৎকারেই আবৃত্তি পারফর্মিং আর্ট হিসাবে কতদূর সফল হতে পারে সে নিয়ে তিনি যা বলেছিলেন তা ধোঁয়াশা কাটানোর পক্ষে যথেষ্ঠ। আবৃত্তি নিয়ে এত স্পষ্ট ও যুক্তিগ্রাহ্য মতামত’ও আমার পাঠের বাইরে, ‘সম্ভাবনা নিশ্চয় অনেকদূর। এতে কবিতার সুবিধেই হবে। পড়ার চাইতে দেখার আর শোনার ঝোঁকটাই এখন নানা কারণে বেশি। এই কারণে চলচিত্র এখন সব চাইতে প্রিয়। কবিতাকে যদি কানে শোনাবার যোগ্য করে তোলা যায় তাতে কবিতার সঙ্গে পাঠকের যোগাযোগের সম্ভাবনা বাড়ে। কিন্তু বাইরের ভঙ্গিটায় জোর পড়লে সে-সম্ভবনা কমেই আসে।’
শঙ্খ’র মতো উচ্চতার একজন কবি ও চিন্তকের সারাজীবনই আসলে নিজেকে তিলে তিলে গড়ে তোলবার ভিত্তিভূমি। একজন তরুণ কবির আত্মবিশ্বাস, যুক্তি এবং সর্বোপরি প্রতি-মুহূর্তে শিক্ষাগ্রহণ করবার প্রক্রিয়া যে কীভাবে ক্রিয়াশীল থাকে তাঁর জীবন সে নিদর্শন বহন করে চলেছে। সেই কবে সন্দীপন চক্রবর্তী, তাপস চক্রবর্তী ও ইমানুল হক-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকার পড়তে পড়তে তার সন্ধান পেতে পারেন পাঠক। বানানবিধি নিয়ে শঙ্খ’র নিজস্ব যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য ছিল। এ-সাক্ষাৎকারে তেমনই এক প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। নিজের নামের বানান নিয়ে শঙ্খ ও বুদ্ধদেব বসুর মধ্যে ঘটে যাওয়া একটি চমৎকার ঘটানার সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে; শঙ্খ’র নিজের বয়ানে পড়া বিশেষ প্রাপ্তি বটে, ‘কবিতার পাণ্ডুলিপি হাতে নিয়ে বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেনঃ ‘নিজের নামের বানান ভুল লেখো কেন?’ ঙ আর ং-এর ব্যবহার বিষয়ে ‘চলন্তিকা’য় শেষ দিকে যে একটা নির্দেশ দেওয়া আছে, দেখে নিতে বলেছিলেন সেটা। বলেছিলেন ‘সংগীত’ লেখা যায়, কিন্তু ‘সংগে’ না। তেমনি ‘শংকর’ হয়, কিন্তু শংখ’ হয় না। …বলে বসলামঃ ‘চলন্তিকার ওই পৃষ্ঠাগুলি আমার জানা। সেই নিয়ম অনুযায়ী শংখ না হবার তো কোনো কারণ নেই।’ অবাক বুদ্ধদেব বললেন, ‘কীভাবে?’ বলিঃ ‘আগে ম থাকলে সেটা অনুস্বর হয়ে যাতে পারে তো? শম্+কর যেমন শংকর, তেমনি শম্ + খ হলে শংখ।’ ‘শম্ + খ? তার মানে কী হবে?’ ‘কেন, শান্তি দেয় যে আকাশ।’ বিচলিত বুদ্ধদেব তাঁর অবিন্যস্ত চুলে আঙুল চালাতে চালাতে বলতে থাকলেনঃ ‘এটা তো আগে ভাবিনি! ভাবতে হবে!’
তাঁকে ভাবিত অবস্থায় রেখে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসি আমি। এই কথাটা শুধু বলিনি তাঁকে যে, বলবার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত আমিও ওটা ভাবিনি, আচমকাই তৈরি হলো একটা ওজর। আর সেই মুহূর্ত থেকে আজও পর্যন্ত, জীবনে আর কখনো ‘শংখ’ লিখিনি আমি, শঙ্খ’ই লিখি।’
বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে এ-ঘটনাটির আরেকটি উচ্চতর, মহত্তর আবেদন আছে। সন্দীপনের অসামান্য কাজ সে ভাবনার কাছে আমাদের আসতে বাধ্য করল। যে আধুনিকতা আমাদের ওজর-সম যুক্তিকেই অকাট্য যুক্তি বলে ভাবতে শেখায়, বিজয় বলে গণ্য করতে শেখায় শঙ্খ সে বিষবাষ্পের বিষয়ে তরুণ বয়স থেকেই সচেতন ছিলেন। ওই যে তিনি ‘কনফেস’ করলেন, উচ্চারণ করলেন ‘ওজর’ শব্দটি- ওখানেই তাঁর সত্তার প্রকৃত সন্ধান পাওয়া যায়।
এ গ্রন্থের প্রতিটি লাইন বারবার পড়তে পড়তে মনে হয় শঙ্খ’র উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ আসলে বহুত্বকে আত্মস্থ করবার, সমস্ত রকম ফান্ডামেন্টাল ধারণা থেকে নিজেকে মুক্ত করবার প্রক্রিয়া। সবার জানা, শঙ্খ ঘোষ রবীন্দ্রকবিতার একটি সংকলন করেছিলেন, ‘সূর্যাবর্ত’। এই গ্রন্থটি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার শেষ ছিল না। কেন্ তিনি ‘ভারততীর্থ’, ‘দেবতার গ্রাস’ ইত্যাদি কবিতাকে সংকলনে রেখেছেন তার পক্ষে বলতে গিয়ে তিনি যা বলেছিলেন তা আসলে শিল্পের অন্যতম শর্ত। এই ধারণ-ক্ষমতা ছাড়া শিল্পের অন্দরমহলে প্রবেশ করা যায় না; তিনি বলেছেন, ‘(বুদ্ধদেব বসু) নানা ধরণের কবিতার কথা বলেছিলেন যেখানে, সেটি মনে করতে বলি। কেউ কেউ ভাবতে পারেন, সেখানে বর্ণিত একেবারে চূড়ান্ত সিঁড়ির লেখাটি ছাড়া আর কিছুই ধর্তব্যের মধ্যে নয়। আমি সেরকম ভাবি না। তাই অনেক-রকম কবিতাই ভালো লাগে আমার’।
বাংলাভাষার জন্য প্রদত্ত প্রায়-সব সাহিত্য পুরস্কার তাঁর হাতে অর্পিত হয়েছে; কিন্তু একজন তরুণ কবির কাছে ধ্রুবতারার মতো হয়ে উঠতে থাকে তাঁর কথা, যখন পুরস্কার-প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘পুরস্কারের উপর নির্ভর করে যে-পড়াটা, সেই পড়াটা বেশি দিন থাকে না। এমনকি রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেও থাকেনি। এটা কয়েক দিনের জন্য, কয়েক মাসের জন্য থাকে, বড়োজোর কয়েক বছর।… গোটা সাহিত্যসমাজের আবহাওয়াটা কলুষিত করছে এই পুরস্কারব্যাবস্থা। ’৫০ সালের আগে বাংলা সাহিত্যে কোথাও পুরস্কার ছিল? তাতে কি কারো পড়া আটকেছিল?’ (কথোপকথনে- সন্দীপন চক্রবর্তী)
-এ গ্রন্থের পাতায় পাতায় একজন প্রধান কবির আশ্চর্য সফর লুকিয়ে রয়েছে; শঙ্খ ভারত-ভবন থেকে মার্কসবাদ, হিন্দু-মুসলিম মৌলবাদ থেকে স্বাধীনতার পর সতীনাথ ভাদুড়ীর রাজনীতি ছেড়ে দিয়ে বিকল্প পথের সন্ধান- ভারত-সন্ধানে, বিশ্ব-ইতিহাস ও সমকালীন রাজনীতির চরিত্র বোঝার জন্য কোণে কোণে ঘুর বেড়িয়েছেন। লক্ষ করার, প্রশ্নকারীর প্রশ্নটিকে জাস্টিফাই করাবার কোনও সচেতন প্রয়াস তাঁর মধ্যে ছিল না। আরও বড় বিষয়, তিনি প্রশ্নকারীর বিরুদ্ধ অবস্থান নিয়েছেন; এমনকি প্রচলিত ধ্যানধারণার বিরুদ্ধেও দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু অশ্লীল চিৎকার করে নিজের ‘সত্যি’টা বোঝাতে হয়নি তাঁকে। ভনিতাহীন ধ্রুপদী ভঙ্গি’ই তার ‘অস্ত্র’, আয়ুধ।
এ গ্রন্থ পাতায় পাতায় ছড়িয়ে রয়েছে সেই সত্য- একজন কবির দায় নেই ক্ষমতা বা ব্যক্তি’কে ‘খুশি’ করার।
সন্দীপন বিশিষ্ট কবি, সম্পাদক। তাঁর কবিতা ‘পুরস্কারের’ সীমা পার করে গেছে। ফলে সেটি নিয়ে আলোচনা করা অপ্রাসঙ্গিক। কিন্তু, শঙ্খ ঘোষের কথা মাথায় রেখেও বলার, এই চমৎকার সংখ্যাটিকে ছড়িয়ে দেবার দায়িত্ব কি গ্রহণ করেছে কোনও প্রতিষ্ঠান? বাংলা কবিতা নিয়ে যেসব প্রতিষ্ঠানের ‘কাজ’ করার কথা ছিল? জানি না; না-হলে অবিলম্বে হওয়া উচিত। কারণ, দায়টা সমসময়ের প্রতি যতটা, ভাবীকালের প্রতিও ততটাই।