মারী এবং রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতা <br />  শীর্ষা

মারী এবং রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতা
শীর্ষা

"কিন্তু, কবির কথায়, "মৃত্যু হাসে বসি।" ওই যে, "মৃত্যু সে ধরে মৃত্যুর রূপ/দুঃখ হয় হে দুঃখের কূপ "! তাই মৃত্যু যখন তার আপনার রূপ ধরে, প্রেম, মায়া, মোহ, বিরাগ, বিচ্ছেদ – সব মিলে মিশে এক অনস্তিত্ব না-থাকায় একাকার হয়ে যায়। অনন্ত সংসারকে আচ্ছন্ন করা 'চিরজীবী প্রেম' বিষণ্ণ দুচোখকে নোনতা অশ্রুর কুয়াশা দিয়ে ঢেকে দেয়। সেই বিষাদকুয়াশা শুধু মানুষের চোখ নয়, সমগ্র বিশ্বের প্রতিটি অন্তঃস্থলে নিজের অস্তিত্ব জানান দেয়।" রবিপক্ষ। লিখলেন শীর্ষা।

‘যেতে নাহি দিব’ – শব্দ তিনটি যেন এক অনন্তযুদ্ধের আহ্বান। গভীর। সকরুণ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিতাটি লিখেছিলেন ১২৯৯ সালে। আজ ১৪২৮। আজও শব্দ তিনটি সমান প্রাসঙ্গিক। বিশেষত এই মারীর আবহে। বলাই বাহুল্য, আগামীর শ’খানেক বছর পরেও এই কবিতার প্রাসঙ্গিকতার মেঘ সামান্যতমও হালকা হবে না – এ যে আমাদের গহীন সত্তায় বরফের মতো দানা বেঁধে থাকা এক অমোঘ ব্যথার নিদারুণ দাবি।
কবিতাটা আমি প্রথমবার পড়ি শিক্ষাসত্রে পড়াকালীন। ক্লাস নাইন তখন। কখনো সোনাঝুরিতলায় ক্লাস হত। কখনো অফিসের আড়াআড়ি জামতলায়। বিশ্বভারতীর বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ক্লাসের চারদিক খোলা। মাথার ওপরে ‘মহানভ অঙ্গন’। আসনের পাশে হাওয়ার দোলায় আমার সঙ্গী হয়ে ক্লাস করছে সোনাঝুরির হলুদ রেণু। বাতাসের মৃদুমন্দ তাড়না আলাদা করছে সোনাঝুরির হলুদ পাপড়িকে। বৃক্ষপিতা থেকে। আর পিতার গহীন থেকে প্রতিবার ধ্বনিত হচ্ছে “যেতে নাহি দিব” – করুণ অন্তর ঠেলে বুদ্বুদের মতো বেরিয়ে এসে আবারও বুদ্বুদ হয়েই মিলিয়ে যাচ্ছে। অস্তিত্বহীন হয়ে যাচ্ছে। শব্দ তিনটি কি তাহলে নিছকই রাবীন্দ্রিক ? না, শব্দ তিনটি নেহাতই মধুর বাংলা ভাষার এক মধুমাখা কবিতা নয়, বরং এক অমোঘ সত্যের বিদ্যুৎ। যা ঝড়-তুফান-ঘূর্ণির কুরুক্ষেত্রে তলোয়ারের মতো ঝনঝনিয়ে ওঠে প্রত্যেক যোদ্ধার অন্তরাত্মা থেকে।
মনে পড়ে, সেই পনেরো-ষোলো বছর বয়সে প্রায় প্রতিদিন পড়তাম কবিতাটা। কবিতার প্রথমাংশে কবি বাড়ি থেকে বিদায় নেবার সময়ের কিছু খণ্ডচিত্র তুলে ধরেছেন। অশ্রুসিক্ত স্ত্রীর নীরবতাকে তুচ্ছ করে কবিতার প্রত্যেক পরতে আঁকা শিশু কবিকন্যার ব্যাকুল আবদার – “যেতে আমি দিব না তোমায়”। যা কবির যাত্রাপথের সর্বত্র প্রতিধ্বনিত হয়েছে। প্রকৃতির প্রত্যেকটি অঙ্গে এক যাতনার সুর, এক বিরহবাঁশির কান্না। এই অনন্ত চরাচরে বিচ্ছেদই একক সত্য যেন। গাছ তার পল্লবকে হারায়। পাখি তার ডানার পালক। মাটি তার ধূলিকণাকেও হারিয়ে ফেলে বাতাসে। আর মানুষ? মানুষ তো তুচ্ছ দাবাসৈনিক – অনন্তের আসা-যাওয়া তার স্থূল চোখে ধরা পড়ে না। যে বেদনার গাছ মানুষের জন্মের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে চোখ মেলে, মানুষ সেই বেদনাবৃক্ষের ছায়ায় খেলতে থাকা এক অবোধমাত্র। বেদনাবৃক্ষের শেকড় ধীরে ধীরে মাটি ছেড়ে ঢুকে পড়ে মানুষের শিরা-ধমনীতে। মানুষ নিজেই এভাবে এক আস্ত বেদনাবৃক্ষ হয়ে ওঠে। অজান্তেই। আর এই ব্যথার সঙ্গে সহবাস করতে করতে ক্ষয় হতে থাকে তার প্রেমের শক্তি।
“চরাচরে/কাহারে রাখিবি ধরে দুটি ছোট হাতে ” – কবিকন্যার প্রতি এই পংক্তিটি কি একটা চ্যালেঞ্জ? নাকি মানুষকে বুঝিয়েছেন কবি তার নিতান্ত গণ্ডিবদ্ধতার কথা? আজ এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে, করোনাকালীন সঙ্কটপূর্ণ পরিস্থিতিতে এসে মানুষ তো সত্যিই বুঝেছে তার গত্যন্তর না থাকার কথা। তার হাতদুটি যে সত্যিই ভীষণ ছোট! ক্ষুদ্র তৃণকে যেভাবে বুকে বেঁধে রাখেন মাতা বসুমতী, যেভাবে আয়ুক্ষীণ দীপশিখাকে আঁধারের গ্রাসে তলিয়ে যেতে দিতে চায় না দীপ – ঠিক সেরকমই মানুষের প্রয়াস। বন্যার মুখে ভেসে চলা শুকনো কাঠের মতো নিতান্তই এক ধরে রাখার চেষ্টা। বেঁধে রাখার কৌশল। অনন্ত। আদিম –
“এ অনন্ত চরাচরে স্বর্গমর্ত ছেয়ে
সব-চেয়ে পুরাতন কথা, সব-চেয়ে
গভীর ক্রন্দন, “যেতে নাহি দিব”।”
যে ক্রন্দন এই মহাবিশ্বের প্রতিটি অণু-পরমাণু বহন করে নিয়ে চলেছে। সৃষ্টির আদি থেকে। প্রেম এবং হারানোর ভয় – হাত ধরাধরি করে হেঁটে চলেছে। বৃত্তাকারে। আমাদের কেন্দ্র করে। যেভাবে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে যাবতীয় গ্রহ-গ্রহাণু। নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকে ইলেক্ট্রনের রাশি। সেভাবেই আমরা এক একটি নিউক্লিয়াস হয়ে উঠি। বুকের গভীরে ধনাত্মক আশা বেঁধে বেঁধে নিজেদের স্থিতিশীল রাখার পরম যত্নগাছটির গোড়ায় সার-জল দিই। প্রেম এবং হারানোর ভয়ের যে সূক্ষ্ম দ্বন্দ্ব আমাদের ধনাত্মক আশাকে ছিটকে কেড়ে নিতে চায়, তার প্রতি দৃষ্টিপাত করি না আমরা। বরং বিদ্রোহী প্রেম পরাভবের ঘুড়িকে ভোকাট্টা করে দিয়ে বলে –
“আমি ভালোবাসি যারে
সে কি কভু আমা হতে দূরে যেতে পারে।
আমার আকাঙ্ক্ষাসম এমন আকুল,
এমন সকল-বাড়া, এমন অকূল,
এমন প্রবল বিশ্বে কিছু আছে আর?”
এই আর্তি কি চিরন্তন নয়? বিদায় নেবার সময় কবি যে স্নেহের করুণ আর্তি তাঁর শিশুকন্যার মুখে আঁকা দেখেছিলেন, যে আর্তি যাত্রাপথের প্রতিটি প্রাকৃতিক উপকরণে ছড়ানো ছিল – সেই আর্তি কি আজও সমান প্রকট নয়? এই মারীর প্রকোপে আমরা অনেকেই হারাচ্ছি প্রিয়জনকে। কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই নেই হয়ে যাচ্ছে আমাদের প্রেমের আধার, প্রেরণার উৎস, জীবন নামক দুঃসহ কাঁটাপথের একান্ত সঙ্গীটি। তবে কি এই আর্তি প্রকৃতই চিরন্তন? অন্তহীন? কবি কি এটাই বোঝাতে চেয়েছেন যে হারানোর ভয়, যন্ত্রণা, একাকিত্বের সকল উপাদান মিলে মিশে দানা বেঁধেই প্রেমের অলিন্দ তৈরি হয়? সেই পিঞ্জরনিবাসে প্রিয়তমের বসত – কোন চিরন্তন শর্ত নয়। হারানোর ভীতিই যেন একমাত্র শর্ত। হারানোর ভীতিই যেন সেই নিবাসের ভিত্তিপ্রস্তর। হারানোর ভীতিই যেন প্রতিমুহূর্তে আমাদের প্রেম সম্পর্কে সচেতন করে রাখে। আমাদের মজ্জায়-শিরায়-রক্তে-মস্তিষ্কে যে ভয়ের ডঙ্কা বাজে, তা দিয়ে যেন আমাদের প্রেমেরই আরতি হয়। যন্ত্রণার এই চূড়ান্ত ব্যবহার তো মানুষের জীবনেই সম্ভব – তাই না? এক যন্ত্রণাকে পুষতে পুষতে আমরা তুচ্ছ করে ফেলি অন্যান্য যন্ত্রণাদের। এক যন্ত্রণাকে পুষতে পুষতে আমরা হারিয়ে দিই আপাতযুদ্ধগুলোকে। যন্ত্রণার লালন আমাদের আপোষ করতে শিখিয়ে দেয় যেন সহজেই। প্রেমকে জিততে হলে, প্রেমের বন্যায় ভাসতে হলে – হারানোর ভীতির অস্তিত্বও অবশ্যম্ভাবী মেঘ হয়ে ওঠে। যে মেঘের বর্ষণেই প্রেমের গর্ব –”মরণের মুখের সম্মুখে” দাঁড়িয়েও অটল স্বীকারোক্তি – “মৃত্যু, তুমি নাই”। মৃত্যুর হাসিকে তুচ্ছ করে দেওয়ার এক অসম্ভব প্রচেষ্টা, একটি অস্তিত্বকে মিথ্যে করে তোলার প্রয়াস তাকে অস্তিত্বহীনতার কথা জানিয়ে।
কিন্তু, কবির কথায়, “মৃত্যু হাসে বসি।” ওই যে, “মৃত্যু সে ধরে মৃত্যুর রূপ/দুঃখ হয় হে দুঃখের কূপ “! তাই মৃত্যু যখন তার আপনার রূপ ধরে, প্রেম, মায়া, মোহ, বিরাগ, বিচ্ছেদ – সব মিলে মিশে এক অনস্তিত্ব না-থাকায় একাকার হয়ে যায়। অনন্ত সংসারকে আচ্ছন্ন করা ‘চিরজীবী প্রেম’ বিষণ্ণ দুচোখকে নোনতা অশ্রুর কুয়াশা দিয়ে ঢেকে দেয়। সেই বিষাদকুয়াশা শুধু মানুষের চোখ নয়, সমগ্র বিশ্বের প্রতিটি অন্তঃস্থলে নিজের অস্তিত্ব জানান দেয়। কোথাও মেঘমন্দ্রস্বরে। কোথাও নিভৃতে। এক স্তব্ধ সকাতর বেদনার সুর খান খান হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে ‘উদাসী বসুন্ধরা’র আপাদমস্তক – “মেঠো সুরে কাঁদে যেন অনন্তের বাঁশি/ বিশ্বের প্রান্তর-মাঝে।” সত্যিই সে সুরেলা বাঁশিটি অনন্তের। এক অসীম আর্তির। যে আর্তি চিরন্তন। যে আর্তি আধার ছাড়িয়ে নিরাধারের দিকে ধাবিত। যে আর্তির দ্বিতীয় নাম প্রেম। কিংবা ‘যেতে নাহি দিব’ নামক এক যন্ত্রণার বাকশক্তিহীন নিরুপায় গাছ।

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes