মহম্মদ সামিম-এর ছটি কবিতা
জাতক
এ এক আশ্চর্য পালক, রঙের উৎযাপন
উড়ছে, উড়ছে, শূন্যে ঢেউ খেলে ভাসছে
পায়ের শিকল ছিঁড়ে পালিয়েছে পাগল
এই পালক— ঝিলমিল রোদ, পুড়ে যায়
ভোরের রমণ, চাদরে লেগে থাকে আঁচ
অনন্ত অভিসরণ যেন, নৌকোভর্তি সুখ !
পালকে কি জন্মান্তর সম্ভব? কণ্ঠ ছেড়ে
এই রব তুলে এলোমেলো উড়ে গেল
গৃহবন্দি পাগল, মাথায় রঙিন মুকুট
এ এক আশ্চর্য মুকুট, ডানাকাটা পাখির মতো
বিদীর্ণ হৃদয়ের বেদনা অস্ফুট।
জীবিকা
এইসব পদচারণার কোনও পরিত্রাণ নেই
তুমি যতই হাতছানি দাও, কোলাহল ভুলে।
পিপীলিকা তো উচ্চাকাঙ্ক্ষাহীন, মন্থর অপরিসীম
মাটিকে সাক্ষী রেখে অন্নরস শোষণ করে।
আমরা স্মৃতি জড়িয়ে কালজয়ী হতে চাই
ছায়াকে খ্যাতি ভাবি, আগুনকে প্রশংসা …
এইসব পথের বাঁকে নিজেকে বুঝিয়ে বলি—
“তুচ্ছ ভাবো বিচ্ছেদ, তুচ্ছ ভাবো চুম্বন”
প্রতিটি গল্পের শেষে দহন-ব্যথা থাকে
যে কথার ব্যাপ্তি আজও তুমি বোঝনি
যেমন বোঝনি,
পিপীলিকার ভ্রমণসূচিই ক্ষুধার সরণি।
মর্ম
এসো শোক, বিহঙ্গ বিস্তার করি
সব আলো নিভে যেতে পারে যেকোনও সময়
আকাশের বুকে ছড়িয়ে রাখো সমস্ত স্বর
পাখিদের ছুটি নেই, উড়ে যাবে নিশ্চিত।
চিরায়ত দহন তোমার মুকুট
প্রতিটি আড়াল, প্রতিটি দ্বন্দ্ব ভুলে যাও
এসো আজ, নোঙর খুলে রাখি
ঢেউ এসে ভেঙে দিক নির্জন বন্দর
প্রাচীন ক্ষতের কাছে এসো, মুঠো খুলে বসি।
সম্মোহন
সব পাতা ঝরে গেলে, আঁকাবাঁকা ডালপালা বিস্তৃত
আকাশের দিকে বাহু তুলে যে গাছ দাঁড়িয়ে থাকে —
সে শুধু শীর্ণ বিদীর্ণ পর্ণশূন্য গাছ নয়,
সে আমার হাতের অবিন্যস্ত আয়ুরেখা,
খরস্রোতা নদীর উপর জমাট পড়ে থাকা বলিরেখা,
যেন কোনও পরাজিত সম্রাট, আত্মসমর্পণের পর
মুঠো খুলে, মুকুটের অহংকার মাটিতে নামিয়ে
সামান্য জীবনের কাছে নিঃস্ব ভিক্ষুক
এ চরাচর মর্মরিত, শুকনো পাতার কণ্ঠভার
হাওয়ার সাথে স্মৃতির সখ্যতা,
গর্ভ পরিচয় কার ?
জন্মান্তর বুঝে নিক বজ্রাহত গাছ
ধ্বংসের সব আয়োজন শেষে, চেনা অভ্যেস বশে
পৃথিবী জুড়ে আঁকা হোক বৃক্ষ-বিহঙ্গ-কারুকাজ।
যবনিকা
দুঃখকে আগলে রাখে গভীর জীবনবোধ
শ্বাসের চমৎকার আয়োজন ব্যথাউপশম
দিনশেষে মুছে যায় ক্ষতের কোমল দাগ
নির্জন দৃষ্টির ভিতর হেঁটে যায় কবরবন্ধু
উন্মাদ এই আলো, পাঁজরে নিবিড় আগুন
মনে হয়, কিসের এত ডাকাডাকি, আদর,
সব ফেলে চলে তো যেতেই হবে নিষ্ফল
শূন্যের কাছে তুমি শুশ্রূষা, প্রসারিত সুখ।
স্নেহ দিয়ে তোমাকে আত্মসমর্পণে ছুঁয়েছি
বটের ঝুরির মতো ধ্যানের মহিমায় মাটি
দুঃখের মৃত্যুকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে বেঁচে আছি একা।
ঘাস
জেগে আছি এখনও, এটুকুই বড় কথা
চোরাবালির ভিতর থেকে ফিরে এসেছি,
এটুকুই বড় সান্ত্বনা, বড় আশার প্রস্তাবনা
গন্ধরাজ গাছের নীচে পড়ে আছে যে আলো,
ছাইসাদা কাঠবিড়ালির গুটি গুটি পদক্ষেপে
এখনও যে বিশ্বাস বেঁচে আছে, তার মতো
এই আমি, জেগে উঠছি আবার, সনির্বন্ধ …
মেঘেদের ভাঁজে পড়ে আছে যত অভিযোগ
শরীরে লেগে আছে পড়ন্ত বিকেলের আঁচ
তবু, হেঁটে হেঁটে পেরিয়ে যাচ্ছি শত অপেক্ষা
এর থেকে বড় যাপন আর কী হতে পারে ?
সমস্ত মেহনতি মানুষের পিঠ, স্পর্ধার মাঠ
সেখানে আঙুল ছোঁয়ালে, ডানা মেলে ধরে ঘাস।