ভাবের ঘর পর্ব ৩। বাল্যবন্ধুঃ ১।  <br /> সপ্তর্ষি বিশ্বাস

ভাবের ঘর পর্ব ৩। বাল্যবন্ধুঃ ১।
সপ্তর্ষি বিশ্বাস

দেশবাড়িতে ফিরবার টানের গহনে ‘আড্ডা’, ‘আড্ডা-টান’ অদ্যাপি অপরিবর্তিত কিন্তু যা বদলে গেছে, বহু বৎসর আগেই, তা আড্ডা-সঙ্গীরা ।
এই বদলানোর আরম্ভ ১৯৯১ সাল হয়ে ক্রমে ১৯৯৩-৯৪ সালে। সে’ও আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগের পঞ্জিকা। একমাত্র সৌমিত্র ছাড়া আর কেউ রইল না তালিকায় । কালক্রমে , আরো এক দশকের মধ্যে, সৌমিত্রও বে-লিস্ট। ওই ‘বে-লিস্ট’ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই “বাল্যবন্ধু” আর “বন্ধুতালিকা” হয়ে গেল পুরোপুরি আলাদা । পরের ত্রিশ বৎসর ধরে দেশ গ্রামের বন্ধু তালিকা রয়ে গেছে প্রায় অপরিবর্তিত।
কিশোরদা মৃতদের দেশে পাচার হয়ে গেলেও বন্ধু তালিকায় অদ্যাপি ভাস্বর।
ভাবি ‘বাল্যবন্ধু’ শব্দটি নিয়ে। বালক বয়সের ঠিক কতটা গভীরে গেলে বাল্যবন্ধুত্বের সংজ্ঞা-পরিধির ইঙ্গিত পাওয়া যায় ?
আর তার গণ্ডিই বা কতদূর বিস্তৃত ?
মাস বছরের হিসাব?
অ-আ-ক-খ সকাল ?
হাই-ইস্কুল দুপুর ?
হাই ইস্কুল দুপুর ডিঙ্গিয়ে এগারো বারো ক্লাসের জল ভেঙেও ?
ঠিক নির্ণয় কতরে পারিনা কারন গত ৩০ বছরের পরিবর্তিত বন্ধু তালিকায় দু’টি কলেজ-বছরের গণ্ডিতে যে সকল মুখ ঢুকে পড়েছিল বন্ধু-তালিকায়, তারাও মুছে গেছে — হয়তো সময়ের নিয়মেই। যে রয়ে গেছে, রয়ে যাবে, সে সন্দীপনদা। সে না’ত ছিল সমপাঠী, না সমান বয়সী । আমি যখন সদ্য কলেজে পা, তখন সে কলেজ-সীমার বেড়া ডিঙ্গিয়ে যাচ্ছে।
ভাবি ‘বাল্যবন্ধু’ শব্দটি নিয়ে। ‘বাল্য বন্ধুত্ব’ কি ভিন্ন ,ক্রমপরিনত,পরিণত বয়সের বন্ধুত্বের থেকে ?
বাল্যবন্ধু অনেক ক্ষেত্রেই পাড়া-বন্ধু বা প্রতিবেশী-বন্ধু। পাড়া-ইস্কুল, পাড়া-পাঠশালা যখন ছিল, তখন বাল্যবন্ধু, পাড়া-বন্ধু আর পাঠশালা-বন্ধু একই হতো, অনেক ক্ষেত্রে, অনেকের ক্ষেত্রে। কিন্তু ‘নিও লিবারেলি’ যুগে এসে তা আর রইলোনা । গ্রামে গঞ্জেও রইল না । সেখানেও নানান কিসমের ‘প্রাইভেট পাঠশালা’ গজাতে লাগলো। আগেও ছিল এমন কিছু ‘প্রাইভেট’ ইস্কুল, পাঠশালা। কিন্তু ‘নিও লিবারেলি’ মদত, প্রথমত মগজে এবং পরে প্রয়োগে, তাকে দিলো দাবানল করে। যাদের পকেটে বিনিয়োগ করবার মতো কালো বা শাদা অর্থ ছিল, তাদের মগজ উত্তেজিত হলো ইস্কুল ব্যবসায় টাকা লগ্নী করবার ফিকিরে। যাদের কাছে ইস্কুলে পাঠানোর মতো কাচ্চা-বাচ্চা ছিল, এদের মগজ ধন্দে পরলো — কোথায় পাঠালে ‘এডুকেশন’ হবে বেশি জোরদার, এতোই জোরদার যে, চাকরি আর খুঁজতে হবেনা, চাকরিই “ঢুন্ডে নেবে” প্রতিভাদিগকে। অর্থাৎ এবার অর্থ ও বিত্তের ভাগে আলগা হয়ে ‘শিক্ষায়তন’ পরিনত হলো, বিপুল হারে, ‘বাণিজ্য নিকেতনে’ এবং যার ফলে পাড়া-ইস্কুল, পাড়া-পাঠশালা’য় রইলো শুধু তারাই, যাদের ‘প্রাইভেট’ এ ঢালবার মতো আর্থিক ক্ষমতা নেই। সুতরাং বাল্যবন্ধু’র পাড়া-বন্ধু বা প্রতিবেশী-বন্ধু হওয়ার সম্ভাবনা লোপ পেতে লাগলো।
ওই ‘নিও লিবারেলি বাতাস’, মফস্বলে বইবার ঢের আগেই আমার পাঠশালা-ভোর গিয়ে এসেছে হাই-ইস্কুল দুপুর। ফলে আমার ‘বাল্য বন্ধু’ জোটার মানচিত্রে ‘নিও লিবারেলি’ দেওয়াল দেখতে হয়নি। আমার পাঠশালা-সকাল মানে লাল পাড় শাদা শাড়ি পরনে এক মহিলা। একটি রিক্সায়। মহিলার কোলে একটি শিশু। কিনারে আরেকজন। রিক্সা চলেছে মফস্বলি পীচ্ রাস্তা ধরে। রাস্তার পাশে পাশে বয়ে চলেছে একটা নদী। নদী নয়। খাল। পরে যদিও গিয়ে মিলেছে নদীতে। এই মফস্বলের প্রান্তেই। নদীও নিশ্চয়ই কোথাও গিয়ে মিশেছে সাগরে। কিন্তু কোথায় কেজানে। রাস্তার ধারে ধারে বাড়ি। প্রায় সব বাড়ি থেকেই ভেসে আসছে পোড়োদের স্বর নয়তো হারমোনিয়াম বাজিয়ে গানের রেওয়াজ। রিক্সা পার হচ্ছে মণীন্দ্র মহাজনের দোকান, জোড়া তেঁতুল গাছ, পার হচ্ছে রজনী শা’র বাগান।সরকারি হাসপাতাল। ইষ্টিশান রোড। যমজ বোনের মতো রাধা-দুর্গা সিনেমা হল্। পার হয়ে ছোটো গলী। খানিক এগিয়ে গিয়ে থামা। রিক্সা থেকে নামা। ‘ভিকমচান্দ বালিকা বিদ্যালয়’। এখানেই সকালে বসে আমাদের পাঠশালা। ছ’টা থেকে দশটা। ‘ভিকমচান্দ বালিকা বিদ্যালয়’ — বিরাট পাঁচিল তোলা ইস্কুল বাড়ি। ইউ’র মতো আকার। শাদা দেওয়াল। ফটক থেকে বাঁধানো, উঁচু পথ চলে গেছে প্রিন্সিপালের কোঠা অবধি। বারান্দা ঘিরে নীল নীল নাম না জানা ফুলের গাছ। গাছের ডাল ভাঙ্গা যায় সহজেই। ডাল ভাঙ্গলেই শাদা শাদা আঠালো রস আসে বার হয়ে। বারান্দা গুলো উঁচু হলেও মাঠটা নীচু। বৃষ্টি হলেই মাঠ জলে থৈ থৈ।পেছনে একটা পুকুর। শ্যাওলা ঢাকা। ‘নিও লিবারেলি’ ভাষায় আজ যদি এর বিজ্ঞাপন লেখা হয় তাহলে ‘কেভিয়েট’ হবেঃ ‘পালিত হয় রবীন্দ্র জয়ন্তী, ২৩ শে জানুয়ারী, শহীদ ক্ষুদিরাম দিবস, বিশ্ব বাংলা ভাষা দিবস ইত্যাদি’। ‘ সব বিষয়ই পড়ানো হয় বাংলায়, ইংরেজি আছে সাব্জেক্ট্ হিসেবে’। ‘এই ইস্কুলটি একজন মহিলার একক প্রয়াস’। ‘সবচেয়ে কম ফী’ নেওয়া হয় এই ইস্কুলে…’। ‘ঐ দেখো ইস্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা।ঐ দেখো তারা নাটক করছে — ‘শারোদৎসব’, ঐ দেখো তারা কবিতা বলছে ‘ব্রাহ্মণ’, ‘শেষ শিক্ষা’, ‘কান্ডারী হুঁশিয়ার’। ইত্যাদি। এবং ২০২৩ এর ফ্যাসিবাদ-দগ্ধ চালচিত্রে, এই বিজ্ঞাপনের ফাঁদে কারা পা দেবে, তা, পাঠিকা-পাঠক, নির্ণয় করে নিতে পারেন।
এই ইস্কুলের ইতিহাস, গো পাঠিকা, হে পাঠক, সোজা বাংলায় এরকমঃ আমার বাবা কলেজে পড়াতো। মা’ও পড়াতো । তবে অন্যত্র। বিয়ের পরে চাকরি ছেড়ে চলে এলো মা। বাবা’র শহরে। আমাদের দুই ভাইকে পাঠানো হয়েছিল ‘প্রান্তিক’ নামের এক কিন্ডারগার্টেন স্কুলে । কেননা ঐ স্কুলে বাবার কলেজের অধ্যাপক মাণিক বাবু’র ছেলেরাম যায় যায় হোমরা চোমরা বিনয় বাবুর দুই ছেলে । অতএব আমাদেরো নিয়তি যে হবে ঐ স্কুল তাতে আর বিচিত্র কি? ইস্কুলের রিক্সা ভ্যানে করে যেতাম। প্রায়ই সেই যাওয়া হতো কাঁদতে কাঁদতে। ফিরতামও ঐ রিক্সা ভ্যানে। আমাদের পাড়ার আর কোনো বাচ্চা ঐ ইস্কুলে যেতোনা। ফলে অনেকটা পথ একা একা আসতে হতো ভ্যানে। ঐ একা আসার প্রতিটি মুহুর্ত্ত ছিল ভয়ের। যদি ড্রাইভার কাকু আজ বাড়ি ফিরিয়ে দেওয়ার বদলে নিয়ে চলে যায় অন্য কোথাও ।যদি বিক্রি করে দেয় ।অবশেষে পাড়ার মোড়ের মশ্জিদ আর তার লাগোয়া কবরখানাটা দেখা মাত্র বুকে বয়ে যেতো এক আনন্দের শিহরণ! আহ্! বাড়ি আর দূরে নয় ।আহ্! ‘হোম্ সুইট্ হোম্’ …
প্রতি সন্ধ্যায় ইস্কুলের খাতা গুলি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে দেখতো মা। কি’যে দেখতো স্বাভাবিক ভাবেই বুঝতাম না তখন। তবে মাঝে মাঝে ডাক পরতো আমারো …
‘লিট্ল্’ বানান এ ক’টা ‘টি’?’
‘দু’টো’
‘খাতায় তাহলে তিনটে লিখেছো কেন?’
কিংবা ‘নাইনের সঙ্গে সেভেন প্লাস্ করলে কতো হয়?’ । আঙ্গুলে গুনে টুনে, অবশেষে বলি ‘সিক্সটিন্’ ।‘ কিন্তু খাতায় ত লিখেছ ফিফ্টিন্ ।এই ম্যাথ্ গুলো রাফ্ খাতায় আবার করো বসে বসে ’ । রাগ হতো। ভাবতাম ‘মিস্’ দেখে ‘কারেক্ট্’ দিয়ে দিয়েছে । তা আবার দেখা কেন? অনিচ্ছা নিয়ে খুলে বসতাম বই খাতা …
একদিন রীতিমতো ভীত হয়ে গেলাম মা যখন বল্লো ‘ কাল ইংলিশ্ আর ম্যাথ্ খাতা স্কুলে নিয়ে যেতে হবেনা …’ ‘আরে মিস্ বক্বে যে …’ ‘ আমি দুটো নতুন খাতা এনেছি তোমার জন্য, পুরোনো গুলো আমার কাছে থাক্…’ নতুন খাতা পাওয়ার আহ্লাদে মা কেন রেখেদিলো পুরোনো খাতাগুলো এই প্রশ্ন চাপা পরেগেলো ।
ইস্কুলের সামনের দিকটা গোল মতন। গেট্ খুলে ঢুকেই দুটো বড় বড় গাছ । এতে যে ফুল ফোটে তা দিয়ে লাটিম বানায় বাচ্চারা। আমাদের ক্লাস বসে এক তলায়। ইস্কুলের ফটক দিয়ে কেউ ঢুকলে দেখা যায়না তবে বারান্দায় উঠে প্রিন্সিপাল ম্যাডামের কোঠার দিকে গেলে দেখাযায়। হঠাৎ দেখি মা! বারান্দা পার হয়ে চলেছে প্রিন্সিপাল ম্যাডামের কোঠার দিকে! এক দৌড়ে ক্লাসঘর ছেড়ে সোজা মার কাছে। পেছনে পেছনে ‘মিস্’। মা বল্লো ‘আজ আর ভ্যানে যেতে হবে না, আমি বসে সঙ্গে করে নিয়ে যাবো।এখন ক্লাশে যাও। আমি প্রিন্সিপাল ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করে আসি …’
অগত্যা ফিরতে হলো ক্লাশ ঘরে। কিন্তু মন পড়ে রইলো কখন মা’র কথা শেষ হবে প্রিন্সিপাল ম্যাডামের সঙ্গে আর কখন মা’র সঙ্গে রিক্সায় চাপবো ।
একটু পরেই ক্লাশের দরজায় দেখা গেলো মেট্রন মাসীকে। এ’ও শুভলক্ষন। মা’বাবা এসে বাচ্চাকে নিতে চাইলে ক্লাশ ঘরে এসে সে খবর জানিয়ে যাওয়ার কাজ মেট্রন মাসীর। নিশ্চয় মা ডাকছে !! হায়, কিন্তু মেট্রন মাসী এসে বল্লো প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডাম ডাকছেন ক্লাসের ‘মিস্’ কে। মিসের ভ্রূ তখন কুঁচকে ছিল কি’না মনে নেই তবে মিনিট দশেক পরে যখন ফিরে এসেছিলেন তখনকার তাঁর জ্বলন্ত দৃষ্টি, বিশেষতঃ আমার দিকে, আমার চোখে ভাসে এখনো …’অবিনাশ ইয়োর্ মম্ ইজ কলিং ইউ …’ বই খাতা বাক্সে ভরে এক দৌড়ে চলে এলাম মা’র কাছে। রিক্সা দিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে অনেক গল্প হলো ।মা’কে প্রশ্ন করলাম ‘আজ ইস্কুলে এলে কেন?’ মা বল্লো ‘এইতো, তোকে নিয়ে যেতে …’
পরদিন থেকে ক্লাশে মিসের ব্যবহারে দেখা গেলো বিশেষ পরিবর্তন। আগে যে সমস্ত অপরাধে ক্ষমা পেয়েছি অনায়াসে, যে সব অপরাধের জন্য জয়ন্ত, নবল কশোর সিং, মনোজ, সোনালী কেউ’ই পায়না শাস্তি, সে সবের জন্যও শাস্তি জুটতে লাগলো আমার। তা’য় বাড়ি যাওয়ার আগে, প্রতিদিন, সমস্ত খাতা প্রিন্সিপাল মিস্’কে দেখিয়ে যাওয়ার নিয়ম হলো আমার জন্য। সেই আরম্ভ, সে’ই মা’র মাথায় ঢুকলো একটা ইস্কুল করার চিন্তা যেখানে এভাবে তিনটে ‘টি’র ‘লিটিল্’ বানানে ‘কারেক্ট্’ দেওয়া হবেনা, যেখানে প্রতিমাসে বেতন বাড়বে না, যেখানে বাংলা ভাষায় পড়ানো হবে বাচ্চাদেরকে।
তখনি প্রথম দেখি অরুনিমা মাসী আর ঝর্ণা মাসীকে। আমাদের বাড়িতে। এঁদেরকে নিয়ে বেড়িয়ে যেতো মা। কখনো ফিরতে ফিরতে হয়ে যেতো সন্ধ্যা। মা আর বাবার কথা বার্তার মাঝখান থেকে ‘ইস্কুল’ শব্দটি ছিট্কে লেগেছে কানে। কোনো কোনো দিন আমাদের রেখে যাওয়া যেতোনা। বায়না করতাম। তাই আমাদেরো সঙ্গে নিয়ে বেড়িয়ে যেতো মা। এরকমই একদিন গিয়েছিলাম সন্তোষ জৈন’দের বাড়িতে। মনে আছে ‘দিদি’ ‘দিদি’ বলে মা’র সঙ্গে কথা বলছিলেন ভদ্রলোক। আমাদেরকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খেলতে । মা’কে প্রশ্ন করেছিলাম ‘আমরা এদের বাড়িতে যাই কেন?’ মা বলেছিল ‘তোমাদের জন্য একটা নতুন ইস্কুল, নতুন রকমের ইস্কুল হচ্ছে। তাই’।
কথাটা ভালো করে না বুঝলেও ঐ ভ্যানে চড়ে ঐ ‘প্রান্তিক’ ইস্কুলটিতে আর নিরানন্দ যেতে হবেনা এমন একটা সম্ভাবনায় আমি আর ভাই দুজনেই আনন্দিত হয়েছিলাম যার পরনাই। জল্পনা কল্পনাও চলেছিল অনেক ।
অবশেষে একদিন মা বল্লো ‘কাল থেকে আর ইস্কুলে যেতে হবেনা’ ।
আহা, এমন আনন্দ সংবাদ!! শুনে যেন বিশ্বাসই হচ্ছিল না। মা বল্লো ‘দু সপ্তাহ বাড়িতেই পড়াশোনা করবে তারপর যাবে নতুন ইস্কুলে …’ ।
নতুন ইস্কুল? তার মানে সেই স্কুলটি হয়েগেছে, যার জন্য মা এতো দৌড়াদৌড়ি করতো? সে কোথায়? কি তার নাম? মা বল্লো ‘নতুন ইস্কুলের নাম মণিমুক্তা বিদ্যামন্দির, ঐ ইস্কুলে তোমাদের ক্লাসে পড়াবেন অরুনিমা মাসী। আমিও থাকবো ।’ সে যে ঠিক কি রকমের উত্তেজনা! বাড়িতে আসতে লাগলো বড় বড় রঙ্গীন কাপড়, তাতে নানা রঙ্গে ‘মণি মুক্তা বিদ্যামন্দির’ লেখা হ’তে লাগলো তুলিতে-কালিতে। তখনো ছিল পাড়া, প্রতিবেশী। মা’কে ‘মামিমা’,’কাকিমা’ বলার ‘দাদা-দিদি’রা। তারাই আঁকায় জুটেছে। এর পরেই আরম্ভ হলো রিহার্সেল, মা বল্লো ‘উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে নাটক হবে ।শেষশিক্ষা, তুমি হবে গুরু গোবিন্দ সিংহ.’।
স্থাপিত হলো ‘মণিমুক্তা বিদ্যামন্দির’।
এই সকলই ‘নিও লিবারেলি’ বাতাসের বিপরীত বাতাস। ‘নিও লিবারেলি’ যুগের দেড় দুই দশক আগের। সেই ‘ইস্টম্যান কালার’ আমলের। নিউ লিবারেলি বাতাস বইবার খানিকটা আগেই কলেজ আমার পাঠের দুই বৎসর । ১৯৮৯,১৯৯০ সাল। তখনো ‘নিও লিবারেলি’ প্রদূষণ বলতে, মফস্বলে, কলকাতা বা দিল্লীর বাসি-খবর কাগজের উড়ে আসা। তাতে কিছু খবর। ‘বড়দের’ আলোচনা। ছাত্র রাজনীতিতেও আলাপ আলোচনা। কিন্তু সবই অস্পষ্ট, ঝাপসা। কি হচ্ছে, কি হবে, কি হতে পারে — কেউ ই আদতে পারেনি বুঝতে। ঠিক যেমন বোঝা যায়নি, তখন, কানা-ঘুষায় ‘জয় শ্রীরাম’ আর ‘মন্দির এহি বনায়েঙ্গে’ — ইত্যাকার বিপদ সঙ্কেতের অতলতা।
মা’র ইস্কুল, ‘মণিমুক্তা বিদ্যামন্দির’ আরম্ভ হয়েছিল ১০ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে । আমার ক্লাসে আমি আর দুইজন সমপাঠী। প্রকৃত প্রস্তাবে সহপাঠিনী। একটি সাঁকো উঠেছিল গড়ে। কিন্তু হাই-ইস্কুল পর্বে ছেলে-ইস্কুল, মেয়ে-ইস্কুল আলগা আর আমরা তখন আমাদের নিজ ভিটায় উঠে আসায়, পাড়া ও হয়ে গেলো আলগা, দূর। শহরের আরেক প্রান্তে । অতএব পাঠশালা-সখ্যের ইতিহাস এখানেই সমাপ্ত। এবারে খতিয়ে দেখা যাক পাড়া-বন্ধুত্বের হাটবাজার। পাড়া-বন্ধু,প্রতিবেশী-বন্ধু বলতে পাশের বাড়ির সমবয়সী দুটি ছেলে মেয়ে আর অতিদূর আত্মীয়তার সম্পর্কের সম্পর্কিত একটি পরিবারের একটি ছেলে, বাপি । পাশ-বাড়ির মালিকজন, আমার বাবা আর ওই বাপি’র বাবা — সব্বাই পড়ায়। কলেজে একই কলেজে। ফলে, এই যে ‘বন্ধুত্ব’, এতে আর্থসামাজিক অবস্থান, সক্রিয় না হলেও,তলে তলে ছিল নিশ্চিত বহমান । পাড়ার অন্য ছেলেদের দের চেয়ে, তৎকালেও, “আমরা একটু উপরে”, “আমরা একটু আলাদা”, “আমরা পোবেসারের ছেলেরা” এই সকল বোধ, অস্পষ্ট হলেও, ছিল, নিশ্চিত । রাজু নামের আরেক ছোকরা ছিল আরেক পাশ-বাড়িতে। আমাদেরই বয়সী। তবে তার বাবাটি ছিল পুলিশ। ‘পুলিশ জাত’কে ঘৃণা মেশানো ভয় চোখে দেখা একটি হেতু রাজুটির সঙ্গে ‘দোস্তি’টি ‘দোস্তানা’তে গিয়ে না পৌঁছানোর একটি হেতু। পক্ষান্তরে রাজুর সঙ্গে ‘দোস্তি’ রাখবার টানের মূলে ছিল, তার আঠারো-উনিশে পা দেওয়া বড় বোন রুনার দুধ। রাজুর আশেপাশে থাকলে আমরাও থাকতে পারি রুনা’র বাগান-কেয়ারির ছায়াতে নাহোক, আশেপাশে — এই লোভ। তখন রুনাকে ‘লাইন’ দেওয়ার কথা ভাবতেও পারিনা কারন রুনার চোখে তখন আমরা ‘বাচ্চা’।

‘বাল্যবন্ধুত্ব’ সম্ভাবনার পরের পর্ব অবশ্যই হাই-ইস্কুলে পা রাখবার পর । সেখানেও পাড়া বন্ধু থাকতে পারে। নাও থাকতে পারে । সেখানে এমনও হয়, কিছু পাড়া-ছেলে, যাদের হয়তো আগে দেখেছি পাড়ায়, পাড়া-মাঠে, তাদেরই দেখা গেল ক্লাস-ভিড়ে । যেমন বাদল দেবরায় । দেখেছি আগে । তবে চেনা হলো, ক্রমে এক রকমের বন্ধুত্বও, হয়ে গেল ওই ইস্কুল সুবাদে। হাই-ইস্কুলে যাওয়া রাস্তাতেও ছিল বন্ধুত্ব সম্ভাবনা। তখনো দলে দলে ছেলেমেয়ে, আর্থ সামাজিক অবস্থান নিরপেক্ষ, হেঁটেই যেতো-আসতো। গাড়ি না হোক, হেস-কুটারে তুলে প্রতিভাধর, বিদ্যাধরীদিগকে, বাপ-কাকা-মামা-জ্যাঠা-মাসী-মামি’র ইস্কুলে দিয়ে আসার যুগ অনেকটাই দূরে। ইস্কুলে যেতে আসতে ভিন-ইস্কুলের ছেলেরাও বন্ধু হতো। যেমন শ্যামসুন্দর ইস্কুলের বিষ্ণু। … বাদল, বিষ্ণু এরা কেউই সেই অর্থে সামাজিক দাঁড়িপাল্লায় ওজনদার আবহ থেকে আসা নয়। এদের প্রত্যেকেই একেকটি উপন্যাস। কিন্তু এই মুহুর্তে বন্ধুত্বের কাহন বা বান্ধব-জীবনের কাহন নয়, ‘বাল্যবন্ধু’ শব্দের অন্তর্গত দ্বান্দ্বিকতার খোঁজ নেওয়াই আমার যাত্রা। অতএব উপন্যাস গুলিকে মাইল-পাথরের মতো স্থাপিত রেখে এগিয়ে যাই।
ইস্কুলে বন্ধুত্ব হয়ে যায় ভিন পাড়ার, বেপাড়ার ছেলেদের সঙ্গেও। আমারো জুটেছিল। সৌমিত্র ওই দলে । মণিময়, প্রশান্ত ব্যানার্জি’ও। মণিময়ের সঙ্গে একটা ক্ষীণ সংশ্রব রয়ে গেছে অদ্যাপি। প্রশান্ত ব্যানার্জি, ডাক-নাম ‘তপু’, মারা গেছে অকালে । তারো অন্তত ২৫ বচ্ছর আজ। সেই আমাদের ২৪-২৫ বছর বয়সের দিকেই তার মৃত্যু। ভাবি, বেঁচে থাকলেও বন্ধুত্ব বেঁচে থাকতো কি? ভাবি, যদি এমন হতো, যে, যারা আমার বন্ধু তালিকায় অপরিবর্তিত, গত ৩০ বছর ধরে, তারা যদি হাই-ইস্কুলে বা পাড়ায় থাকতো আশেপাশে, অর্থাৎ, যে সময়ে তাদের সঙ্গে হয়েছে সাক্ষাৎ, তা যদি হতো এক-দেড় দশক আগে, তাহলে কি হতো ?
এর উত্তরের খোঁজে যেতে হবে সংশ্রব গড়ে উঠবার রহস্যে ।
ধুলাবালি-খেলা যুগ যখন ছিল, যখন ছিল মাঠ,ধানক্ষেত,পতিত জমি — তখন ওই সকল ধুলাবালি-খেলা’র টানেই গড়ে উঠতো প্রথম বন্ধুত্ব । পাড়াতে ,ইস্কুলে। ধুলাবালির নিকটজন হয়েও খেলুড়ে আমি ছিলাম না কখনো। তবু, বালক বয়সের নিয়মে জুটেছি খেলা-ভিড়ে আদতে আড্ডাবাজি’র টানে। আর, বই-টান বেশি হওয়াতে একদল ছেলের সঙ্গে হয়ে গেল বেশি ঘনিষ্ঠতা যারা ‘গল্প-বইয়ে’র ছেলে। সিক্স-সেভেনে যখন লিখতে ধরলাম, তখন এরাই আমার ‘পাঠক’। প্রথম পাঠক।
‘বই-কথা’, ইস্কুল কলেজ দিনের যখন উঠলই, তখন একজনের কথা লিখে রাখি এখানে।
রঞ্জিত। রঞ্জিত সিং।
বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরী এই ছেলেটি তার আশ্চর্য স্নিগ্ধ-উজ্জ্বল পাহাড়িয়া লাজুক মুখ নিয়ে, মৃদু হাসি নিয়ে, ঠিক কোন ক্লাসে এসে ভর্তি হয়েছিল মনে নেই। ফাইভ সিক্সের ক্লাস-কোঠা গুলি, বিরাট সব বৃদ্ধ বৃক্ষদের বিপুল ছায়া হেতু সততই আলো-আঁধারি। ওই আলো-আঁধারি চোখে ভেসে ওঠে না রঞ্জিতের আবহে। রঞ্জিতের আবহে দেখতে পাই আকাশ, কখনো নীল, কখনো ধূসর। উঁকি দেয় রেডক্রস হাসপাতাল চত্বরের গাছ গুলির শাখা । অর্থাৎ বড় রাস্তার দিকের ক্লাস-কোঠা গুলি । অর্থ হয়, ক্লাস সেভেন আর এইট – এরই কোনটাতে আমাদের বই-সখ্য। ক্রমে গাড়তর সখ্যের সম্ভাবনা।
বই লেনদেনের আরম্ভ গোলাপী মলাটের রবিনহুড থেকে। রঞ্জিতই প্রথম দিয়েছিল, বই, আমাকে। তার সংগ্রহে ছিল হাজার কিসমের অ্যাডভেঞ্চার বই – সব্যসাচীর টারজান, নানান শিকার কাহিনী, নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ-সুধীন রাহা’র অনুলিখনে আইভান হো, থ্রি মাস্কেটিয়ার্স, ম্যান ইন দ্য আয়রন মাস্ক … । খুব কম , প্রায় কথা না -বলা এই ছেলেটি কলকলিয়ে উঠতো বই-কথাতেই শুধু। আর আমার সঙ্গেই শুধু। দু একদিন স্যার ম্যাডামদের কাছে নাজেহালও হতে হয়েছে – বই বাক্সে ‘গল্প বই’ পাওয়া যাওয়ার দরুন। যদিও ওই বইগুলো এনেছিল আমার জন্য আর আমার ব্যাগেও ছিল ‘গল্প বই’ কিন্তু ঘটনাচক্রে আমি ধরা খাইনি। ধরা পড়ে গিয়েছিল রঞ্জিত।
কে জানে কিভাবে এই ছেলে ফেল করে বসলো ক্লাস এইটে।
কিভাবে? একশোর মধ্যে ৩০ নম্বর না পাওয়ার মতো প্রতিভা রঞ্জিতের ছিল না তবুও ফেল করে গেল। কেন? আজ মনেহয় নিশ্চয়ই কিছু ঘটেছিল, ঘটে যাচ্ছিল তার পারিবারিক অথবা প্রাতিবেশিক আবহে কিংবা তার বাড়িতে যা তার বয়ঃসন্ধির নিভৃত ব্যক্তি জীবনে ফেলেছিল ছায়া। নতুবা পরীক্ষা-খাতা উলটে মেডেল-আনা নির্বোধ না হলেও ফেল করে যাওয়ার মতো ধীমান ছিলনা রঞ্জিত। তবু রঞ্জিত, রঞ্জিতই শুধু, ফেল করে বসলো ক্লাস এইটে আর তার বাবা এসে স্কুল ছাড়িয়ে নিয়ে গেলেন তাকে । সখ্যের ‘আলাপ’ পেলোনা বন্ধুত্বের ‘বিস্তার’। ওই হেতুই হয়তো এক বিচ্ছেদের বেদনা টের পাই রঞ্জিতকে ঘিরে। এখনো।
হয়তো ফেল করবার ঘটনাটি না ঘটলে আমাদের বন্ধুত্ব তালিকায় সে থাকতো, হয়তো থাকত না, ক্রমে। তবু বন্ধুত্বের ‘বিস্তার’ না পাওয়া এই সখ্যের ‘আলাপ’ আজো বেজে যায় সন্ধ্যাকালীন কোনো রাগের বেদনায়, বিষাদে।
রঞ্জিত, রঞ্জিত সিং, আছিস কি এখনো বেঁচে ? এখনো বই পড়িস ? কি বই ? এখনো এডভেঞ্চারে টান নাকি বাইরের এডভেঞ্চার-পথ ছেড়ে হেঁটে চলেছিস, আমারই মতন, মর্মের আনাচে কানাচে, চড়াই-উৎরাই-এ, এডভেঞ্চারের খোঁজে?

CATEGORIES
Share This

COMMENTS Wordpress (0)

demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes
Checking your browser before accessing...