
বিভাজনের নিরাময়
কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং
অনুসৃজনে রিনি গঙ্গোপাধ্যায়
"আমি প্রায় অর্ধশতাব্দী পার করেছি স্বাভাবিক সংকেত অনুসন্ধানে; এবং আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে স্বপ্ন ও তার সংকেত বোকা বোকা বা অর্থহীন নয়। বরং বলা যায় স্বপ্ন খুবই কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য সরবরাহ করে তাদের যারা নিজেদের স্বপ্নের সংকেতের অর্থ বুঝতে অসুবিধার সম্মুখীন হয়। এর ফল হল, এটা সত্যি, পার্থিব কেনাবেচার ব্যাপারে আমাদের প্রায় কিছুই করার নেই। কিন্তু জীবনের অর্থ কোনো ব্যক্তির ব্যবসায়ী জীবন দেখে ব্যাখ্যা করা যায় না; মানবের কোনো গভীর ইচ্ছা তার ব্যাংক একাউন্ট কখনোই জানায় না। মানবের ইতিহাসে যেখানে সমস্ত উপলব্ধ শক্তি প্রয়োগ করা হয় প্রকৃতিকে বুঝতে সেখানে খুব সামান্য মনোযোগই দেওয়া হয় মানুষকে বুঝতে, যা হয় তার মনস্তত্ত্ব। যদিও প্রচুর গবেষণা করা হয়েছে মনের সচেতন ক্রিয়ার ব্যাপারে। কিন্তু মনের সবচেয়ে জটিল ও অপরিচিত অংশ, যেখান থেকে সংকেত উৎপন্ন হয় এখনো পর্যন্ত তাকে আবিষ্কার করা হয়নি। এটা প্রায় অতুলনীয় যে যদিও আমরা প্রতি রাতে এর থেকে সংকেত পেয়ে থাকি তবু এই সংযোগের রহস্য উদ্ধার করা বেশ ক্লান্তিকর; কিন্তু খুব কম মানুষই এটা নিয়ে ভাবিত।"
আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি একটি নতুন পৃথিবী তৈরি করেছে যা প্রকৃতিকে দমন করে এবং যা বিপুল পরিমাণ যন্ত্র দ্বারা জনবহুল হয়ে উঠেছে। পরবর্তীতে সংশয়াতীতরূপে এর প্রয়োজন এত বৃদ্ধি পায় যে আমরা এর থেকে মুক্তির উপায় বা যন্ত্রের অধীনতা দূর করার উপায় ভাবতেও পারিনা। মানুষ তার মস্তিষ্কের বৈজ্ঞানিক এবং উদ্ভাবক দুঃসাহসিক প্ররোচনা অনুসরণ করতে বাধ্য এবং তার চমৎকার কৃতিত্বে মানুষ পরম আনন্দ লাভ করে। একই সঙ্গে তাঁর প্রতিভায় ঝুঁকিপূর্ণ প্রবণতা দেখা যায় এমন জিনিস আবিষ্কারে যা পরবর্তীতে আরো আরো বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। কারণ তারা প্রতিনিধিত্ব করে ভালো আরো ভালোর যার অর্থ দাঁড়ায় সামগ্রিক আত্মহত্যা।
পৃথিবীতে তুষারধ্বস যেভাবে বেড়ে চলেছে তাতে উপসাগরে বন্যার সম্ভাবনা থেকে মুক্তির উপায় মানুষ এখনই অনুসন্ধান করতে শুরু করেছে। কিন্তু প্রকৃতি হয়তো তার উর্বর মস্তিষ্কের দ্বারা মানুষের বিরুদ্ধে গিয়ে আমাদের সমস্ত পূর্বানুমানকে নস্যাৎ করে দেবে। যেমন, মানববোমা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা নিয়েছে। প্রকৃতির ওপর দর্পভরে দমন চালিয়েও আমরা আজও তারই শিকার, কারণ আমরা এখনো পর্যন্ত নিজেদের প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখিনি। ধীরে, কিন্তু এটা দেখা যাচ্ছে যে অনিবার্যভাবে প্রকৃতির ধ্বংসের সামনে আমরা প্রার্থনা করছি।
এমন কোনো ঈশ্বর নেই যাকে আমরা আবাহন করতে পারি দীর্ঘ সময় ধরে আমাদের সাহায্য করার জন্য। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ধর্মও রক্তাল্পতা রোগ বৃদ্ধিতে ভুগছে কারণ সাহায্যকারী সবকিছু জঙ্গল থেকে, নদী, পাহাড় থেকে এবং জন্তু-জানোয়ার থেকে চলে গেছে, এবং ঈশ্বর অন্তরীণ হয়ে অদৃশ্য হয়েছেন অবচেতনে। আমরা মূর্খের মতো মনে করি ঈশ্বর লজ্জাজনকভাবে অবস্থান করে আমাদের অতীতের ধ্বংসাবশেষে। আমাদের বর্তমান জীবন যে ঈশ্বরী কারণ দ্বারা দমিত হয় তা আসলে আমাদের বৃহৎ ট্রাজিক মায়া। এই কারণের সাহায্যে আমরা নিজেদের আশ্বাস দিয়ে থাকি , আমরা প্রকৃতির উপর জয়লাভ করেছি।
কিন্তু এটা কেবলমাত্র একটি শ্লোগান, এই আপাত বিজয় অভিভূত করে তোলে আমাদের সাধারণ বাস্তবের প্রতি, যেমন জনসংখ্যা বৃদ্ধি যা আমাদের সমস্যাকে মানসিক অক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত করে প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি করার জন্য প্ররোচিত করে। এটা খুবই স্বাভাবিক যে মানুষ একে অপরের থেকে উচ্চতর হওয়ার জন্য ঝগড়া করে , সংগ্রাম করে। তাহলে আমরা কিভাবে প্রকৃতির উপর বিজয়প্রাপ্ত হলাম?
যে কোনো পরিবর্তন কোনো একটা জায়গা থেকে শুরু হয় , একক ব্যক্তি তার অভিজ্ঞতা লাভ করে এবং তাকে বহন করে। পরিবর্তন প্রকৃতপক্ষে শুরু হয় স্বতন্ত্র ব্যক্তির মধ্য দিয়ে; হতে পারে সে আমাদের মধ্যেই কেউ। সবাই বৃত্তাকার দেখতে অভ্যস্ত নয় এবং এটার জন্য অপেক্ষা করতেও অভ্যস্ত নয় যে সে যে কাজটা ঘৃণা করে সেটা তার জন্য অন্য কেউ করে দেবে , এটা অনেক বেশি মূল্যবান হতে পারে যখন আমরা প্রত্যেকে নিজেদেরকে জিজ্ঞেস করবো কোন সুযোগে আমাদের অবচেতন এমন কিছু কি জানে যা আমাদের সাহায্য করতে পারে। নিশ্চিতভাবেই সচেতন মস্তিষ্ক এই প্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় কোনো কাজ করতে অক্ষম। বর্তমান সময়ে মানুষ যন্ত্রণাক্ষতভাবে জানে যে তার বৃহৎ ধর্ম অথবা নানা দার্শনিক মতামত তাকে সরবরাহ করতে পারেনা সেই ক্ষমতাশালী উদ্দীপক চিন্তা যা তাকে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা দেবে , যা বর্তমান পৃথিবীর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে তার প্রয়োজন।
আমি জানি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা কি বলবেঃ সবকিছুই সঠিক হবে যদি মানুষ বৌদ্ধ ধর্মের অষ্টাঙ্গিক মার্গকে যথাযথ অনুসরণ করে এবং আত্মার কাছে সৎ হয়। খ্রিস্টান ধর্ম আমাদের বলে যদি মানুষের ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস থাকে তবে অবশ্যই একটি সুন্দর পৃথিবী আমরা পেতে পারি। যুক্তিবাদীরা দৃঢ়তা সহকারে বলে যদি মানুষ বুদ্ধিমান ও যুক্তিসঙ্গত হতো, আমাদের সমস্ত সমস্যা পরিচালনযোগ্য হতো। বিরক্তির কারণটা হল কেউই সমস্যার সমাধান করার জন্য কিছু করে না।
খ্রিস্টানরা প্রায়ই জিজ্ঞাসা করে কেন ঈশ্বর তাদের সঙ্গে কথা বলেন না, যেহেতু সে বিশ্বাস করে এমনটা সাবেক কালে ঘটত। যখন আমি এমন প্রশ্ন শুনি, আমি সবসময় ভাবি সেই ইহুদি পণ্ডিতের কথা যিনি জিজ্ঞাসিত হয়েছিলেন, কেমন করে ঈশ্বর প্রায়ই সাবেক কালে দেখা দিতেন মানুষদের , যদিও এখন কেউই তাঁর দেখা পান না। ইহুদি পন্ডিতটি উত্তরে বলেছিলেন, ‘এখনকার দিনে এমন ব্যক্তিই নেই যে দীর্ঘদিন যথেষ্ট নত হয়ে থাকতে পারে’।
এই উত্তরটা মাথায় পেরেকের আঘাত করে। আমরা আমাদের বিমুগ্ধতা দিয়ে আমাদের সচেতন মানসিকতাকে এতটা বিজড়িত করে রাখি যে আমরা ভুলে যাই সাবেক কালের বাস্তবের কথা যে ঈশ্বর কথা বলতেন প্রধানত স্বপ্নদর্শন এর মধ্য দিয়ে। বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা অবচেতনের কল্পনাকে অপ্রয়োজনীয় মায়া বলে প্রত্যাখ্যান করে। খ্রিস্টানরা চার্চ ও বাইবেলকে নিজেদের এবং অবচেতনের মাঝখানে রাখে। এবং যুক্তিবাদী বুদ্ধিজীবীরা এখনো পর্যন্ত জানেই না যে সচেতন মন তাদের সম্পূর্ণ মানসিক অবস্থা নয়। এই অজ্ঞতা বর্তমানেও আছে। ফলে তারা জানে না সত্তর বছরেরও বেশি সময় ধরে অবচেতন যে কোনো গুরুতর মানসিক অনুসন্ধানের অত্যাবশ্যকীয় বনিয়াদ।
আমরা খুব বেশিদিন এটা ভাবতে সমর্থ থাকব না যে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের মতো আমরাও প্রাকৃতিক ঘটনাবলীর গুণাবলী বা শত্রুতা হিসেবে বিচার করতে পারি। আমরা আমাদের উদ্ভিদবিজ্ঞানকে প্রাচীনকালের মতো প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় উদ্ভিদ হিসেবে বিভাজন করি না। অথবা আমাদের জীববিদ্যাকে নির্বোধের মতো নিরীহ ও ভয়ঙ্কর প্রাণীদের মধ্যে বিভক্ত করিনা। কিন্তু আমরা এখনো এটা ধরে নিয়ে আত্মতুষ্ট যে সচেতনতা হল জ্ঞান এবং অবচেতন হল অজ্ঞান। বিজ্ঞানে এই ধরনের অনুমান হাসির খোরাক হয়। উদাহরণ স্বরূপ , জীবাণু জ্ঞান না অজ্ঞান?
অবচেতন যাই হোক না কেন এটা স্বাভাবিক যে অবচেতন সংকেত উৎপন্ন করে যার অর্থপূর্ণতা প্রমাণ করতে হয়। আমরা এমন কাউকে জীবাণু বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হিসেবে গ্রহণ করব না যে কোনদিন মাইক্রোস্কোপে চোখ রাখেনি। ঠিক একইরকম ভাবে যে ব্যক্তি স্বাভাবিক সংকেত বিষয়ে দীর্ঘদিন গুরুতর পড়াশোনা করেনি তাকে কখনোই এ বিষয়ে বিচারক গ্রহণ করব না। কিন্তু এ বিষয়ে মানবাত্মার সাধারণ অবমূল্যায়ন এতই দুর্দান্ত যে না কোনো ধর্ম, না কোনো দর্শন, না বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদ স্ব-ইচ্ছায় এদিকে দ্বিতীয়বার তাকাতে চায়।
এছাড়াও ক্যাথলিক চার্চ মনে করে যে ঈশ্বর স্বপ্ন প্রেরণ করেন। বেশিরভাগ চিন্তক স্বপ্নকে বোঝার জন্য কোন গুরুত্বপূর্ণ চেষ্টা করে না। আমার সন্দেহ হয় প্রোটেস্টট্যানদের গ্রন্থ বা মতবাদ খুব ধীরে আনত করে এই সম্ভাবনা যে ঈশ্বরের বাণীই অনুভূত হয় স্বপ্নে। কিন্তু যদি একজন ধর্মতত্ত্ববিদ সত্যিই ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন, সে কোন্ কর্তৃত্বের পরামর্শ দেবেন এটা বোঝার জন্য যে ঈশ্বর স্বপ্নে কথা বলতে অপারগ?
আমি প্রায় অর্ধশতাব্দী পার করেছি স্বাভাবিক সংকেত অনুসন্ধানে; এবং আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে স্বপ্ন ও তার সংকেত বোকা বোকা বা অর্থহীন নয়। বরং বলা যায় স্বপ্ন খুবই কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য সরবরাহ করে তাদের যারা নিজেদের স্বপ্নের সংকেতের অর্থ বুঝতে অসুবিধার সম্মুখীন হয়। এর ফল হল, এটা সত্যি, পার্থিব কেনাবেচার ব্যাপারে আমাদের প্রায় কিছুই করার নেই। কিন্তু জীবনের অর্থ কোনো ব্যক্তির ব্যবসায়ী জীবন দেখে ব্যাখ্যা করা যায় না; মানবের কোনো গভীর ইচ্ছা তার ব্যাংক একাউন্ট কখনোই জানায় না।
মানবের ইতিহাসে যেখানে সমস্ত উপলব্ধ শক্তি প্রয়োগ করা হয় প্রকৃতিকে বুঝতে সেখানে খুব সামান্য মনোযোগই দেওয়া হয় মানুষকে বুঝতে, যা হয় তার মনস্তত্ত্ব। যদিও প্রচুর গবেষণা করা হয়েছে মনের সচেতন ক্রিয়ার ব্যাপারে। কিন্তু মনের সবচেয়ে জটিল ও অপরিচিত অংশ, যেখান থেকে সংকেত উৎপন্ন হয় এখনো পর্যন্ত তাকে আবিষ্কার করা হয়নি। এটা প্রায় অতুলনীয় যে যদিও আমরা প্রতি রাতে এর থেকে সংকেত পেয়ে থাকি তবু এই সংযোগের রহস্য উদ্ধার করা বেশ ক্লান্তিকর; কিন্তু খুব কম মানুষই এটা নিয়ে ভাবিত। মানুষের সবচেয়ে বড় যন্ত্র , তার মনস্তাত্ত্বিকতা, খুব কমই চিন্তার মধ্যে আসে। আর এটাকে প্রায়ই সরাসরি অবিশ্বাস করা হয় এবং তুচ্ছ করা হয়। ‘এটা শুধুই মনস্তাত্ত্বিকতা’ – প্রায়ই খুব কম অর্থ বহন করে; এটা আসলে কিছুই নয়।
এই অপরিসীম কুসংস্কার কোথা থেকে আসে? আমরা স্বাভাবিকভাবেই ব্যস্ত থাকি আমরা কি ভাবি তাই নিয়ে; আমরা সম্পূর্ন ভুলে যাই অবচেতন কী ভাবে আমাদের সম্পর্কে সে বিষয়ে। সিগমুন্ড ফ্রয়েডের ধারণা নিশ্চিত করে যে মনস্তত্ত্ব বিষয়ে বেশিরভাগ মানুষের অবজ্ঞা কতখানি। তাঁর আগে এটা নিছক অবহেলিত ও উপেক্ষিত ছিল। বর্তমানেও তা নৈতিকভাবে অস্বীকার করা হয়।
এই আধুনিক অবস্থান নিশ্চিত ভাবেই একমাত্রিক এবং অন্যায্য। চেনা বাস্তবের সঙ্গে এর কোনো বিরোধ নেই। আমাদের অবচেতন সম্পর্কে আসল জ্ঞান দেখায় যে এটা হল একটি প্রাকৃতিক ঘটনা; ফলে যেমন প্রকৃতি নিজে তেমনই অবচেতনও নিরপেক্ষ। এর মধ্যে থাকে মানব প্রকৃতির সমস্ত দিকগুলি – আলো এবং অন্ধকার , সুন্দর এবং নোংরা , ভালো এবং মন্দ , গভীর এবং নির্বোধ। ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের পাঠে, একই রকম সমষ্টিগত পাঠে, সংকেত একটি প্রকাণ্ড কাজ; এবং কোনো একজন এই বিষয়ে সর্বেসর্বা হতেও পারে না। কিন্তু এটা শেষপর্যন্ত শুরু হয়েছে। প্রাথমিক ফলাফল যথেষ্ট উৎসাহজনক এবং তারা নির্দেশ করছে সেই উত্তরের প্রতি যা আরো বহু উত্তরহীন প্রশ্নে জর্জরিত করে রেখেছে বর্তমান মানব সভ্যতা।