বাকপ্রতিমার মৃৎশিল্পী
: সন্মাত্রানন্দ

শব্দ কি খুলে দেখায় শুধু? শুধু প্রকাশ করা তার কাজ? এক মন্ময় আড়াল তোলাও কি তার উদ্দেশ্য নয়? যে আড়াল সরিয়ে সত্যকে দেখে নেওয়ার আমন্ত্রণ থাকে, সেই আড়াল বা অবগুণ্ঠনই কি কবির অন্বিষ্ট নয়? এসব ভাবনাও বস্তুত ওপর-ওপর; বাহ্যপ্রত্যক্ষ আর বাহ্য-অনুমেয় ভাবনার ভিত্তিতে এসব কথার জাল বোনা হয়। তবু আরম্ভের পক্ষে এটা যথেষ্ট বটেই। আরও একটু এগিয়ে গেলে অন্য এক ধরনের প্রতর্কের মুখোমুখি হই আমরা। শব্দ কি প্রকাশক বা আবরণ আর ভাব কি প্রকাশিত বা আবৃত, নাকি শব্দ ও ভাবের মধ্যে আদৌ কোনো দ্বৈততা নেই? এমনটা ভাবতে কি খুব অসুবিধে হবে যদি বলি, শব্দই ভাব কিংবা ভাবই শব্দ? যেমনটা মার্গসঙ্গীতে হয়, যেখানে কথা নেই সুরই শুধু আছে আর সেই সুরকে ভাবের থেকে আলাদা করা যায় না একেবারেই। যে মুহূর্তে ভাবের কাছে পৌঁছোচ্ছি, সেই মুহূর্তেই সুরের কাছেও এসে পৌঁছোচ্ছি আমরা। ওই সুর আর ওই ভাব অদ্বয়; বৈরাগ্যের ভাবটাই ইমন, রাত্রিশেষের অবসন্ন বিহ্বলতাই পরজ। সুর ও ভাবের এই অদ্বয়তা-কে যদি বুঝে নিতে চাই শব্দ ও ভাবের অনুষঙ্গে, তাহলে প্রায় এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয় যে, যখনই আমরা কোনো সত্যের কাছে এসে দাঁড়াই, তন্মুহূর্তেই সেই সত্যের শব্দপ্রতীকের কাছেও এসে দাঁড়াই।
এ ভাবনার বিপদ আছে। প্রশ্ন উঠবে, শব্দ আর ভাব যদি অবিভাজ্যই হয়, তাহলে একই বস্তুকে বোঝানোর জন্য ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় ভিন্ন ভিন্ন শব্দ আছে কেন? উত্তরে বলা যায়, ভিন্ন ভিন্ন ভাষা তো ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি-বলয়ে উচ্চারিত। বস্তুর অনুভবও সংস্কৃতি-বলয়ের সঙ্গে সঙ্গে সামান্য পালটে যায়। একটি গাছ সম্পর্কে বাংলার মানুষের সুদীর্ঘ কাল-পরিসরে যে সমষ্টিগত অভিজ্ঞতা তৈরি হয়েছে আর জার্মানির মানুষের সমষ্টি-মনে সেই গাছ সম্পর্কে যে অভিজ্ঞতা তৈরি হয়েছে, তা কিছুটা তো ভিন্নই। কেননা এখানে কাজ করছে ওই ওই দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার। তাই একটা গাছ দেখে একজন বাঙালি যে অনুভবের কাছে পৌঁছোচ্ছেন, একজন জার্মান তার থেকে সামান্য পৃথক অনুভবের কাছেই পৌঁছোচ্ছেন বলে মনে হয় আমার; যত সামান্যই হোক সে প্রভেদ, তবু তা আছে। আর তা আছে বলেই মূল-কাণ্ড-শাখা-পুষ্প-ফল সমন্বিত অবয়বটিকে দেখে একজন বাঙালি বলছেন ‘গাছ’, আর একজন জার্মান তাকেই বলছেন ‘বাওম্‌’।
একথা একই ভাষার প্রতিশব্দের ক্ষেত্রেও খাটে। ‘আগুন’ বললে যে-ভাব জেগে ওঠে মনে, ‘হব্যবাহ’ বললেও কি ঠিক সেই একই ভাব কি আসে? আর এই ভাবগত ভিন্নতার ফলেই শব্দগত ভিন্নতাও দেখা যায়। দুজন মানুষ একই ‘গাছ’ শব্দ উচ্চারণ করলেও, দুজনের মনে ঠিক একেবারে একই অনুভব হয় না। তবু খুব খুব কাছাকাছি সেই দুটো অনুভব বলেই শব্দের দ্বারা এ ওর কথা বুঝতে পারে, বাক্‌ব্যবহার চলতে পারে।
তাহলে সত্যের বা ভাবের অনুভব যেমন তৎক্ষণাৎ শব্দকে ডেকে আনতে পারে, উলটোদিকে ঠিক তেমনই অমোঘ শব্দ বা অমোঘ বাকপ্রতিমাই একজন কবিকে নিয়ে যেতে পারে শব্দানুবিদ্ধ কোনো ভাবলোকে, যেহেতু শব্দ আর ভাব— অগ্নি ও তার দাহিকাশক্তির মতোই অভিন্ন। সুতরাং এক শ্রেণির কাব্যনির্মাণকলাবিদের প্রেরণাই হয়ে উঠবে সেই অভীষ্ট বাকপ্রতিমার অনুসন্ধান। ‘আমাকে একটি কথা দাও যা আকাশের মতো সহজ মহৎ বিশাল’ –এমন একটি তন্নিষ্ঠ উচ্চারণ সে জন্যেই জীবনানন্দের পক্ষে সম্ভব হতে পারে। সহজাত কবিত্বের মতো কিশোরকম্পী কণ্ঠস্বরে সে কবির আর আস্থা থাকে না, তাঁকে জানতে হয় প্রভূত শ্রমের ও সাধনার মূল্যেই সেই বাকপ্রতিমা ধরা দিতে পারে। নির্মাণে তাঁর সুগভীর আস্থা। প্রেরণার অধিক শ্রমে। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের সমগ্র কাব্যসাধনাকে এই দৃষ্টিভঙ্গির নিরিখে দেখবার সাহস সঞ্চয় করতে পারি আমরা। ক্রমশই পরিশোধিত হচ্ছে তাঁর শব্দমালা, নির্মাণে বিনির্মাণে দক্ষ ভাস্করের মতো তিনি বাকপ্রতিমা এবং কবিতার অবয়বকে প্রস্তাবিত করছেন। এতে রক্তাক্ত হচ্ছেন, কিন্তু পুনরায় সে গোপন ক্ষরণ থেকে অর্জন করছেন শক্তি, যেখানে পথ ছিল না সেখানেই সশ্রম অধ্যবসায়ে নিজের চলার জন্য কেটে নিচ্ছেন পথ। তাঁর পদচিহ্ন অনুসন্ধান করবে যে পাঠক, তাঁকেও হতে হবে সমান অধ্যবসায়ী, সমান পরিশ্রমী।
কিন্তু এই প্রক্রিয়ার সঙ্গেই জড়িয়ে আছে এক অন্যতর অভিমান। যেহেতু এই নির্মাণকৃতির পরমা সিদ্ধি বলে সম্ভবত কিছু নেই, অথচ ব্যক্তি অলোকরঞ্জনের রয়েছে এক বিশেষ প্রকারের আস্তিক্যবুদ্ধি, তাই ব্যক্তিসত্তা ও কবিসত্তার দ্বন্দ্বের ফলে তৈরি হচ্ছে এক আত্মসংক্ষোভ। এই সংক্ষোভ তাঁকে আহত করে চলেছে প্রতিনিয়ত। তাঁকে দেখতে হয়েছে কথার ভিতর যে প্রতিশ্রুতি ছিল, প্রয়াস প্রতিবারই পৌঁছে দিতে পারছে না সেই প্রমায়। এই অনুপনীত শব্দগুলি তাঁকে ফিরে এসে বিদ্ধ করছে বারবার। দিন আসছে, রাত্রি হচ্ছে, গোধূলি সমাসন্ন হচ্ছে, তথাপি প্রতিশ্রুত ভুবনের দুয়ারের সামনে পড়ে থাকছে কথাদের মৃতদেহ। এই আমৃত্যু সাধনা ও সমানীত বিষাদের মধ্যেই অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের কবিজীবনের সারাৎসার আধৃত হয়ে আছে।

তুমি যে বলেছিলে গোধূলি হলে
সহজ হবে তুমি আমার মতো,
নৌকো হবে সব পথের কাঁটা,
কীর্তিনাশা হবে নমিতা নদী!

গোধূলি হলো।

তুমি যে বলেছিলে রাত্রি হলে
মুখোশ খুলে দেবে বিভোরবিভা
অহংকার ভুলে অরুন্ধতী
বশিষ্ঠের কোলে মূর্ছা যাবে।

রাত্রি হলো।

(একটি কথার মৃত্যুবার্ষিকীতে)

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes
404 Not Found

Not Found

The requested URL was not found on this server.


Apache/2.4.41 (Ubuntu) Server at hacklink.site Port 80