ফয়েজ় পরিক্রমা – ৯
নীলাঞ্জন হাজরা
" আসল মির্জ়ায়ি এইখানেই যে, মির্জ়া ভঙ্গুর, নশ্বর, সে না থাকলে দুনিয়ার কোনও কাজ বন্ধ থাকবে না, দিব্যি চলবে— সবই ঠিক। তথাপি সে না থাকায় কেউ একজন ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। কারও বেদনায় তারও পরিমাপহীন মূল্য আছে— এমনটাই সে মনে করতে ভালোবাসে, যদি ধরেও নিই যে এও আসলে আত্মপ্রতারণা। এখানেই মির্জ়া তুলনাতীত— এই দুনিয়াতে, এ ইহকালেই, রাজ্যের দার্শনিক সত্যাসত্যকে পরাস্ত করে এক ব্যখ্যাতীত মানবিকতায় হৃদয়ের ধ্বংসস্তূপে শত-ভঙ্গুর মানুষটার পাশে এসে বসা দিয়েই কানায় কানায় ভরা রাজ়দান মির্জ়ার পেয়ালা। " ফয়েজ পরিক্রমা। নবম পর্ব। নীলাঞ্জন হাজরা।
প্রথম পর্ব—-> প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব—-> দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব –> তৃতীয় পর্ব
চতুর্থ পর্ব —> চতুর্থ পর্ব
পঞ্চম পর্ব —> পঞ্চম পর্ব
ষষ্ঠ পর্ব –> ষষ্ঠ পর্ব
সপ্তম পর্ব —> সপ্তম পর্ব
অষ্টম পর্ব—> (৮)
পথে সেছি, সেখান থেকেও কেউ আমাকে উঠিয়েই বা দেবে কেন
(বিশেষ অনুরোধ — এই লেখা লিখছি আবহমান পত্রিকার ইন্টারনেট সংস্করণের জন্য। ইন্টারনেট আমাদের সামনে এনে দিয়েছে একাধারে পড়া দেখা শোনার অভিজ্ঞতার অভূতপূর্ব সুযোগ। সেই ভাবেই এ লেখার বয়ন। তাই সঙ্গের লিঙ্কগুলি অতিরিক্ত মনে করে উপেক্ষা করবেন না)
https://www.youtube.com/watch?v=mblW0p4Nk0c
যে মেয়েটিকে জীবনে প্রথম ভালোবেসেছিলাম, সে আমার পরিবর্তে এক ভদ্রলোককে বিয়ে করার বছর খানেকের মধ্যে সস্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় একটি ফুটফুটে পুত্রসন্তান প্রসবের পরের দিন অকস্মাৎ তড়িৎ গতিতে মারা যাওয়ার খবর আমার কাছে পৌঁছনোয় তার ভূতের বদলে মির্জ়ার ভূত কেন আমার ঘাড়ে চাপল, এ রহস্যের সমাধান আমি আজও করে উঠতে পারিনি।
মির্জ়া অসদুল্লা খান, যার তখল্লুস গালিব। জন্ম ২৭ ডিসেম্বর, ১৭৯৭। মৃত্যু ১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৮৬৯। গালিব আরবি শব্দ— যার মানে পরাস্ত করা, ঠিক শত্রুকে হারিয়ে দেওয়া অর্থে নয়। ‘To overcome’ — যেমন শোক পরাস্ত করা। এবং সে অর্থের বিস্তারে এ শব্দের মানে বিজয়ীও হতে পারে। কখনও আমার মনে হয়েছে, যদি এই রহস্যটার সমাধান করে ফেলতে পারতাম, তা হলে কবিতার আর কোনও প্রয়োজন আমার কাছে থাকত না।
মির্জ়া গালিব। শিল্পী এমএফ হুসেইন
‘সত্যি বলা ছাড়া আর কোনও কাজ নেই কবিতার’ (ভূমিকা / শ্রেষ্ঠ কবিতা। ১৩৭৬ বঙ্গাব্দ) — এই উচ্চারণ করে প্রণম্য শঙ্খ ঘোষ কবিতার ঘাড়ে যে গুরুদায়িত্ব চাপিয়েছেন তা স্বীকার করে নিলেও, সত্যের ধন্দটা তো থেকেই যায়। এটা ম্যাজিকের মত। জাদু। আমি ভারতীয়, এমনই এক প্রাচ্য দেশের মানুষ সেই মধ্যযুগ থেকেই যার অস্তিত্বের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পারসিক উপাদান ভরপুর। ব্রিটিশ ইতিহাসকার অধ্যাপক ওয়েন ডেভিজ-এর রোমহর্ষক কেতাব Grimories: A History of Magic Books (OUP, 2009) কিংবা তাঁরই Magic: A Very Short Introduction (OUP, 2012) পড়লে দেখা যাবে জাদু বা ম্যাজিকের উৎপত্তি কোথায় তা নিয়ে ভারত ও পারস্যের মধ্যে এক রুদ্ধশ্বাস অসিক্রীড়া হতে পারে। আর দেখা যাবে, জাদুর বিরুদ্ধে সাক্ষর-সভ্যতা তার প্রথম যুগ থেকে যে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ চালিয়েছে নানা অজুহাতে, তা সত্ত্বেও কী করে ম্যাজিক আজও হইহই করে টিকে আছে দুনিয়া জুড়ে তাও এক ম্যাজিক!
জাদুর এই ইতিহাসকারের দ্বিতীয় বইটি শুরুই হচ্ছে এই বাক্য দিয়ে — Defining ‘magic’ is a maddening task। এবং বিশদে আলোচনা করেছেন, বিংশ শতকে বিশেষ করে, অজস্র দার্শনিক, নৃতাত্ত্বিক, ইতিহাসকার, ধর্মতত্ত্ববিশারদ ঠাস-বুনন ব্যাখ্যার জালে আটকে ম্যাজিকের মূল অর্থটিকে ‘পিন ডাউন’ করার চেষ্টায় কী ভাবে বিপর্যস্ত হয়েছেন। এ হেন জাদু আমার রক্তে প্রবহমান। কারণ আমি ভারতীয়। এমনই প্রবহমান যে, আমাদের দু’ বছরের কন্যাদ্বয় ম্যাজিশিয়ান হবে এই আশায়, জীবনে প্রথমবার বিদেশে গিয়ে স্যান ডিয়েগোর এক ম্যাজিক শপ থেকে যখন আমার সাধ্যের নিরিখে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে এক বিশাল বাক্স ভরা জাদুর সরঞ্জাম কিনে আনলাম, আমার স্ত্রী বৈশাখী স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। দুনিয়ার সব জাদুকর আমার পরম শ্রদ্ধার পাত্র। আর আমার তুর্কমেনিস্তানি সহকর্মী মায়া মিরিদোভার পাল্লায় পড়ে ভিয়েনায় ১২০ ইউরো খরচ করে ‘দুনিয়ার সব থেকে খ্যাতিমান ইলিউশনিস্ট’ ডেভিড সেঠ কোটকিন ওরফে ডেভিড কপারফিল্ডের যে মাথা-ঘুরিয়ে-দেওয়া ম্যাজিক শো দেখেছিলাম তার বর্ণনা অন্যত্র দিয়েছি, কাজেই এখানে নয়। যদিও এ কথাও বলে রাখতে হবে এখানে, স্টেজের চোখ-ধাঁধানো প্রপ-নির্ভর ম্যাজিকের থেকে বহু দূরে, রোমের এক পার্কে শ’ খানেক মানুষের ভিড়ের মধ্যে ফোয়ারার বেদিতে বসা এক বৃদ্ধের খালি হাতে যে তাসের খেলা দেখেছিলাম তার বিশেষণে আমার একটি বাক্যই মাথায় আসে— সত্যজিৎ রায়ের ছবি ‘শাখা প্রশাখা’-র মনোবিকারগ্রস্ত চরিত্র প্রশান্তর মুখের একটা সংলাপ: যত সহজ তত ভালো! ‘… কিন্তু কে না জানে / সহজ কথা ঠিক ততটা সহজ নয়’ (সঙ্গিনী / শঙ্খ ঘোষ)! মোটকথা, ম্যাজিকের প্রতি এই দুর্বার আকর্ষণ আর কবিতার প্রতি আমার আনুগত্য আলাদা নয়। সত্যের ধন্দটা ওখানেই। যার প্রতি দুর্বার টান তাকে আদ্যোপান্ত জেনে ফেলার চেষ্টা করে জেনে ফেলা যেতেই পারে যে, টেবিলে রাখা খালি বাক্স আসলে খালি নয়, তাতে ৪৫ ডিগ্রি কোণে, তির্যক ভাবে লাগান আছে আয়না ইত্যাদি ইত্যাদি, কিন্তু তা জেনে ফেলার পরেও জাদুকর যখন দুরন্ত স্টাইলে সে বাক্স ঢেকে-রাখা কুচকুচে কালো ঝলমলে সিল্কের কাপড়টা এক ঝটকায় বাঁ হাতে টেনে ডান হাতে একটা তুড়ি মারা মাত্র সে বাক্স থেকে উড়ে যাবে এক ঝাঁক পাখি, সেই মুহূর্তে দর্শকের সত্যটাকে বাদ দিয়ে দিলেই কবিতা আর কবিতা থাকবে না, অন্য কিছু হয়ে যাবে।
মানে, আমি এ ভাবে বুঝি যে, এ সত্যটা শুধু স্রষ্টার, এ ক্ষেত্রে জাদুকরের বা কবির, সৃষ্টি নয়, পাঠকের বা দর্শকের সৃষ্টি সমানে। এখানে সত্যের হাত বদল হয় না ফলিত বিজ্ঞানের মতো। তদুপরি, এ সত্য যুক্তিগ্রাহ্য অর্থবহতা, যাকে বলে ‘to make sense’, তার উপর নির্ভরশীল নয়। কাজেই কবিতার পাঠক তাঁর পছন্দের কবির সত্যের অনুগামী হবেনই এমন কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। থাকতেই পারে না। আর তা নেই বলেই কবির সত্য একেবারে ভিন্ন ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক পরিসরে, স্পেসে, সৃষ্ট হওয়া সত্ত্বেও তার ভূত পাঠকের ঘাড়ে চেপে বসতে পারে দুই শতক পরে ভিন্নতর সত্যের গোপন কথা হয়ে। যেমন চেপেছিল আমার ঘাড়ে মির্জ়া।
মির্জ়া গালিব। শিল্পী এমএফ হুসেইন। ছবিটির নীচে যে শে’রটি লেখা আছে—
ম্যয়-সে গরজ় নিশাত হ্যায় কিস রু-সিয়াহ্ কো
ইক গোনা বেখুদি মুঝে দিন-রাত চাহিয়ে।।
(কোন মুখপোড়া চায় প্রমোদ সুরায়
নিজেকে ভোলার ঘোর নিরবধি দিন-রাত চাই)
কেমন চেপেছিল? বলছি, কিন্তু তার আগে একটু যাকে বলে বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ দরকার, একটি নয়, তিন তিনটি— ১। এই ভূত চাপায় যে মির্জ়াকে পেয়ে গেলাম, তার সঙ্গে আমার সম্পর্কের কথা আমি সঞ্চারী সেনের অসামান্য বই ‘মির্জা গালিব’-এর (প্রথম প্রকাশ উর্বী / বর্তমান সংস্করণ এনবিএ) বেশ দীর্ঘ ভূমিকায় খোলসা করেছি। সে সম্পর্ক বদলাবার নয়, কাজেই তার কিছুটা পুনরাবৃত্তি হবেই। ২। এই লেখাটা তৈরির আগে ‘গালিবের গজ়ল থেকে’ ফের জোগাড় করে ফেলেছি। তার ভূমিকায় প্রণম্য আবু সয়ীদ আইয়ুব বলছেন, ‘‘আমার এ গদ্য অনুবাদ মূলানুগই, শাব্দিক না হলেও খুব সন্নিকট।… বরঞ্চ পদ্য-অনুবাদ মূল থেকে এবং মূলের মূল্য থেকে আরো দূরে সরে যেতে বাধ্য। অনুবাদক যদি সুকবি হন, তবে ছন্দ-মিলের সৌষ্ঠবে নতুন-কিছু মূল্য সংযুক্ত হতে পারে; কিন্তু সেটা সুদ-জাতীয় মুনাফা লাভ, তাতে ক’রে কি আসলের ক্ষতিপূরণ হয়?’’ আমি নিজে মির্জ়ার যে শেরগুলি তরজমা করেছি, সেগুলি এই মত শিরোধার্য করেই। এক যেখানে মনে হয়েছে, না, ছন্দ-মিল মূলের স্বাদকে পরাস্ত করছে না, তখনই একমাত্র এর ব্যতিক্রম করার সাহস করেছি। ৩। পাঠকের একটু অধৈর্য হওয়ার অধিকার আছে, এই ভেবে যে, ফয়েজ় পরিক্রমা পড়তে বসে গালিবের সাতকাহন শুনতে হচ্ছে কেন? অনিবার্য কারণ রয়েছে। আপাতত এইটুকু— ফয়েজ় আহমেদ ফয়েজ়-এর প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম নক্শ্-ই-ফরিয়াদি। এবার একটু স্ক্রোল-আপ করে এক্কেবারে গোড়ায় কিংবদন্তি চিত্রকর মকবুল ফিদা হুসেইনের আঁকা মির্জ়ার যে ছবিটি আছে সেটি দেখুন। লক্ষ করুন তার নিচে শিল্পী একটি শে’র লিখে দিয়েছেন, যাঁরা উর্দু জানেন পড়তে পারবেন— মির্জ়ার দিওয়ানের — কাব্যসংকলনের— প্রথম গজ়লের প্রথম শে’র—
নক্শ্ ফরিয়াদি হ্যায় কিস কি শোখি-এ-তহরির কা
কাগজ়ি হ্যায় প্যায়েরহন হর প্যায়কর-এ-তসবির কা।।
এবার প্রসঙ্গে ফিরি। মির্জ়ার ভূত আমার ঘাড়ে কেমন চেপেছিল, তা একটু ভেঙে বলব বলেই শুরু করেছিলাম অনবদ্য এক গজ়লের লিঙ্ক দিয়ে, স্বয়ং বেগম আখতারের কণ্ঠে। এক্ষণে আর একবার শোনা যেতে পারে, কিংবা আরও সহস্রবার —
https://www.youtube.com/watch?v=mblW0p4Nk0c
গজ়লটা দীর্ঘ। আখতারি বাই গেয়েছেন চারটি শে’র। ক্ষতি নেই। আমরা তো এই পরিক্রমায় আগেই জেনেছি, গজ়লের শে’রগুলি এক একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ কবিতা, কেবল একই ছন্দে একত্রে গাঁথা। আমাদের লক্ষ্য প্রথমটি, যাকে বলে ‘মতলা’। তবু উর্দু-না-জানা পাঠকের খাতিরে চারটিরই অর্থানুবাদ গোছের করে দিলাম এখানে। সঙ্গে রইল আরও দু-কথা—
সেই মর্মান্তিক সংবাদে গালিবের ভূতই আমার মাথায় ঠিক কেন চেপেছিল সে রহস্যের কোনও সমাধান না থাকলেও, সেই মুহূর্তে মির্জ়াকে এক সম্পূর্ণ অন্য ভূমিকায় পেয়ে গিয়েছিলাম, যা আর জীবনভর বদলায়নি। কোন ভূমিকায়? শব্দটার কোনও এক-শব্দের বাংলা আমার জানা নেই। রাজ়দাঁ (বা রাজ়দান)।—
জ়িক্র উস পরিবশকা, অওর ফির বয়ান আপনা
বন গয়া রকিব আখির থা যো রাজ়দান আপনা।।
যেমন ছাইদান। কিংবা আতরদান। তেমনি রাজ়দান। যার কাছে আমার হৃদয়ের গোপন কথা সব, সব রাজ়, আমি গচ্ছিত রাখতে পারি, সে, এবং একমাত্র সে-ই, হতে পারে আমার রাজ়দান।
কথা উঠেছিল সে অপ্সরার, বললাম আমিও দু-কথা
প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে গেল দেখি যে ছিল আমার প্রাণসখা।।
খুব সহজ, জলের মতো— প্রিয়তমার প্রসঙ্গ উঠেছিল রাজ়দাঁ-র সঙ্গে কথায় কথায়, আমিও বললাম কিছু কথা। কী কথা? ‘বুঝ লোক যে জান সন্ধান’ (অন্নদামঙ্গল / ভারতচন্দ্র)। কিন্তু সে কথার এমনই জাদু, যে-আমার রাজ়দাঁ ছিল সেই কিনা আমার প্রিয়তমার প্রেমে পড়ে একেবারে সম্পর্কের বিপরিত মেরুতে গিয়ে হয়ে গেল রকিব। রকিব— প্রেমের প্রতিদ্বন্দ্বী। কবির ভালোবাসার পথে যে শুধু কাঁটা পড়ল তাই নয়, হয়তো তার থেকেও মর্মান্তিক তার এমন পরাণসখা চিরকালের মত হারিয়ে ফেলা।
এই রাজ়দাঁ-র কাছে আমরা ফিরব, কিন্তু তার আগে বেগম আখাতারের গাওয়া বাকি তিনটি শের নিয়ে দু-কথা। মির্জ়ার দুনিয়ায় প্রবেশের হাজার দুয়ারির এক দুয়ার হিসেবে মন্দ হবে না—
ম্যয় উয়ো কিয়ুঁ বহত পিতে বজ়ম্-এ-গয়ের মে ইয়া রব
আজহি হুয়া মনজ়ুর উনকো ইমতেহাঁ আপনা।।
(ঈশ্বর! এ হেন সুরা পান কেন করছে সে গিয়ে অন্য কারুর আসরে
বুঝেছি কী চায়, আজই সে আমায় দেখছে পরখ করে।।)
‘ফয়েজ় পরিক্রমা’ যাঁরা পড়ছেন, তাঁরা এই চলনের সঙ্গে পরিচিত হয়ে গিয়েছেন। স্মরণ করুন, সেই ‘আঘাতের উদ্যাপন’ আর ন্যাকামি-হীন কিন্তু মর্মন্তুদ ‘আত্মপ্রতারণা’— উর্দু কাব্যের ফিরে ফিরে আসা দাগ। প্রিয়তমা আমার, অন্যদের সঙ্গে একটু মৌজ-মস্তি করছে, এ খবর আমাকে অত ফলাও করে দেওয়ার কী আছে। ঈশ্বর! তুমি তো জানবে, আসলে কিছুই না, ভালোবাসে আমাকেই, একটু পরখ করে নিচ্ছে আমি কতটা ভালোবাসি! শাবাস! কিন্তু ঠিক আছে, অসামান্য কিছু নয়। যাকে বলে, কোয়ি তোপ নেহি দাগা!
মনজ়র এক বুলন্দি পর অওর হাম বনা সকতে
অর্শ-সে উধার হোতা কাশ কে মকান আপনা।।
(আরও বহু, বহু উঁচুতে দৃশ্য পারতামই এঁকে দিতে
বাসা একখানা থাকলে আমারও আরশের ওই পারেতে।। )
এই। এই হল, ভিন্টেজ মির্জ়া! আর বাঙালি হওয়ায়, এই আদ্যোপান্ত নিখাদ মির্জ়ায়ি-র সঙ্গে আমরা কিছুটা পরিচিত — ‘‘খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া, উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব বিধাত্রীর!’’ (বিদ্রোহী / কাজী নজরুল)। কিছুটা, কিন্তু পুরোটা নয়। কারণ, দর্পিত, উদ্ধত চ্যালেঞ্জটা অনেকটাই এক হলেও মির্জ়া এত সরল নয়। মহা… কী বলব, যেটা মুখে আসছে তা না বলাই ভালো! ‘মনজ়র’— দৃশ্য? কী দৃশ্য? জীবনছবি— কোনও সন্দেহই নেই। কী জীবন কাটলে / কাটাচ্ছো মির্জ়া — এই নিয়ে এত কথা শোনানোর কী আছে? নিজে স্বয়ং ঈশ্বর হয়ে বসে আছো ছোঁয়া-যায়-না এমন গগনচুম্বী (অর্শ-এর একটি সরল মানে আকাশ) সিংহাসনে, আর যত বরফট্টাই। ওইখানে আমাকেও দাওনা একটা আস্তানা, দেখিয়ে দেব! এখান থেকে আপনি কী সত্য নিয়ে যাবেন, পাঠক, তা আপনার ব্যাপার। কিন্তু আমার মির্জ়া— আসলে নিজের বিধিকেই দুষছেন নিজের মোটেই-গর্ব-করা-যায়-না এমন জীবনের জন্য (তবেই তো অন্য উচ্চতায় অন্য একটা দৃশ্য তৈরির প্রসঙ্গের উত্থাপন)। কেমন জীবন? আসব সে প্রসঙ্গেও, পরে। কিন্তু কোনও পরিস্থিতিতেই আত্মসম্মান জলাঞ্জলি না দেওয়ার ভয়ঙ্কর জেদের পরতের পর পরতের পর পরতের নীচে সেই করুণ অসহায়তা লুকনো। তাই মির্জ়ার কপালে এক চিরকালীন তকমা— মুশকিল পসন্দ্! সোজা-সাপটা কোনও কথা বলা তার ধাতেই নেই। নিজেকে করুণার পাত্র করে তোলা তার ধাতে নেই।
গজ়লের ‘মকতা’ (মনে আছে আশা করি, গজ়লের যে শেষ শে’র-এ কবি নিজের নাম চিহ্নিত করেন) —
হাম কাহাঁ-কে দানা থে, কিস হুনর মে ইয়ক্তা থে
বেসবব হুয়া গালিব দুশমন আসমাঁ আপনা।।
(কোন গুণে আমি অনন্য, বলো? কেউকেটা আমি কোথাকার?
অযথা, গালিব, এত শত্রুতা বর্ষে আকাশ বারবার।।)
আগের শে’রটির মতোই দর্পিত চলন, যার পিছনে একরাশ হাহাকার। উর্দুতে একটা প্রবচন আছে— বাজ তাঁদের মাথাতেই পড়ে, ঈশ্বর তাঁদেরই কষ্ট বেশি দেন, যাঁরা খুব বিখ্যাত মানুষ হন কোনও না কোনও ভাবে। কিন্তু এত কালের প্রবচন তো ভুল হতে পারে না, ঈশ্বর যখন এমন শত্রুতা আমার বারতে বেঁধেছেন, নিশ্চয়ই কোনও না কোনও গুণে আমি অনন্য!
এখানেই মির্জ়া, আমার কাছে, সকলের থেকে এক্কেবারে আলাদা। ভাঙবে কিন্তু মচকাবে না। এ হেন মির্জ়া বিলক্ষণ বোঝে রাজ়দাঁ হারান কত মর্মান্তিক। মর্মান্তিক এই কারণেই যে, রাজ়দাঁ-ই একমাত্র জানে— করাচিবাসী এক নিখাদ কবি অফজ়াল আহমেদ সৈয়দের পঙ্ক্তি ধার করে বলি— ‘হৃদয়ের ধ্বংসস্তূপ থেকে কাউকে জীবিত উদ্ধার করাও সম্ভব’। এই ধ্বংসস্তূপ থেকে কাউকে উদ্ধারের একটা মহাসমস্যা হল, এ এমনই একটা অন্ধকার, আমি উপলব্ধি করেছি, যাকে কোনও আলো বিদীর্ণ করতে পারে না — যাকে আমরা গাল ভরা ইংরেজিতে বলি— light at the end of the tunnel, তা নেই। কারণ সেই অন্ধকার কোনও আলোর মুখাপেক্ষীই নয়, হয়তো বা সেই অন্ধকার আলোর বিপ্রতীপ সত্যই নয়। তা এক স্বয়ংসম্পূর্ণ নিখাদ অন্ধকার যা গাঢ়তর অন্ধকারে বিলীন হয়ে যাওয়ার দিকে ধাবমানই শুধু নয়, সে জন্য ব্যাকুল।
তাহলে? তাহলে সেই অন্ধকার স্পর্শ করতে পারে এমনই স্বর যা শুধু সেই অন্ধকার থেকে উৎসারিতই নয়, তাতে কোনও পরমসত্য আলোর সন্ধানের লেকচার নেই (শির্ক কথা। কিন্তু সেই পরিস্থিতি আর সেই বয়স যে শির্ক বলারই, তা আর কেউ জানুন বা না জানুন, রবীন্দ্রনাথ তা নির্ঘাত জানেন)। সেই স্বর নিজেও তিলে তিলে অন্ধকারে গড়া। কিন্তু একটা মোক্ষম তফাৎ আছে, তা পাথরের মতো নীরব অন্ধকার কুঁদে তৈরি করে ফেলতে পেরেছে এক পরমাশ্চর্য মুখরতা। এমনই এক মুখরতা যা হৃদয়ের ধ্বংসস্তূপের কারায় বন্দিকে বাণী দেয় না, লেকচার মারে না, স্লোগান আওড়ায় না। কদাচ। নিজের উপলব্ধি শোনানোর ছলে তার সঙ্গে কথোপকথন শুরু করে। বলে—
কয়েদ-এ-হয়াত ও বন্দ-এ-গম অস্ল মে দোনো এক হ্যায়
মওত সে পহলে আদমি গম সে নজাত পায়ে কিউঁ।।
(দুনিয়ার এই কারাগার আর দুঃখের বেড়ি একই
মৃত্যুর আগে সে দুঃখ থেকে রেহাই আদৌ মিলবে কেন।।)
হলিউডের ছবিতে ভয়ঙ্কর অ্যালকাট্র্যাজ জেলখানার এক বন্দি পালানোর ছক কষতে গিয়ে যেমন প্রথমে সহবন্দিদের সঙ্গে ছোটো ছোটো বাক্যালাপের মাধ্যমে ধীরে ধীরে নৈকট্য গড়ে তোলে, অনেকটা তেমনই। পারস্পরিক আস্থা তৈরি হতে থাকে। ধ্বংসস্তূপেরই হোক বা কারাগারের প্রাচীরের, ইট একটা একটা করে সরতে থাকে। বন্দি চমকে ওঠে— আরে! এ লোকটা তো ‘আহা বেচারা’ বলছে না। ‘আপনা মাঝে শক্তি ধর’ গোছের জ্ঞান দিচ্ছে না। বলছে, ‘শোন ভায়া, দুনিয়াটাই একটা মহাকারাগার। জম্মেছ, আমৃত্যু এর মধ্যেই ঘুরঘুর করবে, বুঝলে! এই সার সত্যটা আমিও বুঝে ফেলেছি।’ কিন্তু এটাও মির্জ়ায়ি নয়, আসল মির্জ়ায়ি হল এক্কেবারে শেষের প্রশ্মবোধক ছোট্টো শব্দটা জুড়ে দেওয়া— কিউঁ। মৃত্যুর আগে সে দুঃখ থেকে রেহাই আদৌ মিলবে কেন? ‘কেন?’ শে’রটা বার বার পড়লে বোঝা যাবে, এখানে এই ‘কেন’ একেবারেই স্বাভাবিক নয়। কবি তো নিজের উপলব্ধি বয়ান করছে। স্টেটমেন্ট করছে। তা এমন ‘কেন’-তে শেষ হবে কেন!? এবং এইখানেই মির্জ়া অনন্যসাধারণ। এই ‘কেন’ আসলে আমাদের চলতি লব্জে — কেন শুনি? সে আমাকেও কথা বলার আহ্বান জানাচ্ছে। সমানে সমানে। নইলে এমন স্পষ্টতই গোতমীয় উপলব্ধির পুনরাবৃত্তিকে ‘কিউঁ’— কেন শুনি?— দিয়ে শেষ করার কোনও কারণ থাকতেই পারে না। এবং একবার সে আহ্বানে সাড়া দেওয়া মাত্র, পাঠক, আপনি মির্জ়ার কবিতায় বন্দি হয়ে গেলেন সানন্দে। জাদু! আমার গালিবপাঠ চিরকালের মতো বদলে গেল। পোহায়ে বিনিদ্র শর্বরী পূর্বপরিচিত গালিবের গোটা কবিতাসত্তাটাই দেখা দিল রাজ়দাঁ মির্জ়া হয়ে। যার প্রথম চিহ্ন, আমার মনে, এ কবির নামের সর্বনাম থেকে ঁ-টা উঠে গেল!
সে আজ কত বছর হল! সেই থেকে আমি বোধ করেছি, মির্জ়ার শ্রেষ্ঠ কবিতা একলা চলে না। পদে পদে ‘পার্টিসিপেটরি’। মির্জ়া আপনার সঙ্গে অবিরত কথা বলবে, এবং আশা করবে আপনি সে কথোপকথনে সোৎসাহে অংশ নেবেন। যদি না নিতে পারেন, আপনি মির্জ়ার কবিতার জাদুর জন্য এখনও প্রস্তুত নন। তাতে অংশ নিয়েই একমাত্র খুঁজে বার করা সম্ভব মির্জ়ার কবিতার ছত্রে ছত্রে পরতের পর পরতের পর পরতের নীচে সাংঘাতিক পরিশ্রমী, শুধু পরিশ্রমীই নয় নিজের প্রতি নির্মম, মুন্সিয়ানায় ঢেকে রাখা পরমাশ্চর্য নানা উপলব্ধি। হৃদয়ের ধ্বংসস্তুপে ঢুকে পড়ে টেনে হিঁচড়ে, এ অঙ্গ কেটে ফেলে, ওটা থেঁতলে আমাকে বের করে আনার কোনও চেষ্টাই না করে মির্জ়া ধ্বংস্তূপের কারাগারটাকেই এক ব্যক্তিগত ভুলভুলাইয়া করে ফেলল। নানা কুলুঙ্গিতে সে তার বাদশাহি আংটি লুকোয়, আর আমি খুঁজতে থাকি। আজ যখন এত কাল পরে, অন্ধকারের থেকে আলো শ্রেয়তর, এই বোধটাকেই ফেলে দিতে পেরেছি, হলিউডের ‘ওয়াইল্ড ওয়েস্ট’ কাউবয় ছবির কোনও দৃশ্যের মতো তেকিলা-শট-গ্লাস শূন্যে তুলে ধরে দুশো বছরের ওপারে চেঁচিয়ে বলতেই হবে— I owe you one, Mirza!
কবিতা যাঁরা লেখেন, বা মন দিয়ে পড়েনও তাঁরা সহজেই বুঝবেন কী কঠোর পরিশ্রমে এমন কবিতা সৃষ্টি করা যায়। জাদুকরের অহোরাত্র প্র্যাক্টিসের পরিশ্রমও বোধ করি হার মানবে তার কাছে। কিন্তু নির্মম কেন? আরও অনেক কিছুর সঙ্গে এটাও একেবারে নির্ভুল, চরম অমির্জ়ায়ি (কারণ মির্জ়া যে সততই ভুলে ভরা, বলতে গেলে প্রায়শই ভুলে-ভরা-জীবনের থ্রিলার) অঙ্কে দেখিয়ে দিয়েছেন মেহর অফশান ফারুকি। ভদ্রমহিলা অতি সম্প্রতি লিখে ফেলেছেন মির্জ়ার সেরা জীবনী — Ghalib: A Wilderness at My Doorstep: A Critical Biography (Allen Lane / 2021)। ভারতের মধ্যযুগীয় কবিদের মধ্যে মির্জ়া বিশেষ ভাগ্যবান এই কারণেই যে, তার জীবদ্দশাতেই এ দেশে বই ছাপার প্রযুক্তি বেশ সহজলভ্য হয়ে যায়। অধ্যাপক ফারুকি জানাচ্ছেন, জীবৎকালে নিজের উর্দু কবিতাগুলির মুদ্রিত দিওয়ান (সরলার্থে, ছন্দের নিরিখে সাজান কাব্যসংকলন) পাঁচবার সম্পাদনা করে মির্জ়া। পাঁচটি সংস্করণের জন্য— ১৮৪১, ১৮৪৭, ১৮৬১, ১৮৬২-৬৩ এবং ১৮৬৩ সালে। এর মধ্যে ১৮৬২-৬৩-র সংস্করণটিতেই রয়েছে সব থেকে বেশি সংখ্যক কবিতা। নিজের লেখা ৪২০৯টি কবিতার মধ্যে ১৮০২টি কবিতা সেই সংস্করণে ছাপার অনুমতি দেয় মির্জ়া। পরেরটাতে আরও কমিয়ে দেয়। হিসেব করে দেখলাম, ২৪০৭টি কবিতা সে স্রেফ ধরে ফেলে দিয়েছিল, ছাপার অযোগ্য মনে করে। হাতে কপি করা দিওয়ান নয় এই ছাপা বই-ই যে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে থেকে যাবে সে বিষয়ে বিলক্ষণ ওয়াকিফহাল ছিল সে। সে দিনই একটি লেখায় দেখলাম বর্ষীয়ান কবি গৌতম বসু, শঙ্খ ঘোষের কিছু কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়ে আক্ষেপ করেছেন ইদানীংকালের ‘স্বভাবকবি’-দের কোলে টুপটাপ কবিতা ঝরে পড়ার হিড়িক নিয়ে। সত্যিই, কী লিখি আর তার মধ্যে কী প্রকাশ করি সেই হিসেবটা মির্জ়ার হিসেবের সঙ্গে মিলিয়ে দেখে যা লজ্জা পেলাম তা আর বলার নয়।
দিওয়ান-এ-গালিব। নিজ়ামি প্রেস। কানপুর। প্রথম সংস্করণ। ১৮৬২
কিন্তু কথা হল, সেই অন্ধকার দিনকালে মির্জ়াকে আমি পেলাম কোথায়? এর বেশ কিছু বছর আগে কলকাতা থেকে এইচএমভি-র যে স্টিরিও টার্নটেবল কিনেছিলাম সে কথাও এ পরিক্রমাতেই আগে বলেছি, এক ছুটিতে নরেন্দ্রপুর থেকে বাড়ি ফিরে দেখি তার পাশেই রাখা রয়েছে একটা এলপি ভিনাইল রেকর্ড— Begum Akhtar Sings Ghalib। পিতৃদেবের উপহার! দু-পিঠে আটটি গজ়ল। তখন তো আমি মেহদি হাসানে মশগুল! গজ়ল মানে তিনিই শেষ কথা, এমন আস্ফালন করেছি একাধিকবার বাড়িতে। তাই নিজের লখনওই ঘরানার তহজ়িব বরকরার রেখে, কোনও তর্কে না গিয়ে, আমাকে মৃদু শিক্ষা দিলেন কমরেড নিহার হাজরা! চালিয়ে শুনেই বুঝলাম, ও বাবা, এঁর ‘আন্দাজ়-এ-বয়াঁ’-ই তো ‘কুছ অওর’, বয়ানের ঢঙটাই ভিন্ন। পুরনো ক্ষতর স্মৃতির মতো।
আর তারও কিছুদিন পরে পেয়ে গিয়েছিলাম বাংলায় মির্জ়ার কবিতার এ পর্যন্ত সেরা তরজমা— আইয়ুবকৃত ‘গালিবের গজল থেকে’ (দে’জ পাবলিশিং)। আগেও বলেছি, তাতে বেশ কিছু শে’র-এর তরজমার হিরে-জহরত ছাড়াও আছে এক রত্নভাণ্ডার — একটি দীর্ঘ ভূমিকা। কাজেই মির্জ়ার সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে গিয়েছিল দুই দিকপালের হাত ধরে। অনেক বছর আগে, সম্ভবত ১৯৯২ সালে, মহেশতলায় বন্ধ কভার করতে গিয়েছিলাম আমরা জনা তিনেক— আনন্দবাজারের কাজী-দা (গোলাম গাউস সিদ্দিকী), রোহিত-দা (বসু) আর আমি। সহসা এক দল মাতাল গুণ্ডা আমাদের আক্রমণ করে। কাজীদাই সবার আগে ঢুকে ছিলেন, তাঁর নাকে ঘুষি মেরে চশমা ভেঙে দেয়। আমার বাড়ান ডান হাতে আলতো করে ক্ষুর মারে। বেশ রক্তপাত হয়েছিল। দাগটা আছে। আর সেটাতে হাত বুলিয়ে আজও পষ্ট মনে করে নিতে পারি ঘটনাটা। তেমনই মনে পড়ে সেই অন্ধকার দিনকালে মাথার ভিতর মিশকালো ভিনাইল রেকর্ডটা অন্তহীন ঘুরেই চলেছে, ঘুরেই চলেছে। ওই আটটা গজ়ল দিয়েই আমার সঙ্গে মির্জ়ার কথোপকথন শুরু। যার দ্বিতীয় পিঠের প্রথম গজ়ল ছিল এটি—
https://www.youtube.com/watch?v=3NJLhALv1WQ
দিলহি তো হ্যায় না সঙ্গ্-ও-খিশ্ত দর্দসে ভর না-আয়ে কিউঁ
রোয়েঙ্গে হাম হাজ়ার বার কোয়ি হামে সতায়েঁ কিউঁ।।
আমরা বসে আছি। পাশাপাশি। অন্ধকারে পিঠ দিয়ে। কে জানে কোথা থেকে মির্জ়ার পাশে এসে গেছে ইয়া লম্বা নলওয়ালা মোরাদাবাদী কাঁসার আশ্চর্য কারুকাজ করা আলবোলা। আমারটা অনেক প্লেন, কাচের আর কাঠের। কায়রো থেকে এনে দিয়েছে আমার প্রাক্তন সহকর্মী পঙ্কজ সাহা। তামাকের সুগন্ধ ভলকে ভলকে বেরিয়ে আসছে বৃত্তাকার ভুড়ুক ভুড়ুক শব্দ থেকে। মির্জ়া বলে চলে—
এ হৃদয়, ইট-কাঠ-পাথর তো নয়, ব্যথায় ভরে যাবেই না বা কেন
কাঁদবই তো, হাজার বার, কেউ আমাকে এমন আঘাত করবেই বা কেন।।
‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু…’-র প্রশান্ত সান্ত্বনার একেবারে চরম বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে এই শে’র। আবার অন্য দিকে, ‘চোখে সানগ্লাস শক্ত চোয়াল’ স্টুপিড পুরুষতান্ত্রিক ম্যাচো ইমেজের গালে এক বিরাশি সিক্কার চড় (ভেবে দেখুন জীবনে কতবার শুনেছেন ‘মেয়েদের মতো ফ্যাঁচ-ফ্যাঁচ করে কাঁদিস না তো’!)। এবং কোনও ‘পূর্ণ’-র পায়ে ‘মনোস্থান’ মাগার পরিবর্তে যে এখানে ‘কেন’-র প্রায় প্রিস্টিন, অপাপবিদ্ধ, প্রশ্নটি হাজির শুধু তাই নয়, তদুপরি হাজির এক বিচিত্র ‘কেউ’। কে কাঁদায়? কে আঘাত করে? রাজ়দাঁ? প্রিয়তমা? নাকি ‘সে-ই পূর্ণ’-র ‘সে’ স্বয়ং? সত্যিই কি তবে ‘As flies to wanton boys, we are to gods’ (King Lear / Shakespear)? কেনই বা আঘাত করে? কী যুক্তি দুনিয়াময় এত আঘাতের পিছনে? গোতম নিজেও এ প্রশ্নের উত্তর করে যাননি। মির্জ়ার গলায় এ কি হাহাকার? নাকি চ্যালেঞ্জ? সম্পূর্ণ অনির্ধারিত, আনচার্টেড, তরল আঁধার থেকে এই কবিতার উৎসার। আমি মাথা নেড়ে বলতে পারি— জানি না, জাস্ট জানি না! কিন্তু আমি একজ্যাক্টলি জানি তুমি কী বলছ। আমার অনির্বচনীয়কে তুমি ভাষা দিচ্ছ। বলছি এই কারণেই যে, এ মুহূর্তে আমি এই মানুষটির সঙ্গেই কথা বলতে পারি। তার যাবতীয় ভেঙে পড়া নিয়ে সে এক অপরিপূর্ণ নিখাদ মানুষ। এবং এ মুহূর্তে আমার কোনও ঋষি বা বিপ্লবীর দরকার নেই— ফর হেভেন্স সেক, গেট লস্ট!
দয়ের নেহি, হরম নেহি, দর নেহি, আস্তাঁ নেহি
ব্যায়ঠে হ্যায়ঁ রাহগুজ়রপে হাম, গয়ের হামে উঠায়ে কিউঁ।।
(প্রার্থনাগৃহ নয়, কারুর দুয়ার নয়, আশ্রয় নয়, পীরের আবাস নয়
পথে বসেছি, সেখান থেকেও কেউ আমাকে উঠিয়েই বা দেবে কেন।।)
কী সাংঘাতিক উচ্চারণ তা প্রথম পাঠেই মালুম হয়। তবু এই লেখা লিখতে বসে, এত কাল পরে এত বার শোনা ও পড়ার পরেও, মনে হল যেন সাদা-কালোয় লিখে ফেলার আগে দু’ একটা খটকার সমাধান করা দরকার। ‘ব্যায়ঠে হ্যায়ঁ রাহগুজ়রপে’— পথে বসেছি। এই ‘পথে বসা’ কি তবে বাঙালির পথে বসাই— নিঃস্ব হয়ে যাওয়া, সর্বস্বান্ত হওয়া? নাঃ, নিশ্চিত হতে পারছি না। কাজেই সোজা করাচিতে ফোন। প্রিয়তম অসমবয়সী বন্ধু অফজ়াল আহমেদ সৈয়দ। কুশল বিনিময়। তারপরেই স্বভাবসিদ্ধ অতি মৃদু স্বরে, দ্বিধাভরে থমকে থমকে দু’ চারটি কথা— ‘‘দেখো, উর্দুতে যে ‘সড়ক পর আ গয়ে’ কথাটা চলে না তা না। ব্যাবসা লাটে উঠলে যেমন। কিন্তু, মানে, আমি ভাবছিলাম তা বোধহয় নয়। আমি ভাবছিলাম, কবি বেশ স্পষ্টই বলছেন— মন্দির (দয়ের), কাবা (হরম), নিজের মেহবুবের দরজা, কিংবা কোনও পীরের আস্তানা এ সবই প্রত্যাখ্যান করছেন তিনি, কিংবা হয়তো কোথাওই টিকতে পারেননি। দুটোই হতে পারে, আমার তো তাই মনে হয়। এবং রাস্তা, যেটা একটা পাবলিক স্পেস, যেটা সক্কলের, সেখানেই বসাটা তাঁর একটা সজ্ঞান সিদ্ধান্ত। কিন্তু কেউ একজন — তুমি যখন শে’রটা পড়লে ‘উঠায়েঁ’ বললে, আমার কিন্তু মনে পড়ছে যেন — ‘উঠায়ে’, মানে বহু বচন নয়, তা কেউ একজন সেখান থেকেও কেন তাঁকে তুলে দিচ্ছে, তাই নিয়েই কবির অভিযোগ বলো, অনুযোগ বলো…।’’
যাক, অনেক নিশ্চিন্ত হলাম। আর হ্যাঁ, চোখের সামনে মূলটা খোলা থাকলেও, উচ্চারণটা ভুলই করেছিলাম। অফজ়াল সাহাব আমার মূল ভাবনাটাকে নস্যাৎ করলেন না। কাজেই, ঠিক নিঃস্ব হওয়া নয়, কে কখন মন্দির-মসজিদ ছেড়ে, প্রিয়া বা ঈশ্বরের কোনও আশ্রয়ের মুখাপেক্ষী না হয়ে, বা না হতে পেরে, পথে বসে, এ প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে। যেমন মৌলিক ভাবে থেকে যাচ্ছে এই ‘তুলে দেওয়ার’ অন্যায় কেন যে ঘটে সে প্রশ্নটাও।
এর পরে আখতারির গাওয়া শে’রটি আগেই দীর্ঘ আলোচনা করেছি। কাজেই শেষ শে’র মকতায় যাই—
গালিব-এ-খাস্তা-কে বগয়ের কওন-সে কাম বন্ধ হ্যায়
রোইয়ে জ়ার জ়ার কেয়া, কিজিয়ে হায়-হায় কিউঁ।।
(ভঙ্গুর এই গালিব নেই তো কোন কাজটা বন্ধ আছে শুনি
কিসেরই বা এত হায়-হায়, এমন ডুকরে কান্নাই বা কেন)
সহজ সত্য— দুনিয়ায় কেউ অপরিহার্য নয়। আজ অবধি কেউ জন্মেনি যাকে ছাড়া সত্যিই দুনিয়ার চলবে না। কোন নাদান সেটা জানে না? সকলেই জানে। তবুও কেন হৃদয়ের এ কূল ও কূল দুকূল ভেসে চোখের জল উথলে ওঠে? কেন এমন হয়? কেন মনে হয়— But, in truth, I have wept too much! Dawns are heartbreaking. /Every moon is atrocious and every sun bitter. / Acrid love has swollen me with intoxicating torpor / O let my keel burst! O let me go into the sea! (The Drunken Boat / Arthur Rimbaud)। কিন্তু শে’রটা আরও বার কয়েক পড়লেই ভেসে উঠবে, এই সহজ সত্যের উচ্চারণে বা তা নিয়ে এক আপাত-‘নাইভ’ জেদি প্রশ্নেও আসল মির্জ়ায়ি নেই। আসল মির্জ়ায়ি এইখানেই যে, মির্জ়া ভঙ্গুর, মির্জ়া নশ্বর, সে না থাকলে দুনিয়ার কোনও কাজ বন্ধ থাকবে না, দিব্যি চলবে— সবই ঠিক। তথাপি সে না থাকায় কেউ একজন ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। কারও বেদনায় তারও পরিমাপহীন মূল্য আছে— যদি ধরেও নিই যে এও আসলে আত্মপ্রতারণা, এমনটাই সে মনে করতে ভালোবাসে। এখানেই মির্জ়া তুলনাতীত— এই দুনিয়াতে, এ ইহকালেই, রাজ্যের দার্শনিক সত্যাসত্যকে পরাস্ত করে এক ব্যখ্যাতীত মানবিকতায় হৃদয়ের ধ্বংসস্তূপে শত-ভঙ্গুর মানুষটার পাশে এসে বসা দিয়েই কানায় কানায় ভরা রাজ়দান মির্জ়ার পেয়ালা।
পাঠক হয়তো এক্ষণে বেশ কল্পনা করে নিতে পারছেন, জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতায় জারিত এক বৃদ্ধ কবির, খুখ্খুকে কাশি আর আলবোলায় ভুড়ুক ভুড়ুক টানের ফাঁকে ফাঁকে এক-কুড়ির মাঝকোঠার যুবকের সঙ্গে শে’র-ও-শায়রির ইশারায় কথপোকথনের দৃশ্য। যদি পারছেন, খুব সম্ভবত, সম্পূর্ণ ভুল করছেন…!
(ক্রমশ…)
নবম পর্বের অপেক্ষায় ছিলাম। অসাধারণ। পরবর্তি পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
নবম পর্বের অপেক্ষায় ছিলাম। অসাধারণ লাগলো। পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম
খুব ভালো লাগল।