ফয়েজ় পরিক্রমা – ৭
নীলাঞ্জন হাজরা
"ফরহাদ আর জামিশদ বা ‘জম’-এর কথা তো শুনলাম। আর এই শেরেই এক অর্থে লুকিয়ে আছে ফয়েজ় পাঠের চাবিকাঠি। এ প্রসঙ্গে বিশদে ফিরতে হবে আমাদের, অনেক পরে। আপাতত শুধু এইটুকুই যে, কবি একটা বিশেষ সময়ে — কারান্তরালে তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ভোরের হাওয়ার হাত’ রচিত হওয়ার সময়ে — এই শে’রে এসে বলেই দিলেন আমার কবিতা বুঝে নিতে হলে প্রতীকের পিছনে তাকাতে হবে। আর একটা কথা এই গজ়ল প্রসঙ্গে — ‘হরম’ মানে পবিত্র প্রার্থনাগৃহ’ যেমন হতে পারে তেমনই হতে পারে ‘নিষিদ্ধ দুনিয়া’। তরজমাকারের কী বিড়ম্বনা ভাবুন। তা হলে কি এ শে’র বলছে ‘প্রাথনাগৃহের মানুষেরা বেশ আছে / তুমি তাদের কথাই বলো’? আরও আছে। দয়ের-এর একটা অর্থ মন্দির। হরম বোঝান হয় ‘কাবা’ কিংবা মসজিদ বোঝাতে, বিশেষত ‘দয়ের-ও-হরম’ গোছের শব্দবন্ধে — মন্দির-মসজিদ। তবে কী ফয়েজ় বলছেন — মন্দিরের মানুষেরা দিব্যি আছেন / তুমি কাবার মানুষদের কথা বলো? অন্তত কিছুকাল ফয়েজ়-সহবাসের জোরে আমি বলব, অসম্ভব। আমার পাঠে এখানে ‘হরম’ নিষিদ্ধ দুনিয়া অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। " ফয়েজ পরিক্রমা-৭। নীলাঞ্জন হাজরার কলমে।
প্রথম পর্ব—-> প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব—-> দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব –> তৃতীয় পর্ব
চতুর্থ পর্ব —> চতুর্থ পর্ব
পঞ্চম পর্ব —> পঞ্চম পর্ব
ষষ্ঠ পর্ব –> ষষ্ঠ পর্ব
কী ক্ষমতা যে ভালোবাসায়, সেই কথা বলো
(বিশেষ অনুরোধ — এই লেখা লিখছি আবহমান পত্রিকার ইন্টারনেট সংস্করণের জন্য। ইন্টারনেট আমাদের সামনে এনে দিয়েছে একাধারে পড়া দেখা শোনার অভিজ্ঞতার অভূতপূর্ব সুযোগ। সেই ভাবেই এ লেখার বয়ন। তাই সঙ্গের লিঙ্কগুলি অতিরিক্ত মনে করে উপেক্ষা করবেন না)
উস্ কুঞ্জ্-এ-লব চিপকে হুয়ে মুহ্ কো রাখ-কে হাম
দিলচস্প্ ইস মকাম-মে হর্ফ-ও-কলাম কেয়া।।
(সে ঠোঁটের কোণে সেঁটে রেখেছি মুখ
মনমাতানো সেই ঠিকানায় কবিতা কিসের, কিসের লেখালিখি।।)
আমার এক বান্ধবীর লব্জে, একেই বলে ‘দমবন্ধ চুমু’! উর্দু কাব্যে যে এমন রুদ্ধশ্বাস অপূর্ব যৌনতা থাকতে পারে তাও, আমি দেখেছি, বাঙালির কাছে প্রায় অবিশ্বাস্যই। অঢেল যে আছে তা আমি পাইনি। কিন্তু আছে। আর সেটা, আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন প্রণম্য গোপীচাঁদ নারঙ্গ্, উর্দু কবিরা সরাসরি পেয়েছেন ভারতের দীর্ঘকালীন পরম্পরা থেকে। কাব্য-মহাকাব্য থেকে উদ্ধৃত করা যায় ঢের, কিন্তু আমি সে পরম্পরার প্রথম স্পর্শযোগ্য স্পর্শ পেয়েছিলাম ১৯৮৭ সালে। সে কী হইহই। বাইশ জন মানুষ। তার মধ্যে প্রেসিডেন্সি কলেজের ইতিহাস বিভাগের প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের ১৯ জন ছাত্রী, তিন জন ছাত্র ও এক মাস্টারমশাই — অজয় বন্দ্যোপাধ্যায়।
আমার সহপাঠী, এখনও বন্ধু, ঊর্মিলা, তার বাবা প্রণম্য ইতিহাসকার বরুণ দে, তস্য বন্ধু তরুণকুমার ভাদুড়ী (হ্যাঁ তিনিই) তখন সম্ভবত মধ্যপ্রদেশ পর্যটন বিভাগের সর্বেসর্বা। কাজেই সাতনা স্টেশনে যখন এই সম্মিলিত হট্টগোল নামল তখন সেখানে অপেক্ষা করছে একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পেল্লায় টুরিস্ট বাস ও বছর তিরিশের এক ভারি বিনয়ী ঝকঝকে যুবক, যার নামটা আজ আর মনে নেই — সবাই সিংজি বলেই ডাকছিলাম আমরা। তিনি গাইড। আগামী দিন কুড়ি সে দুই-ই আমাদের সঙ্গে ছিল। সেই বাতাসিয়া স্মৃতির কাহন এখানে নয়। কেবল এইটুকুই যে, সেই সফরে চাণ্ডেলা বংশের রাজা বিদ্যাধরের আদেশে একাদশ শতকের এক্কেবারে শুরুতেই — মানে ওই ওপরের শে’র রচনার সাতশো বছর আগে — তৈরি গুহাবাসী মহাদেবের হিন্দু স্থাপত্য কাণ্ডারিয়া মহাদেব মন্দিরে যখন পৌঁছলাম তখন লাজুক সিংজি দু-লাইনে তার ইতিহাস আউড়ে একটি বাক্য বলে দ্রুত বাসে ফিরে গিয়েছিলেন — মন্দিরের গায়ে যে সব কারুকার্য আছে সেগুলির অর্থ ভেঙে বলার দরকার নেই, তোমরা নিজেরাই বিলক্ষণ বুঝতে পারবে। ওই শে’র থেকে এ কারুকার্য খুব দূর নয় —
‘কুঞ্জ্-এ-লব’ কথাটা আমি আর একটি শে’রেই পেয়েছি। আপনারাও পেয়েছেন দ্বিতীয় পর্বে। কভি তো সুবহ তেরে কুঞ্জ্-এ-লব-সে হো আগাজ় / কভি তো শব সর-এ-কাকুল-সে মুশ্কবার চলে।।
দুটির রচনার মধ্যে তফাৎ মোটামুটি তিনশো বছর। প্রথমটি মীর তাকি মীরের (এই শে’রটি আমি উর্দুর মহাপণ্ডিত গোপীচাঁদ নারঙ্গের একটি অনবদ্য বক্তৃতায় পেয়েছি, আমার অল্প-বিস্তর মীরপাঠে নয়) দ্বিতীয়টি ফয়েজ়ের। বেশ মজা লেগেছিল দেখে মীরের একেবারে ঠোঁটে লেগে থাকা প্রেমের ‘টাইট ক্লোজ-আপ শট’, ফয়েজ়ে এসে কী ভাবে মন-কেমন-করা লং শট হয়ে গেল। ‘কুঞ্জ্’ কথাটার অর্থ এমনিতে হতে পারে একেবারে বাংলা, বা সংস্কৃত, ‘কুঞ্জ’। কাজেই ‘কুঞ্জ্-এ-লব’ যদি অর্থ করি ‘ঠোঁটের কুঞ্জ’, এবং আমরা বাঙালিরা চিরকালজয়ী গীতিকারের ‘কুঞ্জবনে মোর মুকুল যত / আবরণবন্ধন ছিঁড়িতে চাহে’-র স্মৃতিতে প্রেমাস্পদের ঠোঁটে আবরণবন্ধন ছিন্ন করার ব্যাকুলতা দিয়ে দিই, কে আটকায়? নবীন পাবলো নেরুদাও তো ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা’-র স্প্যানিশ তরজমা হয়ে ঘুর পথে পৌঁছে গিয়েছিলেন ইত্যাকার পঙ্ক্তিতে — In my sky at twilight you are like a cloud / and your form and color are the way I love them. (Poem XVI. Twenty Poems of Love and a Song of Despair. Pablo Neruda. The Poetry of Pablo Neruda. P. 931. Farrar, Straus and Giroux. Kindle Edition.) এবং এই কবিতার তরজমাকার মার্কিন কবি এম.এস. মারওয়িন একেবারে নোট দিয়ে বলেই দিয়েছেন — This poem is a paraphrase of the thirtieth poem in Rabindranath Tagore’s The Gardener.)
‘এক কুড়ি প্রেমের কবিতা ও একটি হাতাশাময় গান’ রচনার দিনের নবীন নেরুদা
আমার মনে আছে, প্রিয় জ্যোতি-দা, জ্যোতির্ময় দত্ত— যিনি বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্তের মতো দিকপালদের কবিতা-আড্ডার অন্দরমহলের মানুষ, যা থেকে অনুমেয় কবিতা নিয়ে তাঁর পড়াশুনা কী অগাধ, যদিও তাঁদের থেকে বয়সে অনেকই ছোটো— একবার খুব উস্মা প্রকাশ করেছিলেন যে, নেরুদার ওপর রবীন্দ্রনাথের এই প্রভাব চিলেনো কবি নিজে কখনও স্বীকার করেননি, অন্যকে খুঁজে বার করতে হয়েছে। সম্ভবত কথাটা ঠিক না, কোথাও যেন পড়েছিলাম যে নেরুদা শেষ জীবনে সে কথা নিজেই বলে গিয়েছেন। তবে তার থেকেও বড়ো কথা — কবির রক্তে যে কখন কোথা থেকে কী এসে জমে এবং তা ক্রমে কোন কোন কবিতায় রং বদলে হাজির হয় কবি নিজেই হয়তো কচিৎ তার হদিশ রাখেন। দীপ্তি ত্রিপাঠীর অসামান্য ‘আধুনিক বাংলা কাব্যপরিচয়’ খুলে সেই কতো ছোটোবেলাতেই তো দেখে নিয়েছিলাম ডব্লিউ বি ইয়েট্স-এর He Reproves the Curlew কী ভাবে ‘হায় চিল’ হয়ে গিয়েছে। রবীন্দ্রনাথের কত হাসির কানায় কানায় ভরা নয়নজলতরঙ্গে যে শেলি অনুরণিত তা আমরা সকলেই জানি। তাতে কী? এমনটাই তো স্বাভাবিক, সত্যি বলতে কী, খুব জরুরি। যেমনটা একবার কবীর সুমন আমাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কবি সুকান্তকে উদ্ধৃত করে (বোধন) বলেছিলেন— দেখতে হবে রক্তে পূর্বপুরুষ উপস্থিত কি না। হক কথা, আমি অবশ্য বলব ‘পূর্বজ’।
কিন্তু কথা হচ্ছিল কুঞ্জ্-এ-লব নিয়ে। তা ঠোঁটের কুঞ্জ হতেই পারে, যদিও ঠোঁটের সংস্পর্শে এসে কথাটার মানে সাধারণ লব্জে হয়ে যায় ‘কোণ’। ঠোঁটের কোণ। তোমার ঠোঁটের কোণে কখনও তো ফুটে উঠুক ভোর / বিনুনির পাকে পাকে কখনও আবার কস্তুরীগন্ধী আঁধার।।
আর যেমনটা দেখলাম, কী ভাবে মীরের শব্দবন্ধ নিয়েও ছবিটা একেবারে বদলে দিলেন ফয়েজ়। ফয়েজ়ের কবিতায় কী যৌনতা নেই তবে? আছে। খুব প্রথার বাঁধনে আছে। মীরের তরতাজা ছোঁয়া তাতে নেই। যেমন ধরুন —
গুঁধ-কে গোয়া পত্তি গুল কি উয়ো তকরিব বানায়ি হ্যায়
রঙ্গ্ বদন কা তব দেখো যব চোলি ভিগি পসিনে-মে।।
(বিনুনি বুনে পাতা বুঝি ফুলের গড়েছে সেই অবয়ব
দ্যাখো দেহের রঙ যখন কাঁচুলি ঘামে ভিজে জবজব।।)
রুদ্ধশ্বাস! পাবলো নেরুদার সেই দূরবর্তী ‘your form and color’-কেই মীর হাজির করলেন কী আশ্চর্য ইন্দ্রিয়স্পর্শী প্রেমে। ‘ভিজে জবজব’ শব্দবন্ধটা অবিশ্যি আমার পছন্দ হচ্ছে না। তবু রাখলাম। রাখলাম এই কারণেই যে, তরজমায় মীরের এক সাংঘাতিক দক্ষতার নাগাল পাওয়া যে কী কঠিন তার এটা বেশ ভালো উদাহরণ। প্রথমত একটা ছবি তৈরি করার দক্ষতা, কিন্তু তার থেকেও বড়ো কথা দুটো এমন চিত্রকল্পকে অনায়াস সাবলীলতায় পাশাপাশি ফেলে পাঠককে-চ্যালেঞ্জ-করা যার একটা বেশ জটিল, অন্যটা যেন একেবারে পথচলতি মানুষের মুখের লব্জ থেকে তুলে আনা। বিনুনিতে যেমন চুল তার পূর্ণ প্রসারে দেখা যায় না, একটার সঙ্গে আরেকটা জড়িয়ে একটা আংশিক ছবি তৈরি করে, ডালে ডালে ঘন পাতা বুঝি ঠিক সেই ভাবে ফুলের সঙ্গে জড়িয়ে তাকে আংশিক আড়াল করে রেখেছে। ফুলের রঙ পাতার ফাঁকে টুকি দিচ্ছে মাত্র। সেখান থেকে সাঁ করে তিনি যে পরের ছবিটা আঁকলেন, তা ভেঙে বলার অপেক্ষা রাখে না, সকলেই বিলক্ষণ বুঝে নিতে পারবেন। আর সেই পঙ্ক্তিতে ব্যবহৃত শব্দগুলোও এক্কেবারে দিল্লিবাসীর, উত্তরভারতবাসীর মুখের ভাষা! চোলি। যদিও তিনিই যে প্রথম তা করলেন তা নয়। সেখানেও উপস্থিত এক পূর্বজ — মনে পড়ে? আমরা এ সফরেই সে চোলি দেখে এসেছি কুলি কুতব শাহের দরবারি আসরে — চোলি মস্ত্ খুলি মস্ত্…। কিন্তু এও দেখুন, সেই দরবারি চোলি-কে মীর ঘামে ভিজিয়ে কেমন মাটির কাছাকাছির দৃশ্যগন্ধ দিয়ে দিলেন।
ইনি অবশ্য শ্বেদ নয়, স্নানসিক্তা বোধহয়।
হেমেন মজুমদার (১৮৯৪-১৯৪৮)। ছবির নাম ‘সূর্যমুখী ফুল’।
২০১৫ সালে ১৫ ডিসেম্বর ক্রিস্টি’জ-এ নিলাম হয়েছে ৯৮
লক্ষ ২৫ হাজার টাকায়!
আমরা এই সফরে চলতে চলতে লক্ষ করব, উর্দু কবিরা প্রায় শততই তাকে বলছেন ‘বন্দ-এ-কাবা’। বুকের আচ্ছাদনের বাঁধন। মীর এখানে সে সবের ধার ধারলেন না। যাঁরা ভাবলেন ‘চোলি-কে পিছে কেয়া হ্যায়, চোলি-কে পিছে’ মার্কা রগরগে গান লিখে খুব কেল্লা ফতে করেছেন, সে গান শুনে মীর ও কুতব শাহের ভূতের মুচকি হাসি লক্ষই করলেন না তাঁরা। তাই তরজমায় ‘শ্বেদসিক্ত’ গোছের শব্দ এড়ানো দরকার ছিল। কিন্তু ‘ঘামে ভিজে জবজব’ কী যথেষ্ট ঠিকঠাক হলো। আমার অন্তত খুব পছন্দ হলো না। বেশ। কিন্তু পাঠককে চ্যালেঞ্জটা কোথায়? চ্যালেঞ্জটা এখানেই যে কোনটা কার উপমা বলুন তো, ভিজে স্বচ্ছ হয়ে যাওয়া কাপড়ের ফাঁক দিয়ে টুকি দেওয়া স্তনের রঙের উপমা পাতার আড়ালে টুকি দেওয়া ফুল, নাকি উল্টোটা?
আরও আছে। অনেক। নারঙ্গ্ তাঁর ওই বক্তৃতায় বারংবার বলছেন, মেহদি হাসানের কণ্ঠে মীর শুনুন। শুনি তবে —
https://www.youtube.com/watch?v=sw6E4ZSHYBo
গজ়লটি পুরো গাননি মেহদি হাসান। যেমনটা আগেই বলেছি, দরকার নেই, কারণ গজ়লের এক একটি শে’রই স্বয়ং সম্পূর্ণ কবিতা, কাজেই গায়ক গজ়লের যে কোনও শে’র নিজের পছন্দ মতো বেছে নিয়ে তাতে সুর দিতে পারেন। কেবল গজ়লের প্রথম শে’র, মত্লা, গাইতেই হবে, এবং শেষ শে’র যদি গান তা হলে তাকে শেষেই রাখতে হবে।
আমিও পুরো গজ়লটা না দিয়ে মেহেদি হাসানের গাওয়া শে’রগুলি এবং আমার নিজের বিশেষ পছন্দের কয়েকটা শে’র এখানে তুলে দিলাম —
১।
আ কেয় সাজ্জাদা-নশিন কয়েস হুয়া মেরে বাদ
না রহি দশ্ত্-মে খালি কোয়ি জা মেরে বাদ।।
(নতজানু কত যে কয়েস, আমি যে আর নেই
মরুতে রইল না এক চিলতে জায়গা আর খালি, আমি যে আর নেই।।)
২।
মিয়ান মে উসনে জো কি তেগ-এ-জফা মেরে বাদ
খুঁ-গিরফ্তা কোয়ি কিয়া অওর না থা মেরে বাদ।।
(নিষ্ঠুরতার ছোরা সে তো তুলেই দিল কোষে
রক্তাক্ত কে হবে আর, আমি যে আর নেই।।)
৩।
তেজ় রাখনা সর-এ-হর খার কো অ্যায় দশ্ত-এ-জুনুঁ
শায়দ আ যায়ে কোয়ি আবলা-পা মেরে বাদ।।
উন্মাদনার মরু, শানিত রেখ প্রখর তোমার প্রত্যেকটি কাঁটা
যদি আসে কেউ ক্ষতিত পায়ে, আমি যে আর নেই।।
৪।
দোস্তি কা ভি তুঝে পাস না আয়া হ্যায়
তু নে দুশমন সে কিয়া মেরা গিলা মেরে বাদ।।
(সখ্যেও তো আসা হয়নি তোমার কাছাকাছি
শত্রুকে করলে নালিশ, আমি যে আর নেই।।)
৫।
মুহ্ পে লে দামন-এ-গুল রোয়েঙ্গে মুর্ঘান-এ-চমন
বাগ মে খাক উড়ায়েগি সবা মেরে বাদ।।
(ফুলের আঁচল মুখে চেপে কাঁদবে পাখির দল
বাগানময় উড়বে ছাই, আমি যে আর নেই।।)
৬।
চাক ইসি গম-সে গিরেবান কিয়া হ্যায় ম্যায় নে
কওন খোলেগা তেরে বন্দ-এ-কবা মেরে বাদ।।
(এ দুঃখেই বুকের কাপড় করছি ফালা ফালা
কাঁচুলি তোমার খুলবে কে, আমি যে আর নেই।।)
৭।
উয়ো হাওয়া-খ্বা-এ-চমন হুঁ কে চমন-মে হর সুবোহ্
প্যাহলে ম্যায় যাতা থা অওর বাদ-এ-সবা মেরে বাদ।।
(বাগিচার বাতাস-পায়ী এমন ছিলাম, ভোরে
আগে আমি হাজির হতাম, বাতাস আমার পরে।।)
৮।
বাদ মরনেকে মেরি কব্র-পে আয়া উয়ো মীর
ইয়াদ আয়ি মেরে ইহস্সা-কো দাওয়া মেরে বাদ।।
(মরার পরেই কবরে আমার এসেছিল সে মীর
মনে পড়ল ওষুধ কী, আমার মরার পরে।।)
প্রথমেই মেহদি হাসানের গাওয়া গান ও আমার পড়া গজ়লটির দু’ একটা পাঠভেদের কথা একটু বলে নেওয়া দরকার (সেই কারণেই শে’রগুলিকে ক্রমিক সংখ্যায় চিহ্নিত করা)। পাঁচ নম্বর শের মেহদি গেয়েছেন —
মুহ্ পে রাখ দামন-এ-গুল রোয়েঙ্গে মুর্ঘান-এ-চমন
হর রবিশ খাক উড়ায়েগি সবা মেরে বাদ।।
(ফুলের আঁচল মুখে চেপে কাঁদবে পাখির দল
চারিদিকে উড়বে ছাই, আমি যে আর নেই।।)
কিন্তু সব থেকে গভীর পার্থক্য শুনলাম ছ’ নম্বর শে’রে। আমি পেয়েছি —
চাক ইসি গম-সে গিরেবান কিয়া হ্যায় ম্যায় নে
কওন খোলেগা তেরে বন্দ-এ-কবা মেরে বাদ।।
(এ দুঃখেই বুকের কাপড় করছি ফালা ফালা
কাঁচুলি তোমার খুলবে কে, আমি যে আর নেই।।)
মেহদি গাইলেন —
চাক করনা হ্যায় ইসি গম-সে গিরেবান-এ-কফন
কওন খোলেগা তেরে বন্দ-এ-কবা মেরে বাদ।।
(এ দুঃখেই কফনটাকে করছি ফালা ফালা
কাঁচুলি তোমার খুলবে কে, আমি যে আর নেই।।)
দ্বিতীয়টির আর্তনাদ আমার আরও হৃদয়ভেদী মনে হয়েছে, অন্তিম শয়ানে মৃতদেহ যে কাপড়ে ঢেকে দেওয়া হয়, দুনিয়ার হরেক সংস্কৃতিতে সেই কফন পবিত্র, বস্তুত ছোঁয়া বারণ। তাকেও ফালাফালা করে যদি প্রিয়ার ব্রেসিয়ার অতঃপর কে খুলবে এই চিন্তার হাহাকার — যে হাহাকার হয়তো অনুতাপ আর ইর্ষার মাঝখানে কোথাও দোদুল্যমান — তখন প্রকৃতই যে সাংঘাতিক দাপুটে কবিতা তৈরি হয়ে যায়, তা দুর্লভ। দেহস্পর্শী প্রেমের এক আশ্চর্য উৎসব।
কফন ফালা ফালা করা ওই শে’রটিতে আরও একবার শিগ্গিরি ফিরব কিন্তু তার আগে উর্দু কাব্যে অপরিচিতদের কয়েকটি বহু ব্যবহৃত শব্দ, উপমা, চিত্রকল্পের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া দরকার।
প্রথম অনবদ্য শে’র-এর ‘কয়েস’, আসলে মজনুর আর এক নাম। ল্যায়লি / ল্যায়লা-মজনুর ভালোবাসার আরবি কিংবদন্তি আনুমানিক পঞ্চম শতক থেকে দেশে দেশান্তরে কবিদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। ক্যায়েস ও ল্যায়লি কৈশোরে একে অপরের প্রেমে পড়ে। যৌবনে তাদের বিয়ে দিতে রাজি হয়না ল্যায়লির অভিভাবকরা। তার বিয়ে হয়ে যায় এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে। বিবাহিত ল্যায়লি বহু দূর দেশে গিয়েও ক্যায়েসের প্রেমে ধুঁকতে ধুঁকতে মারা যায়। প্রেমোন্মাদ মজনু খুঁজতে খুঁজতে শেষে ল্যায়লির কবরের সামনে এসে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। এ কাহিনি একেবারে পুরোদস্তুর কাব্যে রূপ নেয় দ্বাদশ শতকের ফারসি কবি নিজ়ামি গঞ্জভি-র কলমে। সে অবধি কয়েস আহত প্রেমিকের প্রতীক। তবে এ গজ়লে মীর এক দুরন্ত স্পর্ধার মোচড়ে, নিজেকে শুধু ‘কয়েস’-এর সঙ্গে তুলনা করেই ক্ষান্ত হননি, বলা যেতে পারে চিরআহত প্রেমিকদের এক বিপুল জমায়েতের ডাক দিয়েছেন, একজন প্রেমিকের মৃত্যুকে ঘিরে! এত অজস্র কয়েস-এর জমায়েত যে বিরহের অনন্ত ঠাঠা মরুতেও আর একচিলতে স্থান খালি থাকবে না!
তেহরানের গোলেস্তান প্রাসাদে রক্ষিত মিনিয়েচার — বনে জঙ্গলে মজনু।
১৫০৭। শিল্পী অজানা
আর সেই ভালোবাসার ঘোরে ক্ষতবিক্ষত হওয়ার যে উদ্যাপন আমরা দেখি কাঁটা শানিত রাখা বা প্রিয়ার ছোরা কোষে তুলে দেওয়ার উন্মাদনায়, তাও উর্দু কবিতায় ফিরে ফিরে আসে। কী ভাবে এই দুই শে’রই গালিবের সমসাময়িক আর এক দারুণ জনপ্রিয় কবির রক্তে জমা হয়েছে এখানে শুনুন —
https://www.youtube.com/watch?v=xQxp7isvR6g
নাওয়ক-আন্দাজ় জিধর দীদা-এ-জানাঁ হোঙ্গে
নিম-বিসমিল কয়ি, কয়ি বেজাঁ হোঙ্গে।।
(প্রাণাধিকের দৃষ্টিতির ছুটবে যেই দিকে
কতো জন যে অর্ধমৃত, প্রাণহীন পড়ে থাকবে কতো।।)
তাব-এ-নজ়জ়ারা নেহি আইনা কেয়া দেখনে দুঁ
অওর বন যায়েঙ্গে তসবির যো হ্যায়রাঁ হোঙ্গে।।
(দৃষ্টির শক্তি নেই, কী আর দেখতে দেব আয়না তোমায়
আর যদি হও বিচলিত গড়ে উঠবে ছবি।।)
তু কাহাঁ যায়েগি কুছ আপনা ঠিকানা করলে
হম তো কাল খ্বাব-এ-অদম-মে শব-এ-হিজরাঁ হোঙ্গে।।
(কোথায় তুমি যেতে চাও, নিজের কোনও ঠিকানা ঠিক করো
বিচ্ছেদের রাত্রি ওগো, আমি তো কাল মানুষের স্বপ্ন হয়ে যাব।।)
এক হাম হ্যায়ঁ কে হুয়ে অ্যায়সে পশেমাঁ কে বস্
এক উয়ো হ্যায়ঁ কে জিনহে চাহকে আরমাঁ হোঙ্গে।।
(এক আমি, কী আর বলি সে লজ্জার কথা
আর এক সে, যাকে চেয়েই আকাঙ্খার হওয়া।।)
ফির বাহার আয়ি ওহি দশ্ত-এ-নবরদি হোগি
ফির ওহি পাওঁ, ওহি খার-এ-মুঘেলাঁ হোঙ্গে।।
(বসন্ত এসেছে ফের, ফের সেই মরুর সফর
ফের সেই দুই পা, ফের সেই বাবলাকাঁটায় ভরা পথ।।)
উম্র সারি তো কাটি ইশ্ক-এ-বুতাঁ-মে মোমিন
আখিরি বক্তমে কেয়া খাক মুসলমান হোঙ্গে।।
(প্রতিমার প্রেমে, মোমিন কাটিয়েছো সারাটা জীবন
শেষের এই দিনে কী ছাই হবে মুসলমান।।)
মোমিন খান মোমিন। এই চিত্রটি বহুল প্রচলিত, যদিও সূত্র অজানা
মোমিন খান মোমিনের (১৮০০-১৮৫২) এ গজ়লে মীর খুঁজে পাওয়া কী আর কঠিন। ভালো কথা, ‘আবলা-পা’ শব্দবন্ধটির আক্ষরিক অর্থ টলটলে ফোসকায় ভরা পা, ক্রমাগত কাঁটা মাড়ালে তার কী চেহারা হতে পারে অনুমেয়। প্রতীকী অর্থে ‘আবলা-পা’ প্রেমিক হৃদয়, স্বতঃসিদ্ধ ভাবেই যার চেহারা ওই পায়ের মতোই। তবে আমায় মুগ্ধ করেছে ‘খ্বাব-এ-অদম’, ‘মানুষের স্বপ্নে’ থেকে যাওয়া শব্দবন্ধের ব্যবহার। নিজের মৃত্যু — ভালোবাসায় মৃত্যুকে — এ ভাবেও দেখা যেতে পারে তবে? অভিধান খুললে দেখা যাবে, খ্বাব-এ-অদম কিন্তু সর্বদা মৃত্যু অর্থেই ব্যবহৃত হয়। ভালোবাসার কী আশ্চর্য সম্মান সারা উর্দু কাব্য জুড়ে। মাঝে মাঝে যা সত্যিই মর্মান্তিক উচ্চতায় পৌঁছে যায়। যেমন, আমার মনে হয়েছে, মোমিনের এই শে’রে তা পৌঁছে গিয়েছে, কিংবা মীরের গজ়লটির এই শে’রটাতেও —
দোস্তি কা ভি তুঝে পাস না আয়া হ্যায়
তু নে দুশমন সে কিয়া মেরা গিলা মেরে বাদ।।
(সখ্যেও তো আসা হয়নি তোমার কাছাকাছি
শত্রুকে করলে নালিশ, আমি যে আর নেই।।)
যাকে কখনও কাছে আসতে দাওনি তুমি, সে চলে যাওয়ার পরে তার শত্রুর কাছে করো তার চলে যাওয়ার অভিযোগ! সে যে নেই এও তোমার অসহনীয় — এত ছিল ভালোবাসার ফল্গুধারা?! কিংবা একেবারে অন্য ভাবে ভাবলে, ওই আবলা-পা-হৃদয় না থাকলে কীসের থাকা তোমার, কীসের দম্ভ, কীসের জৌলুস, সত্যি বলকে কী, কীসের বেঁচে থাকা! গদ্যে ভেঙে বলা অসম্ভব।
কয়েস / মজনু, ল্যায়লার মতো চরিত্র এবং আরও এক প্রেমোন্মাদ যুগল ‘শিরিন ও ফরহাদ’-এর কথা উর্দু কাব্যে এমনই প্রেমের প্রতীক হয়ে বারংবার ফিরে এসেছে। দ্বিতীয়টি পারসিক কিংবদন্তিজাত এবং সেটিও নিজ়ামি গঞ্জভির কাব্যে উদ্যাপিত। নিজ়ামির কাব্য ‘খুসরো ও শিরিন’ কার্যত এক ত্রিকোণ প্রেমের কাহিনি — শিরিনের দুই প্রেমিক, কুটিল খুসরো ও পাগল (ভালোবাসায়) ভাস্কর ফরহাদ। কাহিনির এক মোড়ে বিসোতুন পর্বতে সিঁড়ি কেটে সে পর্বত পার করে শিরিনকে নিয়ে যেতে আহ্বান জানায় খুসরো। ফরহাদ সর্বশক্তি নিয়োজিত করে তাই করতে থাকে। অবশেষে খুসরো যখন দেখে অসম্ভবকে প্রায় সম্ভব করে ফেলেছে ফরহাদ, স্রেফ ভালোবাসার ক্ষমতার জোরে, সে তাকে মিথ্যে খবর দেয়— শিরিন মারা গিয়েছে। সেই সংবাদে মূর্ছা গিয়ে পাহাড় থেকে পড়ে ফরহাদের মৃত্যু হয়। ফরহাদের আর এক নাম কোহকন — পাহাড়কাটিয়ে — ‘কোহ্’ মানে পাহাড়, ‘কন’ খোদাই করা।
পর্বতে নিজের ও শিরিনের ছবি খোদাই করছে ফরহাদ।
মিনিয়েচার। ১৫২৮-২৯। সৌজন্য ওয়াল্টার্স আর্ট মিউজিয়াম
তেমনই ফিরে ফিরে এসেছে আরও কয়েকটি আরবি / পারসিক চরিত্র — জমশিদ বা জম্। ইনি উদ্যাপিত দশম শতকের পারসিক কবি আবু’ল কাসেম ফেরদোসি-র ‘শাহ্নামেহ্’ কাব্যে। দৈবাশিসপ্রাপ্ত এক মহান রাজা মিথ্যাচার ও দম্ভে তাঁর পতন। এক্ষণে মনে করতেই হবে ফয়েজ়-এর সেই দুরন্ত গজ়ল —
অ’জজ়-এ-অ্যাহল-এ-সিতম-কি বাত করো
ইশ্ক-কে দম-কদম কি বাত করো।।
(অত্যাচারী যে কত অসহায় সেই কথা বলো
কী ক্ষমতা যে ভালোবাসায় সেই কথা বলো।।)
বজ়্ম-এ-অ্যাহল-এ-তরব-কো শরমাও
বজ়্ম-এ-অসহাব-এ-গম কি বাত করো।।
(হুল্লোড়-উচ্ছল আসরকে লজ্জা দাও আজ
দুঃখের সাথীদের কেমন আসর, সেই কথা বলো।।)
বজ়্ম-এ-সরোবত-এ-খুশনশিনোঁ সে
অ’জ়মত-এ-চশ্ম-এ-নাম কি বাত করো।।
(বৈভবজমকালো আসরের খুশিমগ্নদের কাছে
সেই নামের দুই চোখের দ্যুতির কথা বলো।।)
হ্যায় ওহি বাত ইয়ুঁ-ভি অওর ইয়ুঁ-ভি
তুম সিতম ইয়া করমকি বাত করো।।
(কথা সেই একটাই, এভাবেই বলো কিংবা ওভাবে
অত্যাচার কিংবা করুণার তুমি যাই কথা বলো।।)
খয়ের হ্যায়ঁ অ্যাহল-এ-দয়ের য্যায়সে হ্যায়ঁ
আপ অ্যাহল-এ-হরম কি বাত করো।।
(প্রার্থনাগৃহের মানুষ যেমনই আছে দিব্যি রয়েছে
নিষিদ্ধ দুনিয়ার মানুষ যারা তুমি তাদের কথা বলো।।)
হিজ্র-কি শব তো কাটহি যায়েগি
রোজ়-এ-বস্ল-সনমকি বাত করো।।
(বিরহের রাত্রি তো কেটেই যাবে ঠিক
প্রিয়ার সাথে মিলনের দিনের কথা বলো।।)
জান যায়েঙ্গে জাননেওয়ালে
ফয়েজ় ফরহাদ ও জম্কি বাত করো।।
(বুঝবার যারা বুঝেই নেবে ঠিক
ফয়েজ় তুমি ফরহাদ, জামশিদের কথা বলো।।)
(গজ়ল। ফয়েজ় আহমেদ ফয়েজ়। দস্ত্-এ-সবা। নুসখাহা-এ-বফা, এজুকেশনাল পাবলিশিং হাউস, দিল্লি, ১৯৮৬। পৃ ১৩৯-১৪০।)
ফরহাদ আর জামিশদ বা ‘জম’-এর কথা তো শুনলাম। আর এই শেরেই এক অর্থে লুকিয়ে আছে ফয়েজ় পাঠের চাবিকাঠি। এ প্রসঙ্গে বিশদে ফিরতে হবে আমাদের, অনেক পরে। আপাতত শুধু এইটুকুই যে, কবি একটা বিশেষ সময়ে — কারান্তরালে তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ভোরের হাওয়ার হাত’ রচিত হওয়ার সময়ে — এই শে’রে এসে বলেই দিলেন আমার কবিতা বুঝে নিতে হলে প্রতীকের পিছনে তাকাতে হবে। আর একটা কথা এই গজ়ল প্রসঙ্গে — ‘হরম’ মানে পবিত্র প্রার্থনাগৃহ’ যেমন হতে পারে তেমনই হতে পারে ‘নিষিদ্ধ দুনিয়া’। তরজমাকারের কী বিড়ম্বনা ভাবুন। তা হলে কি এ শে’র বলছে ‘প্রাথনাগৃহের মানুষেরা বেশ আছে / তুমি তাদের কথাই বলো’? আরও আছে। দয়ের-এর একটা অর্থ মন্দির। হরম বোঝান হয় ‘কাবা’ কিংবা মসজিদ বোঝাতে, বিশেষত ‘দয়ের-ও-হরম’ গোছের শব্দবন্ধে — মন্দির-মসজিদ। তবে কী ফয়েজ় বলছেন — মন্দিরের মানুষেরা দিব্যি আছেন / তুমি কাবার মানুষদের কথা বলো? অন্তত কিছুকাল ফয়েজ়-সহবাসের জোরে আমি বলব, অসম্ভব। আমার পাঠে এখানে ‘হরম’ নিষিদ্ধ দুনিয়া অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে।
এইবার যে প্রসঙ্গ ছেড়ে এসেছিলাম সেই প্রসঙ্গে ফিরি। সেই যে মীরের শের —
চাক করনা হ্যায় ইসি গম-সে গিরেবান-এ-কফন
কওন খোলেগা তেরে বন্দ-এ-কবা মেরে বাদ।।
(এ দুঃখেই কফনটাকে করছি ফালা ফালা
কাঁচুলি তোমার খুলবে কে, আমি যে আর নেই।।)
এইখানে কিন্তু চোলি নয়, সাবেকি বন্দ-এ-কাবা-তে বাঁধা প্রিয়তমার স্তন। যে বন্দ-এ-কবার গিঁটে উর্দু কবিরা এই সেদিন পর্যন্ত আটকে থেকে তাঁদের ষোলো আনা পুরুষ-অবলোকন জাহির করছিলেন। ফয়েজ় তার ব্যতিক্রম নন —
https://www.youtube.com/watch?v=yKQCFn1HXH8
দৃশ্যপট
পথ, ছায়া, গাছ, ইমারত ও দরজার সারি, অলিন্দের বাঁক
অলিন্দে খুলে গেল জ্যোৎস্নার বুক, ধীরে
ঠিক যেমন খোলে কাঁচুলিবাঁধন, ধীরে
অলিন্দবাঁকের নীচে জমেথাকা ছায়াঘননীল
নীলের ঝিল
ঝিলে ঝরা পাতার বুদ্বুদ, গোপনে সাঁতার দেয়
এক পল সাঁতরায়, একটু এগোয়, ফেটে যায়, ধীরে
ধীরে, খুব ধীরে, আলগোছে মদিরা শীতলরঙা
ঢালা হলো আমার এই কাচপেয়ালায়, ধীরে
সুরাপাত্র পেয়ালা তোমার হাতের গোলাপ
স্বপ্নচিহ্ন যেন দূরে, বহু দূরে
ফুটে ওঠে নিজে নিজে, মুছে যায়, ধীরে
উচ্চারে প্রাণ আবার বিশ্বাসের কোনও গভীর আখর, ধীরে
বললে তুমি ‘ধীরে’
ঝুঁকে পড়ে চাঁদ বলে গেল,
‘ধীরে, আরও ধীরে’।
(মূল কবিতা — মন্জ়র। ফয়েজ় আহমেদ ফয়েজ়। দস্ত্-এ-তহে-সঙ্গ্। নুসখাহা-এ-বফা, এজুকেশনাল পাবলিশিং হাউস, দিল্লি, ১৯৮৬। পৃ ৩৭৩-৩৭৪।)
২০১৬ সালে লন্ডনের বার্বিকান সেন্টারের কার্ভ গ্যালারিতে প্রদর্শিত হয়
ইমরান কুরেশির ৩৫টি চিত্র। শিরোনাম ‘Where the shadows
are so deep’। প্রতিটি ছবি ফয়েজ়ের কবিতায় অনুপ্রাণিত।
সেই সিরিজের একটি ছবি
‘বন্দ-এ-কবা’ খোলার থেকে কবিতায় দেহস্পর্শী ভালোবাসায় আর এগোননি ফয়েজ়। এবং আমরা দেখব সাবেকি উর্দু কবিতার স্তন্যপানে বেড়ে উঠেও তার বহু কিছুই বদলে দিচ্ছিলেন ফয়েজ়, কিন্তু তার ‘মেজাজটাই তো রাজা’ গোছের পুরুষ-অবলোকনকে বৈপ্লবিক ভাবে চ্যালেঞ্জ করেননি তিনি।
এমনকী মীরের ঘামে ভেজা ‘চোলি’-র মাটির কাছাকাছি ঘামে-ভেজা-জীবনের তীব্র অবয়ব ও রঙ, form and colour, ফয়েজ়ে অনুপস্থিতি। জীবনের এক্কেবারে গোড়ায়, প্রথম কাব্যগ্রন্থ নক্শ-ই-ফরিয়াদি যখন সবে গড়ে উঠছে, যখন তাঁর কারারুদ্ধ হয়ে সম্ভাব্য মৃত্যুদণ্ডের দিন গোণা বাকি, সে সময়ে সেই অনুপস্থিতি নিজেই যেন টের পেয়ে মগ্নতা থেকে ধড়ফড়িয়ে উঠে লিখে বসেছিলেন তাঁর বিপুল জনপ্রিয় ‘মুঝসে পহলিসি মুহব্বত মেরে মহবুব না মাঙ্গ্’। সে মাইলফলক আমরা ইতিমধ্যেই ছুঁয়ে এসেছি, তাই পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু আমরা ক্রমে এও দেখব যে, কারান্তরালে তেমন কবিতা থেকে একেবারে সরে গিয়েছিলেন ফয়েজ়। কিন্তু তাঁর মগ্নকবিতারও পরমাশ্চর্য জাদু তাদের দশকের পর দশক ধরে দেশে দেশান্তরে জনসাধারণের রুখে ওঠার নিশান হয়ে করে তুলেছে। সে জাদু ফাঁস করার সাধ্যি আমার নেই, তা এ সফরের লক্ষ্যও নয়। যা এ সফরে আমরা বুঝব, মগ্নকবিতার এই নিশান হয়ে ওঠার সঙ্গে মিশে আছে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনচর্যা। এ দুয়ের মাঝে কোনও ফাঁক নেই, সম্পৃক্ত। কোনও ধাপ্পা নেই।
সেই জীবনচর্যার, কাব্যের তো বটেই, একটা মৌলিক উপাদানও ফয়েজ়ের রক্তে এসে জমেছিল মীরের কাব্য, এবং মীর আবার সে কাব্য যে পরম্পরা থেকে শুষে নিচ্ছিলেন সেই খাঁটি ভারতোপমহাদেশীয় পরম্পরা থেকে। রক্তে পূর্বজদের বোধের, স্বপ্নের, বিশ্বাসের ভ্রমাতীত চিহ্ন উপস্থিত।
কী ভাবে? সে খোঁজ করব আমরা পরের সফরে। ‘রয়েল বেঙ্গল রহস্য’ লেখার সময় ফেলুদা তোপসেকে উপদেশ দিয়েছিল ওই অ্যাডভেঞ্চারে পাওয়া একটা ধাঁধা দিয়ে লেখাটা শুরু করতে। কেন? তাতে পাঠককে সুড়সুড়ি দেওয়া হবে বলেছিল ফেলুদা। সে কথা তোপসের মোটে পছন্দ না হওয়ায় আরও একটু ভেঙে বলেছিল, তাতে পাঠক গোড়া থেকে মাথা খাটানোর সুযোগ পাবে। সেই পরম্পরায় আমিও একটা অপূর্ব গান দিয়ে আসলে পরের পর্বটা এখানেই শুরু করে দিলাম— মন দিয়ে শুনলে ধরে ফেলা সম্ভব আমি পূর্বজদের কোন পরম্পরার কথা বলছি। এখানে আর ভেঙে বলব না, সে পরম্পরার দাপট দেহলীন প্রেমের দাপটের থেকে অনেক প্রবল, এবং বিশেষত আজকের ভারতের মোদী-শাহি হিন্দুত্ববাদী ফাশিস্ত দাপটের গালে সপাটে থাপ্পড় —
https://www.youtube.com/watch?v=eEPcbMvKA0w
(ক্রমশ)