
ফয়েজ় পরিক্রমা – ১২
নীলাঞ্জন হাজরা
দিন আর রাত্রির দংশে যাওয়া এই পরিধান
(বিশেষ অনুরোধ — এই লেখা লিখছি আবহমান পত্রিকার ইন্টারনেট সংস্করণের জন্য। ইন্টারনেট আমাদের সামনে এনে দিয়েছে একাধারে পড়া দেখা শোনার অভিজ্ঞতার অভূতপূর্ব সুযোগ। সেই ভাবেই এ লেখার বয়ন। তাই সঙ্গের লিঙ্কগুলি অতিরিক্ত মনে করে উপেক্ষা করবেন না)
এই পরিক্রমায় কত কিছুই যে নতুন করে জানছি! গত পর্ব শেষ করেছিলাম ‘আপকি ইয়াদ আতি রহি রাতভর’ গজ়লটি দিয়ে। গজ়লটির বাংলা তরজমার শেষে বন্ধনীতে লিখেছিলাম ফয়েজ় এর প্রথম পঙ্ক্তিটি কেন উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন বুঝিনি। খোঁজ করে সে কারণটা জানতে পারলাম আর পেয়ে গেলাম এক আশ্চর্য বর্ণনা। ফয়েজ়ের সমসাময়িক আর এক বিখ্যাত কবি ছিলেন মখদুম মহিউদ্দিন। বিংশ শতকের দ্বিতীয়-তৃতীয় দশকেই উর্দু সাহিত্যে যে বামপন্থী ধারার জোয়ার এসেছিল, সেই ধারায় একই নৌকোয় ফয়েজ়ের সহযাত্রী ছিলেন মখদুম। ফয়েজ়ের থেকে বছর তিনেকের বড়ো ছিলেন। জন্ম ১৯০৮। প্রয়াত হন ১৯৭৯ সালে। এইটুকু মনে রেখে আমরা শুনি সেই বর্ণনা।
২০১১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ফয়েজ়ের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে পাকিস্তানের Daily Times সংবাদপত্রে একটি উত্তর-সম্পাদকীয় প্রবন্ধ লেখেন এস এম নয়ীম। তারই একটি অংশ বাংলা তরজমায় হুবহু তুলে দিলাম— ‘‘জীবনে উল্লেখযোগ্য ভাবে ফয়েজ় সাহাবের মুখোমুখি হয়েছিলাম তিন বার— প্রথমবার ব্রিটেনে (১৯৫০-এর দশকের শেষের দিকে যখন আমি লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিক্সে পড়ি), দ্বিতীয়বার ব্যাঙ্ককে এবং তৃতীয়বার, যেবার তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল প্রায় এক বছর, বইরুতে। এর মধ্যে এই শেষ যোগাযোগটির স্মৃতি আমি বড়ো আদরে হৃদয়ে লালন করি।… রাওয়লপিন্ডিতে আমাদের দুজনেরই বন্ধু ডঃ আইয়ুব মির্জ়া— যাঁর বাড়িতে আমার প্রায়ই দেখা হতো ফয়েজ় এবং অ্যালিসের সঙ্গে — আমায় বলেছিলেন, প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও)-র সাহায্যে প্রকাশিত আফ্রো-এশিয়ান সাহিত্য পত্রিকা ‘লোটাস’-এর প্রধান সম্পাদক হয়ে ফয়েজ় বইরুতে রয়েছেন, এবং আমার উচিত তাঁর সঙ্গে দেখা করা। আমি যে হোটেলে উঠেছিলাম ফয়েজ় সাহাবের অ্যাপার্টমেন্টটা ছিল তার থেকে হাঁটা পথ। কাজেই একদিন দেখা করতে গেলাম। ফয়েজ় এবং অ্যালিস উষ্ণ আতিথেয়তায় আমায় স্বাগত জানালেন। বললাম, রাষ্ট্রপুঞ্জের বইরুত শাখায় আমার বদলি হয়ে আসার সম্ভাবনা আছে, কিন্তু এখানকার নিরাপত্তা-পরিস্থিতির কথা ভেবে আমি দোনোমনো করছি। তাঁরা আমার আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে আমায় বইরুতে চলে আসতে উৎসাহ দিলেন। আমার বদলি পাকাপাকি করতে রাষ্ট্রপুঞ্জ এক বছর লাগাল।
‘‘১৯৮১-তে যখন আমি বইরুতে পৌঁছলাম অ্যালিস তখন পাকিস্তান ফিরে যাওয়ার তোড়জোড় করছেন। অ্যালিস খুশি হলেন যেহেতু আমি আমার পরিবারকে পাকিস্তানেই রেখে এসেছিলাম, আমি সন্ধেগুলো ফয়েজ় সাহাবের সঙ্গে কাটিয়ে তাঁর নিঃসঙ্গতা কিছুটা দূর করতে পারব। আমার কাছে এ ঈশ্বরের বর। বিকেলে কাজ সেরে হোটেলে ফেরার পর আমার প্রায় কিছুই করার থাকত না এবং ফয়েজ় সাহাবের প্রতি বিপুল শ্রদ্ধায় আমি খানিকটা আড়ষ্ট হয়ে থাকলেও তাঁর সঙ্গ আমায় দারুণ আনন্দ দিত। তাঁর সঙ্গে বহু ভারি কৌতুহলোদ্দীপক কথোপকথনের আনন্দময় সুযোগ আমার হয়েছিল, যদিও স্বীকার করতেই হবে অনেক কথোপথনের সময়েই দীর্ঘ ছেদ পড়ত দুতরফেই — তাঁর দিক থেকে মনের মধ্যে কোনও কবিতা ঘনিয়ে ওঠার জন্য, আমার দিক থেকে পাছে তাঁর চিন্তার স্রোতে বাধা পড়ে এই ভয়ে।
‘‘যদিও আমার হোটেল তাঁর অ্যাপার্টমেন্ট থেকে মাত্র মিনিট পনেরোর হাঁটা পথ ছিল, ফয়েজ় সাহাব আমায় বললেন যে বাড়িতে তাঁর অ্যাপার্টমেন্ট সেখানে অনেকগুলি খালি অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে, সেগুলিরই একটাতে উঠে আসতে। দিনে দিনে বইরুতের নিরাপত্তা পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছিল। কাজের প্রথম যে দিন রাষ্ট্রপুঞ্জের দফ্তরে গেলাম সহসা বিমান হামলার সাইরেন বেজে উঠল, ইজরায়েলি বোমারু বিমান ভয়াবহ শব্দে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে শহরের কিছু কিছু অংশে বোমা ফেলল, আমরা সকলে বাড়িটার বেসমেন্টে জড়সড় হয়ে রইলাম। ফয়েজ় সাহাবকে তাঁর অফিসে ফোন করে আমার সেই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা বললাম। ফয়েজ় বললেন না ঘাবড়িয়ে সন্ধ্যায় তাঁর অ্যাপার্টমেন্টে যেতে। যখন তাঁর সঙ্গে দেখা হল, দেখি তাঁর মধ্যে উৎকণ্ঠার লেশমাত্র নেই।…
‘‘সেই সন্ধ্যার পর একটা প্রথাই হয়ে দাঁড়াল সন্ধ্যায় তাঁর বাসায় অথবা কমোডর হোটেলের লাউঞ্জে বসে পাকিস্তানের, আরব-ইজরায়েলের বা লেবাননের রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করা বা সে সময়ে বেঁচে থাকার অপরিহার্য উপাদান— একটা ক্যাসেট প্লেয়ার চালিয়ে গজ়ল শোনা। মনে আছে, একবার ছায়া গাঙ্গুলির কণ্ঠে, মখদুমের লেখা আমার প্রিয় গজ়ল ‘আপকি ইয়াদ আতি রহি রাতভর’ চালালাম । তিনি আমাকে গজ়লটা বারবার চালাতে বললেন। ফয়েজ় সাহাব জানালেন মখদুমের মৃত্যুর পরে তিনি একই প্রথম পঙ্ক্তি ব্যবহার করে একটি গজ়ল লিখেছিলেন।…’’
প্রসঙ্গত, ছায়া গাঙ্গুলি এই গজ়লটি গেয়েছিলেন ‘গমন’ নামের একটি হিন্দি ফিল্মে। গমন রিলিজ করে ১৯৭৮ সালে। পরিচালক মুজ়ফ্ফর আলি। মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেন স্মিতা পাতিল এবং ফারুক শেখ। গজ়লটির সুরকার জয়দেব। ছায়া গাঙ্গুলি এ গানের জন্য শ্রেষ্ট প্লেব্যাক গায়িকা হিসেবে জাতীয় পুরষ্কার পেয়েছিলেন। ফয়েজ়কে যে গান এত মুগ্ধ করেছিল তা একবার শোনা দরকার বইকি—
Chhaya Ganguly – Gaman (1978) – ‘aap ki yaad aati rahi’ – YouTube
কিন্তু এত দীর্ঘ যে উদ্ধৃতি দিলাম, তা ফয়েজ়ের গজ়লটি যে মখদুমের একটি গজ়লের প্রথম পঙ্ক্তি থেকে উড়ান নিয়েছে তা প্রতিষ্ঠা করার জন্যে নয়। এই উদ্ধৃতির মুখ্য উদ্দেশ্য ফয়েজ় মানুষটিকে আর একটু ব্যক্তিগত ভাবে দেখার চেষ্টা— ইজরায়েলি বোমাবাজিকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার মুহূর্তে কিংবা কথা বলতে বলতে সহসা দীর্ঘ নীরবতায় ডুবে যাওয়ার মুহূর্তে তাঁকে দেখা।
ফয়েজ় নির্বাসনে কী এক অপূরণীয় নিঃসঙ্গতায় ভুগতেন তার একাধিক টুকরো টুকরো বর্ণনা পাওয়া যায়। কিন্তু সে সবের থেকেই তাঁর সেই হৃদয়ে মোচড় তোলা নিঃসঙ্গতা অনেক বেশি মুখর তাঁর কবিতায়, বিশেষ করে ‘মেরে দিল মেরে মুসাফির’ কাব্যগ্রন্থে সংকলিত কবিতাগুলিতে। তাই আর বর্ণনা শোনার পরিবর্তে আমরা তেমন কয়েকটা কবিতার তরজমা পড়ে নিতে পারি পরপর—
ঝরে গিয়েছে ফুল সব
ঝরে গিয়েছে ফুল সব
ধরে না কিছুতেই অশ্রু আকাশের
শিখাহীন হয়েছে প্রদীপ
আয়না চুরামার
হারিয়ে গেছে বাজনা সব
নিভে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে ঘুঙুর
আর মেঘের পিছনে ওই
দূরে, বহু দূরে এই রাতের সোনাছেলে
ব্যথার তারা
মিটমিট করছে যেন
ঝনঝন করছে যেন
হাসছে যেন
—
(লন্ডন, ১৯৭৮)
দৃশ্য
সারাটা আকাশ আজ উত্তাল সমুদ্র এক
রওয়ানা দিয়েছে যার হরেক দিকে মেঘের জাহাজ
মাথায় মাথায় তাদের কিরণের মাস্তুল
পরে আছে নকশি-কাঁথা যেন
নীলে ভেসে কিছু গম্বুজের দ্বীপ
নানা কসরতে মশগুল যেন সকলেই
ওই যে আবাবিল পাখি— স্নানে মশগুল
গোঁৎ খেয়ে সোঁ করে নেমে আসে চিল
কোনও শক্তি নেই যা কিনা পরখ হবে এদের ওপর
কোনও বেড়া নেই কোনও দেশের সীমানার
এ নীলের নীচে কোনও সাবমেরিন নেই
এ নীলের ওপরে কোনও রকেট নেই, নেই তোপ
এখানে তো প্রকৃতি পঞ্চভূতে পূর্ণ ক্ষমতায়
কী প্রশান্তি এই উত্তাল সমুদ্র জুড়ে
(সমরকন্দ, মার্চ, ১৯৭৮)
এ মুহূর্ত সময়ের শোক পালনের
আকাশের সব নদী থমকে গিয়েছে
ওই যে দিগন্তের কিনারে লেগেছে এসে
বিষাদরঙা চাঁদের তরণি
নেমে গিয়েছে মাটির পাড়ে
সব মাঝি
নক্ষত্র সব
উপড়ে গেছে প্রতিটা পাতার নিঃশ্বাস
তন্দ্রায় আচ্ছন্ন বাতাস
কঠোর নৈঃশব্দের হুকুম জানিয়ে গেছে ঘণ্টা প্রহরের
তাই তো নীরবতায় গুম হয়ে গেছে সব ডাক
ভোরের শুভ্র বুক থেকে
তীব্র অন্ধকারের চাদর সরে গেছে
তাই তো ছড়িয়ে পড়েছে তার
শরীর, মুখ জুড়ে
নিরাশ নিঃসঙ্গতার ছায়া
আর সে পায়নি তো কোনওই খবর
কেউই আর পায়নি তো কোনওই খবর
কেউই আর পায়নি তো কোনওই খবর
দিনশেষে শহর ছেড়ে
কোন মুখী হবে ভেবেছিল
পথ নেই, ঠিকানাও নেই
কোনও মুসাফির
চায় না কোনও সফরে রওনা হতে আর
দিন আর রাত্রির শিকল থেকে
ভেঙে পড়া মুহূর্ত এটা
এ মুহূর্ত সময়ের শোক পালনের
এমন সময় এলে নেহাতই আনমনে
কখনও-বা আমিও তো দেখি
নিজস্ব পরিচয়ের পরিধান খুলে ফেলে দেখি
কোনওখানে লজ্জার কালো কালো দাগ
কোনওখানে ভালোবাসার কতো ফুলকারি
কোথাও অশ্রুরেখা
কোথাও বা হৃদয়ের রক্তের ছোপ
এই ছেঁড়াফাটা— শক্রুর হাতের নিশানা
বন্ধু মেহেরবানের এইখানে লেগেছে মোহর
এই লাল— চাঁদের মতোন যার মুখ, তার ঠোঁট
এই দয়া দুর্মুখ কোনও প্রবীনের
দিন আর রাত্রির দংশে যাওয়া এই পরিধান
শতচ্ছিন্ন এ পোশাক আমার
যত প্রিয়, তত অপ্রিয়
কখনও এ পাশবিক উন্মাদনার ভীষণ ফরমান
আঁচড়িয়ে ছিঁড়ে ফেলে ছুড়ে ফেলি দূরে
কখনও হরফ ভালোবাসার, মুছে ফেলা যায় না যা
চুমু খেয়ে টেনে নিই বুকে
(তাশকন্দ। ১৯৭৯)
আমার অতিথিরা
ওই তো খুলেছে দরজা আমার ব্যথার আশ্রয়ের
ওই তো একে একে অতিথিরা এসে গেছে ফের
সন্ধ্যা ওই এসে গেছে নিজের পথে পথে
বিষণ্ণতার ফরাস বিছিয়ে দিয়ে যেতে
ওই এসে গেছে রাত চাঁদ আর তারাদের
ব্যথার কাহিনি সব শোনাতে নিজের
ওই তো এসেছে ভোর ঝলমলে তিরের
শানিত ফলায় মান ভাঙাতে স্মৃতির ক্ষতদের
ওই যে দুপুর এল লুকিয়ে আস্তিনে
চাবুক আগুনের
এই তো এসেছে সব অতিথি আমার
যাদের সাথে নিশিদিন মনের কারবার
কখন যে কে আসে এদের, কে-ই বা চলে যায়
খবর কি রাখে দুই চোখ কিংবা হৃদয়
মন আমার স্বদেশভূমির পানে রওনা হয়ে যায়
সাগরের কেশর মুঠোয়
সহস্র আশঙ্কা-উদ্বেগ নিয়ে
কত না প্রশ্ন বুকে নিয়ে
(বইরুত ১৯৮০)
—
প্যারিস
দিনান্ত— অলিগলি, পথেপথে, বাজারে বাজারে দাঁড়িয়ে গিয়েছে সারি সারি
হলদেটে মুখ নিয়ে আলো
তারই মাঝে প্রত্যেকের ভিক্ষাপাত্র থেকে ঝরছে রিমঝিম
কলকলে এ শহরের অতৃপ্তি যত
দূর পশ্চাদ্পটে দিকচক্রবালে কুয়াশায়
হারান ঐশ্বর্যের রেখাচিহ্ন আঁকা
পুরোভূমি জুড়ে
দেওয়ালের ছায়ার সঙ্গে মিশে কোনও ছায়া
ভিন্নতর ছায়াদের কল্পিত ভ্রান্ত আশা বুকে
একদিন-প্রতিদিনের মতো
চলেছে বিড়বিড়িয়ে
যুগের নিষ্ঠুরতার ভূমিকা বকে বকে
এবং কোনও আগন্তুক
এড়িয়ে এইসব ছায়া ও আলোর সারি
চলেছে নিজের স্বপ্নহীন নিশিআশ্রয়ে
(প্যারিস, অগাস্ট ১৯৭৯)
খুব মন দিয়ে কবিতাগুলি বারবার পড়লে এমনটা মনের মধ্যে ভেসে ওঠা অস্বাভাবিক নয় যে এই কবির হৃদয় ভূমিকম্পকালে সিস্মোগ্রাফের মতো অস্থির। ফয়েজ় বিষয়ে এ উচ্চারণ বহু ফয়েজ়-প্রেমীকেই বিরক্ত করবে, কারণ ব্যক্তি-ফয়েজ়, যেমনটা আমরা দেখলাম এস এম নয়ীমের বর্ণনায়, বা যেমনটা পাওয়া যেতে পারে ফয়েজ়ের ঘণিষ্ঠ যে-কোনও মানুষের বর্ণনাতেই — তাঁর স্বভাবছিল ঋষিসুলভ। একেবারে কপিবুক গীতা যেন—
দুঃখেষ্বনুদ্বিগ্নমনাঃ সুখেষু বিগতস্পৃহঃ
বিতরাগভয়ক্রোধঃ স্থিতধীর্মুনিরুচ্চতে।।
(অধ্যায় ২। শ্লোক ৫৬।)
যে কেতাব দিয়ে কার্যত আমার ফয়েজ় আবিষ্কার শুরু, এ পরিক্রমার গোড়াতেই যার আলোচনা করেছি বিশদে, সেই The Unicorn and the Dancing Girl নামক কেতাবে খালিদ হাসান ফয়েজ়ের সঙ্গে বিশেষ করে লন্ডনে নানা সময় কাটানোর বেশ দীর্ঘ স্মৃতিচারণা করেছেন। অনেক ছোটো ছোটো ঘটনায় গেঁথে তোলা এক আশ্চর্য মানুষের ছবি। যেমন, লিখছেন হাসান, ফয়েজ় নিজের কথা বলার সময় কখনও ‘ম্যায়’ শব্দটি ব্যবহার করতেন, বলতেন ‘আপ’— এক অদ্ভুত উর্দু শব্দ যা ব্যাকরণগত ভাবে তৃতীয় পুরুষের নির্ণায়ক হলেও নিজের সম্পর্কেও ব্যবহৃত হয়, খাস খানদানি অতি-অতি মৃদুভাষী উর্দু-তহজ়িবে সেটাই রেওয়াজ়। ‘আমি’ ‘আমি’ করাটা সেখানে সেখানে সাংঘাতিক শ্রুতিকটু। এ হেন ফয়েজ় লন্ডনে সর্বদাই পারিষদ পরিবেষ্টিত হয়ে থাকতেন। তিনি লন্ডনে এসেছেন, পাকিস্তানি-ভারতীয় মহলে এ খবর রটা মাত্র তাঁর সঙ্গে দেখা করার হুড়োহুড়ি পড়ে যেত। কেউ স্রেফ খোশগপ্পো করতে আসতেন, কেউ চাটুকারিতা, কারও অপাঠ্য কবিতা শুনতে হতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে। নির্বিকার ফয়েজ় মৃদু হেসে সব সহ্য করতেন, নিজে কথা বলতেন সামান্যই। লিখছেন খালিদ, ‘‘এমনই একজন যে কিনা ফয়েজ়ের উপস্থিতিতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধায় গদগদ হয়ে থাকে, একবার আমার কাছে ফয়েজ়কে নিয়ে যা-তা বললো। বক্তব্য, ফয়েজ়ের মধ্যে আর কবিতা বাকি নেই, যে কবি তিনি এক সময়ে ছিলেন, এখন তার ছায়া মাত্র, এবং সেটা তাঁর বিলক্ষণ জেনে রাখা ভালো। কথাগুলো আমি ফয়েজ়কে বলে দিয়েছিলাম, উনি কেবল হেসেছিলেন।’’
এ হেন ফয়েজ়কে বলছি ‘অস্থিরমতি’? আমি বলছি না, তাঁর কবিতা বলছে—
দিন আর রাত্রির দংশে যাওয়া এই পরিধান
শতচ্ছিন্ন এ পোশাক আমার
যত প্রিয়, তত অপ্রিয়
কখনও এ পাশবিক উন্মাদনার ভীষণ ফরমান
আঁচড়িয়ে ছিঁড়ে ফেলে ছুড়ে ফেলি দূরে
কখনও হরফ ভালোবাসার, মুছে ফেলা যায় না যা
চুমু খেয়ে টেনে নিই বুকে
১৯৭৮-৭৮ থেকে ১৯৮২ পর্যন্ত কখনও লন্ডন, প্যারিস, কখনও তাশকন্দ, সামারকন্দ, মস্কো, কখনও বইরুত — ডেরা থেকে ডেরায়। শান্তি নেই। এক অদ্ভুত অস্থিরতা। জানেন না তাঁর ‘শতচ্ছিন্ন’ কিন্তু কোথাও বন্ধু মেহেরবানের মোহর লাগা, কোথাও টুকটুকে ঠোঁটের ছাপ পড়া ‘পোশাক’ নিয়ে তিনি ঠিক কী করতে চান। সহসাই ফের গীতার কথাই মনে পড়ে—
বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায় নবানি গৃহ্ণাতি নরোপরাণি
তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণান্যন্যানি সংযাতি নবানি দেহি।।
(অধ্যায় ২। শ্লোক ২২)
কিন্তু ফয়েজ়ের ‘বসন’ তাঁর অনিত্য দেহ নয়, যা কিনা কোনও না কোনও সময়ে তার ‘আত্ম’, ‘self’ ত্যাগ করে নয়া বসন নিয়ে নেবে। গীতা ছুঁয়েও যেন অদ্ভুত মোচড়ে তার মৌলিক ইঙ্গিতকেই সম্পূর্ণ উলটে দিলেন মার্কসবাদী ফয়েজ়— এই বসনই, এই পোশাকই তিনি, এই তাঁর সব, এই তাঁর ‘self’, এবং তিনি গীতার স্থির অটল বিশ্বাসে নিশ্চল নন, বরং এ পোশাকের হাজার স্মৃতির টানাপড়েনে সাংঘাতিক উদ্বেল। একেবারেই প্রসঙ্গত, গীতার এমন ছোঁয়া আমি ফয়েজ়ে অন্যত্রও পেয়েছি, যার দ্যোতনা তিনি একেবারে বদলে দিয়েছেন। যেমন, ‘শাম-এ-শহর-এ-ইয়ারাঁ’ (প্রাণবান্ধবদের শহরে সন্ধ্যা) কাব্যগ্রন্থে ‘তুম আপনি করনি কর গুজ়রো’ শিরোনামের কবিতার শেষ পঙ্ক্তি দুটি—
তুম আপনি করনি কর গুজ়রো
যো হোগা দেখা যায়েগা
সন্দেহাতীত এ উড়ান সরাসরি এখান থেকে—
কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন
মা কর্মফলহেতুর্ভুর্মা তে সংগোস্তবকর্মাণি।।
(কাজ করে যাওয়ার অধিকার তোমার আছে, কিন্তু তার ফলে কাদচ না
তোমার কর্মফল যেন তোমার কর্মের উদ্দেশ্য না হয়, আবার অকর্মণ্যতার প্রতি আকর্ষিতও হয়ো না যেন।।)
(অধ্যায় ২। শ্লোক ৪৭)
এই উড়ানে ফয়েজ় যেখানে পৌঁছলেন তার তরজমা, অন্তত আমার দ্বারা, বাংলায় অসম্ভব, লিখতে পারি—
তুমি নিজের কর্ম করে যাও
যা হবে দেখা যাবে।।
কিন্তু উর্দু ‘যো হোগা দেখা যায়েগা’-র মধ্যে, সোজা বাংলায়, যে রেলা আছে, যে-একটা দারুণ বেপরোয়া সাহস আছে, যে সাহস ভয়াবহ ইজরায়েলি বোমারু বিমান হামলাকেও তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ায়, একটা মুষ্টি উদ্যত ভাব আছে, ‘যা হবে দেখা যাবে’ লিখে তার ধারে কাছেও যাওয়া যায় না। যদি লিখি, ধরা যাক— ‘যা হবে দেখে নেওয়া যাবে’, তা হলে তা আবার এক অন্য ইঙ্গিতবাহী হয়ে পড়ে, কারণ ‘দেখে নেব’ কথাটা স্পষ্টতই প্রতিশোধস্পৃহাবাহী। প্রতিশোধস্পৃহা ফয়েজ়ের কবিতা থেকে বহু আলোকবর্ষ দূরে। তরজমা যাই হোক, মোট কথা, ওই ‘যো হোগা দেখা যায়েগা’-র হিরের কাঠির ছোঁয়ায় গীতার ‘ভবিতব্যবাদী’ শ্লোক কী একেবারেই এক অন্য মাত্রা পেল না?
কিন্তু মূল প্রসঙ্গে ফিরি, ফয়েজ়ের নির্বাসনের কবিতায় যেমন এক অস্থিরতা আছে, তেমনই আছে এক নিরবচ্ছিন্ন বিষণ্ণতা। সেই দীর্ঘ অবিচ্ছিন্ন বিষণ্ণতার মাঝে কখনও বা ভেসে থাকা হাকুট তিক্ততা— ‘দিন আর রাত্রির দংশে যাওয়া এই পরিধান’। দংশনের বিষ যেন তাঁর শিরায় শিরায়। নইলে প্যারিস নামক দুনিয়ার মাথা-ঘুরিয়ে-দেওয়া জাঁকজমক, শিল্প-সাহিত্য-চলচ্চিত্র, প্রতিবাদ, ফ্যাশন-পারফিউমের এমন শহরের এই বর্ণনা?! সে আগন্তুক, কোনও আলো, কোনও ছায়া তার নিজের নয়। আছে বটে রাত্রির এক ডেরা, কিন্তু তাতে আর কোনও স্বপ্ন বাকি নেই।
এই তিক্ততা ফয়েজ়ের কবিতায় বিরল। একেবারে অনুপস্থিত নয় — মনে পড়বেই ১৯৭১ সালের সেই অভিশপ্ত মার্চ মাসে লেখা ‘হজ়র করো মেরে তনসে’ / সাবাধান থাকো এই দেহ থেকে, যে প্রসঙ্গও আমরা ছুঁয়ে যাব এই পরিক্রমায় — কিন্তু বিরল। ‘প্যারিস’ বা ‘হজ়র করো মেরে তনসে’-র মতো কবিতায় ফয়েজ় তাঁর মজ্জাগত তগজ়্জ়ুলকে পরিত্যাগ করছিলেন সজ্ঞানে। কিন্তু কেন? কবিতার এই তিক্ততার জটিল রসায়ন কোনও পরীক্ষাগারে পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষায় ভেঙে বলা অসম্ভব তার উপাদানগুলি কী, অন্তত ১৯৭৯ থেকে ১৯৮২ যে সময়টা তিনি কাটাচ্ছিলেন ‘লোটাস’ পত্রিকার দারুণ সম্মানজনক পদের দায়িত্ব নিয়ে বইরুতে, ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন এমন সব দেশে-শহরে যা অনেক মুসাফিরের কাছেই স্বপ্ন, তেমন সময়কালে এমন তিক্ততা কেন?
তবু একটা আন্দাজে পৌঁছন যেতে পারে। আর সে জন্য আমাদের লক্ষ্য করতে হবে যে, ‘মেরে দিল মেরে মুসাফির’ কাব্যগ্রন্থে স্বদেশ-বিচ্ছেদের বিষাদমেদুর কবিতা ছাড়াও, তিনি আরও এক রকমের কবিতা লিখছিলেন বইরুত ঘিরে। আর লক্ষ্য করতে হবে, তেমন কবিতা, ফলস্তিনি আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা সত্ত্বেও তাঁর আর এক কিসিমের ‘বিচ্ছিন্নতাবোধ’, যার কারণের সম্ভাব্য চিহ্ন আমরা পেয়ে যাব আর এক নিখাদ কবির এক মুক্তগদ্য মন্তব্যে।
ফয়েজ়ের সেই সব কবিতা, সেই কবির মন্তব্য নিয়েই হবে এ পরিক্রমার পরের পর্ব।
(ক্রমশ…)
পূর্বের লেখাগুলি– Previous episodes