প্রেম-অপ্রেমের নব আখ্যান : তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস
:: অজয় সাহা
প্রায় সহস্রাধিক বছরের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে কথাসাহিত্যের বয়স মাত্র সার্ধশতবর্ষ। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের বিবিধ সংরূপগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা নবীন এই ধারাটি যেমন ঋদ্ধ, তেমনি সুবিপুল জনপ্রিয়। আধুনিক রীতির বাংলা উপন্যাসের স্রষ্টা বঙ্কিমচন্দ্র থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত প্রায় দেড়শ বছরের ধারায় এর ব্যাপ্তি ও বিস্তৃতি ঈর্ষণীয়। বিপুল ঐতিহ্যের সেই উত্তরাধিকারের ধারায় বর্তমানে এক ঝাঁক নবীন প্রতিভা-সম্পন্ন ঔপন্যাসিক অবতীর্ণ হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন অভিজিত তরফদার, সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়, প্রচেত গুপ্ত, কৃষ্ণেন্দু মুখোপাধ্যায়, শেখর মুখোপাধ্যায়, তিলোত্তমা মজুমদার, বিভাস রায়চৌধুরী, অহনা বিশ্বাস, মন্দাক্রান্তা সেন, সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়, বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিনোদ ঘোষাল, স্মরণজিৎ চক্রবর্তী, তমাল বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। এঁরা সকলেই একুশ শতকের কথাকার। আর এঁদের মধ্যে বয়ঃকনিষ্ট হলেন তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু আত্মপ্রকাশেই মৌলিক ও উচ্চ প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘মায়াকাচ’ লাভ করেছে ‘বর্ণপরিচয় সাহিত্য সম্মান ২০১১’। তাঁর আখ্যান চটুল চলচ্চিত্র বা টেলিসিরিয়ালের বিরক্তিকর উপাদানে পুষ্ট নয়, বরং একটা ভিন্নধর্মী প্রচেষ্টার লক্ষণ বিদ্যমান।
বাংলা কথাসাহিত্যের আঙিনায় সদ্য পদার্পণ করা তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে। বর্তমানে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক। তরুণ এই কথাকার গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছেন সমকালীন বিচিত্র মানব জীবনকে। বাঙালি মধ্যবিত্ত জীবনের প্রেম-দাম্পত্য-যৌনতার নানান রূপ, মনস্তত্ত্বের বিবিধ ঘাত-প্রতিঘাত ও সমকালীন সমাজজীবন রূপায়িত হয়েছে তাঁর সদ্য প্রকাশ পাওয়া উপন্যাসগুলিতে।
‘মায়াকাচ’ : আধা ইচ্ছার সংকট
তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম উপন্যাস ‘মায়াকাচ’ ১৪১৮ বঙ্গাব্দের শারদীয় দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৪১৯ বঙ্গাব্দে। কল্পনাপ্রবণ এক চরিত্রের আদর্শের সঙ্গে বাস্তবের সংঘর্ষ তথা ব্যক্তি ও সমাজের টানাপোড়েন, অন্যদিকে প্রেমের এক জটিল খেলা অতি সূক্ষ্মভাবে এই অখ্যানের পটে উদ্ভাসিত হয়েছে। প্রধান চরিত্র তথা নায়কের উত্তম পুরুষের জবানিতে আখ্যান বর্ণিত হয়েছে।
আখ্যানের নায়ক কৃষ্ণেন্দু শিশুকাল থেকেই ‘ভাবুকমার্কা ইম্প্রাক্টিক্যাল’। বাবা রাশভারী, প্রবল বিষয়ী এবং রক্ষণশীল। কৃষ্ণেন্দুর বাবার ছোটোকাকা ওরফে ‘কাকাদাদু’ এবং বড় জেঠু উজ্জ্বল কেরিয়ার সত্ত্বেও ছয় ও সাতের দশকে সাম্য আর সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। চরমপন্থী ও তাত্ত্বিক নেতা বড় জেঠু সাতের দশকের উত্তাল দিনগুলোয় নিরুদ্দেশ হয়ে যান। অকৃতদার কাকাদাদু চাকরি ও সম্পত্তির টাকায় পত্রিকা প্রকাশ করতেন। পারিবারিক সঙ্কটের ক্ষেত্রেও বর্গাদারের হয়ে সওয়াল করেছেন। তাঁরই সান্নিধ্য ও তদারকিতে কৃষ্ণেন্দু বড় হয়েছেন।
ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে সহপাঠিনী নন্দিনীর সঙ্গে আলাপ। প্রথম দর্শনে ‘বাচাল বা মিশুকে’ এই মেয়েটিকে দেখে তাঁর মনে হয়েছে – বিন্দু মাত্র দৃষ্টিনান্দনিকতাহীন ওই চেহারার নাম ‘নন্দিনী’ কেন ? ক্লাস শুরুর দিকের কিছু ঝামেলার প্রেক্ষিতে সুরক্ষা জোগানোর অলিখিত দায় যেন স্থানীয় অভিভাবক হয়ে নন্দিনী নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। যদিও কালো, মোটা, কুদর্শনা, ঘামের গন্ধ ধরা, রুক্ষ ফাটল ধরা ত্বকের এই মেয়েটির পাশে বসতে তাঁর মন বিষিয়ে উঠেছে। মনে হয়েছে, ‘এই রকম এক নারী ইন্দ্রিয়ের কাছে পীড়াদায়ক।’ বিশেষত অন্যত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে যখন সুন্দরীরা রয়েছেন। তাই নন্দিনীকে কিছুটা রূপচর্চার কথা বলেছেন। কিন্তু নন্দিনী পুরুষতন্ত্রের প্রতি প্রবল ধিক্কার জানিয়েছেন – ‘সৌন্দর্য আসলে একটা মিথ, পুরুষতান্ত্রিক নির্মাণ’ (পৃ. ২৮)। সাজসজ্জার মধ্যে দিয়ে নিজেকে পণ্য করে তুলে পুরুষতন্ত্রের কাছে আত্মসমর্পণের প্রবল বিরোধী ছিলেন – ‘প্রাকৃতিকভাবে আমি যেমন, তাই থাকতে চাই’। ফলে আস্তে আস্তে নন্দিনী হয়ে ওঠেন ‘দৃশ্য, গন্ধ, স্পর্শ, লিঙ্গ নিরপেক্ষ বন্ধু’।
আখ্যানের প্রধান দুই পাত্র-পাত্রী কৃষ্ণেন্দু ও নন্দিনীকে ঔপন্যাসিক বেশ যত্ন করেই নির্মাণ করেছেন। মনস্তাত্ত্বিক বিবর্তনের স্তরগুলি সূক্ষ্মভাবে তুলে ধরেছেন। ডিপার্টমেন্টের কালচারাল কাজকর্ম থেকে মেসের দৈনন্দিন জীবনের সবকিছুতেই নন্দিনী হয়ে উঠেছেন কৃষ্ণেন্দুর নির্বিকল্প সহকারী। কিন্তু অতি কল্পনাপ্রবণ কৃষ্ণেন্দুর ‘মূলস্থ সব অতৃপ্তি’র জায়গাটা বেশ জটিল ও রহস্যময়। তাঁর মাথার ভিতরে অপরিচিত জগতের অপরূপাদের আসা-যাওয়া। যদিও এটাও বোঝেন – ‘ওরা যতক্ষণ দূরে আছে, অপরূপ আছে, হাতের মুঠোই এলেই ওরা নিতান্ত সাধারণ হয়ে যাবে’ (পৃ. ৩৪)। কিন্তু তাঁর রক্তমাংসের শরীর, ইন্দ্রিয়রা হাঁক পাঁক করে। ঘুরে ফিরে সুদর্শনা মেয়েদের খোঁজে। তাঁর স্বপ্নের অধরা নারীরা হলেন – জার্মান টেনিস কুইন স্টেফিগ্রাফ, বয়সে অনেকটা বড় একই শহরের সুবর্ণাদি কিংবা কেমিস্ট্রি বিভাগের অতি সুন্দরী শ্বেতা। আর নন্দিনী – ‘সে অর্থে মেয়ে হিসেবেও মেনে নিতে কোথাও একটা বাধে’। কিন্তু বাস্তব জগতে বন্ধু বলতে তাঁকে ছাড়া কাউকে পাননি। এছাড়া একটা নির্ভরশীলতাও তৈরি হয়েছে। ফলে ইন্দ্রিয়ের বাইরে গিয়ে তাঁকে উপযুক্ত মর্যাদা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
এদিকে বাড়িতে কাকাদাদুর মৃত্যু আসন্ন। গোপনে কৃষ্ণেন্দুর হাতে একটা ইচ্ছাপত্র দেন – যা তাঁর বহুলালিত বিশ্বাস আর ইচ্ছের কথা এবং মৃত্যুর পর তা বাস্তবায়নের নির্দেশনামা। মরণোত্তর দেহদান এবং মৃত্যুতে অশৌচ পালন বা শ্রাদ্ধাদি না করা – ইচ্ছাপত্র দেখে তাঁর সর্বাঙ্গ শিউরে উঠলেও বাস্তবায়িত করার কথা দেন। অন্যদিকে জীবনবোধের ভিন্ন মেরুতে থাকা তাঁর বাবা অন্যান্য শরিকদের এড়িয়ে রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যার যুক্তিতে কাকাদাদুর সম্পত্তির পুরো অংশ কৃষ্ণেন্দুর নামে দানপত্র করিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। নীতিগতভাবে কৃষ্ণেন্দু এর প্রতিবাদ করলে বাবা তাঁকে প্রবল তাছিল্য করেছেন।
পরীক্ষাকেন্দ্রিক পড়াশোনায় কৃষ্ণেন্দুর প্রবল আপত্তি। কিন্তু ভালো ফলের প্রত্যাশায় নন্দিনী তাঁকে পরীক্ষা উপযোগী প্রস্তুতি নিতে বললে বিস্মিত হয়ে কৃষ্ণেন্দু অনুভব করেছেন – ‘শুধু কি বন্ধুত্বের অধিকারে প্রত্যাশা করেছে, নাকি ওর অন্য কোনও অধিকার জন্মেছে ?’ (পৃ. ৯৯) কিন্তু বিদেশ বিভুঁইয়ে নন্দিনীর সাহচর্যও যেন তাঁর কাছে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
এমন সময় নির্জন অন্ধকারে দু-জনে হেঁটে যাওয়ার সময় অসামাজিক কিছু লোকজন তাঁদের কুৎসিত ইঙ্গিত করেন। কৃষ্ণেন্দু প্রতিবাদ করলে তাঁরা তাঁকে আঘাত করেন এবং নন্দিনীকে কটুক্তি করে বলেন – ‘করতে তো অনেক কিছুই পারি। কিন্তু তোকে দেখে সে সব কিছু করতে ইচ্ছে করে না। ফোট শালী।’ (পৃ. ১০২) বাহ্যিক অসুন্দর হওয়ার জন্য আমাদের সমাজে মেয়েদের অনেক অনাদর, অবহেলা, বিদ্রুপ সহ্য করতে হয়। নন্দিনী চরিত্রের মধ্যে লেখক মানবিক অস্তিত্বের সংকটকের সেই কদর্য দিকটি নিপুনভাবে তুলে ধরেছেন। একটা সময় নন্দিনী বন্ধুদের কাছে নিজের কুৎসিত চেহারা নিয়ে নিজেই রসিকতা করেছেন। কিন্তু মানুষের সহ্যেরও তো একটা মাত্রা থাকে। আজ নন্দিনী নারীত্বের সেই মাত্রাতিরিক্ত অপমানের জ্বালায় কৃষ্ণেন্দুকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন – ‘এর চেয়ে বিকলাঙ্গ হলেও মেনে নিত। … এখন আমার আইডেন্টিটির চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে আমি একটা খারাপ দেখতে মেয়ে। … দেহ বিক্রির বাজারেও যার রেট শূন্য।’ (পৃ. ১০৬) বাহ্যত রূপহীনা বলে তাঁর জাগতিক অস্তিত্বের কোনও দাম নেই। চরম শূন্যতাবোধের মর্মপীড়ায় আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেন।
চিঠি পড়েই কৃষ্ণেন্দু রুদ্ধশ্বাসে ছুটে গেছেন নন্দিনীর বাড়িতে। নন্দিনীকে দেখতে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলেছেন – ‘কে বলেছে তুই অবাঞ্ছিত। … তোর মত সুন্দর মনের মানুষ আমি আর দেখিনি।’ (পৃ. ১০৮) আবেগে জড়িয়ে ধরেছেন। জেদ করে ভালোবেসে জীবনসঙ্গী হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন।
এর পরেই লেখক কৃষ্ণেন্দুকে ভিন্ন পথে চালিত করেছেন। আখ্যান অংশও ক্লাইম্যাক্স পর্যায়ে পৌঁছাতে শুরু করে। সহমর্মিতা ও সমবেদনার জায়গা থেকে নন্দিনীকে প্রেম নিবেদন করেছেন। অন্তর থেকে প্রেমের প্রগাঢ়তায় কৃষ্ণেন্দু এটা করেননি। তাই দেখি কুরূপা নন্দিনীকে দেখে তাঁর শারীরিক কামনা জাগে নি। এরপর অদ্ভুত এক বিকারগ্রস্ততায় তিনি ভেবেছেন, ‘প্রেম কেনই বা এতটা শরীর নির্ভর হবে ? শরীরের কাছে এ দাসত্ব তো মানবতার অপমান।’ (পৃ. ১১৪) ফলে ফ্যান্টাসির আশ্রয় নেন। কল্পনা শক্তির জোরে ভেবেছেন – ‘বেঢপ পাথরের মতো ওর শরীরের উপর আমার নতুন দেখার ছেনি গিয়ে পড়বে, একটু একটু করে বেরিয়ে আসবে আমার আকাঙ্ক্ষার মূর্তি। নন্দিনী হয়ে উঠতে থাকবে, ঠিক যে ভাবে আমি চাইছি।’ (পৃ. ১১৫) আর এখানেই আমরা চরিত্রটির মধ্যে এক চরম আত্মপ্রতারণা লক্ষ করি।
প্রেমের এক জটিল খেলায় মেতে ওঠেন কৃষ্ণেন্দু। তাঁর কল্পনায় প্রতিদিন নন্দিনী পালটে যেতে শুরু করেন নতুন নতুন ইচ্ছের শরীরে – কখনও লাস্যময়ী অভিনেত্রী, কখনও মধ্যযুগীয় অভিসারিকা, অপরূপা সঙ্গীত শিল্পী, উঠতি ফ্যাশন মডেল, এমনকি কলেজ জীবনে দেখা ইতিহাসের ম্যাডামে। ‘শত সহস্র চাহিদার সামনে সে যেন কল্পতরু।’ কিন্তু মিথ্যে মিথ্যে সব শরীর নিয়ে এই ভাবে মজে থাকার শেষ কোথায় ? সর্বনাশা এই খেলার মধ্যেই তো লুকিয়ে রয়েছে চরমতম প্রতারণার বীজ। এতে নিজে ধ্বংস হয়েছেন, আর সরল-পবিত্র মেয়েটিকেও প্রতারিত করে রসাতলে নামিয়েছেন। নন্দিনীও আপাত সরল কৃষ্ণেন্দুর কুটিল রহস্যময় অন্তর-আকাঙ্ক্ষার হদিশ না পেয়ে মর্মান্তিক পরিণতির ফাঁদে পড়েছেন।
এমন সময় কাকাদাদুর মৃত্যকালে কৃষ্ণেন্দু সেই ‘ইচ্ছাপত্রে’র প্রসঙ্গ তুললে পরিবারের সকলেই আপত্তি করেছেন। সামনেই মেজ জেঠুর মেয়ের বিয়ে, তাই তিনি এই কলঙ্ক নিতে নারাজ। বাবা তীব্র আপত্তি করে বলেছেন, ‘দূর থেকে এগুলোকে যত আদর্শবাদী মহাপুরুষোচিত মনে হোক, আসলে এগুলো লোকটার কিছু শয়তানি আর বিধ্বংসী জেদ। আমাদের বিপদে ফেলে উনি সারাজীবন আনন্দ পেয়েছেন।’ (পৃ. ১৩১) এরপর আবার ঘটা করে শ্রাদ্ধের পরিকল্পনা শুনে বিরক্ত হয়ে কৃষ্ণেন্দু বলেছেন – ‘শ্রাদ্ধ মানে তো শ্রদ্ধা জানানো। লোকটার উপর যে তোমাদের বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা ছিল না, শ্রাদ্ধ করে তোমরা সেটারই জানান দেবে।’ (পৃ. ১৩৭) ছেলের বেয়াড়াপনা ভাবগতিকে বাবা অতিষ্ঠ হয়ে সমস্ত নথি দেখতে চেয়ে ছিঁড়ে ফেলে দেন। একুশ শতকেও বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের অপরিবর্তনীয় রক্ষণশীল মানসিকতার স্বরূপটি লেখক তাৎপর্যপূর্ণভাবে তুলে ধরেছেন।
কাকাদাদুর স্নেহ ও আদর্শে উদ্বুদ্ধ এবং প্রবল আবেগপ্রবণ কৃষ্ণেন্দু আত্মীয়-স্বজনদের দুর্ভাগ্যজনক আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে বাড়ি ত্যাগ করেন। ট্রেনে আসতে আসতে প্রচণ্ড আত্মদ্বন্দ্বে তাঁর মনে হয়েছে – বেঁচে থাকাটাই অর্থহীন। তাই মাঝ পথে ট্রেন থেকে নেমে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন – কিন্তু পারেন নি।
এদিকে নন্দিনী বাবার ক্যানসারের চিকিৎসার কারণে ও মায়ের চাকরির বদলির জন্য বাড়ি বিক্রি করে কলকাতায় চলে যেতে চাইলে কৃষ্ণেন্দুর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। কারণ সমস্ত ক্ষেত্রেই না পারার গ্লানিময় জীবনে নন্দিনীই তাঁর সবচেয়ে মূল্যবান প্রাপ্তি। তাই তাঁকে হারাতে চাননি। নন্দিনী পারিবারিক সমস্যার কথা ডিটেলে জানিয়েও নিজেকে সমর্পণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছেন – ‘যে দিন মনে করবি, নিজে আর এক জনের ভাত কাপড়ের ব্যবস্থা করতে পারছিস, ডাকিস, আমি ঠিক চলে আসব।’ (পৃ. ১৫৮) কিন্তু কৃষ্ণেন্দু যে কোনও মূল্যে নন্দিনীকে আটকাতে ‘নরনারীর সম্পর্কের খেলার শেষ তাসটা আস্তিন থেকে বের’ করেছেন। পরের দিন দুপুরে ফাঁকা ঘরে নন্দিনীর সঙ্গে শারিরীকভাবে মিলিত হয়েছেন। মিলনের আনন্দে বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে অর্ধস্ফুট গোঙানির মতো ‘শ্বেতা… শ্বেতা…আ’ ধ্বনি উচ্চারণ করলে নন্দিনী সজোরে ধাক্কা দিয়ে বলেছেন – ‘ধাপ্পাবাজ, শয়তান’। অবচেতন মনের প্রতারণায় কৃষ্ণেন্দু হতবাক। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে নন্দিনী কাঁদতে কাঁদতে উচ্চারণ করেছেন মর্মান্তিক হৃদয় যন্ত্রণার কথা – ‘আমি জানতাম তুই আমাকে আদৌ ভালোবাসিসনি। আমার মতো মেয়েকে ভালোবাসা যায় না। … আমার মধ্যে দিয়ে তুই অন্য কাউকে, আর একজনকে চেয়ে এসেছিস।’ (পৃ. ১৬২)
বাস্তবিক কৃষ্ণেন্দু নন্দিনীকে কল্পযন্ত্র হিসেবেই ব্যবহার করেছেন। মানবীয় অস্তিত্বের চূড়ান্ত অবমাননা করেছেন। লজ্জায়, ঘৃণায় রাত্রে ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন – ‘মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা উঠে গিয়েছিল। তবু মরিনি। আধা ইচ্ছার সঙ্কট, আর কি ?’ (পৃ. ১৬৬) এরপর অমেরুদণ্ডী প্রাণীর মতো বাবার ইচ্ছার অধীন হতে হয়েছে। পরে চাকরি পেয়েছেন। কিন্তু যেন ‘আধমরা মানুষ, দিনগত পাপক্ষয়কারী’। বছর দশেক পরে হঠাৎ একদিন চলে গেছেন সেই ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে – স্মৃতি হাতড়ে বেড়িয়েছেন। অন্ধকার নেমে এসেছে, প্রাণপণে বলে উঠেছেন – ‘নন্দিনী ফিরে আয়। সশরীরে না হোক, ছায়ার শরীর নিয়ে ফিরে আয়।’ ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস ? যে নন্দিনীর মধ্যে তিনি ছায়ার শরীর খুঁজতেন, আজ সেই নন্দিনীকেই ছায়ার শরীরে ফিরে পেতে ব্যাকুল। আর আত্মোপলব্ধির চরম স্বীকারোক্তি দিয়ে বলেছেন, ‘আমি আর অপরূপাদের চাই না, তোর যাবতীয় ত্রুটি নিয়ে ফিরে আয়।’ (পৃ. ১৬৮)
তীব্র বিষাদে পূর্ণ, আত্মদ্বন্দ্বে ক্ষত-বিক্ষত এক আশ্বর্য চরিত্ররূপে কৃষ্ণেন্দুকে লেখক দক্ষতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন। অতিমাত্রায় ভাবুক ও ইমপ্র্যাক্টিক্যাল এই তরুণ বাস্তব জীবন অনভিজ্ঞতার জন্য ভাবের জগতে বিচরণ করেছিলেন। তাই ‘আধা ইচ্ছার সংকট’ তিনি কখনোই কাটিয়ে উঠতে পারেননি। দুর্বোধ্য-দুজ্ঞেয় মনের মায়াময় জগৎ থেকে বেরিয়ে যখন রূঢ় বাস্তবকে চিনলেন – তখন তাঁর ট্রাজিক পরিণতি ঘটে গেছে। যদিও পাঠকের অনুভবে এ পরিণতি আকস্মিক বা অপ্রত্যাশিত নয়। অপর পক্ষে নন্দিনী পুরোপুরি প্র্যাক্টিক্যাল। তাই প্রিয়জনের কাছে চরম প্রতারিত হওয়ার পরও বলতে পেরেছিলেন – আত্মহত্যার প্রশ্নই ওঠে না, বরং কৃষ্ণেন্দুর প্রতি ঘৃণাই তাঁর নতুন করে বাঁচার শক্তি হবে।
একমুখী এক নিটোল প্লটের বাঁধনে লেখক সদ্য বয়ঃপ্রাপ্ত তরুণ-তরুণীর প্রেম-অপ্রেমের এক নব আখ্যান নায়কের আত্মকথনে নিপুণভাবে উপস্থাপন করেছেন। বর্ণনা বা সংলাপের ভাষায় কোথাও জড়তা নেই। মার্জিত ও গতিশীল বাচনে এক তরুণের ব্যর্থ প্রেম ও ব্যর্থ জীবনের নিপুণ আলেখ্য রচিত হয়েছে। প্রথম সৃষ্টিতেই তরুণ ঔপন্যাসিক তমালবাবু যথেষ্ট মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন।
‘মর্ম মেঘ’ : দাম্পত্যের সঙ্কট
তমাল বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস ‘মর্ম মেঘ’ (২০১৩) –এ বাঙালি উচ্চ-মধ্যবিত্তের দাম্পত্যের সংকটের এক ছবি তুলে ধরেছেন। কাহিনির নায়ক সরকারি হাসপাতালের তরুণ স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ নীলাদ্রিশেখর ভৌমিক। ছোটোবেলায় প্রচণ্ড দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে এখন তিনি সফল ডাক্তার এবং রীতিমতো ধনী। সহকর্মী জয়ন্তর ভাবনায় – ‘পেশেন্ট মানেই তো এক-একটা দু-পা ওয়ালা দাঁতফোকলা গান্ধী-হাসিমার্কা দেড়শো টাকা’। কিন্তু নীলাদ্রির বিবেক ও নীতিবোধ এমন পেশাদারি নয়, জীবন ফিরিয়ে দিতে পারার মতো নিখাদ তৃপ্তি অন্য কোনও পেশায় দেখেননি।
নীলাদ্রির ডাক্তারি তথা বাহ্যিক জীবনের বিরাট সাফল্য দাম্পত্য জীবনের চূড়ান্ত ব্যর্থতার তুলনায় নগণ্য। ব্যস্ততার একঘেয়ে রোজনামচাকে স্ত্রী স্বর্ণালি নিছক অজুহাত ভাবেন। জন্মদিনে স্ত্রীকে নিরবচ্ছিন্ন সঙ্গ দেওয়ার সমস্ত প্রস্তুতি সত্ত্বেও বিবেকবোধে চেম্বারে গেছেন এবং সিনিয়র এক ডাক্তারের বিপদে সাহায্য করতে গিয়ে স্ত্রীকে কোনও সময়ই দিতে পারেননি। শুধু এদিন নয়, পেশাগত ব্যস্ততায় বিয়ের তিন বছরের মধ্যে কোনও অনুষ্ঠানেই কথা রাখতে পারেননি। অথচ দাম্পত্য জীবনের সেরা সময়টা উপভোগের জন্য সন্তান নেননি। কিন্তু এক উদাশীন শৈত্য আর নির্বিকল্প একাকীত্ব ছাড়া কী দিতে পেরেছেন স্ত্রী স্বর্ণালিকে ?
ধনী ডাক্তারের অতীব সুন্দরী কন্যা স্বর্ণালীকে নীলাদ্রি ‘গৃহশোভাবর্ধক’ গৃহবধূ করে রেখেছেন। যদিও নীলাদ্রির ভালোবাসা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু দাম্পত্য জীবনের ভালোবাসা বস্তুটিকে যাঁরা অশরীরী মনে করেন, তাঁরা হয় ভয়ানক মূর্খ, নয় প্রতারক। ‘উর্বর জমি কৃষকের অনাগ্রহে অনাবাদী’ পড়ে থাকার মতো স্বর্ণালির অবস্থা। তাই নীলাদ্রি সম্পর্কে স্বর্ণালির উপলব্ধি – ‘লোকটা যেন আগুনের ব্যবহার না জানা প্রাগৈতিহাসিক গুহামানব।’
স্বর্ণালির ব্যস্ততাহীন কর্মহীন দিনরাত্রি। বড় বাড়ি জুড়ে একা একা ঘোরা আর এলোমেলো সব চিন্তায় মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ভেতরের সত্তা বলে ওঠে – কঠোর, জটিল, দুর্বোধ্য হতে। ভাবেন নীলাদ্রির ‘ক্লান্তি, টেনশন সব বাজে অজুহাত’। যদিও স্বার্ণালি সনাতন ভারতীয় নারী আদর্শেই স্বামীর প্রতি সহমর্মী হন।
নীলাদ্রি বহুবার গোপন অ্যাডভাইস নিতে আসা ক্লয়েন্টদের বলেছেন, ‘যৌনতা বাহ্যিক কোন ওষুধ দিয়ে আনা যায় না। … সবটাই মানসিক খেলা।’ (পৃ. ১১১) কিন্তু নিজের দেওয়া উপদেশগুলো নিজের জীবনে প্রয়োগ এত কঠিন ভাবতে পারেননি। তাই একটু বেশি রোমান্টিক হয়ে বাড়ি ফিরেই স্বর্ণালিকে ছাদে জ্যোৎস্না উপভোগে নিয়ে যান, মিলিত হওয়ার চেষ্টা করেন। উত্তেজনার চূড়ান্ত মুহূর্তের সময় তাঁর সারা শরীর শিথিল হয়ে আসে, আগের মতোই আবারও নিষ্ক্রিয় হয়ে যান। আর্তনাদ করে ওঠেন – জলের রিজার্ভারের দেওয়ালে ঘুষি মারেন। ভাবেন – ‘এত সব ধন মান নাগরিক সাফল্য সব অর্থহীন। ছুরি কাঁচি হাতের দক্ষ সার্জনের সব গর্ব, অসহায় রোগিণীদের চোখে দেখা সদয় দেবতার জাঁকালো মুখোশ সব ধুলোয় লুটোচ্ছে।’ (পৃ. ১১৭) অন্যদিকে বিরক্ত স্বর্ণালি রাগে বড় আকারের টব সুদ্ধ গাছকে উলটে ফেলে দিয়েছেন।
আসলে নীলাদ্রির এমন কামশীতলতার কারণটিও মানসিক। বিচলিত ও বিভ্রান্ত নীলাদ্রি তাঁর ‘গডফাদার’ ডাঃ ভাস্কর সেনগুপ্তের সঙ্গে আলোচনায় অনুধাবন করেছেন – গাইনিকলজিস্টদের এটা অতি পরিচিতির অভিশাপ। ভাস্করবাবুর কথায় – ‘ময়রারা মিষ্টি খায় না, মিষ্টি দেখলে তাঁদের গা গোলায়। শরীরের কারবারির শরীর নিয়ে কোনও রোমাঞ্চ উবে যাওয়াই স্বাভাবিক। এখানে তো কিছু অজানা নেই, কোনও রহস্য নেই, তাই আবিষ্কারের আনন্দও নেই।’ (পৃ. ১২১) ফলে অবচেতনে নীলাদ্রির কাছে তাঁর স্ত্রী স্বর্ণালিও ‘একটা সমগ্রতা নিয়ে আসে না। বিভিন্ন সব স্ত্রী-অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সমষ্টি হিসেবে আসে’। মনের দুঃসহ ভার ও অপরাধবোধে ভুগতে থাকা নীলাদ্রি এই বিষয়টি স্বর্ণালিকে বোঝাতেও চেয়েছেন – ‘যে সব গোপনাঙ্গ সাধারণত পুরুষদের কাছে ভয়ানক কামনার, অনেক সাধ্য সাধনার পর পাওয়া গুপ্তধনের মতো, আমার মত একজন গাইনির কাছে সেগুলো খুবই নিউট্রাল অসাড় যৌন আবেদনহীন মাংসের দলা।’ (পৃ. ১২৪) ফলে ভালোবাসার নিগূঢ় মুহূর্তে কোনও বাসনাই জন্ম নেয় না।
আখ্যানকার গাইনিকলজিস্ট দম্পতির জীবনের এই উদ্ভূত সংকটের আরও গভীরে প্রবেশ করেননি। জটিল এই আখ্যান প্রেক্ষিতটি নিয়ে আর পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে তিনি হয়তো নিরাপদ থাকতে চেয়েছেন। অতৃপ্ত যৌন মিলনের ক্ষণস্থায়ী হতাশাকে ঝেড়ে ফেলে স্বর্নালি স্বামীর পাশে দাঁড়ান। এমন সময় রোগী মৃত্যুজনিত জটিল মানসিক চাপ থেকে মুক্তির জন্য স্বর্নালি তাঁকে সিকিম বেড়াতে নিয়ে যান। আর সেখানে প্রবল ভূমিকম্পের বিপর্যয় থেকে বাঁচতে গিয়ে তাঁরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। শেষে আহত নীলাদ্রির সঙ্গে মিলিত হয়েছেন। স্বর্ণালির ব্যর্থ জীবন যৌবনের যন্ত্রণাদীর্ণতার সূক্ষ্ম কোনও পরিচয় লেখক আর দেননি। উপরন্তু অকারণে উপকাহিনির বিস্তৃত বর্ণনায় লেখকের অযত্নের ছাপ সুস্পষ্ট।
গ্রন্থটির ঊনত্রিশটি অধ্যায়ের মধ্যে দশটি অধ্যায়ে বিস্তৃতভাবে ডাঃ ভাস্কর সেনগুপ্তের স্মৃতিচারণ, সংগ্রাম করে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এবং কর্মজীবনের বিপুল সংঘর্ষের বর্ণনা রয়েছে। ভাস্কর বাবু নীলাদ্রির শ্বশুরের বন্ধু। তিনি অকৃতদার এবং এবং ‘কাসানোভা ইমেজের মানুষ’। আখ্যানের মধ্যে উপকাহিনি সংযোজিত করা হয় মূল কাহিনিকে পরিপুষ্টি দানের জন্য। অর্থাৎ মূল কাহিনিধারাকে পরিণতির দিকে এগিয়ে দেয়। ভাস্করবাবু এখানে ‘গডফাদার’ রূপে নীলাদ্রিকে স্টেবল হতে সাহায্য করেছেন। যাঁর ছায়ায় বসে যন্ত্রণাদীর্ণ নীলাদ্রি শান্তি পান। তবে উপকাহিনি অংশটি অতিকথন হলেও প্রসঙ্গক্রমে লেখক সেখানে যে বর্ণনাগুলি দিয়েছেন তা সমকালীন সমাজ জীবনের অত্যন্ত বাস্তব চিত্র হিসেবে তাৎপর্যপূর্ণ। যেমন –
১। সরকারি হাসপাতালের জঘন্য নোংরা, মৃত্যুর রমরমাময় একটা ‘প্রচ্ছন্ন নরক’ অবস্থা।
(পৃ. ৪৪ – ৪৫, ৮২ – ৮৩)
২। রাজনৈতিক মদতে রোগী তথা রোগীর আত্মীয়দের ডাক্তারদের সাথে দুর্ব্যবহার, মারধর
প্রভৃতি অবাঞ্ছিত ঘটনা। (পৃ. ৮ – ১০, ৫০, ১৪৩ – ১৪৪)
৩। স্বাস্থ্য দপ্তরের গাফিলতিতে সুষ্ঠু চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙে পড়া। (পৃ. ৫১)
৪। পোস্ট নকশাল পিরিয়ড থেকে ইউনিয়নরাজ, আয়াচক্র, সরকারি প্রকল্পের অর্থ নয়ছয়
হওয়া ; প্রতিবাদ করলে উলটে সরকারি কাজে বাধা সৃষ্টির অপরাধে খোদ মন্ত্রীর আদেশে
তাঁকেই সাসপেন্ড করা কিংবা দূরে বদলি করে দেওয়া।
৫। বিশ্বায়নের যুগে ওষুধ কোম্পানিগুলির স্পনসরশিপে আয়োজিত পার্টিতে ‘লোভনীয়
ডিনার’, ‘জম্পেশ ককটেল’ কিংবা ব্যভিচারময় উৎশৃঙ্খল জীবনেরও ছবি ফুটে উঠেছে।
প্রশাসনের মাৎসর্য ও কলুষতা সূক্ষভাবে তুলে ধরার জন্যই লেখক হয়তো ভাস্কর সেনগুপ্তের উপকাহিনিটির ব্যাপক বিস্তার ঘটিয়েছেন। আমরা নজরুল ইসলামের আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস ‘বকুল’ (১৯৯৩)-এ দেখি আই. পি. এস. অফিসার বকুলের অভিজ্ঞতার বয়ানে সরকার প্রশাসনের হীনতা, মাৎসর্যের ছবি। ঘুষখোর অফিসার, কেরানি, অসাধু ব্যবসায়ী, ভণ্ড রাজনীতিক তথা ভ্রষ্ট সমাজের নিপুণ চিত্র। কিংবা তপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘লালফিতে’ (১৯৯৭) উপন্যাসে সিভিল সার্ভিস অফিসার ঋকের অনুভবে ধরা পড়েছে প্রশাসনের অসারতা – কেরানি-আমলা থেকে মন্ত্রী পর্যন্ত কীভাবে অসাধুতার গোপন জাল ছড়িয়ে রেখেছেন। যদিও তমালবাবুর ‘মর্ম মেঘ’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় বিষয় এই সামাজিক সংকটের ছবি তুলে ধরা নয়। তবু এই ঘটনাগুলি কর্মরত ডাক্তারদের উপর কীরূপ মানসিক চাপ ও প্রবল হতাশার সৃষ্টি করে, যা তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনের উপরেও প্রভাব ফেলে, সেই প্রেক্ষিতটি আখ্যানের নায়ক নীলাদ্রির ক্ষেত্রে আমরা লক্ষ করি।
‘ঘাতক’ : অবচেতন মনের কারিকুরি – আত্মনাশী গোপন প্রেম
তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃতীয় উপন্যাস ‘ঘাতক’ জানুয়ারি, ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত। ফ্রয়েডিয়ান মনোবিকলনের এক বিশেষ রূপ এই গ্রন্থে অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও সার্থকভাবে এই আখ্যানে রূপায়িত হয়েছে। মনের সচেতন স্তরের কোনও বাসনার সঙ্গে যদি সামাজিক আদর্শের বিরোধ ঘটে কিংবা অন্য কোনও কারণে তা অতৃপ্ত থাকে, তাহলে তা অবদমিত হয়ে মনের নির্জ্ঞান স্তরে আশ্রয় লাভ করে ও মানসিক বিকারের সৃষ্টি করে। অনেক সময় অবচেতন স্তরের সে বোধ অনুকূল পরিবেশে সক্রিয় হয়ে ওঠে – তখন চেতন মনে দ্বন্দের জন্ম নেয়। আর মানুষ তখন আত্মদ্বন্দ্বে ক্ষত-বিক্ষত হতে থাকে – এই বোধের এক বেদনাঘন রূপায়ন তমালবাবুর ‘ঘাতক’।
কাহিনির কথক ৬৬ বছরের নিঃসন্তান বৃদ্ধ। নীতিবাগিশ, পরিশ্রমী আর নিষ্ঠাবান উচ্চ অফিসারের পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি অবসর গ্রহনের পর এখন ‘জবুথবু মেরে গেছে’। এবার নিজেকে চিনেছেন সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপে। আর জানার নেশা আত্মঘাতী। আত্মানুসন্ধানে করতে গিয়ে নিজের যত্নলালিত ভাবমূর্তি ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।
কথকের ভাইপো ২৯ বছরের অরুণাভর লঞ্চ থেকে পড়ে আকস্মিক মৃত্যু ঘটে। বাড়ির একমাত্র সন্তানের অকাল মৃত্যুতে পিতা-মাতা (অশোক-ইলা) যেন ‘চলমান মৃতদেহ’। আর লাবণ্যময়ী, উচ্চশিক্ষিতা অহনা মাত্র ২৯ বছরেই যৌবনের সম্পৃক্তির কালেই অকালবৈধব্যে বজ্রাহত – হতবাক।
অহনা ছিলেন পরম সেবাময়ী, মিতবাক, বাস্তববাদী – সনাতন ভারতীয় নারীর মূর্ত প্রতীক। উচ্চ মেধাবী ও ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর পাশ করেও সাংসারিক দায়িত্ব পালন করতে ভালোবেসেছিলেন। গান-বাজনা, পুজো-উৎসব, সিনেমা-থিয়েটার, প্রদর্শনী, রেস্টুরেন্ট প্রভৃতির মাধ্যমে চার বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে খুশির পরিবেশে রেখেছিলেন। এ হেন অহনার সংস্পর্শে কথক জ্যাঠা-শ্বশুরের জীবনের মাত্র বদলে গেছে। অহনাদের মধুচন্দ্রিমা যাপনের সঙ্গী হয়ে, নতুন করে বাঁচতে চেয়েছেন। পৌরাণিক যযাতির মতো হৃতযৌবন ফিরে পাওয়ার ব্যাকুলতা জেগেছে।
সদ্য বিবাহিতা অহনার পূর্ণ যৌবনকালে অকাল বৈধব্য নেমে এলেও পারিবারিক কর্তব্যে কোনও ত্রুটি রাখেননি। তাই কথক তথা জ্যাঠাশ্বশুরের মনে হয়েছে – ‘ভবিষ্যতে এই বয়স্ক, রোগজর্জর সংস্কারাচ্ছন্ন দুর্বল মানুষগুলোর সেবাদাসী হওয়াই কি ওর ভবিতব্য ?’ (পৃ. ৩৩) অথচ উপায় তো একটাই, আবার পাত্রস্থ করা। কিন্তু বাড়ির বিধবা বউ-এর অন্যত্র বিয়ে ? মানসম্মান জলাঞ্জলি যাবে না ? যদিও এজাতীয় চিন্তাকে তাঁর মধ্যযুগীয় বর্বরতা বলেই মনে হয়েছে। তাই কথক তাঁকে আবার নতুনভাবে গড়তে চেয়েছেন। চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে বাধ্য করেছেন, নিজেও তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। সুযোগ্য পাত্রের সন্ধান করেছেন। নানা পাত্রের সন্ধান নিতে নিতে তাঁর স্ত্রীর দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক, লম্বা-সুদর্শন তরুণ দীপ্তেশকে উপযুক্ত মনে হয়েছে। কলেজ সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষার প্রস্তুতিতে সাহায্যের জন্য ডেকে আনেন। অহনাকে সাজিয়ে গুছিয়ে আলাপ করিয়ে দেন। সুপ্ত বাসনাকে জাগানোর জন্য ইয়ার্কির ছলে বলেন – ‘এ রকম একটা ছেলের প্রেমে পড়তে পারতিস।’ যদিও অহনা নিস্পৃহ কঠোরতায় তা এড়িয়ে গেছেন।
এরপর কথক চরিত্রের মধ্যে অদ্ভুত এক দোলাচলতা প্রত্যক্ষ করি – ‘মন থেকে ঠিক চাইছিলাম না ওর একটা পাত্র জুটে যাক। … ও চলে গেলে আমি ভেঙে পড়ব।’ (পৃ. ৪০) অহনার বিয়ে দিতে তিনিই বেশি তৎপর, আবার তিনিই চান না অন্য কোনও পুরুষ ওকে স্পর্শ করুক। তাঁর কথায় ‘আসলে অহনার ওপর আমার একটা অধিকার জন্মে গেছে।’ (পৃ. ৪৯) এ তো নিছক জ্যাঠাশ্বশুর বা পিতৃত্বের অনুভূতি নয়, এ তো গোপন প্রেমিকের স্বেচ্ছাচারী স্বত্বাধিকার।
অহনার পড়াশোনার জন্য দীপ্তেশের আসা-যাওয়া শুরু হয়। কিন্তু দীপ্তেশ এলেই কথক ক্ষুব্ধ হন। ওঁর বুদ্ধিদীপ্ততায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। এম. কম. ও ল’ পাশ করা বৃদ্ধ নতুন করে ইংরেজি সাহিত্য পড়া শুরু করেন। টেক্স্ট-এর সঙ্গে নোট বই কিনে ঘর বন্ধ করে রাত জেগে পড়েছেন। ইংরেজি সাহিত্যের গভীর আলোচনা করতে দেখে মুগ্ধ অহনা তাঁর সুন্দর মনের প্রশংসা করলে কথক বলেছেন, ‘কিন্তু এমনও তো হতে পারে, বাইরে থেকে যেটা সুন্দর মনে হচ্ছে – ভেতরে সেটা কদর্য, ভ্রষ্ট, বিকৃত।’ (পৃ. ৫৪)
অবচেতন মনের বিকারে কথক অসুস্থ এক প্রতিযোগিতায় নেমে দীপ্তেশের সঙ্গে বিতর্ক জুড়ে দেন। অহনার সামনেই তথ্যমূলক নানা প্রশ্নে তাঁর পড়াশোনার ঘাটতি বুঝিয়ে দিয়ে পৈশাচিক আনন্দ লাভ করেন। সত্তরের আশেপাশের বৃদ্ধ নিজেকে মননশীল, সূক্ষ্মবোধসম্পন্ন, সৃজনশীল পুরুষ হিসেবে তরুণ দীপ্তেশের সমান আকর্ষণীয় করে তুলতে চান অহনার কাছে। সত্য উপলব্ধি করলেও তিনি তার মুখোমুখি হতে পারেননি। দীপ্তেশকে অহনার সুদর্শন, পণ্ডিত, বহুমাত্রিক পুরুষ বলেই মনে হয়েছে। অন্যদিকে কথক কুৎসিত, ক্রম ক্ষয়িষ্ণু বৃদ্ধ – অসহ্য এই যন্ত্রণা থেকে কাতর প্রর্থনা করেছেন, ‘হে আমার হৃত যৌবন – আমার উষ্ণ আর্দ্র অবাধ্য শরীর নিয়ে ফিরে আয়।’ (পৃ. ৭০) তাই লুকিয়ে অ্যান্টি এজিং ক্রিম ব্যবহার করেছেন। নিজের একঘেয়ে ছবি বদল আনার চেষ্টা করেছেন।
অহনার হতাশাচ্ছন্ন শূন্য জগতে আশা-আকাঙ্ক্ষা, ভরসা, বিশ্বাস ও মুক্তির একমাত্র অবলম্বন ছিলেন এই জ্যাঠাশ্বশুর। অহনা বলেওছেন – ‘আমার সৌভাগ্য তোমার মত একজনের সান্নিধ্য পেয়েছি’। (পৃ. ১১৫) কর্মহীন, ব্যস্ততাহীন অখণ্ড অবসর জীবনে ছায়াসঙ্গীর মতো অহনার সহজ উপস্থিতি, অতি নির্ভরতা ও সান্নিধ্য কথকের চেতন-অবচেতনে সর্বব্যাপী মড়ক সৃষ্টি করেছে–
১। স্বপ্নে প্রত্যক্ষ করেছেন একটা অনাবৃত নারী শরীর এক সুবিশাল উপতক্যার মতো শোয়ানো
আছে। আর তিনি ভূ-পর্যটনের মুগ্ধতা নিয়ে নির্মাণ নৈপুণ্য দেখছেন। (পৃ. ৭৩ -৭৪)
২। ভাইপো বোউ অ্যাটাচ্ড বাথে স্নান করছেন, আর তিনি নিলর্জের মতো কাজে অছিলায় সেই
ঘরে থেকে গেছেন। স্নানের দৃশ্য কল্পনা করেছেন। অহনার শরীর ধোয়া জলের শব্দ তাঁর
সর্বাঙ্গে শিহরণ তুলেছে। (পৃ. ৭৫ – ৭৭)
আর এর ফলে সুদীর্ঘকালের সংযম, নিরপেক্ষতা, বিবেক সব ভেঙে পড়েছে। কৃতকর্মের অনুশোচনায় দগ্ধ হয়েছেন। সবার সামনে থেকে পালিয়ে বেড়াতে চেয়েছেন। চিরকালের নাস্তিক হয়েও মন্দির প্রাঙ্গণে গিয়ে প্রাণপণে বলেছেন – ‘হে দেবী ! আমায় ক্ষমা করো। আমার মনের কলুষ দূর করো।’ (পৃ. ৮০) যদিও শেষে বিশ্বাস স্থাপন করতে না পেরে হাহাকার করে বলেছেন, ‘আমি ঈশ্বর পরিত্যক্ত – আমার পরিত্রাণ নেই – আমি পাতক।’ (পৃ. ৮১) আবার পরক্ষণেই তাঁর মনে হয়েছে, ঈশ্বর নির্মমভাবে যান্ত্রিক – ‘যতসব বাতুল মূল্যবোধ নিজেকে কষ্ট দিয়ে অতিমানুষ
সাজার ভণ্ডামি।’ (পৃ. ৮২) তাই শিশুর মতো জেদ ধরে ভাবেন – ‘আমার জিনিস আমি কাউকে দেব না। অহনা আমার।’ অথচ জানেন, অহনার সচেতন অবস্থায় তাঁকে এভাবে পাওয়া কোনওভাবেই সম্ভব নয়। কিন্তু নির্জ্ঞান স্তরের মানসবিকার কোনও যুক্তিই মানে না। তাই দেখি অহনার বিছানার চাদর দেখে তাঁর অদ্ভুত এক শিহরণ হয়েছে – ‘সারা চাদরটায় ওর শরীরের গন্ধ মাখা। … চাদরটার প্রতিটা সুতোয় ওর বুক, উরু, গভীর নাভি, মসৃণ পেট, নিয়ন্ত্রিত নিতম্বের তাপ লেগে আছে। চাদরটার ওপর সর্বাঙ্গ মেলে দিলাম। বুক ভরে টেনে নিচ্ছি অহনার গন্ধ। … এ গন্ধ আমার, একান্তই আমার।’ (পৃ. ১০৩)
এদিকে কলেজ সার্ভিস কমিশনের সেট পরীক্ষায় অহনার আশাতিরিক্ত সাফল্যের পর দীপ্তেশের সঙ্গে ঘনিষ্টতা বাড়ে। এমন সময় তাঁদের প্রেমপত্রগুলি কথকের নজরে এসেছে। পরে ঘরের মধ্যে দুজনকে আলিঙ্গন অবস্থায় দেখে চরম অস্থির হয়ে ওঠেন। অধিকার হারানোর ভয়ে দীপ্তেশকেই সরিয়ে দেওয়ার ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্ত নেন। ভাড়াটে ঘাতকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন গাড়ি চাপা দিয়ে দীপ্তেশের পা গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু এর পর থেকেই তাঁর অন্তর প্রবল দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন। নিদ্রাহীন গভীর রাতে কড়া ডোজের ঘুমের অসংখ্য ওষুধ খেয়ে জীবন যন্ত্রণা থেকে মুক্তির পুরো প্রস্তুতি নিয়েছেন – কিন্তু পারেননি।
পরের দিন যথারীতি ভাড়াটে ঘাতকের গাড়ির ধাক্কায় দীপ্তেশের পা গুঁড়িয়ে গেছে। আর এই ঘটনা অহনা-দীপ্তেশকে আরও কাছাকাছি এনে দিয়েছে। বিয়ের দিন দীপ্তেশদের বাড়ি থেকে আসা সাদা গাড়ি দেখে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, মনন যুদ্ধে পরাজিত কথকের মনে হয়েছে – ‘যেন একটা অ্যাম্বুলেন্স। ওরা আমার অনুচ্চারিত প্রেমের শব নিতে এসেছে।‘
অহনাহীন বাড়িখানা যেন নিঃস্তব্ধ পুরী – এলাকা থেকে বিচ্ছিন্ন একটা দ্বীপের মতো। কিন্তু এই শূন্যতাই শিখিয়েছে বিযুক্ত হতে, অনাসক্ত হতে, বীতকাম হতে। কথকের অনুভবে – ‘আমি আমার ইন্দ্রিয়গুলোকে নির্বাসন দিয়েছি, উত্তাল অনুভূতিগুলো সমতল হয়ে গেছে – এখন আমি অশরীরী।’ (পৃ. ১৯৫)
তমালবাবুর পুর্ববর্তী উপন্যাস ‘মর্ম মেঘ’-এর মতো এই গ্রন্থে অতিকথন নেই। মেদহীন নিটোল অবয়বে টানটান উত্তেজনাময় এক অখ্যান লেখক নিপুণতার সঙ্গে গড়ে তুলেছেন। অহনা-দীপ্তেশ টাইপধর্মী সমান্তরাল চরিত্র হলেও আখ্যানের কথক আদ্যন্তই বৈচিত্র্যপূর্ণ চরিত্র। বাহ্যত পরম মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী – সকলের প্রণম্য, কিন্তু অন্তর তীব্র বিষে পূর্ণ। কন্যাসম তন্বী ভাইপো বোউ-এর প্রতি তাঁর গোপন প্রেমের সুতীব্র পাপ বোধের দ্বান্দ্বিকতায় এবং আত্মনাশী ঘাতক মনের আশ্রয়ে ক্ষতবিক্ষত চরিত্রটি বাংলা কথাসাহিত্যের ধারায় এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন।
‘ঘাতক’ উপন্যাসটির আর একটি দিক বিশেষভাবে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, যদিও তা আখ্যানের কেন্দ্রীয় বিষয় নয়, তা হল হিন্দু বিধবা সম্পর্কিত চিরাচরিত জটিল সামাজিক সংস্কার সম্বন্ধে সমাজ-মানসিকতার বিবর্তন। একুশ শতকীয় বিশ্বায়নের কালে হিন্দু বিধবা অহনা খুব সহজেই সমাজ-জীবনের মূল স্রোতে ফিরে এসেছেন। বৈধব্য কোনও বাধা হয়ে ওঠেনি।
স্বামীর মৃত্যুর হওয়ার পরে অহনা আস্তে আস্তে বাপের বাড়ি যাওয়াও বন্ধ করে দেন। ব্যক্তিগত বিলাস, বিনোদন ত্যাগ করেছেন। নিজেই অফ হোয়াইট শাড়ি বেছে নিয়েছেন। যদিও শ্বশুর বাড়ির লোকজনের অনুরোধে সালোয়ার কামিজ পরেছেন। শ্বশুর বাড়ির চির অন্ধকারময় পরিবেশে অসীম ত্যাগের দ্বারা অহনা হয়তো ধীরে ধীরে অভিযোজন করে নেবেন। কিন্তু শ্বশুর বাড়ির লোকেরাই পুনর্বিবাহের উদ্যোগ নিয়েছেন। এতে আত্মীয় স্বজনরা হয়তো বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেন ! কিন্তু কথকের উপলব্ধি – “আমাদের তাতে কী এসে যাবে ? আমাদের আর কী-ই বা ক্ষতি হতে বাকি আছে ? … সব জেনে শুনে অসহায় মেয়েটিকে রংহীন, উষ্ণতাহীন, জৌলুষহীন আমাদের দলে মিশে যেতে দেওয়াটা মধ্যযুগীয় অবিচার।” (পৃ. ৩৪)
তাই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ জ্যাঠাশ্বশুর অহনাকে নতুন করে গড়তে চেয়েছেন। মানসিক ভাবে ভঙ্গুর, তীব্র অনিচ্ছুক অহনাকে বুঝিয়েছেন – “আদর্শ গৃহ বধূর ধারণাটা একটা ধাপ্পাবাজি। পুরুষতন্ত্রের বজ্জাতি। আমি তোকে মুখ বুজে এ বাড়ির সমস্যা সামলে যেতে দেব না। এ তো আত্মশক্তির অপচয়। বিপুল সম্ভাবনার অপমৃত্যু। জীবন বিমুখতা কাপুরুষোচিত।” (পৃ. ৩৬) আধুনিকোত্তর একুশ শতকের নব্য মানসিকতার পরিচয় পাই অহনার জ্যাঠাশ্বশুর তথা শ্বশুর বাড়ির লোকেদের মধ্যে। কথকও চেয়েছেন – ‘একুশ শতক একটা ব্রেভ নিউ ওয়ার্ড হোক’।
অহনার পিতা-মাতা পুনর্বিবাহের যাবতীয় দায়ভার শ্বশুরবাড়ির লোকেদের হাতে ছেড়ে দেন। আর কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার মতোই বাড়ির বিধবা বউ-এর পুনর্বিবাহের জন্য সুযোগ্য পাত্রের সন্ধান করেছেন। কলেজ শিক্ষক দীপ্তেশের সাথে সকল পক্ষের সম্মতিতে আনুষ্ঠানিক ভাবে বিবাহ সম্পূর্ণ হয়েছে। বিয়ের পর অহনা নতুন বাড়ি চলে গেলে এ বাড়ি যেন শূন্যপুরী ! কন্যাবিদায়ের মর্মযন্ত্রনাই সকলে ভোগ করেছেন। পুরনো শ্বশুর বাড়ির সঙ্গে অহনার নিয়মিত যোগাযোগ রয়েই গেছে।
অহনার শ্বশুর বাড়ির লোকজনের দায়িত্ব, কর্তব্য, বিবেকবোধ, সহানুভূতি তথা মানবিকতা-বোধের যে পরিচয় আমরা পেলাম তা নব্য সমাজ মানসিকতারই পরিচয়। ‘বউ’কে পরের বাড়ির মেয়ে রূপে দেখা নয়, মনের উদারতায় ও আন্তরিকতায় আত্মজন বলেই ভেবেছেন। ফলে অহনার ‘বিধবা’ হওয়াকে জীবনে একটা দুর্ঘটনা বলেই ভেবেছেন। পুত্রের মৃত্যু পরবর্তীকালে তাঁদের উপলব্ধি – ‘যে যাওয়ার সে গেছে, কিন্তু যে আছে তাকে তো বাঁচতে হবে।’ তাই অহনাকে নতুন জীবন দান করেছেন তাঁরই শ্বশুর বাড়ির লোকজন। অন্য দিকে দেখি অহনা অতি আপনজন হারানোর তীব্র বেদনা ভোগ করেছেন ঠিকই, কিন্তু ‘বৈধব্য যন্ত্রণা ?’ – এটা কী জিনিস অহনাকে উপলব্ধিই করতে হয় নি।
কোনও নারী বিধবা হওয়ার পর বাপের বাড়িতে আশ্রয় নেন এবং বাবা-মা তাঁর পুনর্বিবাহের ব্যবস্থা করেন – এটা স্বাভাবিক। কিন্তু শ্বশুর বাড়ির লোকজন বাড়ির ‘বিধবা বউ’-এর পুনর্বিবাহে শুধু সম্মতি নয়, তাঁকে আত্ম প্রতিষ্ঠিত হতে সব রকম সাহায্য করেছেন এবং নিজেরাই উদ্যোগ নিয়ে অতি সুপাত্রে পুনর্বিবাহ দিয়েছেন – যা বিবর্তিত ও নব্য সমাজ মানসিকতারই নিদর্শন।
ঔপন্যাসিক হিসেবে প্রতিভাবান ও প্রতিশ্রুতিমান তমাল বন্দ্যোপাধ্যায় সবেমাত্র তাঁর পথ চলা শুরু করেছেন। তবে দক্ষ ঔপন্যাসিকের সব গুণ তাঁর মধ্যে বর্তমান। প্রতিটি উপন্যাসের কেন্দ্রীয় বিষয় নির্বাচনে স্বাতন্ত্র্য আছে। তিনটি উপন্যাসেই চরিত্র নির্মাণ, সংলাপ, বাস্তবতাগুণ পাঠককে আকৃষ্ট করে। গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে জীবনকে দেখেছেন – সমাজকে দেখেছেন। প্রতিটি উপন্যাসেই লেখকের একটা দার্শনিক ভাবনার জগৎ খুঁজে পাওয়া যায়। উদীয়মান কথাসাহিত্যিক স্ব-ছন্দেই আপন যাত্রা শুরু করেছেন। আমরা অপেক্ষায় রইলাম আরও বৈচিত্র্যপূর্ণ নব নব সৃষ্টির।
*********************
আকর গ্রন্থ :
১। তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়, ২০১২, মায়াকাচ। কলকাতা : আনন্দ পাবলিশার্স।
২। তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়, ২০১৩, মর্ম মেঘ। কলকাতা : আনন্দ পাবলিশার্স।
৩। তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়, ২০১৪, ঘাতক। কলকাতা : আনন্দ পাবলিশার্স।
প্রাবন্ধিক পরিচিতি :
সহকারী অধ্যাপক, শৈলজানন্দ ফাল্গুনী স্মৃতি মহাবিদ্যালয়, খয়রাশোল, বীরভূম।