প্রসূন মজুমদার-এর দীর্ঘ কবিতা
জন্মচক্র জাদুজল
সব বল্কল খসে যায়। উড়ে যাচ্ছে জল। আদি জলকণা।
জাদু ও জলের কাছে ঋণ।
ভবিষ্যৎ বলে কিছু ছিল না, থাকে না। ভবিতব্য বলে কিছু নেই মনে হয়। মুহূর্ত জানেনা তার পরের প্রপাত। শুধু তুলো। সম্ভাবনা নামের মৃদু ঘোড়ার দৌড়। আর ছুট। পেরোনোর। অতিক্রম্য ভেবে নিজে অতিক্রান্ত হতে পারা নিজেরই মেধায়। কে ধায়? অনন্ত নামের মিঠে স্বাদুফল ঝুলে থাকে দুগ্ধবতী স্তনের আদলে। ও-ই বিষ।ভক্ষণ অথবা তক্ষণ সবই মোক্ষের দিকে ওড়ে যেন ঝড়,যেন বাষ্প দূর দীনতার। দুর্দিনও তার নিজস্ব নতির ভারে মোহন আশ্রয়।
দ্বার দৃষ্টি। দ্বার ঘ্রাণ। দ্বার দূর্বাদল।
দল, দম্ভ, জল,ব্রহ্মে গুপ্ত আধোলীন।
ছলাৎকার অনুশ্বাসে ছলকে ওঠে ছল?
গন্ধের সুস্বাদ ধন্দে প্রোথিত প্রাচীন।
প্রাচীন বটের স্তম্ভ মূলনিম্নে ত্রাণ অর্থে ত্রুটি
ঘুঁটির কুটিল চক্র, ঘোঁটের আঘ্রাণ শর্তে ছুটি।
তাও দিচ্ছে পাক দিচ্ছে বাক, ইচ্ছে, মাকড় – মাকড়
ঊর্ধ্বে ব্রহ্ম, নিম্নে ব্রহ্ম, ভীম সে ব্রহ্ম দুঃখ
ঘুরছে শূন্যে, পুড়ছে পুণ্যে, মূর্ছা,ঘেন্না পাক ওর
স্থূল লুকোচ্ছে, ভুল শুকোচ্ছে, মূল সুখ হচ্ছে সূক্ষ্ম।
তাও তো গন্ধ ছলাৎছন্দ রাস্তাবন্ধ গুহ্যে
কে-ই বা জানছে? জানলে মানছে? নেই যা ভ্রান্তে খুঁজছে।
খুশি যায়,বলে বোধে ট্রাম চলে রোধে নাম ছলে ছাঁকনি।
সব ভুষি খুশি ওঁকারে চুষি, মেধার আঁকুশি বাঁক নিক।
পথ নিচু কিছু গৎ পিছুপিছু লকলকে লোভে সিক্ত
মিষ্ট যা ভাবি, শিষ্ট সাহাবি, ইষ্টকে পাবি?ধিক তোর।
তবু বিশিষ্ট রসে নিকৃষ্ট বিষে আকৃষ্ট বাগ্মী
হ্যাঁ-কে না করিয়ে, ট্যাঁকে টাকা নিয়ে, ঝাঁকে ঝাঁ ঝরিয়ে যাক মিল।
কিছু নেকুপুষু গুজুগুজুফুসু গেয়ে ভাদুটুসু পাক ছাই
দুজনে দুপারে রতি অভিসারে অজানা প্রকারে বাঁক চাই।
এই রাস্তা। এই পথ। এই ধর্ম। এই রথ। এই দিব্য। এই লিখব, কালি।
দাও রক্ত দাও জিভ দাও ভক্ত দাও শিব নাও অর্থ নাও ক্লীব খালি।
সব শূন্য যব পূর্ণ, ভৈরবেরও রব পূর্ণ যোনি।
চিতা ফাটছে বৃথা ফাটছে মৃতাতে অমৃতাও ফাটছে, শনি।
অন্ন চিন্তা,তা ধিন ধিনতা,’আচ্ছে দিন’টা দিচ্ছে নিন তা
সয় না!
পাক লাগাচ্ছে, দাগ লাগাচ্ছে, তাক লাগাচ্ছে বাঘের পুচ্ছে ময়না।
দিব্য সজ্জা নিভবে লজ্জা কার প্রবজ্যা কোথায় দিচ্ছে ভিখ তার।
শিখব ঝুঁকতে, সেলাম ঠুকতে, ধুঁকতে ধুঁকতে গোঁতায়
চাটছি পিক তার।
গুহ্য তন্ত্র গূঢ় অন্ত্রে পরম মন্ত্রে ধর্ম যন্ত্রে ঘুরপাক খায় ঘুরপাক, যায় বুরবাক তার সুর বাক সব গন্ধে গন্ধে সকাল সন্ধে দ্বিধায় দ্বন্দ্বে পুড়তে পুড়তে আদিম খুঁড়তে হাউই ছুঁড়তে চাইছে।
তপ্ত বিশ্ব বৃদ্ধ ভীষ্ম গোমড়া গ্রীষ্ম বানায় দৃশ্য ধ্বংস নাম্নী বংশ সামনে কংস নাম নে চুইংগাম নে
চিটচিটে কালি খিটখিটে খালি পিটপিটে ঢালি গণ্ডা গণ্ডা মিঠাই মণ্ডা যাচ্ছে মন্দা সকাল সন্ধ্যা পাই চেক।
টাকার অর্থই অর্থ বাকিসব বাজারবাবদ বাধ্যত নেবার নয় তবু আরো নিতে কে বাঁধবে? যদি ভাঁড় উপচেই না পড়ল তবে নিতে নিতে ক্ষুধা বাড়ছে। বাড়বেই। যৌনেচ্ছা বাড়বে, কমতে হবে দায়িত্ব জাতির। অতঃপর দৃশ্যে আসবে লাল নীল হলুদ ও সবুজ অথবা অন্য রঙ, নতুবা গন্ধেও থাকবে বৈচিত্র- সুবাস যেন আম, যেন কলা, ষোলোকলা পূর্ণ হবে চৌষট্টি কলায়। তবেই তো যাওয়ার মতো যেতে পারা অবশ্যই একা আর অবশ্যই মাটি থেকে ঊর্ধ্বে আরও ঊর্ধ্বতন উপরে, তলায়।
তলায় তারা উপুড় বিম্বে, হংসচঞ্চু তা দেয় ডিম্বে, কেই বা বেচবে কেই বা কিনবে লোক চাই।
নরক কুণ্ডে জন্ম নিচ্ছে ঘূর্ণিলাট্টু ঘোরার ইচ্ছে খাটের ছত্রি ঢ্যাঁড়াও পিটছে জোঁক চাই।
রক্ত চুষবে আস্তে আস্তে এমন ব্লেড বা এমন কাস্তে কাটবে কিন্তু হাসতে হাসতে দুইদিক।
মাথাও কাটবে খাতাও কাটবে হিসেব খাটবে শরীর ঘাঁটবে শুই, দিক।
দিচ্ছে ভালোই আলতো করে না দিলে নয় তা-ই যেন
মস্তি হচ্ছে হোক না তোদের ভুল করে রোজ চুলকে দেওয়ার বাই কেন?
বাই বলতেই বাতিক বললো জল দিয়ে ধো জিভছোলা
শব্দ হচ্ছে ব্রহ্ম উড়ছে অক্ষরে চাই শিবভোলা।
গ্লুগুম গুম গুম, দ্রুদুম দুম দুম ভভম ভঃ
অর্থ নেই নেই শর্ত নেই তাই লিখছে খ
আকাশ খুলতেই তারার দল, মেঘ হঠাৎ হাঁ
পেরোয় বিদ্যুৎ অর্থহীন দূত ধুধুম ধাঁ।
এই যে পেরোনো, অর্থাৎ অতিক্রম সে সম্ভব অসম্ভব আলোর গতির থেকে বেশি। গতির আলোর দিকে ধাবিত সমস্ত ঈপ্সা কেবল অনন্তলিপ্সার উঁচু ছাদ। সেই ছাদ উঠে যাচ্ছে যত আমি ছুটে যাচ্ছি, খসে যাচ্ছে তারা যেন নিজের শরীর থেকে ছাল। আমার সমস্ত কথা নিঃস্ব আজ, শব্দহীন, প্রকাশঅযোগ্য এই গতির রতির পূর্ণে সব শূন্য,সব দরজা ফাঁকা। ফলত শূন্যের ঘরে শূন্য ঢুকে ঠেলা দিচ্ছে শূন্য থেকে শূন্যের ফোয়ারা উঠে ফিনকি দিচ্ছে পাড়, অসংজ্ঞাতের ঊর্ধ্বে অনুভূতি বলে কিছু নেই তাই কিছু নেই পাওয়া-হারাবার।
বিদ্যাবোধন বিদ্যাবোধন পাইনা না, চাই নানা
অণ্ডশোধন অণ্ডশোধন নাই জানা, তাই জানা
বিদ্যেবহর বিদ্যেবহর যায় জলে যায় জলে
মিথ্যেশহর মিথ্যেশহর নাই বলে,নাই বলে।
কে বলে আর কখন বলে?কাদের জন্য,কোথায় বলে?
বলের খেলা, যন্ত্রবলে, এদিক ওদিক, অস্তাচলে।
তাও ছুটে যায় মত্তপাগল,মস্তপাগল, সঙ্গীহারা
দিনদুপুরে সূর্য চিবোয়, রাত চুষে খায় সন্ধ্যাতারা।
কিসের প্রতাপ?কিসের আশা?বিষের প্রভাব, ব্যর্থ চাষা
হাল ধরে সাপ সর্বনাশা, তাপ ছাড়ে বিষ মুখের ভাষা
দাও চিতা দাও,দাও ফিতা দাও, সাইজ মাপো,সাইজ মাপো
নাও মিতা নাও, বক্তৃতা দাও,প্রাইজ ঝাঁপো, প্রাইজ ঝাঁপো
যায় বেলা যায়, দন্ত কেলায় , ধ্বংস হল,ধ্বংস হল
বংশ গোঁতায়, শংসা প্রথায়,ঝাড়ে ও নির্বংশ হল।
এখন শ্মশান সব। প্রচুর শবের গন্ধ। অথচ শোঁকারও কেউ নেই।
এমনকি কাকও নেই, শকুনেরা শব ছেড়ে ভেগেছে আগেই।
কুকুর যেহেতু প্রিয় পোষ্য হতে ভালোবেসেছিল সেই দোষে
অস্তিত্ব যাবার পরে ইদানীং নিত্যকালে নির্নিকেত পোষে।
আগুন যথেচ্ছ আছে তবু আজ কে তাকে জ্বালাবে!
অতঃপর ঘূণপোকারা খেয়ে সব অচল আসবাবে
কবেই হারাল। তবে? ধীরে ধীরে পুনর্বার যাত্রা শুরু হবে।
আবার প্রথম থেকে সংশোধিত পাঠক্রমে ধীরে
প্রকৃতি পড়াবে পাঠ নির্মিতি-কুশলী ছিলা-তিরে
নতুন তিরের কোন শক্তি আর প্রাণহরণের
দেবে না প্রকৃতি,শুধু লক্ষ্য দেবে ঢের।
এবারও বাছার ভার বাছার উপরে ছেড়ে দেবে?
এ লেখা সমাপ্তিপথে অসমাপ্ত থাক তাকে ভেবে।